রাজনীতি- ‘ছোট মন্ত্রিসভা’র প্রস্তাব এবং প্রত্যাখ্যান by মোহীত উল আলম

বিবিসির হার্ড টক শোতে স্টিফেন সাকুরকে সামাল দিয়ে যখন দেশে ফিরলেন প্রধানমন্ত্রী, তখন বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার শিরোনাম ছিল বিবিসি বাংলা সার্ভিসে তাঁর প্রদত্ত নির্বাচনকালীন ছোট মন্ত্রিসভার প্রস্তাব, যেখানে বিএনপির সদস্যরাও মন্ত্রী হিসেবে থাকতে পারবেন। আগের ধারণানুযায়ী বিএনপির পক্ষ থেকে সেটা সঙ্গে সঙ্গে অগৃহীত হলো।


এক আলোচনায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেছেন, এটি প্রধানমন্ত্রীর আরেকটা ধোঁয়াটে কথা। কীভাবে সেই ছোট মন্ত্রিসভা গঠিত হবে, তার কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি, তাই সেটা গ্রহণযোগ্য নয়।
আচ্ছা, ধারণা যদি স্পষ্ট হয়ে না থাকে, সেটা স্পষ্ট করে দেওয়ার জন্য কি আলোচনায় আসা যায় না! প্রস্তাবটা অস্বীকার করার মধ্যে দেশের চলমান সমস্যা যে আরও গভীরে পতিত হলো।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন বক্তব্য ও কর্মের মধ্যে একটি ধারণা স্পষ্ট হচ্ছে যে ভুল হোক বা শুদ্ধ হোক, তিনি একটি হার্ড লাইন নিতে যাচ্ছেন। এই হার্ড লাইনের পেছনে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা যেমন স্পষ্ট হচ্ছে, তেমনি স্পষ্ট হচ্ছে সর্বোচ্চ ত্যাগের মনোভাবের। মাস দুয়েক আগে চট্টগ্রামের একটি জনসভায় প্রধানমন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে এ ধরনের মরিয়া মনোভাব লক্ষ করা গিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, তাঁরা হয় ক্ষমতায় থাকবেন কিংবা থাকবেন না, কিন্তু সংসদে গৃহীত বাতিলকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলের পুনর্জন্ম দেওয়া সম্ভব নয়। টিভিতে তাঁর ভঙ্গি দেখে মনে হয়েছিল, তিনি এ ব্যাপারে অবিচল।
হার্ড টকে স্টিফেন সাকুরের সঙ্গে তাঁর তীব্র বাক্যবিনিময়কে অনেক বোদ্ধা শ্রোতা তাঁর ইংরেজি কথনে আটকে যাওয়া কিংবা ভুল টেনসে কথা বলাসহ তাঁর অপ্রস্তুতির কথা বলেছেন। কিন্তু আমি যেটা লক্ষ করেছি, সেটা হচ্ছে তাঁর অবস্থানের তীব্র তেজোময় ও নিঃশঙ্ক প্রকাশ।
এই তেজোময় প্রকাশের ভিত্তিভূমি শুধু যে তাঁর ব্যক্তিগত সাহসের প্রকাশ তা নয়, এটির পেছনে পুরো বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার সাহসটা জড়িত। বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার লগ্নে শুধু যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের বৈরিতা কার্যকর ছিল তা নয়, এ দেশের যুদ্ধাপরাধী মহল ছাড়াও একটি জনগোষ্ঠী ছিল, যারা মনে করত বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়া একটা অসম্ভব ব্যাপার।
ঠিক সে রকম আরেকটি অসম্ভবের জোরালো পাঁকে পড়েছে বাংলাদেশ। সেটি পদ্মা সেতু নিয়ে। সাকুর বারবার প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছেন, পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের মতো এত স্বনামধন্য মহাজনি প্রতিষ্ঠানকে বিরক্ত করে বাংলাদেশ কি বৈশ্বিক লজ্জার মুখে পড়েনি? প্রধানমন্ত্রী দাপটের সঙ্গে বললেন: না, দুর্নীতি হয়নি, বিশ্বব্যাংক প্রমাণ দিতে পারেনি। তারা একটি চীনা কোম্পানির জন্য তদবির করছিল। বরং তাদের দিকে কোনো দুর্নীতি হয়েছে কি না, সেটা তদন্ত করা দরকার।
দৃশ্যপটটা তাহলে কী? বাংলাদেশের মতো একটি পুঁচকে অর্থনৈতিক শক্তি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত বৃহত্তম মহাজনি সংস্থা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটি বিরোধপূর্ণ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। যেকোনো বিচারে এই সমীকরণে বাংলাদেশের পরাজয় নিশ্চিত, কিন্তু ঠিক এই একই সমীকরণে ৪১ বছর আগে বাংলাদেশের সৃষ্টি হওয়াটাও ছিল একটি অবাস্তব দৃশ্যপট।
আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করার মতো, পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে সম্ভব নয় বলে যাঁরা মতামত প্রকাশ করছেন, তাঁদের মধ্যে সরকারি ও বিরোধী দুই পক্ষেরই সম্মুখভাগের লোক আছেন। আবার নিজস্ব অর্থায়নের পক্ষ নিয়েছেন এমন অনেকে, যাঁদের জাতীয় অর্থনীতি নিয়ে একটি পরিষ্কার ধারণা আছে এবং যাঁরা সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে চিন্তা করেন (যেমন: এম এম আকাশ, আনু মুহাম্মদ ও আবুল বারকাত)।
বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিকভাবে এমন একটি যুগসন্ধিক্ষণে পৌঁছেছে, যখন দুটি মতই সমানভাবে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি। একটি মত হলো বৈদেশিক সাহায্যনির্ভরতা। যেমন: বিশ্বব্যাংকের সাহায্য ছাড়া পদ্মা সেতু করা যাবে না, ব্রিটিশ কাউন্সিলের সাহায্য ছাড়া ইংরেজির চর্চা করা যাবে না, বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ না এনে দেশ গঠন করা যাবে না ইত্যাদি। আরেকটি মত হলো, বাংলাদেশের সব সমস্যা বাংলাদেশকেই সমাধান করার
নিজস্ব রাস্তা বের করতে হবে। পরনির্ভর থাকার যুগ বাংলাদেশের জন্য ফুরিয়ে গেছে।
জনসংখ্যার ওপর একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ধারণা দিয়েছেন যে বাংলাদেশ এখন উপার্জনক্ষম সর্বোচ্চ জনসংখ্যার গণ্ডির মধ্যে পড়েছে। ১৫ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে ৫৮ শতাংশ লোক ঢুকে গেছে এবং এরা সবচেয়ে বেশি উপার্জনক্ষম। এই অবস্থা আরও তিন বা চার দশক পর্যন্ত স্থায়ী হবে। অর্থাৎ, বেগবান অর্থনীতির সঞ্চালনের প্রথম ধাপে পা দিয়েছে বাংলাদেশ।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, শুধু পদ্মা সেতু নয়, বাংলাদেশের সব সমস্যা সমাধানের জন্য অর্থায়ন আমাদেরই করা উচিত। শুধু প্রয়োজন অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী কিন্তু বাস্তববাদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও কার্যকর করা।
কিন্তু দেশকে নিজস্ব অর্থায়নে গঠন করতে গেলে যে ধরনের মহাপরিকল্পনা ও কর্মযজ্ঞ দরকার, সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর উচ্চাশার সঙ্গে তাঁর কর্মসূচি মিলছে না বলে তিনি যেমন বারবার অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন, তেমনি জাতিও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। তাঁর অনিশ্চিত অবস্থানের একটি উদাহরণ দিই। প্রত্যাখ্যাত জনপ্রতিনিধি সৈয়দ আবুল হোসেনের দুর্নীতির প্রসঙ্গটি যখন তুঙ্গে উঠেছিল, তখন তিনি একাধিকবার প্রচারমাধ্যমে বলেছিলেন, তাঁর নিকট পরিবারের পাঁচজন কেউ দুর্নীতিতে জড়িত নেই, কাজেই তাঁর পরিবারকে দুর্নীতিবাজ বলা যাবে না। কিন্তু এই যুক্তি তো আমরা গ্রহণ করতে পারব না। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর আওতায় যাঁরা সরকারি দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁদের অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়। শুধু তাঁদের কাজের দায়দায়িত্ব নয়, মন্ত্রিসভার সবার কাজের দায়দায়িত্বসহ তাঁর অধীনে সরাসরি পরিচালিত সব মন্ত্রণালয়ের দায়দায়িত্বও তাঁর, সারা দেশের কথা যদি বাদও দিই।
একটি উদাহরণ: বঙ্গবন্ধুর আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্যকে (বিশিষ্ট পদার্থবিদ অধ্যাপক মতিন) যখন দুর্নীতির দায়ে কাঠগড়ায় আনা হয়, তখন তিনি সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষককেও যখন দেখলেন, তিনি ফুঁসে উঠে মাননীয় আদালতকে বলেছিলেন, ‘ওনাকে কেন অভিযুক্ত করা হচ্ছে? সব দায়দায়িত্ব তো আমার। উনি ছিলেন আমার অধীনস্ত।’
বিশ্বব্যাংক দ্বারা ঋণ প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী যেমন একটি সোজা রাস্তা দেখতে চাইছেন যে পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নেই হবে, তেমনি ২০০৭-০৮-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ৯০ দিনের জায়গায় দুই বছর সময় নেওয়া এবং তাঁকে ও বর্তমান বিরোধী দলের নেত্রীসহ রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর নেতাদের কারাগারে নিক্ষেপসহ নানাভাবে নিগৃহীত করা হলে তিনি বুঝে গেছেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাওয়ার অর্থই হচ্ছে সিন্দবাদের দৈত্যটাকে আবার কাঁধে তুলে নেওয়া।
এখন বাংলাদেশের অবস্থা হয়েছে এমন যে সরকারি দলের শত রকম ব্যর্থতার কারণে বিরোধী দলের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। বিরোধী দল কখনো সংসদে যায় না। এটি বহু দিনের পুরোনো অভিযোগ, যেটি বিরোধী দল কানেও তুলছে না। কিন্তু বেতন-ভাতাদি ঠিকই নিচ্ছেন বিরোধী দলের সাংসদেরা। এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিরহিত হওয়ার পর তারা সংসদে না গিয়ে আন্দোলনের নামে জনমনে ভীতির সঞ্চার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনতে সরকারকে বাধ্য করবে—এ রকম কর্মসূচি চালু রেখেছে, আবার ঈদের পরে তা জোরদার করবে বলছে। জ্বালাও-পোড়াওয়ের অভিযোগে বিরোধী দলের নেতাদের কারাগারে যাওয়া ও তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার কারণে পরিস্থিতি শান্তির বদলে অশান্তির দিকে প্রবাহিত হচ্ছে।
তাহলে ২০১২ সালের কোরবানি ঈদের পর থেকে কি বাংলাদেশ যুদ্ধমান দুটি রাজনৈতিক শিবিরের সাংঘর্ষিক প্রতিপক্ষতায় অগ্নিকুণ্ডলীতে পরিণত হবে? সেটি কি আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কোনো দলের জন্যই সুবিবেচনাকর হবে বা ফলপ্রসূ হবে? নিরীহ জনসাধারণ যে ব্যাপকভাবে এই অরাজকতার শিকার হবে, তার দায়দায়িত্ব কে নেবে? সাংঘর্ষিক রাজনীতি সর্বোতভাবে সব সময় পরিহারযোগ্য।
নির্বাচনের সময় সব দলে প্রতিনিধিত্বকারী ছোট মন্ত্রিসভার প্রস্তাব যদি প্রধানমন্ত্রী দিয়ে থাকেন, তাহলে সেটা গ্রহণে সরাসরি অস্বীকার না করে, সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে অসুবিধা কী? বিরোধী দল যদি অন্তর্বর্তী ছোট মন্ত্রিসভার প্রস্তাব গ্রহণ না করে, তাহলে তারা এর বিকল্প কোনো প্রস্তাব দিক না কেন, যেখানে সবার অন্তর্ভুক্তির ধারণা থাকবে?
কিন্তু সেসব কোনোটাই বিচার-বিবেচনার মধ্যে না এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনর্জীবনের দাবি বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে অটল থাকলে বিরোধী দলকে তিনটি শাসনতান্ত্রিক আইনি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। এক, সরকারি দল ২০০৮ সালের নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়েছিল কি না; দুই, সরকারি দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলুপ্তি সংসদীয় রীতির বাইরে গিয়ে করেছিল কি না; তিন, নিরপেক্ষ বা নির্দলীয় সরকারের দাবি তুলতে বা সেটা পাস করাতে বিরোধী দলকে সংসদে যেতে হবে কি না।
বিরোধী দল যদি সংসদে কার্যকর ভূমিকা না রেখে নানা দাবিতে সাংঘর্ষিক আন্দোলনকে তাতিয়ে তোলে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের নানা রকম ভুল পদক্ষেপের কারণে দেশব্যাপী নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমগ্র দেশ।
সরকারি দলের অদক্ষতা আর বিরোধী দলের নেতিবাচকতা মিলে যে একটি রাজনৈতিক বিবমিষাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সেটি থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের কাছে দেশ অনেক বেশি প্রাজ্ঞ রাজনীতি আশা করে। পেশিনির্ভর, স্লোগাননির্ভর রাজনীতির তামাদি পথে চলে কারও লাভ হবে না।
মোহীত উল আলম: অধ্যাপক ও প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.