প্রধান বিচারপতির প্রত্যাশা পূরণ হোক by আবদুল মান্নান
অগ্রজপ্রতিম পড়শী মোহাম্মদ ফজলুল করিম গত রবিবার দেশের আঠারোতম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নিলেন। বিচারপতি ফজলুল করিমের জ্যেষ্ঠতা এর আগে চার বার লঙ্ঘিত হয়েছে।
কিছু দিন আগে সর্বশেষ তাঁর সাথে এশিয়াটিক সোসাইটির এক সেমিনারে দেখা হয়েছিল। অনেক দিন পরে দেখা। উষ্ণভাবে জড়িয়ে ধরে কুশলাদি জিজ্ঞেস করেছিলেন। প্রশ্ন করেছিলাম, অবসরে যাওয়ার আগে প্রধান বিচারপতি হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? স্বল্পভাষী বিচারপতি স্মিত হেসে শুধু বলেছিলেন, দোয়া করবেন। ৪ ফেব্রুয়ারি প্রথমে শুনি তিনি আমাদের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন। খবরটা পত্রিকায় পড়ে অসম্ভব ভাল লেগেছিল। যাক, দেরিতে হলেও একজন বিচারকের প্রতি সুবিচার করা হয়েছে! শপথ নেয়ার একদিন আগে ফোন করেছিলাম অভিনন্দন জানাতে। ও প্রান্তে টেলিফোন বাজতেই বিচারপতি ফজলুল করিম রিসিভার তুলে কোন সুযোগ না দিয়েই সালাম করে নিজের নাম বলেছিলাম। পরিচয় দেয়ার সাথে সাথে একটু অবাক হয়েছিলেন। হয়ত আমার কাছ থেকে ফোন আশা করেননি। স্বাভাবিক। তাঁকে এই আমার প্রথম ফোন করা। এরশাদ আমলে হাইকোর্টের একটা বেঞ্চ যখন চট্টগ্রামে স্থাপিত হলো ব্যারিস্টার ফজলুল করিম তাঁর আইন পেশা চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত করেছিলেন। লালখান বাজারে তাঁর চেম্বার। তিনি তখন আমাদের পারিবারিক আইনজীবী। কাজের জন্য তাঁর চেম্বারে সপরিবারে হাজির হতে হতো। একবার বলেছিলাম একটা ফোন থাকলে সুবিধা হয়। ব্যারিস্টার করিমের সোজা-সাপটা জবাব_ ফোন থাকলে আপনি তো আমার চেম্বারে আসতেন না। আপনার সাথে দেখা হতো না। পারিবারিক কুশলাদি জানা হতো না। এর ওপর আর কোন কথা চলে না। এদিন যখন তাঁকে আমার এবং আমার পরিবারের অভিনন্দন জানালাম তিনি অত্যন্ত বিনীতভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ভাবিকে নিয়ে বাসায় আসবেন। আপনার ওপর আমার বাড়তি দাবি আছে। আপনি আমার পড়শী। আমার বাবাকেও দেখেছেন। বলেছি, অবশ্যই আসব সময় করে। এটি আমার জন্য এক পরম সৌভাগ্য।বাবার নাম আহমদ কবির। আমার পিতামহের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মাঝে মাঝে দু'জনকে দু'একবার হুকো টানতে দেখেছি। চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার প্রসিদ্ধ কোরবান আলী সওদাগরের দোকানের সুগন্ধি দেয়া তামাক। হুকোর টানের সাথে সাথে পিতামহের দোকান হতে সুগন্ধি বাতাসটাকে ভারি করে তুলত। পাড়ার গলির ভেতর আহমদ কবিরের বেশ কিছু বেড়ার কাঁচা-পাকা ভাড়া ঘর, যা এখনও আছে। নিজেই দেখভাল করতেন। থাকেন কাছে আসকার দীঘির পারে। আপাদমস্তক একজন মধ্যবিত্ত। তাঁর ছেলে ব্যারিস্টার পড়তে বিলেত যাচ্ছেন। ষাটের দশকে একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে এই দেশ থেকে ব্যারিস্টার হতে বিলেত যাচ্ছেন তা খবর হওয়ার মতো বিষয় ছিল। হলোও তাই। পরিবার তো বটেই, পাড়া-পড়শীরও আনন্দ ধরে না। সেই ফজলুল করিম পরে ব্যারিস্টার ফজলুল করিম, বিচারপতি ফজলুল করিম, প্রধান বিচারপতি ফজলুল করিম। প্রধান বিচারপতি ফজলুল করিমের শ্বশুর বিচারপতি ইমাম হোসেনও পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তিনিও আমাদের পড়শী। এটি বোধ হয় বাড়তি পাওনা।
বিচারপতি ফজলুল করিম শপথ গ্রহণের আগে-পরে সাংবাদিকদের সাথে খোলামেলা কথা বলেছেন। বলেছেন দেশের সকল মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তার কথা। গরিব মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়া হতে বঞ্চিত না হওয়ার কথা। তিনি মনে করেন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার স্বার্থে প্রত্যেক বিচারপতির সম্পদের হিসাব জমা দেয়া উচিত। এটি নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী ঘোষণা। কারণ দুঃখজনক হলেও সত্য সব সময় এ দেশের দায়িত্বশীল পদের সকল মানুষ সন্দেহের উর্ধে থাকতে ব্যর্থ হয়েছেন। দেশের উচ্চ আদালত এখনও মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার শেষ আশ্রয়স্থল। তাকে সব সময় সকল বিতর্কের উর্ধে রাখা বাঞ্ছনীয় এবং তা শুধু বিচারপতিদের কার্যকলাপ দ্বারাই সম্ভব।
২০০৬ সালে আমার সুযোগ হয়েছিল ভারতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি যশবন্ত বিষ্ণু চন্দ্রচুড়ের সাথে মুম্বাইয়ে ঘণ্টা দুই সময় কাটানোর। পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসেবে আমি মুম্বাইয়ের একটি নামকরা উচ্চ শিা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করছি। প্রতিষ্ঠানটি একটি ট্রাস্টের অধীন পরিচালিত, যার চেয়ারম্যান হচ্ছেন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচুড়। তখন তিনি পুনায় তাঁর পৈত্রিক বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। জানিয়ে রেখেছিলেন তিনি আসবেন এবং দুপুরে একসাথে খাবেন। আমি বেশ শিহরণ বোধ করছিলাম। জীবনে প্রথমবার একজন প্রধান বিচারপতির সাথে সাাত হবে! তাও ভারতের মতো বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের! দেখা হলে তাঁর সাথে কী নিয়ে কথা বলব তাও ঠিক করে নিলাম মনে মনে। ইন্টারনেট ঘেঁটে তাঁর সম্পর্কে কিছু তথ্যও বের করে ফেললাম।
বেলা একটার দিকে প্রায় তিন ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে একটা সাদামাটা এম্বেসডর গাড়িতে বিচারপতি এলেন। অত্যন্ত সাদাসিধে মানুষ। হাত বাড়িয়ে নিজ থেকেই নিজের নাম বললেন। আমি কিছুটা হলেও অভিভূত। এক সাথে ভেতরের সভাক েনিয়ে পাশাপাশি বসলাম। বিচারপতি চন্দ্রচুড় ভারতের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দীর্ঘতম সময় দায়িত্ব পালন করেছেন_ সাত বছর চার মাস। অনেক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। দুই একটি রায় দিয়ে সমালোচিত হয়েছেন। অনেকণ ধরে নানা প্রসঙ্গে আলাপ হলো। তিনিই বক্তা, আমরা শ্রোতা। আমি তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাঁর দীর্ঘ আইন পেশা ও বিচারক জীবনে কোন্ বিষয়টি তাঁর কাছে সব সময় পীড়াদায়ক বলে মনে হয়েছে। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন এই বিশাল ভারতবর্ষে এখনও আইনের দরজাটা শুধু বিত্তবানদের জন্যই খোলা। গরিবদের হয় বিচার চাওয়ার সাহস বা সামর্থ নেই অথবা বিচার চেয়েও ন্যায় বিচার পাওয়া হতে বঞ্চিত হন এবং অধিকাংশ মানুষের জন্য বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। বললেন, এই অবস্থা সারা উপমহাদেশের েেত্রই কমবেশি প্রযোজ্য। একই ধরনের বক্তব্য প্রকাশ করলেন বিচারপতি ফজলুল করিম। বিচারপতি চন্দ্রচুড় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে হেবিয়াস কর্পাস বিষয়ক এক মানবাধিকার সংরণের মামলায় ইন্দিরা সরকারকে সমর্থন দিয়ে প্রচণ্ডভাবে সামলোচিত হয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫ সালে দেশে জরুরী আইন জারি করেন এবং সংবিধানের মৌলিক অধিকার স্থগিত করেন। শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়। গ্রেফতার করা হয় বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে। সকলকে ডিটেনশন দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। দেশের নিম্ন আদালতসমূহে সরকারের এহেন আচরণের বিরুদ্ধে রায় দিলে সরকার সুপ্রীমকোর্টে আপীল করে। শীর্ষ আদালতে বিচারপতি চন্দ্রচুড়ের নেতৃত্বে চারজন বিচারপতি সরকারের প েরায় দেন। শুধু একজন বিচারপতি এইচআর খান্না ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি বলেন বিনা বিচারে কাউকে কারাগারে আটক রাখা সংবিধানের মৌলিক চেতনার পরিপন্থী। এ সম্পর্কে খুব দ্বিধার সাথে বিচারপতি চন্দ্রচুড়কে সেদিন প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি একটু চুপ থেকে বললেন, এই বিষয় নিয়ে এতদিন পর আর কথা বলতে চাই না। মনে হলো সেদিন সরকারের প েএবং মানবাধিকারের বিপ েঅবস্থান নিয়ে হয়ত বিচারপতি চন্দ্রচুড় পরবতর্ীকালে নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন। আমার বোঝার ভুলও হতে পারে। তবে যাঁরা বিচরপতি ফজলুল করিমকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁকে জানেন তাঁদের প্রত্যাশা থাকবে প্রধান বিচারপতি হিসেবে যে কয়েক মাস তিনি দায়িত্ব পালন করবেন (তিনি আগামী সেপ্টেম্বর মাসে অবসরে যাবেন) তিনি সব সময় অতীতের ন্যায় সত্য ও মানবাধিকারের প েথাকবেন।
একটি ঘটনা দিয়ে লেখাটি শেষ করি। ব্যারিস্টার ফজলুল করিম যখন চট্টগ্রামে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করছেন, একদিন একটি রাজনৈতিক দলের কিছু শীর্ষ স্থানীয় নেতা তাঁর কাছে আসেন। চট্টগ্রাম শহরের একটি সরকারী স্কুলের মাঠে তাদের তিন দিনব্যাপী একটি কর্মিসভা করার জন্য স্কুল কর্তৃপ অনুমতি দিয়েছিল। পরে কর্তৃপ সেই অনুমতি বাতিল করে। রাজনৈতিক দলটি স্কুল কর্তৃপরে বিরুদ্ধে মামলা করবে। আসলেন শহরের অন্যতম খ্যাতিমান আইনজীবী ব্যারিস্টার ফজলুল করিমের কাছে। ব্যারিস্টার সাহেব বললেন, যারা অনুমতি দিয়েছে তারা প্রয়োজনে বাতিল করার অধিকারও রাখে। অপরপ দাবি জানালেন বিষয় যা হোক তারা হাইকোর্টে রিট করবেন। ব্যারিস্টার সাহেবের মতে, তাদের কোন মামলা নেই। এবার অর্থের টোপ। টাকা যা লাগে তা আমরা দেব। আপনি মামলা করেন। এবার কিছুটা ধৈর্য্যচু্যতি ঘটার পালা ব্যারিস্টার ফজলুল করিমের। আমি জানি আপনাদের টাকার অভাব নেই। আইনজীবীরও অভাব হবে না। কিন্তু আপনাদের মামলা নেয়াটা আমি উচিত মনে করি না। কারণ আপনাদের কোন মামলা নেই। মামলা নিলে তা হবে চরমভাবে অনৈতিক। সেখানেই বিষয়টার সমাপ্তি। সে দিন এই ঘটনা নিজের সামনে ঘটতে দেখে বেশ চমৎকৃত হয়েছিলাম। সব আইনজীবী যদি এভাবে চিন্তা করতেন তাহলে আমাদের বিচারালয়গুলো আরও মানবিক গুণাবলীর আশ্রম হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশের ১৮তম প্রধান বিচারপতি ব্যারিস্টার ফজলুল করিমের নতুন দায়িত্ব পাওয়াতে তাঁকে যাঁরা কাছ থেকে চেনেন তাঁরা নিঃসন্দেহে সকলে আনন্দিত। তাঁরা প্রত্যাশা করেন তিনি তাঁর নতুন দায়িত্বে সফল হবেন এবং তিনি যে আকাঙ্ার কথা জনগণকে শুনিয়েছেন তা বাস্তবায়নের ল্যে কাজ করে যাবেন। বিচারপতি ফজলুল করিমের দীর্ঘায়ু ও সফলতা কামনা করি। তাঁর প্রত্যাশা পূরণ হোক।
লেখক : শিাবিদ
No comments