সময়ের প্রেক্ষিত- ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ by মনজুরুল হক
ছায়ার সঙ্গে বিরামহীন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যে নিজের জন্যই ক্ষতিকর, সেই হিসাব মনে হয় বাংলাদেশের বর্তমান নেতৃত্বের জানা নেই। ফলে জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করে ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকেই বাংলাদেশের এই বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটি বিরতিহীনভাবে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেই এখন যেন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে।
তবে এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। জনগণ তো দলটিকে আস্থায় নিয়েই বিপুল ভোটে নির্বাচন করে সরকার গঠনের সুযোগ আওয়ামী লীগের জন্য করে দিয়েছিল। আর তাই মানুষের প্রত্যাশা ছিল এ রকম যে আগের প্রায় সাত বছরের অপশাসনের সব রকম আবর্জনা দূর করে জনগণকে আস্থার মধ্যে নিয়েই দলটি হয়তো উন্নত এক ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়ে নেওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এবং যার ফলে জনতা আবারও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা দীর্ঘায়িত করবে। তবে এখন কি আর তা বলার উপায় আছে?
আমি অবশ্যই বলছি না, সবটাই ইতিমধ্যে বিয়োগের খাতায় লেখা হয়ে গেছে। তবে আগামী এক বছরে পরিস্থিতির কোনো রকম রদবদল না হলে হিসাব যে ঠিক সে রকমই দাঁড়াবে, তা বুঝে নিতে খুব বেশি বিজ্ঞতার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আর সে রকম পরিস্থিতি দেখা দিলে এর জন্য সেই ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে আসল শত্রুকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দেওয়াকেই যে দায়ী করতে হবে, তা মনে হয় সহজেই অনুধাবন করা সম্ভব। সরকারের এই ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ আবার বহুমুখী, যার কোনোটার কোনো রকম প্রয়োজন একেবারেই ছিল না।
প্রথমেই বলতে হয় শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূসের প্রসঙ্গ। কার বুদ্ধি আর পরামর্শে যে সেই পঙ্কিল পথ ধরে সরকারের হাঁটা, আমার মতো প্রবাসী অভাজনের পক্ষে তা বুঝে ওঠা মুশকিল। অধ্যাপক ইউনূস তো সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো অবস্থাতেই নন। তাঁর সাফল্য আর প্রাপ্তিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে যদি সরকারের পক্ষ থেকে এটা করা হয়ে থাকে, তাহলে আমি বলব, সেটা হচ্ছে সরকারের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্লান্তিকর ও অবসাদ নিয়ে আসা ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ। সে রকম যুদ্ধের কিছু সমরনায়ককে আবার দেখা গেছে ঢাকা থেকে বিমানে টোকিও উড়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল ভাড়া নিয়ে সবিনয় অনুরোধ জানিয়ে নিয়ে আসা কতিপয় জাপানির সামনে এ রকম ব্যাখ্যা তুলে ধরার প্রয়াসে লিপ্ত হতে যে অধ্যাপক ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলে আমাদের বর্তমান প্রশাসনের প্রধানও সেই স্বীকৃতি অনায়াসে দাবি করতে পারেন। সেই ছায়াযোদ্ধাদের ইউনূস-বধের প্রক্রিয়া এখন এতটাই তিক্ত আকার নিয়েছে যে এখন তারা আরও বলতে শুরু করেছে, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়ার পেছনেও আছে ইউনূসের ষড়যন্ত্রের হাত। এটাও তো সেই ছায়ার সঙ্গেই যুদ্ধ বটে।
অন্যদিকে যাকে নিয়ে এতটা হইচই, সেই অধ্যাপক ইউনূস কিন্তু এত সব উসকানির মুখেও খুবই সংযত আচরণ দেখিয়ে যাচ্ছেন, যা কিনা তাঁর ভাবমূর্তিকে নিয়ে যাচ্ছে আরও কিছুটা ওপরে। গত সপ্তাহে অধ্যাপক ইউনূস এসেছিলেন জাপানে তাঁর নতুন বাণিজ্যিক তত্ত্ব সামাজিক ব্যবসাসংক্রান্ত এক সেমিনার উপলক্ষে। জাপানে এই গ্রামীণ ব্যাংক-গুরুর ভক্তের অভাব নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেই ভক্তকুলের মধ্যে কাউকে আবার দেখা গেছে আমাদের বাংলাদেশের ছায়াযোদ্ধাদের মতোই একই রকম আচরণ প্রদর্শন করতে, যেমনটা হয়েছিল বছর খানেক আগে টোকিওর এক সেমিনারে। সেমিনারের সঞ্চালক অধ্যাপক যখন মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে তুলে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে একহাত দেখে নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করার আহ্বান উপস্থিত সুধীদের প্রতি জানিয়েছিলেন, তখন বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি যে জাপানি অধ্যাপকও হচ্ছেন বাংলাদেশি সেই ছায়াযোদ্ধাদেরই উল্টো পিঠ। তবে এর বাইরে অন্য আর কোনো রকম বাড়াবাড়ি একেবারেই দেখা যায়নি এবং অধ্যাপক ইউনূস নিজে ছিলেন খুবই সংযত আর আবেগবর্জিত।
এবারের সফরে অধ্যাপক ইউনূস টোকিওর বিদেশি সাংবাদিকদের প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন, যেখানে তাঁর বক্তব্যের বিষয় ছিল সেই একই সামাজিক ব্যবসা। অর্থনৈতিক কিংবা ব্যবসায়িক ধারণা হিসেবে অধ্যাপক ইউনূসের নতুন এই তাত্ত্বিক উপস্থাপনা নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন দেখা দেওয়া খুবই স্বাভাবিক। আমি নিজেও যেমন বুঝে উঠতে পারিনি বিশ্বের তাবৎ মানুষ যখন বাণিজ্যের জগতের মুরব্বিদের বিশ্ব অর্থনীতির এই বেহাল অবস্থার জন্য দায়ী করছেন, ঠিক তখনই তিনি কেন সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতিকে উদ্ধারে এগিয়ে আসার আহ্বান ঠিক সেই একই গোষ্ঠীর কাছেই জানাচ্ছেন। তবে সেটা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ এবং বলতে দ্বিধা নেই যে বক্তব্য তুলে ধরার মধ্য দিয়ে এমন একটি ইন্দ্রজাল তৈরির ক্ষমতা অধ্যাপক ইউনূসের আছে, যা কিনা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকা মানুষের মধ্যেও অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম।
টোকিওর সাংবাদিক মহলে অধ্যাপক ইউনূস খুবই পরিচিত আর শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। এবার নিয়ে এক যুগ সময়ে পঞ্চমবারের মতো টোকিওর বিদেশি সাংবাদিকদের প্রেসক্লাবে তাঁর আগমন। প্রতিবারই দর্শক-আসন ছিল প্রায় পরিপূর্ণ। নিজেকে আমি এ কারণে সৌভাগ্যবান মনে করি যে পাঁচবারের সেই সংবাদ সম্মেলনের মধ্যে তিনবারই সঞ্চালকের দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয়েছে। এবারেও তেমনটাই কথা ছিল, তবে শেষ মুহূর্তে টাইম সাময়িকীর স্ট্রিঙ্গার লুসি বার্মিংহামের অনুরোধে সেই দায়িত্ব পালনের সুযোগ তাঁর জন্য আমি করে দিয়েছিলাম।
অধ্যাপক ইউনূস তাঁর বক্তব্য শেষ করার পর প্রশ্নোত্তর পর্বে অধিকাংশ প্রশ্ন সামাজিক ব্যবসাকেন্দ্রিক হলেও এএফপির টোকিও ব্যুরোর এক সাংবাদিক গ্রামীণ ব্যাংককে কেন্দ্র করে চলতে থাকা বিতর্ক নিয়ে দুটি প্রশ্ন তাঁকে করেছিলেন। একটি প্রশ্ন ছিল নতুন কিছু ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের অনুমতি লাভের প্রক্রিয়া কেন বিলম্বিত হচ্ছে, সে বিষয়ে এবং অন্য প্রশ্নটি ছিল গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরকারের গঠিত কমিশনের কর্মকাণ্ড নিয়ে। পাঠক, লক্ষ করুন, দুটি প্রশ্নই কিন্তু হচ্ছে যথেষ্ট উসকানিমূলক, যার উত্তর দেওয়ার প্রক্রিয়ায় সরকারকে সহজে তুলাধোনা করার সুযোগ অধ্যাপক ইউনূসের সামনে ছিল। তবে তিনি কিন্তু সেই ছায়াযুদ্ধের পথে একেবারেই পা বাড়াননি, বরং খুবই শান্ত কণ্ঠে সেই সাংবাদিককে তিনি বলেছিলেন, আমাদের মতো দেশে আমলাতন্ত্র যে সচরাচর কাজ করে ধীরগতিতে, সেটা তাঁর ভুলে যাওয়া উচিত নয়। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন যে তাঁর নিজের এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে সব রকম কাগজপত্র ইতিমধ্যে জমা দেওয়া হয়েছে এবং কোন সিদ্ধান্তে কমিশন উপনীত হয়, সেটা এখন দেখার অপেক্ষা। তবে তিনি আরও বলেছিলেন, সব সময়ই তিনি আশাবাদী। সংক্ষিপ্ত সেই উত্তরের মধ্য দিয়েই ছায়াযোদ্ধাদের সঙ্গে নিজের পার্থক্য তিনি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন। ফলে পদ্মা সেতুর পেছনে ইউনূসের হাত থাকার কথা বলে মুখে যাঁরা ফেনা তুলে ফেলছেন, ছোট অথচ তাৎপর্যপূর্ণ এ ঘটনাটি তাঁদের মনে রাখা উচিত।
ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ বাংলাদেশে সরকারের ঘনিষ্ঠজনদের অনেকেই করছেন। এই ছায়াযোদ্ধাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ রকম যে নিজেদের কোনো রকম ভুল কখনোই এঁরা স্বীকার করতে নারাজ। অর্থাৎ, সব নষ্টের মূলে আছে অন্যেরা, আমি কিংবা আমরা নই। ঠিক সে রকম এক দৃষ্টান্ত টোকিওতে কিছুদিন আগে রেখে গেলেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
জুলাই মাসের শুরুতে তিনি জাপানে এসেছিলেন আফগানিস্তান-সংক্রান্ত দাতা আর দখলদারি গোষ্ঠীর এক সম্মেলনে যোগ দিতে। টোকিওতে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অবস্থান ছিল একেবারেই যেন চোখের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া। সংবাদমাধ্যম তো নয়ই, এমনকি জাপানের সরকারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও কোথাও দেখা যায়নি তাঁর উপস্থিতির খবর। তবে সেটা হচ্ছে ভিন্ন প্রসঙ্গ। টোকিওতে অবস্থানকালে তিনি অবশ্য বর্তমান এ প্রতিবেদক সম্পর্কে উষ্মা প্রকাশ করে দলীয় সমর্থকদের নাকি বলেছেন যে তাঁকে হেয় করার জন্যই প্রথম আলোতে জাপানের ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়ে টোকিওর দূতাবাস সরিয়ে নেওয়া-সংক্রান্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছিল। পাঠক, একবার স্মরণ করে দেখুন সেই সময়ের ঘটনা। মন্ত্রী অবশ্য এ রকমও দাবি করেছেন বলে শোনা যায় যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কল্যাণের চিন্তা মাথায় রেখে সেই সিদ্ধান্ত তিনি নিলেও অন্যায়ভাবে পত্রিকায় তাঁকে দোষারোপ করা হয়। তবে যে কথাটি তিনি বলেননি তা হলো, সিদ্ধান্ত ন্যায়সংগত ও দেশপ্রেমমূলক হওয়া সত্ত্বেও কেন প্রথম আলোর সেই সংবাদের আলোকে সিদ্ধান্ত তাঁকে শেষ পর্যন্ত পাল্টাতে হয়েছিল।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলটিকে অনেক আশা নিয়ে দেশের মানুষ ভোট দিয়েছিলেন। দলের সাফল্যের পাল্লাও যে একেবারেই কম, তা তো নয়। তবে তার পরও সেই সাফল্যের অনেকটাই পানসে হয়ে যাচ্ছে ছায়াযুদ্ধে শক্তি ক্ষয় করে, যে যুদ্ধের কোনো রকম প্রয়োজনীয়তা একেবারেই নেই। যত দ্রুত নীতিনির্ধারকেরা এটা অনুধাবনে সক্ষম হবেন, ততই নিজেদের জন্য আর দেশের জন্যই কেবল তাঁরা কল্যাণ নিয়ে আসবেন।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
আমি অবশ্যই বলছি না, সবটাই ইতিমধ্যে বিয়োগের খাতায় লেখা হয়ে গেছে। তবে আগামী এক বছরে পরিস্থিতির কোনো রকম রদবদল না হলে হিসাব যে ঠিক সে রকমই দাঁড়াবে, তা বুঝে নিতে খুব বেশি বিজ্ঞতার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আর সে রকম পরিস্থিতি দেখা দিলে এর জন্য সেই ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে আসল শত্রুকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দেওয়াকেই যে দায়ী করতে হবে, তা মনে হয় সহজেই অনুধাবন করা সম্ভব। সরকারের এই ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ আবার বহুমুখী, যার কোনোটার কোনো রকম প্রয়োজন একেবারেই ছিল না।
প্রথমেই বলতে হয় শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূসের প্রসঙ্গ। কার বুদ্ধি আর পরামর্শে যে সেই পঙ্কিল পথ ধরে সরকারের হাঁটা, আমার মতো প্রবাসী অভাজনের পক্ষে তা বুঝে ওঠা মুশকিল। অধ্যাপক ইউনূস তো সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো অবস্থাতেই নন। তাঁর সাফল্য আর প্রাপ্তিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে যদি সরকারের পক্ষ থেকে এটা করা হয়ে থাকে, তাহলে আমি বলব, সেটা হচ্ছে সরকারের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্লান্তিকর ও অবসাদ নিয়ে আসা ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ। সে রকম যুদ্ধের কিছু সমরনায়ককে আবার দেখা গেছে ঢাকা থেকে বিমানে টোকিও উড়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল ভাড়া নিয়ে সবিনয় অনুরোধ জানিয়ে নিয়ে আসা কতিপয় জাপানির সামনে এ রকম ব্যাখ্যা তুলে ধরার প্রয়াসে লিপ্ত হতে যে অধ্যাপক ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলে আমাদের বর্তমান প্রশাসনের প্রধানও সেই স্বীকৃতি অনায়াসে দাবি করতে পারেন। সেই ছায়াযোদ্ধাদের ইউনূস-বধের প্রক্রিয়া এখন এতটাই তিক্ত আকার নিয়েছে যে এখন তারা আরও বলতে শুরু করেছে, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়ার পেছনেও আছে ইউনূসের ষড়যন্ত্রের হাত। এটাও তো সেই ছায়ার সঙ্গেই যুদ্ধ বটে।
অন্যদিকে যাকে নিয়ে এতটা হইচই, সেই অধ্যাপক ইউনূস কিন্তু এত সব উসকানির মুখেও খুবই সংযত আচরণ দেখিয়ে যাচ্ছেন, যা কিনা তাঁর ভাবমূর্তিকে নিয়ে যাচ্ছে আরও কিছুটা ওপরে। গত সপ্তাহে অধ্যাপক ইউনূস এসেছিলেন জাপানে তাঁর নতুন বাণিজ্যিক তত্ত্ব সামাজিক ব্যবসাসংক্রান্ত এক সেমিনার উপলক্ষে। জাপানে এই গ্রামীণ ব্যাংক-গুরুর ভক্তের অভাব নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেই ভক্তকুলের মধ্যে কাউকে আবার দেখা গেছে আমাদের বাংলাদেশের ছায়াযোদ্ধাদের মতোই একই রকম আচরণ প্রদর্শন করতে, যেমনটা হয়েছিল বছর খানেক আগে টোকিওর এক সেমিনারে। সেমিনারের সঞ্চালক অধ্যাপক যখন মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে তুলে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে একহাত দেখে নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করার আহ্বান উপস্থিত সুধীদের প্রতি জানিয়েছিলেন, তখন বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি যে জাপানি অধ্যাপকও হচ্ছেন বাংলাদেশি সেই ছায়াযোদ্ধাদেরই উল্টো পিঠ। তবে এর বাইরে অন্য আর কোনো রকম বাড়াবাড়ি একেবারেই দেখা যায়নি এবং অধ্যাপক ইউনূস নিজে ছিলেন খুবই সংযত আর আবেগবর্জিত।
এবারের সফরে অধ্যাপক ইউনূস টোকিওর বিদেশি সাংবাদিকদের প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন, যেখানে তাঁর বক্তব্যের বিষয় ছিল সেই একই সামাজিক ব্যবসা। অর্থনৈতিক কিংবা ব্যবসায়িক ধারণা হিসেবে অধ্যাপক ইউনূসের নতুন এই তাত্ত্বিক উপস্থাপনা নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন দেখা দেওয়া খুবই স্বাভাবিক। আমি নিজেও যেমন বুঝে উঠতে পারিনি বিশ্বের তাবৎ মানুষ যখন বাণিজ্যের জগতের মুরব্বিদের বিশ্ব অর্থনীতির এই বেহাল অবস্থার জন্য দায়ী করছেন, ঠিক তখনই তিনি কেন সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতিকে উদ্ধারে এগিয়ে আসার আহ্বান ঠিক সেই একই গোষ্ঠীর কাছেই জানাচ্ছেন। তবে সেটা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ এবং বলতে দ্বিধা নেই যে বক্তব্য তুলে ধরার মধ্য দিয়ে এমন একটি ইন্দ্রজাল তৈরির ক্ষমতা অধ্যাপক ইউনূসের আছে, যা কিনা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকা মানুষের মধ্যেও অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম।
টোকিওর সাংবাদিক মহলে অধ্যাপক ইউনূস খুবই পরিচিত আর শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। এবার নিয়ে এক যুগ সময়ে পঞ্চমবারের মতো টোকিওর বিদেশি সাংবাদিকদের প্রেসক্লাবে তাঁর আগমন। প্রতিবারই দর্শক-আসন ছিল প্রায় পরিপূর্ণ। নিজেকে আমি এ কারণে সৌভাগ্যবান মনে করি যে পাঁচবারের সেই সংবাদ সম্মেলনের মধ্যে তিনবারই সঞ্চালকের দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয়েছে। এবারেও তেমনটাই কথা ছিল, তবে শেষ মুহূর্তে টাইম সাময়িকীর স্ট্রিঙ্গার লুসি বার্মিংহামের অনুরোধে সেই দায়িত্ব পালনের সুযোগ তাঁর জন্য আমি করে দিয়েছিলাম।
অধ্যাপক ইউনূস তাঁর বক্তব্য শেষ করার পর প্রশ্নোত্তর পর্বে অধিকাংশ প্রশ্ন সামাজিক ব্যবসাকেন্দ্রিক হলেও এএফপির টোকিও ব্যুরোর এক সাংবাদিক গ্রামীণ ব্যাংককে কেন্দ্র করে চলতে থাকা বিতর্ক নিয়ে দুটি প্রশ্ন তাঁকে করেছিলেন। একটি প্রশ্ন ছিল নতুন কিছু ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের অনুমতি লাভের প্রক্রিয়া কেন বিলম্বিত হচ্ছে, সে বিষয়ে এবং অন্য প্রশ্নটি ছিল গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরকারের গঠিত কমিশনের কর্মকাণ্ড নিয়ে। পাঠক, লক্ষ করুন, দুটি প্রশ্নই কিন্তু হচ্ছে যথেষ্ট উসকানিমূলক, যার উত্তর দেওয়ার প্রক্রিয়ায় সরকারকে সহজে তুলাধোনা করার সুযোগ অধ্যাপক ইউনূসের সামনে ছিল। তবে তিনি কিন্তু সেই ছায়াযুদ্ধের পথে একেবারেই পা বাড়াননি, বরং খুবই শান্ত কণ্ঠে সেই সাংবাদিককে তিনি বলেছিলেন, আমাদের মতো দেশে আমলাতন্ত্র যে সচরাচর কাজ করে ধীরগতিতে, সেটা তাঁর ভুলে যাওয়া উচিত নয়। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন যে তাঁর নিজের এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে সব রকম কাগজপত্র ইতিমধ্যে জমা দেওয়া হয়েছে এবং কোন সিদ্ধান্তে কমিশন উপনীত হয়, সেটা এখন দেখার অপেক্ষা। তবে তিনি আরও বলেছিলেন, সব সময়ই তিনি আশাবাদী। সংক্ষিপ্ত সেই উত্তরের মধ্য দিয়েই ছায়াযোদ্ধাদের সঙ্গে নিজের পার্থক্য তিনি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন। ফলে পদ্মা সেতুর পেছনে ইউনূসের হাত থাকার কথা বলে মুখে যাঁরা ফেনা তুলে ফেলছেন, ছোট অথচ তাৎপর্যপূর্ণ এ ঘটনাটি তাঁদের মনে রাখা উচিত।
ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ বাংলাদেশে সরকারের ঘনিষ্ঠজনদের অনেকেই করছেন। এই ছায়াযোদ্ধাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ রকম যে নিজেদের কোনো রকম ভুল কখনোই এঁরা স্বীকার করতে নারাজ। অর্থাৎ, সব নষ্টের মূলে আছে অন্যেরা, আমি কিংবা আমরা নই। ঠিক সে রকম এক দৃষ্টান্ত টোকিওতে কিছুদিন আগে রেখে গেলেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
জুলাই মাসের শুরুতে তিনি জাপানে এসেছিলেন আফগানিস্তান-সংক্রান্ত দাতা আর দখলদারি গোষ্ঠীর এক সম্মেলনে যোগ দিতে। টোকিওতে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অবস্থান ছিল একেবারেই যেন চোখের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া। সংবাদমাধ্যম তো নয়ই, এমনকি জাপানের সরকারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও কোথাও দেখা যায়নি তাঁর উপস্থিতির খবর। তবে সেটা হচ্ছে ভিন্ন প্রসঙ্গ। টোকিওতে অবস্থানকালে তিনি অবশ্য বর্তমান এ প্রতিবেদক সম্পর্কে উষ্মা প্রকাশ করে দলীয় সমর্থকদের নাকি বলেছেন যে তাঁকে হেয় করার জন্যই প্রথম আলোতে জাপানের ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়ে টোকিওর দূতাবাস সরিয়ে নেওয়া-সংক্রান্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছিল। পাঠক, একবার স্মরণ করে দেখুন সেই সময়ের ঘটনা। মন্ত্রী অবশ্য এ রকমও দাবি করেছেন বলে শোনা যায় যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কল্যাণের চিন্তা মাথায় রেখে সেই সিদ্ধান্ত তিনি নিলেও অন্যায়ভাবে পত্রিকায় তাঁকে দোষারোপ করা হয়। তবে যে কথাটি তিনি বলেননি তা হলো, সিদ্ধান্ত ন্যায়সংগত ও দেশপ্রেমমূলক হওয়া সত্ত্বেও কেন প্রথম আলোর সেই সংবাদের আলোকে সিদ্ধান্ত তাঁকে শেষ পর্যন্ত পাল্টাতে হয়েছিল।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলটিকে অনেক আশা নিয়ে দেশের মানুষ ভোট দিয়েছিলেন। দলের সাফল্যের পাল্লাও যে একেবারেই কম, তা তো নয়। তবে তার পরও সেই সাফল্যের অনেকটাই পানসে হয়ে যাচ্ছে ছায়াযুদ্ধে শক্তি ক্ষয় করে, যে যুদ্ধের কোনো রকম প্রয়োজনীয়তা একেবারেই নেই। যত দ্রুত নীতিনির্ধারকেরা এটা অনুধাবনে সক্ষম হবেন, ততই নিজেদের জন্য আর দেশের জন্যই কেবল তাঁরা কল্যাণ নিয়ে আসবেন।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
No comments