গুপ্তহত্যার পর লাশ ফেলার ডাম্পিং গ্রাউন্ড মুন্সীগঞ্জ? by শংকর কুমার দে
গুপ্ত হত্যার বা লাশ ফেলে যাওয়ার নিরাপদ স্থান অর্থাৎ ডাম্পিং গ্রাউন্ডে পরিণত হয়েছে মুন্সীগঞ্জ। গত দুই বছরে এ রকম অন্তত ৩৪ জনের লাশ পাওয়া গেছে এই জেলায়।
এরা সবাই গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। উদ্ধার করা লাশগুলোর মধ্যে পরিচয় মিলেছে মাত্র ১০ জনের। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাকির হোসেন মজুমদার জানান, তিনি এ জেলায় এসেছেন মাস ছয়েক। ঐ সময়ে তিনি যা দেখছেন তা হচ্ছে- অন্য কোথাও হত্যা করে সুযোগ বুঝে মুন্সীগঞ্জের সড়কে বা সেতু থেকে নদীতে লাশ ফেলে দেয়া হচ্ছে।পুলিশের নথি অনুযায়ী বেশিরভাগ লাশ পাওয়া গেছে ধলেশ্বরী নদীতে। বাকিগুলো রাস্তার পাশে নির্জন স্থানে। মৃতদেহগুলোর হাত-পা- চোখ বাঁধা এবং মাথায় গুলি ও শরীরে জখমের চিহ্ন। নদীতে ফেলা লাশগুলোর শরীরের সঙ্গে সিমেন্টের বস্তা বা ভারি বস্তু বেঁধে দেয়া হয়। ৩৪টি লাশের মধ্যে ২০১১ সালে পাওয়া গেছে ২২টি লাশ। এসব ঘটনায় থানায় মামলা হলেও কোন ঘটনারই কুলকিনারা পায়নি পুলিশ।
নারায়ণগঞ্জের শাওনের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় সাক্ষ্যপ্রমাণ পায়নি মর্মে পুলিশ ফাইনাল রিপোর্ট দেয়ায় মামলাটি নথিভুক্ত হয়ে গেছে। বাকি মামলাগুলো এখনও তদন্তাধীন বলে জানিয়েছে জেলা পুলিশ অফিস।
আবার কিছু লাশ উদ্ধারের ঘটনায় হত্যার কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে সেসব ঘটনায় হত্যা মামলার পরিবর্তে অপমৃত্যু মামলা করেছে পুলিশ। পরিচয়বিহীন উদ্ধার করা লাশগুলো পরে দাফনের জন্য আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে বা পৌরসভার মাধ্যমে দাফন করা হয়।
যেসব মৃতদেহের পরিচয় মিলেছে তাদের একজন হলেন ঢাকা মহানগরের ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের ছাত্রদল নেতা ইসমাইল ওরফে আল-আমিন। ২০১১ সালের ৮ ডিসেম্বর শহরের যুগনীঘাট এলাকায় ধলেশ্বরী নদী থেকে আল-আমিনসহ দুজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। দুজনই গুলিবিদ্ধ ও হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ছিলেন। লাশের সঙ্গে সিমেন্টের বস্তা বাঁধা ছিল। আল-আমিনকে এর এক সপ্তাহ আগে পুরান ঢাকার হাতিরপুল সড়ক থেকে এক দল লোক ধরে নিয়ে যায়। তখন তাঁর পরিবার অভিযোগ করেছিল, র্যাব পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকের একদল লোক আল-আমিনকে ধরে নিয়েছিল। অবশ্য র্যাব এ ধরনের অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। এর চার দিন পর ১৩ ডিসেম্বর একই স্থান থেকে একই রকম অবস্থায় আরও তিনটি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এদের মধ্যে একজনের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি হলেন ফরিদপুরের সালথা উপজেলার বড় লক্ষ্মণদিয়া গ্রামে মঞ্জুর মুন্সী (৪৩)। একই বছরের ২২ নবেম্বর একই নদী থেকে নারায়ণগঞ্জের ধর্মগঞ্জের শাওন নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০১১ সালের ২২ জুলাই সিরাজদিখান উপজেলায় ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের পাশের খাদ থেকে উদ্ধার করা হয় পুরান ঢাকার দয়াগঞ্জ থেকে অপহৃত রাজিবের (২৫) মৃতদেহ। মুখ ও হাত নতুন গামছা দিয়ে বাঁধা অবস্থায় পড়েছিল গুলিবিদ্ধ লাশটি। রাজিব পুরান ঢাকা থেকে অপহৃত হয়েছিলেন।
গুপ্ত নারী হত্যার ঘটনাও ঘটছে। সর্বশেষ ২১ জানুয়ারি সিরাজদিখান উপজেলার মধ্যপাড়ায় আলুর জমির আইলে পাওয়া যায় ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস লাগানো এবং পেছন থেকে দু হাত বাঁধা অজ্ঞাত (২০) এক নারীর লাশ। সালোয়ার কামিজ পরা এই নারীর পরিচয় এখনও মেলেনি বলে জানিয়েছেন, সিরাজদিখান থানা। পুলিশ জানায়, এই যুবতী এই এলাকার নয়। এই জেলা হলে লোকজন চিনতে পারত। হয়ত অন্য কোথাও হত্যার পর লাশ এখানে ফেলে রাখা হয়। এ ব্যাপারে হত্যা মামলা হলেও গত ৭ দিনেও কোন ক্লু খুঁজে পায়নি পুলিশ।
মুন্সীগঞ্জে এমন লাশ উদ্ধারের ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটছেÑ এই জেলাকে কি অপরাধীরা ডাম্পিং গ্রাউন্ড হিসেবে বেছে নিয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার মোঃ শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘ঠিক এমনটা নয়, অন্যান্য স্থানেও লাশ পাওয়া যায়। তবে মুন্সীগঞ্জের ওপর দিয়ে দু’টি হাইওয়ে ও নদী পথ থাকায় এটা হচ্ছে।’
লাশ ফেলার ডাম্পিং গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ঢাকার অদূরে মুন্সীগঞ্জে। মুন্সীগঞ্জকে লাশ ফেলার ডাম্পিং স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করার সন্দেহের তীর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্নস্থান থেকে নিখোঁজ বা গুম করার পর হত্যা করে লাশ ফেলে রেখে আসা হচ্ছে মুন্সীগঞ্জ জেলার বিভিন্নস্থানে। যাদের লাশ উদ্ধার করা হচ্ছে তাদের বাড়ি মুন্সীগঞ্জে নয় অথচ লাশ পাওয়া যাচ্ছে মুন্সীগঞ্জে। কখনও লাশ নদীতে ভেসে ওঠছে আবার কখনও রাস্তার ধারে ফেলে রাখা হচ্ছে। কারা কোথায় কিভাবে হত্যা করার পর লাশ মুন্সীগঞ্জে ফেলে আসছে তা খুবই রহস্যাবৃত।
গত ২৪ জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান ও শ্রীনগর উপজেলা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ইব্রাহিম (২০), কুদ্দুছ (৪২), মাসুদের (৩২) লাশ। তাদের লাশ পাওয়া গেছে রাস্তার ধারে। মুন্সীগঞ্জের বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদী থেকে দুই বছরে উদ্ধার করা হয়েছে অন্তত ৩৪ লাশ। এসব লাশ ছিল বিকৃত ও বীভৎস। যাদের লাশ শনাক্ত করা গেছে তাদের কারও বাড়ি মুন্সীগঞ্জ এলাকায় নয়। রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকা থেকে তারা নিখোঁজ ও গুম হওয়ার পর লাশ পাওয়া যায় মুন্সীগঞ্জ এলাকার বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর বুকে। নদীর বুকে ভাসমান ও তীরে ঠেকানো অবস্থায় পাওয়া লাশগুলো দেখে হত্যাকা-ের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। হত্যাকারীরা অন্যত্র থেকে অপহরণ, নিখোঁজ ও গুম করে হত্যার পর লাশগুলো মুন্সীগঞ্জ এলাকার নদীবক্ষকে বেছে নেয় তখন। গত বছরের কয়েক মাস মুন্সীগঞ্জ এলাকার নদীবক্ষসহ বিভিন্নস্থানকে লাশের ডাম্পিং এলাকা হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায়। কয়েক মাস বিরতির পর আবার মুন্সীগঞ্জের বিভিন্নস্থানে লাশ ফেলা শুরু হয়েছে।
গত ২৪ জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান ও শ্রীনগর উপজেলা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ইব্রাহিম (২০), কুদ্দুছ (৪২), মাসুদ (৩২)-এই তিনজনের লাশ রাস্তার ধারে গুলিবিদ্ধ ও নতুন গামছা দিয়ে পিছমোড়া হাত বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যাওয়ার পর আবার আলোচনায় এসেছে মুন্সীগঞ্জ। ভৌগোলিক কারণেই মুন্সীগঞ্জ এলাকাকে হত্যাকা-ের পর লাশ ফেলার নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার রশুনিয়া ব্রিজের নিচে গত ১৬ জানুয়ারি নিখোঁজ হওয়ার ৮ দিন পর লাশ পাওয়া গেছে ইব্রাহিমের। তার লাশের সঙ্গে পাওয়া গেছে কুদ্দুছের লাশও। ইব্রাহিম পূর্ব জুরাইনে তার মামার বাড়িতে থাকত। শ্রীনগর উপজেলার দত্তপাড়া গ্রামের ইব্রাহিম পূর্ব জুরাইনে মামার বাড়িতে থাকার সময়ে ঢাকার কদমতলী এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা ইসমাইল হত্যাকা-ের আসামি ছিল ইব্রাহিম। তার সঙ্গে পাওয়া লাশ কুদ্দুছের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর জেলার গোগলদী গ্রামে। কেরানীগঞ্জের আমবাগিচা এলাকায় স্ত্রী, পুত্র-কন্যা নিয়ে থাকত। গত ১১ জানুয়ারি নিখোঁজ হবার প্রায় ১৪ দিন পর কুদ্দুছের লাশ পাওয়া গেছে ইব্রাহিমের লাশের সঙ্গে। অথচ তারা কেউই পূর্ব পরিচিত নয়। তাদের দুই জনের লাশ এক সঙ্গে পাওয়া গেল কিভাবে ? আবার মাথায় গুলিবিদ্ধ, নতুন গামছা দিয়ে হাত পেছনে বাঁধা অবস্থায় তার লাশ পাওয়া যাওয়ায় কারা এভাবে হত্যা করে লাশ ফেলে রেখে আসতে পারে তা নিয়ে নিহতের পরিবারগুলোর সন্দেহের তীর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে।
মাসুদের লাশ পাওয়া গেছে শ্রীনগর উপজেলার শ্রীধরপুর এলাকা থেকে। সে থাকত কেরানীগঞ্জের আমবাগিচা এলাকায়। সে নিখোঁজ হয় ১৪ দিন আগে গত ১১ জানুয়ারি। মাসুদ যেদিন নিখোঁজ হয় তখন একই দিনে নিখোঁজ হয় কুদ্দুছও। কুদ্দুছ ও মাসুদ থাকত একই এলাকা কেরানীগঞ্জের আমবাগিচা এলাকায়। অথচ তাদের দুই জনের লাশ পাওয়া গেছে মুন্সীগঞ্জের উপজেলায়। মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায় পাওয়া গেছে কুদ্দুছের লাশ। কুদ্দুছের লাশ যেখানে পাওয়া গেছে সেখান থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে শ্রীনগর উপজেলার শ্রীধরপুর রাস্তার ধারে পাওয়া গেছে মাসুদের লাশ। কুদ্দুছ ও মাসুদ একই এলাকায় থাকত এবং একই দিনে নিখোঁজ হওয়ার পর দুই জনের লাশ প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে দুই উপজেলায়। মাথায় গুলিবিদ্ধের চিহ্ন ও হাত নতুন গামছা দিয়ে হাত বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেছে। যারা নিহত হয়েছেন তাদের কারও বাড়িই মুন্সীগঞ্জে নয়। রাজধানী ঢাকা ও কেরানীগঞ্জ থেকে তারা নিখোঁজ হয়েছেন। তারা পনেরো থেকে বিশ দিন আগে নিখোঁজ হওয়ার পর তাদের লাশ উদ্ধার হয়। মাথায় গুলিবিদ্ধ, দু’হাত গামছা দিয়ে বাঁধা অবস্থায় রাস্তার ধারে যেভাবে তাদের লাশ ফেলে রাখা হয়েছে তাতে সন্দেহের তীর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে। নিহত পরিবারগুলোর পক্ষ থেকেও তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ক্রসফায়ার করে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। তবে বরাবরের মতোই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উর্ধতন এক কর্মকর্তার সঙ্গে এই ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এভাবে হত্যা করতে যাবে কেন ? এ পর্যন্ত যত নিখোঁজ, গুম, অপহরণ হয়েছে তার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাম ব্যবহার করে এ ধরনের হত্যাকা- করে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতো সন্ত্রাসী বাহিনীও অবৈধভাবে আগ্নেয়াস্ত্র, হ্যান্ডকাপ, ইউনিফর্ম, ওয়াকিটকি, গাড়িসহ সবকিছুই ব্যবহার করছে। এই ব্যাপারে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। মুন্সীগঞ্জে ইব্রাহিমের লাশ পাওয়ার পর তার পরিবারের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে, তাকে গুম করার পর ক্রসফায়ার করে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখা হয়েছে। ইব্রাহিম হত্যাকা-ের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন তারা।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে প্রতিপক্ষ এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসৎ কর্মকর্তা ও সদস্যদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে সন্ত্রাসীদের মতোই অপহরণ, নিখোঁজ, গুম করে হত্যার পর লাশ অন্যত্র ফেলে রেখে আসছে। মুন্সীগঞ্জ জেলা এলাকাকে লাশ ফেলার নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হতে পারে।
No comments