গণআদালত থেকে ট্রাইব্যুনাল সর্বাধিনায়ক শেখ হাসিনা by মুহম্মদ শফিকুর রহমান
বাংলাদেশ এখন যে কাল অতিক্রম করছে
ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে তা ‘উত্তরণের’ কাল। সামনে নির্বাচন, ‘আন্তর্জাতিক
অপরাধ ট্রাইব্যুনালে’ ঘাড় মোটা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে;
তাদের একজন বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির দ-াদেশ দেয়া হয়েছেÑঅর্থাৎ শেষ
নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রায় কার্যকর করা হবেÑআইনের ভাষায় “ঃড় নব
যধহমবফ নু ঃযব হবপশ ঃরষষ যব রং ফবধফ.” তবে এই নরপশু এখন পলাতক। রায়ে বলা
হয়েছে, সে যখনই গ্রেফতার হবে তখনই তার ফাঁসির দ- কার্যকর করা হবে।
এ রায়ের মাধ্যমে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকি-মিলিটারি জান্তা বর্বর মানবতাবিরোধী অর্থাৎ হত্যা, গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়ার যে-যে যুদ্ধাপরাধ করেছে, তখন তাদের সহযোগী ছিল জামায়াত-ছাত্রসংঘ (ছাত্রশিবির)। জামায়াত-ছাত্রসংঘ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবেই পাকি-মিলিটারিদের দোসর হয়েছিল। যেমন ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছেÑ
“The then Pakistan Government and the Military setup a number of auxiliary forces such as Rajakers, Al-Budr, Al-Shams and Peace Committee. These forces were formed to collaborate with the Pakistani Military in identifying and eliminating all those who sympathies with the liberation of Bangladesh, individuals belonging to minority religions groups, especially the Hindus, Political groups belonging to the Awami league and other pro-liberation political parties, Bengalee intellectuals and innocent civilians. “People of the then rest Pakistan whole heartedly supported the war and participated in the call to free Bangladesh.
“But a small number of Bengalees, Biharis, other Pro-Pakistani, as well as member of different religion based political parties, Particularly Jamaat and its student wing Islami Chhatra Sangha (ICS) (Present Islami Chhatra Shibir (ICS) joined and/or collaborated with the Pakistani Military to actively oppose the creation of independent Bangladesh.
“And most of them committed and facilitated the commission of atrocities. “As a result, three million people were killed, near about a quarter million women raped, about 10 million people forced to flee to India and million others internally displaced.
“Susan Brownmiller, a as feminists, Journalist and author who conducted a detailed study, has estimated the number of raped women at over 400000 (four lac).”
রায়ের এ অংশটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে হুবহু ইংরেজিটি তুলে ধরলাম এজন্য যে, এর মাধ্যমে জামায়াত-শিবিরকে আবারও নিষিদ্ধ করতে আর কোন বাধা থাকবে না। অংশটির সংক্ষিপ্ত বাংলা করলে দাঁড়াবে তখনকার পাকিস্তান ও পাকি-মিলিটারি জান্তা তাদের বর্বরতা চালানোর জন্য বেশকিছু সহযোগী বাহিনী যেমন রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং শান্তি কমিটি গঠন করে। এসব বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তি, গ্রুপ, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়, রাজনৈতিক দল যেমন আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি, বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষকে চিহ্নিত করে নিশ্চিহ্ন করার কাজে তাদের সক্রিয় সহযোগিতা করে। তখনকার পূর্ব পাকিস্তান পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করলেও কেবল ওইসব পাকিস্তানপন্থী কিছু বাঙালী, বিহারি এবং জামায়াত ইসলামী ছাত্রসংঘ (এখন ছাত্রশিবির)সহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বিরোধিতা করে। তাদের বেশিরভাগই পাকিদের যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত ছিল বা নিজেরাও অংশ নেয়। ফলে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয় এবং আড়াই লক্ষাধিক নারী ধর্ষিত ও শহীদ হয়। প্রায় এক কোটি মানুষ নিরাপত্তার জন্য ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। দেশের অভ্যন্তরেও বহু মানুষ নিজ বাড়ি-ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। সুসান ব্রাউনমিলার আমেরিকার এক নারী অধিকার কর্মী, সাংবাদিক ও লেখক দীর্ঘদিন গবেষণার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ধর্ষিতা মা-বোনের সংখ্যা ৪০০০০০ (চার লাখ)-এর বেশি।
এই প্যারার প্রথমে আমি জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার জন্য ‘আবারও’ শব্দটি এজন্য ব্যবহার করেছি যে, স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু করেন। তখন ৪০ হাজারের মতো গ্রেফতার হয়, এর মধ্যে ১১ হাজারের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয় এবং তাদের মধ্যে ৬ শতাধিক অপরাধীর ফাঁসি, যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। সাতক্ষীরার চিকন আলী নামে এক যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হয়। তখন জাসদের মুখপত্র ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় হেড লাইন হয়েছিল: “চিকন আলীদের ফাঁসি হয়, মোটা আলীরা বেঁচে যায়”। ঘাড় মোটা রাজাকারগুলোর বিচার তখনও শেষ হয়নি বা গোলাম আযমসহ অনেকে বিদেশে পলাতক ছিল।
কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মাথায় ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যা এবং মিলিটারি জিয়া ক্ষমতায় এসে দালাল আইন তুলে দিয়ে সব যুদ্ধাপরাধীকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু তখন জামায়াত-শিবিরসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। জিয়া সেই নিষেধাজ্ঞাও তুলে দেয় এবং পাকিস্তানে পলাতক গোলাম আযমকে দেশে ফিরে জামায়াতকে সংগঠিত করার সুযোগ করে দেয়। এরই বিরুদ্ধে বাঙালী জাতি, বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠী বিগত ২০০৮-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটকে চার-পঞ্চামাংশ আসন উপহার দেয়Ñ অনেক লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম প্রদান লক্ষ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। শেখ হাসিনা তার নির্বাচনী ইশতেহার ও ওয়াদা অনুযায়ী ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করে রাজাকার, আলবদরদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেন এবং বিচারকার্য শুরু করেন।
এই দিক বিচারে বাঙালীর দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালীর হাজার বছরের স্বপ্নসাধ যাপন/স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সর্বাধিনায়ক যেমন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তেমনি এ সময়ে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সাহসী লড়াইয়ের সর্বাধিনায়ক হলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা।
অবশ্য কেবল বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায় হলো। একইভাবে ওই ফাঁসির দড়িতে বাঁধা আছে গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, মুজাহিদ, সাকা চৌধুরী, সাঈদী, আবদুল কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, মীর কাশেম আলী, আব্দুল আলিমসহ ঘাড় মোটা জালিমরা। এদের বেশির ভাগের বিচার প্রায় শেষ পর্যায়ে এবং আগামী ৬/৭ মাসের মধ্যে রায় ঘোষণা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
॥ দুই ॥
বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির দ-াদেশে গোটা বাংলাদেশ আনন্দে ভাসছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে শহর-বন্দর-গ্রাম সর্বত্র মানুষ মিছিল করে, মানববন্ধন করে, মিষ্টি খাওয়া-খাওয়ি করে আনন্দ করছে। মানুষের প্রত্যয় ঘোষণাÑ আর কোন অপশক্তিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য বন্ধ করতে দেয়া হবে না।
মানুষ তো আনন্দ করছে, কিন্তু আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া একবারেই মুখ খুলছেন না। তার মন খুব খারাপ। অধিক শোকে কাতর হয়ে পড়েছেন। হবেন নাইবা কেন, দুর্নীতি ও অর্থপাচারের দায়ে পুত্রদ্বয় দেশান্তরী, লন্ডন-মালয়েশিয়ায় বিলাসী জীবন যাপন করলেও দেশে তো আসতে পারছেন না। ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটাও গেল; অন্যদিকে শেখ হাসিনা যেভাবে মানুষের আয় বাড়িয়ে ব্যয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনীতি উপহার দিলেন; হাতিরঝিল, এয়ারপোর্ট থেকে হাত-পা ছড়ানো বিভিন্নমুখী ফ্লাইওভার, যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদের অসহনীয় যানজট নিচে ফেলে উড়ে যাবার দীর্ঘপথÑ আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এগুলো উদ্বোধনের পর কেবল যানজটই প্রশমন হবে না, এক দৃষ্টিনন্দন ঢাকা গড়ে উঠবে। তাছাড়া ৪+২=৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকতে থাকতে তিনি হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে খড়কুটো ধরে বাঁচার মতো জামায়াত-শিবির রাজাকার-আলবদরদের ওপর ভর করে আরেকটি বড় ধরনের ভুল করেছেন। জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা পুলিশের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে বা মানুষের গাড়ি-বাড়ি ভাংচুর করে বা অগ্নিসংযোগ করে জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করে তার দায় সরকারের ওপর চাপিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার যে অঙ্ক এতদিন কষছিলেন, তাও এখন আর মিলছে না। বাচ্চু রাজাকার সব গোলমাল করে দিল। সর্বশেষ ক্ষীণ আশা কুহকিনী হলো পদ্মা সেতুÑ বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন না করলে শুরু করা যাবে নাÑ অন্তত আগামী নির্বাচনে এই ঢেঁড়াটা বাজাতে পারবেন। তাতেও জোর বাড়ি দিয়ে ফাটিয়ে দিলেন শেখ হাসিনা। বিশ্বব্যাংককে জানুয়ারির মধ্যেই ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ যা হয় বলার আলটিমেটাম দিয়েছেন। বলেছেন, নয়তো সরকার অন্য ব্যবস্থায় কাজ শুরু করে দেবে। অর্থাৎ এই ট্রামকার্ডটাও গেল। খাদ্য এবং বিদ্যুত সহনীয় অবস্থায়। সরকারের বিরুদ্ধে বলার প্রায় সব পয়েন্ট হাতছাড়া হয়ে গেল।
হাতে রইল শুধু সংসদ। বলবেন সংসদে তাদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। এটা যে মিথ্যা জনগণ জানে। তারা টেলিভিশনের মাধ্যমে দেখছে, খালেদা জিয়া সদস্যপদ বাঁচানোর জন্য একদিন সংসদে গিয়ে টানা ১ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট বক্তৃতা করেছেন। বরং জনগণই উল্টা প্রশ্ন করবেন আপনারা ভোট নেন সংসদে যান না, সংসদে গিয়ে এলাকার উন্নয়ন এবং জনগণের অভাব-অভিযোগ তুলে ধরেন না। রাজপথে সরকারকে গালাগাল করেন, গাড়ি ভাংচুর করেন। পুলিশের ওপর হামলা চালান এবং যে দাবিতে এসব করেন তাও সংসদে গিয়ে তুলে ধরেন না, তো আপনারা ভোট নিয়ে কি করবেন?
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাইরে থাকতে তবু হাছামিছা বলে একটু গরম করে রাখতেনÑ কুচ কুচ অনুভূত হন। তিনি গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেলে মুখপাত্র হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তরিকুল ইসলামকে। মওদুদ-মোশাররফ-আনোয়ার-নজরুলরা থাকতে তাকে কোন যোগ্যতায় মুখপাত্র করা হলো কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না। তবে তার চোখ বন্ধ করে জিহ্বা জড়ানো কথাবার্তার অনেকটাই বোঝা যায় না; এ থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল তরিক মিয়ার যোগ্যতা হলো তার মুখে প্রায় সারাক্ষণই ‘পাত্র’ থাকে। তাই মুখ+পাত্র=মুখপাত্র। এই মুখ+পাত্র=মুখপাত্র যখন বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধী বিচারের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪০ হাজার রাজনৈতিক কর্মী হত্যারও বিচার করতে হবে ?’Ñ মিলল কথাটা? প্রথমত স্বাধীনতার পর ৪০ হাজার রাজনৈতিক কর্মী হত্যার তথ্য তিনি কোথায় পেলেন? নাকি তারা বাম রাজনীতির নামে তখন যেসব মানুষ হত্যা করেছেন তাদের গুনেছেন? তাতেও ৪০ হাজার হবে নাÑ ৪ হাজার হবে কিনা সন্দেহ। তাছাড়া একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকি-সহযোগী হিসেবে হত্যা, গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, মানুষকে বাড়িছাড়া করা এসব অপরাধের সাথে অন্য কোন অপরাধ মেলানো যাবে কি? একাত্তরের অপরাধ হলো একটি জাতিকে হত্যার মতো, রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে আঘাত করার মতো।
অবশ্য বেচারাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তার ম্যাডামই তো বছরখানেক আগে সিলেটে জনসভায় বলেছেন, গোলাম আযম-নিজামী গং যুদ্ধাপরাধী নয়। এর পর থেকেই দেখা গেছে খালেদা জিয়ার সভা-সমাবেশের সামনের অঞ্চল থাকে জামায়াত-শিবিরের দখলে, তাদের হাতে থাকে গোলাম আযমসহ যুদ্ধাপরাধী ছবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড-ব্যানার-ফেস্টুন। তারা সেøাগান দেয় ট্রাইব্যুনাল ভাঙ্গার, সেøাগান দেয় ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়া থেকে বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের ছিনিয়ে নেয়ার। কাজেই খালেদা জিয়া মুখ খুলবেন না এটাই স্বাভাবিক এবং তিনি এখন জামায়াত-শিবিরেরই চেয়ারপারসন।
॥ তিন ॥
জামায়াতের অর্থভা-ার আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিস্ট নিয়োগ করে কিছুটা ফল হয়েছে। কিছু দেশ বিভ্রান্তি ছড়াবার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি বৃহস্পতিবার মহাজোটের আনন্দ মানববন্ধন উদ্বোধনকালে বলেছেন, বিবিসিসহ কিছু মিডিয়া বাচ্চু রাজাকারকে ‘ধর্মযাজক’ বলার চেষ্টা করছেন, যা মোটেই সত্য নয়। বাচ্চু রাজাকারের ভাল নাম আবুল কালাম আযাদ, মুক্তিযুদ্ধকালে বাচ্চু রাজাকার নামে ফরিদপুর অঞ্চলে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করে। এ জন্যই তার বিচার হয়েছে। একে একে অন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ও অচিরেই হবে। কেউ কেউ বলছেন, তারা মৃত্যুদ- সমর্থন করেন না। আমি প্রশ্ন করি, ইরাকের সাদ্দাম হোসনকে যখন নৃশংসভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিল তখন তারা কোথায় ছিলেন? বরং তখন তারাও ইরাকে মিলিটারি পাঠিয়ে আমেরিকার নীলনকশা বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে।
আমরা বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায়ের দিকে তাকালে দেখতে পাব? এই পাষ- ১৪ জন হিন্দুকে হত্যা, দু’জন মহিলাকে ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করেছে। যে কারণে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, “We should not forget the millions of victims who deserve that their tormentors are held accountable”.অর্থাৎ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ স্বাভাবিকভাবে আশা করে তাদের ওপর নির্যাতনকারীদের গলায় দড়ি পড়বে এবং শাস্তি ভোগ করবে।
॥ চার ॥
বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির দ- এক শ্রেণীর গলাজীবীর মুখে চপেটাঘাত করেছে। এরা আবার মধ্যরাতের গলাজীবী, বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। এদের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার, কেউ সবজান্তা সাংবাদিকÑতাদেরকে বুদ্ধিজীবী না বলে উপায় আছে?
এবার তারা কি বলবেন? নিশ্চয়ই প্রশ্ন তুলবেন বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে। বলবেন সরকার চাপ দিয়ে এসব করাচ্ছে। দেশব্যাপী যখন দাবি উঠছে বিচার ত্বরান্বিত করার তখন এই জ্ঞানপাপীরা বলতে শুরু করেন এটা বিচারকার্যে নগ্ন হস্তক্ষেপ। বস্তুত তাদের এসব কথাবার্তা সবই হচ্ছে বিচারকার্য বন্ধ করার শয়তানি। জামায়াতী এজেন্ডা বাস্তবায়ন। বস্তুত একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এদের জীবনে-মননে চরম গ্লানি এনে দিয়েছে। এরা যেমন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেনি মানসিক দৈন্যের কারণে অথবা ‘পাকিস্তানী দিল’-এর কারণে; কিন্তু দেশ তো স্বাধীন এবং শত্রুমুক্ত হবার পর মনে হলো ভুল করেছে। কিন্তু এখন তো আর সময় নেই। আর তাই যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের দলেও ভিড়তে পারছেন না আবার কিছুটা আধুনিক শিক্ষা থাকার কারণে রাজাকারদের দলেও ভিড়তে পারছেন না। তাই বুদ্ধিজীবী সেজেছেন। এদের কেউ কেউ এক সময় ভাসানী ন্যাপ বা ছাত্র সংগঠন, ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। একটা অংশ মুক্তিযুদ্ধেও গেছে। তাদের মধ্যে রাশেদ খান মেনন বা রনোদের বাদ দিয়ে বাকিরা যেভাবে মিলিটারি জিয়ার মঞ্চে উঠলেন তাতে করে তাদের চরিত্রের কুমারিত্ব তখনই চলে যায়। আর যার কুমারিত্ব থাকে না সে যে কোন জায়গায় ভাড়া খাটতে পারে। ড. আসফ, ড. পেঁয়াজ করিম, মাহফুজরা তা-ই করছেন।
মধ্যরাতের এক শ্রেণীর গলাজীবী প্রশ্ন তোলেন, আওয়ামী লীগ তো আগেও ক্ষমতায় ছিল তখন কেন বিচার করেনি? তারা জেনেশুনেই এই মিথ্যা অভিযোগটা উত্থাপন করছেন। অথবা ইচ্ছা করেই ভুলে যাবার ভান করছেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু কিভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেন বা কেন জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করেন তার বিবরণ আগেই দিয়েছি।
দ্বিতীয়ত বঙ্গবন্ধু সরকার একাত্তরে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও নাগরিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া এবং পাকি-মিলিটারিদের সহযোগী হিসেবে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকায় জামায়াত-ছাত্রসংঘ (ছাত্রশিবির)সহ সকল ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির গোলাম আযমসহ প্রায় ৩০ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেন। এই গোলাম আযমসহ অনেকে সেদিন আজকের বাচ্চু রাজাকারের মতো পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সবুর খান, ফকা চৌধুরীর মতো ঘাড়মোটা রাজাকারদের কারাগারে পাঠানো হয়। কারণ এরা কেবল ৩০ লাখ শহীদ ও ৪ লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের ও তাদের পরিবারের গ্লানির জন্যই দায়ী নয়। এই দুর্বৃত্তরা বাংলাদেশের আত্মাকে হত্যা করতে চেয়েছিল, রাষ্ট্রের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল।
এসব কথা জেনেও এই জ্ঞানপাপীরা প্রশ্ন তোলেন। এরা এও ভাল করে জানেন যে, জাতির জনককে হত্যার পর মিলিটারি জিয়াই ক্ষমতা দখল করে দালাল আইন বাতিল করে সব যুদ্ধাপরাধীকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেন এবং একই সঙ্গে জামায়াত-শিবিরকে আবারও রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। দুর্বৃত্ত গোলাম আযমকে দেশে নিয়ে আসেন। আর খালেদা জিয়া নিজামী-মুজাহিদ (বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী আলবদর) এর গাড়িতে শহীদের রক্তরাঙ্গা পতাকা তুলে দেন। এরপরও কি বলা যাবে জিয়া মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বা খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করেন?
তৃতীয়ত কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালেও ক্ষমতায় এসেছিল। তখন কেন বিচার করেননি? জ্ঞানপাপীরা জেনে-শুনেও এ অবান্তর প্রশ্নটি করেন। তারাও ভাল করেই জানেন সে বার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার অঙ্গীকার ছিল না এবং আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাও ছিল না। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং আ স ম আবদুর রবকে ধার করে মন্ত্রী বানিয়ে তবেই সরকার গঠন করেছিলেন। আসন সংখ্যার দিক থেকে সে বার দুর্বল সরকার পরিচালনা করেছেন এবং বলা যায় ওই দুর্বল সরকার দিয়েও সুশাসন বা Good Governmence দিতে পেরেছিলেন, যা নজিরবিহীন।
ঢাকা, ২৬ জানুয়ারি ২০১৩
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
এ রায়ের মাধ্যমে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকি-মিলিটারি জান্তা বর্বর মানবতাবিরোধী অর্থাৎ হত্যা, গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়ার যে-যে যুদ্ধাপরাধ করেছে, তখন তাদের সহযোগী ছিল জামায়াত-ছাত্রসংঘ (ছাত্রশিবির)। জামায়াত-ছাত্রসংঘ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবেই পাকি-মিলিটারিদের দোসর হয়েছিল। যেমন ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছেÑ
“The then Pakistan Government and the Military setup a number of auxiliary forces such as Rajakers, Al-Budr, Al-Shams and Peace Committee. These forces were formed to collaborate with the Pakistani Military in identifying and eliminating all those who sympathies with the liberation of Bangladesh, individuals belonging to minority religions groups, especially the Hindus, Political groups belonging to the Awami league and other pro-liberation political parties, Bengalee intellectuals and innocent civilians. “People of the then rest Pakistan whole heartedly supported the war and participated in the call to free Bangladesh.
“But a small number of Bengalees, Biharis, other Pro-Pakistani, as well as member of different religion based political parties, Particularly Jamaat and its student wing Islami Chhatra Sangha (ICS) (Present Islami Chhatra Shibir (ICS) joined and/or collaborated with the Pakistani Military to actively oppose the creation of independent Bangladesh.
“And most of them committed and facilitated the commission of atrocities. “As a result, three million people were killed, near about a quarter million women raped, about 10 million people forced to flee to India and million others internally displaced.
“Susan Brownmiller, a as feminists, Journalist and author who conducted a detailed study, has estimated the number of raped women at over 400000 (four lac).”
রায়ের এ অংশটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে হুবহু ইংরেজিটি তুলে ধরলাম এজন্য যে, এর মাধ্যমে জামায়াত-শিবিরকে আবারও নিষিদ্ধ করতে আর কোন বাধা থাকবে না। অংশটির সংক্ষিপ্ত বাংলা করলে দাঁড়াবে তখনকার পাকিস্তান ও পাকি-মিলিটারি জান্তা তাদের বর্বরতা চালানোর জন্য বেশকিছু সহযোগী বাহিনী যেমন রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং শান্তি কমিটি গঠন করে। এসব বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তি, গ্রুপ, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়, রাজনৈতিক দল যেমন আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি, বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষকে চিহ্নিত করে নিশ্চিহ্ন করার কাজে তাদের সক্রিয় সহযোগিতা করে। তখনকার পূর্ব পাকিস্তান পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করলেও কেবল ওইসব পাকিস্তানপন্থী কিছু বাঙালী, বিহারি এবং জামায়াত ইসলামী ছাত্রসংঘ (এখন ছাত্রশিবির)সহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বিরোধিতা করে। তাদের বেশিরভাগই পাকিদের যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত ছিল বা নিজেরাও অংশ নেয়। ফলে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয় এবং আড়াই লক্ষাধিক নারী ধর্ষিত ও শহীদ হয়। প্রায় এক কোটি মানুষ নিরাপত্তার জন্য ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। দেশের অভ্যন্তরেও বহু মানুষ নিজ বাড়ি-ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। সুসান ব্রাউনমিলার আমেরিকার এক নারী অধিকার কর্মী, সাংবাদিক ও লেখক দীর্ঘদিন গবেষণার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ধর্ষিতা মা-বোনের সংখ্যা ৪০০০০০ (চার লাখ)-এর বেশি।
এই প্যারার প্রথমে আমি জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার জন্য ‘আবারও’ শব্দটি এজন্য ব্যবহার করেছি যে, স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু করেন। তখন ৪০ হাজারের মতো গ্রেফতার হয়, এর মধ্যে ১১ হাজারের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয় এবং তাদের মধ্যে ৬ শতাধিক অপরাধীর ফাঁসি, যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। সাতক্ষীরার চিকন আলী নামে এক যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হয়। তখন জাসদের মুখপত্র ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় হেড লাইন হয়েছিল: “চিকন আলীদের ফাঁসি হয়, মোটা আলীরা বেঁচে যায়”। ঘাড় মোটা রাজাকারগুলোর বিচার তখনও শেষ হয়নি বা গোলাম আযমসহ অনেকে বিদেশে পলাতক ছিল।
কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মাথায় ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনককে হত্যা এবং মিলিটারি জিয়া ক্ষমতায় এসে দালাল আইন তুলে দিয়ে সব যুদ্ধাপরাধীকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু তখন জামায়াত-শিবিরসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। জিয়া সেই নিষেধাজ্ঞাও তুলে দেয় এবং পাকিস্তানে পলাতক গোলাম আযমকে দেশে ফিরে জামায়াতকে সংগঠিত করার সুযোগ করে দেয়। এরই বিরুদ্ধে বাঙালী জাতি, বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠী বিগত ২০০৮-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটকে চার-পঞ্চামাংশ আসন উপহার দেয়Ñ অনেক লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম প্রদান লক্ষ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। শেখ হাসিনা তার নির্বাচনী ইশতেহার ও ওয়াদা অনুযায়ী ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করে রাজাকার, আলবদরদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেন এবং বিচারকার্য শুরু করেন।
এই দিক বিচারে বাঙালীর দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালীর হাজার বছরের স্বপ্নসাধ যাপন/স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সর্বাধিনায়ক যেমন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তেমনি এ সময়ে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সাহসী লড়াইয়ের সর্বাধিনায়ক হলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা।
অবশ্য কেবল বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায় হলো। একইভাবে ওই ফাঁসির দড়িতে বাঁধা আছে গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, মুজাহিদ, সাকা চৌধুরী, সাঈদী, আবদুল কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, মীর কাশেম আলী, আব্দুল আলিমসহ ঘাড় মোটা জালিমরা। এদের বেশির ভাগের বিচার প্রায় শেষ পর্যায়ে এবং আগামী ৬/৭ মাসের মধ্যে রায় ঘোষণা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
॥ দুই ॥
বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির দ-াদেশে গোটা বাংলাদেশ আনন্দে ভাসছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে শহর-বন্দর-গ্রাম সর্বত্র মানুষ মিছিল করে, মানববন্ধন করে, মিষ্টি খাওয়া-খাওয়ি করে আনন্দ করছে। মানুষের প্রত্যয় ঘোষণাÑ আর কোন অপশক্তিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য বন্ধ করতে দেয়া হবে না।
মানুষ তো আনন্দ করছে, কিন্তু আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া একবারেই মুখ খুলছেন না। তার মন খুব খারাপ। অধিক শোকে কাতর হয়ে পড়েছেন। হবেন নাইবা কেন, দুর্নীতি ও অর্থপাচারের দায়ে পুত্রদ্বয় দেশান্তরী, লন্ডন-মালয়েশিয়ায় বিলাসী জীবন যাপন করলেও দেশে তো আসতে পারছেন না। ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটাও গেল; অন্যদিকে শেখ হাসিনা যেভাবে মানুষের আয় বাড়িয়ে ব্যয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনীতি উপহার দিলেন; হাতিরঝিল, এয়ারপোর্ট থেকে হাত-পা ছড়ানো বিভিন্নমুখী ফ্লাইওভার, যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদের অসহনীয় যানজট নিচে ফেলে উড়ে যাবার দীর্ঘপথÑ আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এগুলো উদ্বোধনের পর কেবল যানজটই প্রশমন হবে না, এক দৃষ্টিনন্দন ঢাকা গড়ে উঠবে। তাছাড়া ৪+২=৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকতে থাকতে তিনি হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে খড়কুটো ধরে বাঁচার মতো জামায়াত-শিবির রাজাকার-আলবদরদের ওপর ভর করে আরেকটি বড় ধরনের ভুল করেছেন। জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা পুলিশের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে বা মানুষের গাড়ি-বাড়ি ভাংচুর করে বা অগ্নিসংযোগ করে জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করে তার দায় সরকারের ওপর চাপিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার যে অঙ্ক এতদিন কষছিলেন, তাও এখন আর মিলছে না। বাচ্চু রাজাকার সব গোলমাল করে দিল। সর্বশেষ ক্ষীণ আশা কুহকিনী হলো পদ্মা সেতুÑ বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন না করলে শুরু করা যাবে নাÑ অন্তত আগামী নির্বাচনে এই ঢেঁড়াটা বাজাতে পারবেন। তাতেও জোর বাড়ি দিয়ে ফাটিয়ে দিলেন শেখ হাসিনা। বিশ্বব্যাংককে জানুয়ারির মধ্যেই ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ যা হয় বলার আলটিমেটাম দিয়েছেন। বলেছেন, নয়তো সরকার অন্য ব্যবস্থায় কাজ শুরু করে দেবে। অর্থাৎ এই ট্রামকার্ডটাও গেল। খাদ্য এবং বিদ্যুত সহনীয় অবস্থায়। সরকারের বিরুদ্ধে বলার প্রায় সব পয়েন্ট হাতছাড়া হয়ে গেল।
হাতে রইল শুধু সংসদ। বলবেন সংসদে তাদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। এটা যে মিথ্যা জনগণ জানে। তারা টেলিভিশনের মাধ্যমে দেখছে, খালেদা জিয়া সদস্যপদ বাঁচানোর জন্য একদিন সংসদে গিয়ে টানা ১ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট বক্তৃতা করেছেন। বরং জনগণই উল্টা প্রশ্ন করবেন আপনারা ভোট নেন সংসদে যান না, সংসদে গিয়ে এলাকার উন্নয়ন এবং জনগণের অভাব-অভিযোগ তুলে ধরেন না। রাজপথে সরকারকে গালাগাল করেন, গাড়ি ভাংচুর করেন। পুলিশের ওপর হামলা চালান এবং যে দাবিতে এসব করেন তাও সংসদে গিয়ে তুলে ধরেন না, তো আপনারা ভোট নিয়ে কি করবেন?
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাইরে থাকতে তবু হাছামিছা বলে একটু গরম করে রাখতেনÑ কুচ কুচ অনুভূত হন। তিনি গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেলে মুখপাত্র হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তরিকুল ইসলামকে। মওদুদ-মোশাররফ-আনোয়ার-নজরুলরা থাকতে তাকে কোন যোগ্যতায় মুখপাত্র করা হলো কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না। তবে তার চোখ বন্ধ করে জিহ্বা জড়ানো কথাবার্তার অনেকটাই বোঝা যায় না; এ থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল তরিক মিয়ার যোগ্যতা হলো তার মুখে প্রায় সারাক্ষণই ‘পাত্র’ থাকে। তাই মুখ+পাত্র=মুখপাত্র। এই মুখ+পাত্র=মুখপাত্র যখন বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধী বিচারের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪০ হাজার রাজনৈতিক কর্মী হত্যারও বিচার করতে হবে ?’Ñ মিলল কথাটা? প্রথমত স্বাধীনতার পর ৪০ হাজার রাজনৈতিক কর্মী হত্যার তথ্য তিনি কোথায় পেলেন? নাকি তারা বাম রাজনীতির নামে তখন যেসব মানুষ হত্যা করেছেন তাদের গুনেছেন? তাতেও ৪০ হাজার হবে নাÑ ৪ হাজার হবে কিনা সন্দেহ। তাছাড়া একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকি-সহযোগী হিসেবে হত্যা, গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, মানুষকে বাড়িছাড়া করা এসব অপরাধের সাথে অন্য কোন অপরাধ মেলানো যাবে কি? একাত্তরের অপরাধ হলো একটি জাতিকে হত্যার মতো, রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে আঘাত করার মতো।
অবশ্য বেচারাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তার ম্যাডামই তো বছরখানেক আগে সিলেটে জনসভায় বলেছেন, গোলাম আযম-নিজামী গং যুদ্ধাপরাধী নয়। এর পর থেকেই দেখা গেছে খালেদা জিয়ার সভা-সমাবেশের সামনের অঞ্চল থাকে জামায়াত-শিবিরের দখলে, তাদের হাতে থাকে গোলাম আযমসহ যুদ্ধাপরাধী ছবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড-ব্যানার-ফেস্টুন। তারা সেøাগান দেয় ট্রাইব্যুনাল ভাঙ্গার, সেøাগান দেয় ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়া থেকে বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের ছিনিয়ে নেয়ার। কাজেই খালেদা জিয়া মুখ খুলবেন না এটাই স্বাভাবিক এবং তিনি এখন জামায়াত-শিবিরেরই চেয়ারপারসন।
॥ তিন ॥
জামায়াতের অর্থভা-ার আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিস্ট নিয়োগ করে কিছুটা ফল হয়েছে। কিছু দেশ বিভ্রান্তি ছড়াবার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি বৃহস্পতিবার মহাজোটের আনন্দ মানববন্ধন উদ্বোধনকালে বলেছেন, বিবিসিসহ কিছু মিডিয়া বাচ্চু রাজাকারকে ‘ধর্মযাজক’ বলার চেষ্টা করছেন, যা মোটেই সত্য নয়। বাচ্চু রাজাকারের ভাল নাম আবুল কালাম আযাদ, মুক্তিযুদ্ধকালে বাচ্চু রাজাকার নামে ফরিদপুর অঞ্চলে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করে। এ জন্যই তার বিচার হয়েছে। একে একে অন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ও অচিরেই হবে। কেউ কেউ বলছেন, তারা মৃত্যুদ- সমর্থন করেন না। আমি প্রশ্ন করি, ইরাকের সাদ্দাম হোসনকে যখন নৃশংসভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিল তখন তারা কোথায় ছিলেন? বরং তখন তারাও ইরাকে মিলিটারি পাঠিয়ে আমেরিকার নীলনকশা বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে।
আমরা বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায়ের দিকে তাকালে দেখতে পাব? এই পাষ- ১৪ জন হিন্দুকে হত্যা, দু’জন মহিলাকে ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করেছে। যে কারণে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, “We should not forget the millions of victims who deserve that their tormentors are held accountable”.অর্থাৎ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ স্বাভাবিকভাবে আশা করে তাদের ওপর নির্যাতনকারীদের গলায় দড়ি পড়বে এবং শাস্তি ভোগ করবে।
॥ চার ॥
বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির দ- এক শ্রেণীর গলাজীবীর মুখে চপেটাঘাত করেছে। এরা আবার মধ্যরাতের গলাজীবী, বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। এদের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার, কেউ সবজান্তা সাংবাদিকÑতাদেরকে বুদ্ধিজীবী না বলে উপায় আছে?
এবার তারা কি বলবেন? নিশ্চয়ই প্রশ্ন তুলবেন বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে। বলবেন সরকার চাপ দিয়ে এসব করাচ্ছে। দেশব্যাপী যখন দাবি উঠছে বিচার ত্বরান্বিত করার তখন এই জ্ঞানপাপীরা বলতে শুরু করেন এটা বিচারকার্যে নগ্ন হস্তক্ষেপ। বস্তুত তাদের এসব কথাবার্তা সবই হচ্ছে বিচারকার্য বন্ধ করার শয়তানি। জামায়াতী এজেন্ডা বাস্তবায়ন। বস্তুত একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এদের জীবনে-মননে চরম গ্লানি এনে দিয়েছে। এরা যেমন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেনি মানসিক দৈন্যের কারণে অথবা ‘পাকিস্তানী দিল’-এর কারণে; কিন্তু দেশ তো স্বাধীন এবং শত্রুমুক্ত হবার পর মনে হলো ভুল করেছে। কিন্তু এখন তো আর সময় নেই। আর তাই যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের দলেও ভিড়তে পারছেন না আবার কিছুটা আধুনিক শিক্ষা থাকার কারণে রাজাকারদের দলেও ভিড়তে পারছেন না। তাই বুদ্ধিজীবী সেজেছেন। এদের কেউ কেউ এক সময় ভাসানী ন্যাপ বা ছাত্র সংগঠন, ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। একটা অংশ মুক্তিযুদ্ধেও গেছে। তাদের মধ্যে রাশেদ খান মেনন বা রনোদের বাদ দিয়ে বাকিরা যেভাবে মিলিটারি জিয়ার মঞ্চে উঠলেন তাতে করে তাদের চরিত্রের কুমারিত্ব তখনই চলে যায়। আর যার কুমারিত্ব থাকে না সে যে কোন জায়গায় ভাড়া খাটতে পারে। ড. আসফ, ড. পেঁয়াজ করিম, মাহফুজরা তা-ই করছেন।
মধ্যরাতের এক শ্রেণীর গলাজীবী প্রশ্ন তোলেন, আওয়ামী লীগ তো আগেও ক্ষমতায় ছিল তখন কেন বিচার করেনি? তারা জেনেশুনেই এই মিথ্যা অভিযোগটা উত্থাপন করছেন। অথবা ইচ্ছা করেই ভুলে যাবার ভান করছেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু কিভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেন বা কেন জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করেন তার বিবরণ আগেই দিয়েছি।
দ্বিতীয়ত বঙ্গবন্ধু সরকার একাত্তরে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও নাগরিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া এবং পাকি-মিলিটারিদের সহযোগী হিসেবে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকায় জামায়াত-ছাত্রসংঘ (ছাত্রশিবির)সহ সকল ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির গোলাম আযমসহ প্রায় ৩০ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেন। এই গোলাম আযমসহ অনেকে সেদিন আজকের বাচ্চু রাজাকারের মতো পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সবুর খান, ফকা চৌধুরীর মতো ঘাড়মোটা রাজাকারদের কারাগারে পাঠানো হয়। কারণ এরা কেবল ৩০ লাখ শহীদ ও ৪ লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের ও তাদের পরিবারের গ্লানির জন্যই দায়ী নয়। এই দুর্বৃত্তরা বাংলাদেশের আত্মাকে হত্যা করতে চেয়েছিল, রাষ্ট্রের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল।
এসব কথা জেনেও এই জ্ঞানপাপীরা প্রশ্ন তোলেন। এরা এও ভাল করে জানেন যে, জাতির জনককে হত্যার পর মিলিটারি জিয়াই ক্ষমতা দখল করে দালাল আইন বাতিল করে সব যুদ্ধাপরাধীকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেন এবং একই সঙ্গে জামায়াত-শিবিরকে আবারও রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। দুর্বৃত্ত গোলাম আযমকে দেশে নিয়ে আসেন। আর খালেদা জিয়া নিজামী-মুজাহিদ (বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী আলবদর) এর গাড়িতে শহীদের রক্তরাঙ্গা পতাকা তুলে দেন। এরপরও কি বলা যাবে জিয়া মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বা খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করেন?
তৃতীয়ত কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালেও ক্ষমতায় এসেছিল। তখন কেন বিচার করেননি? জ্ঞানপাপীরা জেনে-শুনেও এ অবান্তর প্রশ্নটি করেন। তারাও ভাল করেই জানেন সে বার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার অঙ্গীকার ছিল না এবং আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাও ছিল না। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং আ স ম আবদুর রবকে ধার করে মন্ত্রী বানিয়ে তবেই সরকার গঠন করেছিলেন। আসন সংখ্যার দিক থেকে সে বার দুর্বল সরকার পরিচালনা করেছেন এবং বলা যায় ওই দুর্বল সরকার দিয়েও সুশাসন বা Good Governmence দিতে পেরেছিলেন, যা নজিরবিহীন।
ঢাকা, ২৬ জানুয়ারি ২০১৩
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
No comments