বাচ্চু রাজাকার মামলার রায় ॥ ইতিহাসের অধিকার ফিরে পাওয়া by মুনতাসীর মামুন

মনোজগতে আধিপত্য বিস্তারের প্রথম ধাপ ইতিহাসের ন্যারেটিভ। ১৯৪৭ সালের আগে ভারতের মুসলিম নেতারা ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন। তারা মুসলমান নৃপতিদের কথা তুলে ধরেছেন যারা শৌর্যে-বীর্যে ছিলেন অতুলনীয় এবং মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন,
ভারতীয় মুসলমানরা তাদেরই বংশধর। ইসলামী শাসকদের আমল ছিল স্বর্ণযুগ। ব্রিটিশ ও হিন্দুদের চক্রান্তের কারণে আজ তারা হীনবস্থায়। এই অবস্থা থাকবে না যদি মুসলমানদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা হয়। ইতিহাসের এই ব্যবহার মুসলমান তরুণদের সংগঠনে ভূমিকা রেখেছিল এবং পাকিস্তান মানসিকতা তৈরি করেছিল। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, পাকিস্তান : ইসলাম। ভারত : হিন্দু।
এই ন্যারেটিভ ভাঙতে বিপরীতে বঙ্গবন্ধুকে সোনার বাংলার মিথের কথা বলতে হয়েছিল। নানা বঞ্চনার কথা তুলে তিনি বাঙালী জাতীয়তাবাদকে সংহত করেছিলেন। পোস্টারে লেখা হয়েছিলÑ ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’
১৯৭১ সালের বিজয়ের পর দাঁড়াল বাঙালীদের রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এই রাষ্ট্র সেক্যুলার। এই রাষ্ট্রে থাকবে সিভিল কর্তৃত্ব। এই রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা আছে ৩০ লাখ শহীদ, ৬ লাখ বীরাঙ্গনা, অগনন আহতÑ প্রায় সব বাঙালীর আত্মত্যাগ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং সবশেষে তাজউদ্দীন আহমদের বাংলাদেশ সরকার। ন্যারেটিভের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং স্বাধীনতাবিরোধীরা পরিত্যাজ্য।
জিয়াউর রহমান ও সামরিক বাহিনী, এরশাদ ও সামরিক বাহিনী এবং খালেদা জিয়া আবার এই ন্যারেটিভ বিনষ্ট করতে চেয়েছেন। জিয়া ১৯৪৭ সাল ফিরিয়ে আনলেন। অস্ত্র ও অর্থের সাহায্যে এই ন্যারেটিভ চাপিয়ে দিলেন। বলা হলো, ধর্ম প্রধান, রাষ্ট্র হবে ধর্মীয়; এই রাষ্ট্র হবে মুসলমানদের, রাজাকার আর আলবদরা কেন পরিত্যাজ্য হবে? তারা আমাদের সহযাত্রী, অর্থাৎ ১৯৭১ সালে হত্যা ধর্ষণ কিছুই হয়নি। এই তত্ত্বে নতুন প্রজন্মকে বিশ্বাসী করার জন্য শান্তি কমিটির সদস্যকে প্রেসিডেন্ট, স্বাধীনতাবিরোধী দালালদের প্রধানমন্ত্রী, সিনিয়র মন্ত্রী; রাজাকার, আলবদরদের সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী বানানো হলো। গত ৩০ বছর এই তিনজন এ কাজটি করেছেন। দুটি নতুন প্রজন্ম এই ন্যারেটিভে বিশ্বাস করে। পুরনোদের অনেকে এটি মেনে নিয়েছে। যেটা মুক্তিযুদ্ধপন্থীরা জানে না কিন্তু বিরোধীরা জানে, তা হলো, ইতিহাসের সূত্র ছিন্ন করে দিতে হবে যাতে মনোজগতে ইতিহাসের সত্য স্থান না পায়, যেটি করা হয়েছে পাকিস্তানে। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, শেখ হাসিনা সরকারও এ বিষয়ে একমত পোষণ করে স্কুল-কলেজের শিক্ষাক্রম থেকে ইতিহাস হটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বলা হচ্ছেÑ তারা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী। কপাল আমাদের! ইতিহাসের অধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত করা হয়েছিল, আর সেই অধিকার যাতে আমরা ফিরে না পাই সে ব্যবস্থাই করা হলো ২০১২ সালের বিজয়ের মাসে ইতিহাস বাদ দিয়ে!
এই পটভূমি দিতে হলো, দীর্ঘ হলেও একটি কারণে। আমরা যা হারিয়েছিলাম তা আইনগতভাবে আমাদের ফিরিয়ে দিলেন আন্তর্জাকি অপরাধ বিচার বিষয়ক ট্রাইবুনাল। এর আগে বিচারপতি খায়রুল হকও দুটি রায়ে ১৯৭১ সালের ন্যারেটিভকেই সত্য বলেছিলেন, কিন্তু তার দিকে দৃষ্টি পড়েছে কম। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এখন দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সব ধরনের রাজনীতির জন্য। ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও অন্যরা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের মামলার রায় দিয়েছেন। অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায় হিসেবে দেশ-বিদেশে এ নিয়ে আগ্রহ ছিল। বিচারপতিত্রয় নিরাশ করেননি। আঁটোসাঁটো একটি রায় দিয়েছেন, যা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আদৃত হয়েছে। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমি এই রায়টিকে বহুমাত্রিক মনে করি।
দুই.
এই রায়ে প্রথমেই বাঙালীদের ইতিহাসের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য কণ্টকাকীর্ণ পথ পরিক্রম করেছে। এ পথ পরিক্রমা ছিল যন্ত্রণাময়, রক্তাক্ত, স্বেদ ও আত্মত্যাগের। সমসাময়িক ইতিহাসে মুক্তির জন্য বাঙালীরা যে দাম দিয়েছে আর কোন জাতি তা দেয়নি।
[Undeniably the road to freedom for the people of Bangladesh was arduous and torturous, smeared with blood, toil and sacrifices. In the contemporary world history, perhaps no nation paid as dearly as the Bengalees did for their emancipation.]
অর্থাৎ ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। এত মানুষ শহীদ হলেন কী ভাবে? তাদের হত্যা করেছে পাকিস্তানী সেনা এবং তাদের সহযোগীরা। এই সহযোগী শক্তি কারা? এরা হলো রাজাকার, আলবদর প্রভৃতি। এবং এরা প্রায় সবাই উদ্ভূত জামায়াতে ইসলামী থেকে। এভাবে বিচারের আওতায় চলে আসে পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগীরা। এভাবেই চলে আসে সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামী। আর এভাবেই পুনরুজ্জীবিত হয় ১৯৭১ সালের ন্যারেটিভ, যা ভুূলিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সমমনারা। এ কারণে তারা ইতিহাস বিকৃত করেছিল রাষ্ট্রীয় দলিলে, পাঠ্য বইয়ে। ন্যারেটিভ সঠিক হলে, জামায়াতে ইসলামী যে হত্যাকা-, নিপীড়ন, ধর্ষণ চালিয়েছিল তা আসতে হবে। সে প্রশ্ন এলে বিচারের প্রশ্ন আসবে। যে কারণে, নির্মূল কমিটির আন্দোলনে বার বার বাধা দেয়া হয়েছে; মিথ্যা মামলা দিয়ে শাহরিয়ার কবির ও আমাকে গ্রেফতার, রিমান্ড ও জেলে দেয়া হয়েছে; জাহানারা ইমামসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা হয়েছে। এ কারণেই জিয়াউর রহমান ও বিএনপি নেতারা বলেছেন, কবে কি হয়েছে তা ভুলে যেতে হবে, ভুলে যাওয়া উচিত, দেশের উন্নয়নে সমন্বয়ের রাজনীতি প্রয়োজন। আমরা বলেছি, অপরাধীর শাস্তি না হলে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান তুচ্ছ হয়ে যায়, তাদের ও আমাদের অপমান করা হয়। ৬ লাখ বীরাঙ্গনাকে অপমান করা হয় আর খুনের বিচার তো তামাদি হয় না। বিচারকরাও সেই সত্যের প্রতিধ্বনি করেছেনÑ আমাদের ভোলা উচিত নয় যে, লাখ লাখ ভিকটিমের পাওনা তাদের নিপীড়কদের শাস্তি। সময়ের স্রোত অপরাধ মুছে দেয় না। আন্তর্জাতিক অপরাধ যখন বিচার প্রক্রিয়ার অধীনে আনা হয় তখন বলা যেতে পারে বিচারের দেরি হওয়াটা আর বিচার বঞ্চিত নয়।
[We should not forget it that the millions of victims who deserve that their tormenters are held accountable; the passage of time doesnot diminish the guilt. Therefore, justice delayed is no longer justice denied, particularly when the perpetrators of core international crimes are brought to the process of justice.]
এভাবে মুক্তিযুদ্ধ প্রতিষ্ঠিত হয় রায়ে। এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এ সত্য যে, জামায়াতে ইসলামী স্বাধীনতাবিরোধী দল এবং তার সমর্থক-কর্মীরা যে অপরাধ করেছে তার বিচারও বাঞ্ছনীয়। এভাবে আমরা ইতিহাসের অধিকার ফিরে পাই।
জামায়াতে ইসলামী মানবতাবিরোধী/যুদ্ধাপরাধীদের দল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজি পার্টি ছিল এরকম একটি দল। নুরেমবার্গ মামলায় চারটি সংগঠনেরও বিচার হয়েছিল। ট্রাইব্যুনাল যখন গঠিত হয় তখন আমরা বলেছিলাম, দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীরও বিচার হওয়া বাঞ্ছনীয়। তখন কেউ কর্ণপাত করেননি। নির্মূল কমিটি দু’যুগ ধরে বলে আসছে, জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হোক। স্বাভাবিকভাবেই কেউ কর্ণপাত করেননি। বঙ্গবন্ধু করেছিলেন, তাঁর সে সাহস ও দূরদর্শিতা ছিল। জিয়াউর রহমান জামায়াতকে সিদ্ধ করলেন এ কারণে যে, পাকিস্তান সৌদি অক্ষ, যার প্রতিভূ জামায়াতÑতারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যায় সাহায্য করেছে। আর জিয়া তো পাকিস্তানবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চান, জামায়াত ছাড়া তাকে কে সেই দর্শন শেখাবে? তাছাড়া দেশ ও জাতিকে দু’ভাগ করা ছিল তার রাজনৈতিক লক্ষ্য, যাতে এক ভাগের ‘রাজা’ হতে পারেন তিনি। আর বঙ্গবন্ধু যা করেছেন তা নস্যাত না করলে তার স্থান থাকে কোথায়? সে কারণে, জামায়াত ও জামায়াতী দর্শন সিদ্ধ হলো। দেশ বিভক্ত হলো স্বাধীনতার পক্ষ-স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিতে।
২০০৮ সালের নির্বাচনের সময যখন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের প্রশ্ন এলো, তখন, অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে নির্মূল কমিটি একটি স্মারকলিপি দিয়েছিল জামায়াতকে নিবন্ধন না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে। কারণ, মানবতাবিরোধী অপরাধের দল ছাড়াও নিবন্ধনের শর্ত তারা পূরণ করছিল না। নির্বাচন কমিশন তখন অবৈধভাবে জামায়াতকে নিবন্ধন দিয়েছিল। কোন রাজনৈতিক দল তার প্রতিবাদ করেনি।
জামায়াতকে যাতে নিষিদ্ধ না করা হয় সে জন্য, এ্যাপলজিস্টরা একটি যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। তা হলো, জামায়াত আন্ডারগ্রাউন্ডে গেলে তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা মুশকিল হবে। জামায়াত ষড়যন্ত্রে বিশ্বাসী একটি দল। আন্ডারগ্রাউন্ড, ওভারগ্রাউন্ড যেখানেই থাকুক না কেন জামায়াত ষড়যন্ত্র করবেই। মৌলবাদী জঙ্গী প্রায় ১০০টি সংগঠন আছে যা আন্ডারগ্রাউ-ে এবং তারা কোন না কোনভাবে জড়িত জামায়াতের সঙ্গে। জঙ্গীদের দমন তো এ সরকার ভালভাবেই করেছে। ওভারগ্রাউন্ডে থেকে কি জামায়াত নাশকতামূলক কাজ করছে না? ২০১২ সালের শেষ থেকে এখন পর্যন্ত যে পুলিশ হত্যার জন্য আক্রমণ, গাড়ি ভাংচুর ও জ্বালিয়ে দেয়া, দাঙ্গা, বোমাবাজিÑএগুলো কি জামায়াত/বিএনপি করছে না?
ট্রাইব্যুনালের এই রায়ের ফলে, এই প্রশ্নটি আবার চলে এসেছে সামনে। যুদ্ধাপরাধীদের একটি দল কীভাবে রাজনীতি করবে? রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্য বাস্তবতার দোহাই তুলবে। কিন্তু নৈতিক প্রশ্নটি তো থেকেই যাবে। কারণ, রায়ে বলা হয়েছে: যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে তখন কিছু বাঙালী বিহারী, পাকিস্তানপন্থী, ধর্মভিত্তিক দলের সদস্য, বিশেষ করে জামায়াত এবং এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে পাকিস্তানী মিলিটারির সঙ্গে যুক্ত হয়ে বা সহযোগিতা করে। এবং তারা প্রায় সবাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন [গণহত্যা, ধর্ষণ] করেছে।
[And most of them committed and facilitated the commission of atrocities in violation of customary international law in the territory of Bangladesh.]
আর জে রুমেল নামে একজন গবেষক একটি বই লিখেছেন যার নাম- ‘স্ট্যাটিসটিকস অব জেনোসাইড এ্যান্ড মাস মার্ডার সিন্স ১৯০০।’ তিনি লিখেছেন, আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ও তার জেনারেলরা পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক এলিটদেরও হত্যা করতে চেয়েছিল। তারা হিন্দুদের নির্দিষ্টভাবে হত্যা করতে চেয়েছে আর বাকিদের ভারতে ঠেলে দিতে চেয়েছে। তারা বাঙালীদের অর্থনৈতিক ভিত্তি ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে যাতে কমপক্ষে আরেক জেনারেশন তারা পশ্চিম পাকিস্তানের অধস্তন থাকে।
জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের মিলিটারিদের সঙ্গে মিলে এ কাজটি করেছে। তাদের ক্ষমা করবেন কী ভাবে? তাদের রাজনীতি করতে দেবেন কী ভাবে? জামায়াত এখনও মুক্তিযুদ্ধ স্বীকার করেনি। তাই গ্রেফতারের আগে পর্যন্ত আলবদরের ডেপুটি আলবদর আলী আহসান মুজাহিদ সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন, এ দেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই।
(চলবে)

No comments

Powered by Blogger.