যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সময়ের দাবি- শুরু কবিতা উৎসব- ০ যোগ দিয়েছেন ভারতের কবিরাও ০ উৎসর্গ ফয়েজ আহ্ম্মদ ও সুনীলকে by মনোয়ার হোসেন
সত্য ও সত্তাকে একইসঙ্গে প্রকাশ করে
কবিতা। শব্দের পিঠে শব্দের সংযোজনে উচ্চারিত হয় নানা বিষয়। সে শব্দমালায়
থাকে দ্রোহ, প্রেম, মানবতার কথা ও সময়ের দিনলিপি।
ভাষা
আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ নানা
আন্দোলন-সংগ্রামে হাতিয়ার হয়েছে কবিতা। তাই তো নিছক ভাল লাগা নয়, সময়ের
দাবিও ধ্বনিত হয় কবিতায়। আর চলমান সময়ের সেই সোচ্চার দাবি নিয়ে শুরু হলো
জাতীয় কবিতা উৎসব ২০১৩। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার/দাবি আজ কবিতার সেøাগানে
শুক্রবার উৎসবের সূচনা হলো। উৎসবে দেশবাসীর কলঙ্কমুক্ত হওয়ার দাবি ধ্বনিত
হলো কখনও কবিতায়, কখনও বা কথায়। কবি ও কবিতাপ্রেমীরা এক হয়ে বিচার চাইলেন
একাত্তরের পাপীদের। উচ্চারিত হলো হাজার বছরের বাঙালীর অসম্প্রদায়িক চেতনার
কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বরে শীতের সকালে বসে
দুই দিনব্যাপী উৎসবের উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা। ১৯৮৭ সালে স্বৈরাচারবিরোধী
আন্দোলনের উত্তাল সময়ে প্রথম এ উৎসবের আয়োজন করে জাতীয় কবিতা পরিষদ। এবারের
২৭তম উৎসবটি উৎসর্গ করা হয়েছে পরিষদের অন্যতম প্রাণপুরুষ কবি ও ছড়াকার
ফয়েজ আহমদ এবং জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশের সুহৃদ কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে।
দুই দিনের উৎসবে মেলবন্ধ ঘটছে বাংলাদেশ ও ভারতের কবিদের। রয়েছে নিবন্ধনের মাধ্যমে স্বরচিত কবিতা পড়ার অবারিত সুযোগ। দিনব্যাপী বিভিন্ন পর্বে কবিরা পড়বেন এসব কবিতা। এ ছাড়া আয়োজনে আছে কবিতার গান, অন্য ভাষায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবিতার উপস্থাপনা, আদিবাসী কবিদের কবিতার উপস্থাপনা, খ্যাতিমান বাকশিল্পীদের আবৃত্তি, সেমিনার ও প্রদর্শনী। সব মিলিয়ে কবিতা নিয়ে এ যেন এক অনন্য আয়োজন। প্রথম দিনের সমাপনী আবৃত্তি পর্বে ছিল রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি থেকে দেশবরেণ্য আবৃত্তিশিল্পীদের আবৃত্তি পরিবেশনা। এ ছাড়া দিনভর খ্যাতিমান কবিসহ নানা বয়সী কবিতাপ্রেমীদের ব্যাপক উপস্থিতিতে উৎসব প্রাঙ্গণ ছিল দারুণ সরব।
সকাল পৌনে দশটায় শুরু হয় উৎসব কার্যক্রম। গ্রন্থাগার চত্বর থেকে বের করা হয় শোভাযাত্রা। পদব্রজে শোভাযাত্রাটি গিয়ে থামে চারুকলাসংলগ্ন জাতীয় কবির সমাধিসৌধে। সেখানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী কামরুল হাসানের সমাধিতে নিবেদন করা হয় পুষ্পাঞ্জলি। এরপর শোভাযাত্রা এগিয়ে যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সকল শহীদকে শ্রদ্ধা জানিয়ে অর্পণ করা হয় পুষ্পস্তবক। সকাল সোয়া ১০টায় শুরু উৎসব উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা। শিল্পীদের কণ্ঠে উঠে আসে জাতীয় সঙ্গীতের সুর। সেই সুরের তালে তালে উত্তোলন করা হয় জাতীয় ও উৎসব পতাকা। উত্তোলন করেন উৎসব উদ্বোধক সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ও পরিষদের সভাপতি কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। এরপর সারি বেঁধে মঞ্চে থাকা বিভিন্ন সংগঠনের শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে গেয়ে শোনান একুশের গান ও উৎসব সঙ্গীত। গান শেষে বিগত বছরের শুরু থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতের শিল্প-সাহিত্যসহ নানা অঙ্গনের প্রয়াত কৃতীদের স্মরণে শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন কবি কাজী রোজী। শোকগাথায় উচ্চারিত হয় হুমায়ূন আহমেদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প-িত রবি শঙ্কর, সোহরাব হোসেন, শফিউদ্দীন আহমেদ, নির্মল সেনসহ অনেক কীর্তিমানের নাম।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি আজ কবিতার শীর্ষক উৎসব ঘোষণাপত্র পাঠ করেন পরিষদের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য কবি রবিউল হুসাইন। একাত্তরের বেঈমান ও অপরাধীদের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে সত্তরের দশকে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির ভয়ঙ্কর উত্থান ঘটে। দেশে আজ একাত্তরের গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে চলছে সে বিচারকাজ। এ বিচারপ্রক্রিয়া যখন পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আবার সক্রিয় হয়েছে একাত্তরের ঘাতক জামায়াত-শিবিরগোষ্ঠী ও তাদের সহযোগীরা। প্রকাশ্য রাজপথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলাসহ হরতাল-অগ্নিসংযোগে মেতে উঠেছে। তাই বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ও ন্যয় প্রতিষ্ঠার এ ঐতিহাসিক মুহূর্তে আয়োজিত উৎসবের অমোঘ বাণীÑ যুদ্ধাপরাধের বিচার, দাবি আজ কবিতার। তিনি আরও বলেন, কবিতা ভালবাসা ও শিল্পের সম্ভার। কবিতার ইতিহাস বহুমাত্রিক বোধানুভবের ইতিহাস। যা সময়, কাল, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এ কারণেই কবিরা পরিবেশ ও প্রতিবেশকে এড়িয়ে যেতে পারেন না।
যুগ্ম আহ্বায়কের ভাষণে তারিক সুজাত পরিষদের পরম সুহৃদ ছাড়াকার ফয়েজ আহমদ এবং কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য অবদান ও অম্লান স্মৃতির কথা স্মরণ করেন। উৎসব নিয়ে অহঙ্কারের কথা তুলে ধরে বলেন, গত ছাব্বিশ বছর ধরে বাংলা কবিতার অন্যতম বৃহৎ এ আয়োজনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আহ্বায়কের ভাষণ দেন কবি মুহাম্মদ সামাদ। তাঁর কথায় আসে গীতাঞ্জলির নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির শতবর্ষ পেরোনোর গৌরবের কথা। বলেন, বাংলা ভাষা-সাহিত্যের অগ্রগণ্য কবিপুরুষ রবীন্দ্রনাথের কাছে জাতীয় কবিতা উৎসব অসীম ঋণ স্বীকার করছে। সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য রাখেন ছড়াকার আসলাম সানী।
উদ্বোধকের বক্তব্যে সৈয়দ শামসুল হক বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের গৌরবগাথা স্মরণ করেন। বলেন, ৬১ বছর আগের ভাষার জন্য প্রাণ দেয়া সেই যুদ্ধের কথা স্মরণ করছি। এ দেশের তরুণরা বুকের রক্ত ঝরিয়ে আদায় করেছিল মাতৃভাষার অধিকার। সেদিনকার কোন কবির লেখা একটি দুর্বল কবিতাও ছিল সবল যুদ্ধ। এরপর তাঁর কথায় উঠে আসে চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যু। বলেন, একই সঙ্গে জাতির প্রত্যাশা ও কলঙ্কমুক্ত হওয়ার প্রত্যয় নিয়ে এ বিচার শুরু হয়েছে। এ দাবি শুধু কবি বা কবিতার নয়, দেশের সব নাগরিকের। তাই সব যুদ্ধাপরাধীর অপরাধ শনাক্ত করে বাংলার মাটিতে এ বিচার সম্পন্ন করতে হবে। শহীদদের ঋণ শোধ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পরিষদের সভাপতি কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, জাতীয় কবিতা উৎসব বাংলাদেশের কবিদের প্রাণের উৎসব। আমাদের গৌরব ও অহঙ্কারের এ মিলনমেলায় মিশে গত ছাব্বিশটি উৎসবের রক্ত-ঘাম, অহং ও স্পর্ধা। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রসঙ্গে বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার, দাবি আজ কবিতারÑ এটি একটি উচ্চারণ শুধু নয়, অন্তর্গত বিশ্বাসের এক অমোঘ মর্মকথা। আমাদের বিশ্বাসের সার নিহীত থাকে আমাদের যাপনের প্রতি কণায়। চেতনা ও চারিত্র্যে স্থাপিত হয় কবিতার নব্যরূপ, প্রবাহিত হয় জগৎ ও জীবনের আদর্শিক অগ্নিস্রোত।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়ায় উৎসবে আগত পশ্চিমবঙ্গের কবি বীথি চট্টোপাধ্যায় বলেন, যে কোন অপরাধেরই বিচার হওয়া উচিত। আর যুদ্ধাপরাধ তো অনেক বড় অপরাধ। আমিও এই বিচারের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছি। কবিতার অসীম শক্তি নিয়ে এ বিচারের দাবি জানাচ্ছি।
উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে কবি রফিক আজাদের সভাপতিত্বে শুরু হয় কবিতাপাঠের প্রথম পর্ব। মঞ্চে ডেকে নেয়া হয় ভারত থেকে আসা কবিদের। প্রথম কবিতাটি উচ্চারিত হয় বীথি চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে। পাঠ করেন নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারীর প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়ে রচিত মার খেয়ে কেউ কালী হয় কবিতাটি। এরপর একে একে দেশের কবিদের সঙ্গে ভারতের আমন্ত্রিত কবিরা পড়ে শোনান তাঁদের কবিতা। ভারতের ২৩ কবি যোগ দিয়েছেন এবারের উৎসবে। এদের মধ্যে রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের কবি আশিস সান্যাল, উত্তম দাশ, পঙ্কজ সাহা, চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং, অমৃত মাইতি, মৃণাল বসু চৌধুরী, পীযূষ রাউত, সুবোধ সরকার, বীথি চট্টোপাধ্যায়, কাজল চক্রবর্তী, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, পিনাকী ঠাকুর, স্বপন সেনগুপ্ত, শিবাশীষ মুখোপাধ্যায়, সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, সুতপা সেনগুপ্ত, অলক বন্দ্যোপাধ্যায়, আয়েশা খাতুন, সাকিল আহমেদ, অংশুমান কর, সাদেক আলী ও আসামের মুজিব স্বদেশী।
প্রথম দিন কবিতাপাঠের জন্য ঢাকা ও ঢাকার বাইরের দুই শতাধিক কবি নিবন্ধন করেন। বেলা সাড়ে ৩টায় সাযযাদ কবিরের সভাপতিত্বে বসে কবিতাপাঠের দ্বিতীয় পর্ব। বিকেল পাঁচটায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় পর্বে সভাপতিত্ব করেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ পর্বে সভাপতিত্ব করেন কবি মহাদেব সাহা। রাত আটটায় অনুষ্ঠিত দেশের প্রখ্যাত বাকশিল্পীদের অংশগ্রহণে আবৃত্তি পর্বে সভাপতিত্ব করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ।
আজ শনিবার উৎসবের দ্বিতীয় দিন। এদিন থাকছে দুটি সেমিনার। সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হবে প্রতিবাদের নানা কালপর্ব : কবি ও কবিতা শীর্ষক সেমিনার। এতে মূল প্রবন্ধ পড়বেন আখতার হুসেন। আলোচনা করবেন আশিস সান্যাল, নূহ-উল-আলম লেনিন, হারুন হাবীব, উত্তম দাশ ও গোলাম কুদ্দুছ। সভাপতিত্ব করবেন বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর। সকাল ১১টায় অনুষ্ঠিত অন্য ভাষার কবিতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শীর্ষক সেমিনারে সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। মূল প্রবন্ধ পড়বেন কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়। আলোচনা করবেন সৈয়দ আবুল মকসুদ, মুনতাসীর মামুন, রফিকউল্লাহ খান ও হাসান আরিফ। বেলা সাড়ে ১১টায় কবি শিহাব সরকারের সভাপতিত্ব অনুষ্ঠিত হবে কবিতাপাঠের পঞ্চম পর্ব। বেলা ৩টায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ পর্বে সভাপতিত্ব করবেন কবি অসীম সাহা। বিকেল চারটায় বসবে আদিবাসী কবিদের কবিতাপাঠ নিয়ে সপ্তম পর্ব। এতে সভাপতিত্ব করবেন এ কে শেরাম। বিকেল পাঁচটায় থাকছে পুরস্কার প্রদান পর্ব। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় কবি আসাদ চৌধুরী সভাপতিত্বে বসবে কবিতাপাঠের অষ্টম পর্ব। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় কবি নির্মলেন্দু গুণের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হবে নবম পর্ব। রাত আটটায় পরিবেশিত হবে কবিতার গান। এতে সভাপতিত্ব করবেন আসাদুজ্জামান নূর।
দুই দিনের উৎসবে মেলবন্ধ ঘটছে বাংলাদেশ ও ভারতের কবিদের। রয়েছে নিবন্ধনের মাধ্যমে স্বরচিত কবিতা পড়ার অবারিত সুযোগ। দিনব্যাপী বিভিন্ন পর্বে কবিরা পড়বেন এসব কবিতা। এ ছাড়া আয়োজনে আছে কবিতার গান, অন্য ভাষায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কবিতার উপস্থাপনা, আদিবাসী কবিদের কবিতার উপস্থাপনা, খ্যাতিমান বাকশিল্পীদের আবৃত্তি, সেমিনার ও প্রদর্শনী। সব মিলিয়ে কবিতা নিয়ে এ যেন এক অনন্য আয়োজন। প্রথম দিনের সমাপনী আবৃত্তি পর্বে ছিল রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি থেকে দেশবরেণ্য আবৃত্তিশিল্পীদের আবৃত্তি পরিবেশনা। এ ছাড়া দিনভর খ্যাতিমান কবিসহ নানা বয়সী কবিতাপ্রেমীদের ব্যাপক উপস্থিতিতে উৎসব প্রাঙ্গণ ছিল দারুণ সরব।
সকাল পৌনে দশটায় শুরু হয় উৎসব কার্যক্রম। গ্রন্থাগার চত্বর থেকে বের করা হয় শোভাযাত্রা। পদব্রজে শোভাযাত্রাটি গিয়ে থামে চারুকলাসংলগ্ন জাতীয় কবির সমাধিসৌধে। সেখানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী কামরুল হাসানের সমাধিতে নিবেদন করা হয় পুষ্পাঞ্জলি। এরপর শোভাযাত্রা এগিয়ে যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সকল শহীদকে শ্রদ্ধা জানিয়ে অর্পণ করা হয় পুষ্পস্তবক। সকাল সোয়া ১০টায় শুরু উৎসব উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা। শিল্পীদের কণ্ঠে উঠে আসে জাতীয় সঙ্গীতের সুর। সেই সুরের তালে তালে উত্তোলন করা হয় জাতীয় ও উৎসব পতাকা। উত্তোলন করেন উৎসব উদ্বোধক সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ও পরিষদের সভাপতি কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। এরপর সারি বেঁধে মঞ্চে থাকা বিভিন্ন সংগঠনের শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে গেয়ে শোনান একুশের গান ও উৎসব সঙ্গীত। গান শেষে বিগত বছরের শুরু থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতের শিল্প-সাহিত্যসহ নানা অঙ্গনের প্রয়াত কৃতীদের স্মরণে শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন কবি কাজী রোজী। শোকগাথায় উচ্চারিত হয় হুমায়ূন আহমেদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প-িত রবি শঙ্কর, সোহরাব হোসেন, শফিউদ্দীন আহমেদ, নির্মল সেনসহ অনেক কীর্তিমানের নাম।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি আজ কবিতার শীর্ষক উৎসব ঘোষণাপত্র পাঠ করেন পরিষদের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য কবি রবিউল হুসাইন। একাত্তরের বেঈমান ও অপরাধীদের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে সত্তরের দশকে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির ভয়ঙ্কর উত্থান ঘটে। দেশে আজ একাত্তরের গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে চলছে সে বিচারকাজ। এ বিচারপ্রক্রিয়া যখন পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আবার সক্রিয় হয়েছে একাত্তরের ঘাতক জামায়াত-শিবিরগোষ্ঠী ও তাদের সহযোগীরা। প্রকাশ্য রাজপথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলাসহ হরতাল-অগ্নিসংযোগে মেতে উঠেছে। তাই বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ও ন্যয় প্রতিষ্ঠার এ ঐতিহাসিক মুহূর্তে আয়োজিত উৎসবের অমোঘ বাণীÑ যুদ্ধাপরাধের বিচার, দাবি আজ কবিতার। তিনি আরও বলেন, কবিতা ভালবাসা ও শিল্পের সম্ভার। কবিতার ইতিহাস বহুমাত্রিক বোধানুভবের ইতিহাস। যা সময়, কাল, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এ কারণেই কবিরা পরিবেশ ও প্রতিবেশকে এড়িয়ে যেতে পারেন না।
যুগ্ম আহ্বায়কের ভাষণে তারিক সুজাত পরিষদের পরম সুহৃদ ছাড়াকার ফয়েজ আহমদ এবং কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য অবদান ও অম্লান স্মৃতির কথা স্মরণ করেন। উৎসব নিয়ে অহঙ্কারের কথা তুলে ধরে বলেন, গত ছাব্বিশ বছর ধরে বাংলা কবিতার অন্যতম বৃহৎ এ আয়োজনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আহ্বায়কের ভাষণ দেন কবি মুহাম্মদ সামাদ। তাঁর কথায় আসে গীতাঞ্জলির নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির শতবর্ষ পেরোনোর গৌরবের কথা। বলেন, বাংলা ভাষা-সাহিত্যের অগ্রগণ্য কবিপুরুষ রবীন্দ্রনাথের কাছে জাতীয় কবিতা উৎসব অসীম ঋণ স্বীকার করছে। সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য রাখেন ছড়াকার আসলাম সানী।
উদ্বোধকের বক্তব্যে সৈয়দ শামসুল হক বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের গৌরবগাথা স্মরণ করেন। বলেন, ৬১ বছর আগের ভাষার জন্য প্রাণ দেয়া সেই যুদ্ধের কথা স্মরণ করছি। এ দেশের তরুণরা বুকের রক্ত ঝরিয়ে আদায় করেছিল মাতৃভাষার অধিকার। সেদিনকার কোন কবির লেখা একটি দুর্বল কবিতাও ছিল সবল যুদ্ধ। এরপর তাঁর কথায় উঠে আসে চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যু। বলেন, একই সঙ্গে জাতির প্রত্যাশা ও কলঙ্কমুক্ত হওয়ার প্রত্যয় নিয়ে এ বিচার শুরু হয়েছে। এ দাবি শুধু কবি বা কবিতার নয়, দেশের সব নাগরিকের। তাই সব যুদ্ধাপরাধীর অপরাধ শনাক্ত করে বাংলার মাটিতে এ বিচার সম্পন্ন করতে হবে। শহীদদের ঋণ শোধ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পরিষদের সভাপতি কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, জাতীয় কবিতা উৎসব বাংলাদেশের কবিদের প্রাণের উৎসব। আমাদের গৌরব ও অহঙ্কারের এ মিলনমেলায় মিশে গত ছাব্বিশটি উৎসবের রক্ত-ঘাম, অহং ও স্পর্ধা। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রসঙ্গে বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার, দাবি আজ কবিতারÑ এটি একটি উচ্চারণ শুধু নয়, অন্তর্গত বিশ্বাসের এক অমোঘ মর্মকথা। আমাদের বিশ্বাসের সার নিহীত থাকে আমাদের যাপনের প্রতি কণায়। চেতনা ও চারিত্র্যে স্থাপিত হয় কবিতার নব্যরূপ, প্রবাহিত হয় জগৎ ও জীবনের আদর্শিক অগ্নিস্রোত।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়ায় উৎসবে আগত পশ্চিমবঙ্গের কবি বীথি চট্টোপাধ্যায় বলেন, যে কোন অপরাধেরই বিচার হওয়া উচিত। আর যুদ্ধাপরাধ তো অনেক বড় অপরাধ। আমিও এই বিচারের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছি। কবিতার অসীম শক্তি নিয়ে এ বিচারের দাবি জানাচ্ছি।
উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে কবি রফিক আজাদের সভাপতিত্বে শুরু হয় কবিতাপাঠের প্রথম পর্ব। মঞ্চে ডেকে নেয়া হয় ভারত থেকে আসা কবিদের। প্রথম কবিতাটি উচ্চারিত হয় বীথি চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে। পাঠ করেন নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারীর প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়ে রচিত মার খেয়ে কেউ কালী হয় কবিতাটি। এরপর একে একে দেশের কবিদের সঙ্গে ভারতের আমন্ত্রিত কবিরা পড়ে শোনান তাঁদের কবিতা। ভারতের ২৩ কবি যোগ দিয়েছেন এবারের উৎসবে। এদের মধ্যে রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের কবি আশিস সান্যাল, উত্তম দাশ, পঙ্কজ সাহা, চন্দ্রকান্ত মুড়াসিং, অমৃত মাইতি, মৃণাল বসু চৌধুরী, পীযূষ রাউত, সুবোধ সরকার, বীথি চট্টোপাধ্যায়, কাজল চক্রবর্তী, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, পিনাকী ঠাকুর, স্বপন সেনগুপ্ত, শিবাশীষ মুখোপাধ্যায়, সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, সুতপা সেনগুপ্ত, অলক বন্দ্যোপাধ্যায়, আয়েশা খাতুন, সাকিল আহমেদ, অংশুমান কর, সাদেক আলী ও আসামের মুজিব স্বদেশী।
প্রথম দিন কবিতাপাঠের জন্য ঢাকা ও ঢাকার বাইরের দুই শতাধিক কবি নিবন্ধন করেন। বেলা সাড়ে ৩টায় সাযযাদ কবিরের সভাপতিত্বে বসে কবিতাপাঠের দ্বিতীয় পর্ব। বিকেল পাঁচটায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় পর্বে সভাপতিত্ব করেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ পর্বে সভাপতিত্ব করেন কবি মহাদেব সাহা। রাত আটটায় অনুষ্ঠিত দেশের প্রখ্যাত বাকশিল্পীদের অংশগ্রহণে আবৃত্তি পর্বে সভাপতিত্ব করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ।
আজ শনিবার উৎসবের দ্বিতীয় দিন। এদিন থাকছে দুটি সেমিনার। সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হবে প্রতিবাদের নানা কালপর্ব : কবি ও কবিতা শীর্ষক সেমিনার। এতে মূল প্রবন্ধ পড়বেন আখতার হুসেন। আলোচনা করবেন আশিস সান্যাল, নূহ-উল-আলম লেনিন, হারুন হাবীব, উত্তম দাশ ও গোলাম কুদ্দুছ। সভাপতিত্ব করবেন বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর। সকাল ১১টায় অনুষ্ঠিত অন্য ভাষার কবিতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শীর্ষক সেমিনারে সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। মূল প্রবন্ধ পড়বেন কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়। আলোচনা করবেন সৈয়দ আবুল মকসুদ, মুনতাসীর মামুন, রফিকউল্লাহ খান ও হাসান আরিফ। বেলা সাড়ে ১১টায় কবি শিহাব সরকারের সভাপতিত্ব অনুষ্ঠিত হবে কবিতাপাঠের পঞ্চম পর্ব। বেলা ৩টায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ পর্বে সভাপতিত্ব করবেন কবি অসীম সাহা। বিকেল চারটায় বসবে আদিবাসী কবিদের কবিতাপাঠ নিয়ে সপ্তম পর্ব। এতে সভাপতিত্ব করবেন এ কে শেরাম। বিকেল পাঁচটায় থাকছে পুরস্কার প্রদান পর্ব। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় কবি আসাদ চৌধুরী সভাপতিত্বে বসবে কবিতাপাঠের অষ্টম পর্ব। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় কবি নির্মলেন্দু গুণের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হবে নবম পর্ব। রাত আটটায় পরিবেশিত হবে কবিতার গান। এতে সভাপতিত্ব করবেন আসাদুজ্জামান নূর।
No comments