গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে যাচ্ছে ভারতের অর্থনীতি by টি কে অরুণ
গত কয়েক বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কিছুটা মন্থর থাকার কারণে অনেকেই ভারতের বিকাশের সম্ভাবনাকে খাটো করে দেখিয়ে থাকেন। কেউ কেউ মনে করেন, বিশ্বের বিকাশমান বাজারগুলোর মধ্যে ২০১২-১৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার বিকাশ ভারতের চেয়ে দ্রুত হতে পারে।
এটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মন্তব্য বলে মনে করি না। কারণ ভারতের উৎপাদনশীলতায় যথারীতি তেজিভাব অক্ষুণ্ন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারও ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে উর্ধ্বগতিসম্পন্ন হবে বলে মনে করা যায়।
২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বে ভারতের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯ শতাংশের বেশি। ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে এই হার নেমে গিয়েছিল ৬.৭ শতাংশে। কিন্তু ২০০৮-২০০৯ সালে এসে আবার তা ঊর্ধ্বমুখী হয় এবং ৮.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। এবং পরের দুটি বছরও এই প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। এর পর থেকে প্রবৃদ্ধি নিম্নগতিসম্পন্ন হতে দেখা যায়। ২০১১-১২ বছরে এটা ৬.৫ শতাংশ আগামী মার্চে সমাপ্য অর্থবছরে এই হার ৬ শতাংশে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতের খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে যাওয়া নিয়ে বাইরে থেকে যাঁরা বিশ্লেষণ করছেন, তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু আগামী দুই দশকে যে ভারতের প্রবৃদ্ধিতে নতুন মাত্রা যোগ হতে যাচ্ছে, তা কিন্তু ওই পর্যবেক্ষকদের ধারণাকে ভুল বলে প্রমাণিত করতে সক্ষম হবে।
গত বছর সেপ্টেম্বরে ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করে সরকার। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সে ৪৯ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে এই কর্মসূচির আওতায়, বীমায় তাঁদের বিনিয়োগসীমা ৪৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, টেলিযোগাযোগে সিগন্যাল ব্যবস্থায়ও বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বিদেশিদের। আশা করা হয়েছে, এই পদক্ষেপ অর্থনীতির গতি বাড়াতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য কতটা অর্জন হবে তা বলা যাচ্ছে না। কারণ ভারতের জড়তাসম্পন্ন নীতিনির্ধারণী-প্রক্রিয়ায় এসব সংস্কারের দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল কী হবে তা বলা মুশকিল।
১৯৮৯ সালের পর নব্বইয়ের দশকে মাত্র আড়াই বছর ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠতাহীন অথবা জোট সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছে। যে কারণে নীতিনির্ধারণের সময় সরকারকে যতটা না সংস্কারের কথা ভাবতে হয়েছে, তার চেয়ে বিশি ভাবতে হয়েছে জোটের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার কথা। এ দিক দিয়ে বিবেচনা করলে মনে হবে, বর্তমান সরকার অর্থনৈতিক মন্দার চেয়ে বড় মন্দার মধ্যে বিরাজমান। কিন্তু সেপ্টেম্বরের সংস্কার কর্মসূচির ঘোষণাকে সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা যায়। পার্লামেন্টে যাদের নিয়ে জোট বাঁধা হয়েছে এমন দ্বিতীয় বৃহত্তম দলটি সম্পর্ক ছিন্ন করে এই কর্মসূচির প্রতিবাদে। কিন্তু তারা বাইরে থেকে সরকার টিকিয়ে রাখার জন্য সমর্থন প্রদানের ঘোষণাও দেয়। সংস্কারের পক্ষে রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ের জন্য সরকার কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। টেলিযোগাযোগের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য নিলামের আয়োজন করেছে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সহযোগিতা করার লক্ষ্যে ব্যাংক আইনেরও সংস্কার করছে তারা। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভর্তুকির অর্থ সরাসরি প্রদানের সুবিধা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আবার ভর্তুকির হার কমিয়ে আনারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে যখন বার্ষিক বাজেট ঘোষণা করা হবে, তখন আরো কিছু সংস্কারের ঘোষণা আসতে পারে তা বোঝা যায়।
যারা ভারত সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখতে চান, তাদের জন্য বড় উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য যে রাজনৈতিক অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে সেগুলো।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিবর্তন হিসেবে উল্লেখ করা যায় এখানকার রাজ্যগুলোর নির্বাচনকে (ভারতের ২৮ রাজ্যে নির্বাচিত সরকার শাসন পরিচালনা করছে)। মানুষ পরিষ্কার করে দিয়েছে, ফাঁকা বুলির দিন টেকসই হয় না। অথবা শুধু আশ্বাস দিয়েও পার পাওয়া যাবে না। যা অতীতে হয়ে আসছিল। নেতাদের সুশাসন ও উন্নয়নে মনোনিবেশ করতে হচ্ছে। যারা সফল হতে পারবে তাদেরই পরবর্তী সময়ে পুনরায় ফিরে আসা সম্ভব হবে। যারা ব্যর্থ হবে তাদের নির্বাচনেই বিদায় হতে হবে।
ভারতের রাজনীতি প্রথাগতভাবেই পৃষ্ঠপোষকতার। একেকটি জনগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় নেতা নির্বাচিত হয়ে থাকেন এখানে। নতুন রাজনৈতিক অর্থনীতি এমন নেতাকেই পৃষ্ঠপোষকতা করছে যিনি এই নতুন গতিপথ তৈরি করতে সক্ষম, নগরায়ণে যিনি ভূমিকা রাখতে পারবেন, শিল্পায়নের জন্য ভূমির ব্যবস্থা করতে নীতিনির্ধারণ করতে পারেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করতে পারেন, চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। ভারতের প্রতিটি রাজ্যে এখন বিনিয়োগকারীদের বার্ষিক মেলার আয়োজন করা হয়। যাতে করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সেখানে বিনিয়োগে উৎসাহী হতে পারেন।
প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এমন পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে, যাতে করে সেখানে দুর্নীতি দূর করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়েছে। নতুন মাইনিং বিল খনি নিলামের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সমর্থ হবে। কয়লা খনির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ কমিয়ে আনা হয়েছে। এতে করে কয়লা খনিতে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর এই খাতটি দেশের জ্বালানি ঘাটতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে। এবং দেশের ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সহায়ক হবে। সেন্ট্রাল অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের একটি রুলের কারণে প্রতিটি রাজ্য ইলেকট্রিসিটি রেগুলেটররা বছরে একবার বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করবে। ইলেকট্রিসিটি রেগুলেটরদের বাধার কারণে এর আগে বিদেশ থেকে অধিক মূল্যে কয়লা আমদানি করতে হতো। যে কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় হতো অনেক বেশি।
সুসংবাদ হচ্ছে, ভারত এখন ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। ফলে বিদ্যুতের অভাবে এখন আর ভারতের গ্রামাঞ্চলেও শিল্প-কারখানায় দিনের বেলায় উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে না (রাতের বেলা কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ সঞ্চালনে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। এই সময় গ্রামাঞ্চলের কৃষকরা তাঁদের সেচযন্ত্রগুলো চালিয়ে থাকেন)। একবার যদি ভারতের পল্লী অঞ্চলে বিদ্যুতের পূর্ণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়, তখন ভারতের গ্রামগুলো অবকাঠামোগত সুপরিবর্তনে বিশাল অবস্থানে পেঁৗছাতে সক্ষম হবে। নতুন কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠা হবে, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব নিরসন হবে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া থেকে কৃষকরা উৎপাদনশীলতাকে রক্ষা করতে সক্ষম হবেন, স্থানীয় শিল্পের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে কৃষিজাত পণ্য সংরক্ষণ করে তাঁরা অধিক মুনাফা লাভে সক্ষম হবেন। সরকারি মালিকানাধীন ভারত ব্রডব্যান্ড করপোরেশন দুই লাখ ৫০ হাজার গ্রামে ফাইবার অপটিক ক্যাবল সংযোগের কাজ করছে (ভারতে গ্রামের সংখ্যা ছয় লাখের কিছু বেশি)। কয়েক বছরের মধ্যে ভারতের প্রায় সবাই হাইস্পিড ডাটা জগতে প্রবেশের সুবিধা পাবে। টেলিযোগাযোগের অকল্পনীয় সম্প্রসারণ ও আধুনিক কম্পিউটার ডিভাইসের সুবিধা অর্জন ইত্যাদি কারণে অবশ্যই প্রশংসা পাওয়ার মতো কাজ হয়েছে এখানে। একই সঙ্গে নূ্যনতম ব্যয়ে এসব সেবা পাওয়াও নিশ্চিত হয়েছে।
সরকার নাগরিকদের জন্য অত্যন্ত আধুনিক পরিচিতি নম্বর প্রদানের একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই নম্বর বায়োমেট্রিকস ডাটা ও সফটওয়্যারে নিয়ন্ত্রিত হবে, যা কোনোভাবেই নকল করা সম্ভব হবে না। যাদের কোনো ব্যাংক হিসাব নেই তাদেরও ব্যাংক হিসাব খোলার জন্য সহযোগিতা করবে এই নম্বর। এই হিসাব মাধ্যমে ভর্তুকির অর্থ পরিশোধ করা হবে। এতে করে ভর্তুকির টাকা সরাসরি ভোক্তার হাতে সহজে পেঁৗছে যাবে। ব্যয় হ্রাসে সহযোগিতা করবে। উৎপাদন-সহায়ক হিসেবেও এই পদ্ধতি বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় হিসেবে খাদ্যের উৎপাদনস্ফীতি প্রশংসনীয় বলে গণ্য। বিশেষ করে খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে দুধ, ডিম, মাছ, মাংস, ফল ও ডালের উৎপাদন ক্রমবৃদ্ধি পাচ্ছে। উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এসব দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পল্লীজীবনে সমৃদ্ধি আসছে। এটা মানুষের দৈনন্দিন চাহিদায় অধিক প্রোটিন গ্রহণের সুযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। দারিদ্র্য কমে আসছে গ্রামীণ জীবনে। গত পাঁচ বছরে ২ শতাংশ হারে দারিদ্র্য নিরসন সম্ভব হচ্ছে।
কিন্তু রুপির মূল্যস্ফীতি এখনো রয়ে গেছে। তবে প্রতিটি দুর্বলতা থেকেই সুযোগও তৈরি হতে পারে। গত পাঁচ বছরে চায়নিজ রেনমিনবির তুলনায় ৫০ শতাংশ রুপির মূল্য কমেছে। কিন্তু এই সময়ে ভারতে উৎপাদিত দ্রব্য রপ্তানি ক্ষেত্রে চীনের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে। ভারতের জনসংখ্যা এখন সম্ভাবনার প্রতীক। আর এটা হচ্ছে প্রবৃদ্ধির কথা। যা বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারে। তবে অবশ্যই বিদেশি পুঁজি নির্ভরশীল হওয়াকে অবশ্যম্ভাবী করে নয়।
লেখক : দিল্লি থেকে প্রকাশিত দি ইকোনমিক টাইমসের সম্পাদক
ভাষান্তর : মোস্তফা হোসেইন
২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বে ভারতের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯ শতাংশের বেশি। ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে এই হার নেমে গিয়েছিল ৬.৭ শতাংশে। কিন্তু ২০০৮-২০০৯ সালে এসে আবার তা ঊর্ধ্বমুখী হয় এবং ৮.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। এবং পরের দুটি বছরও এই প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। এর পর থেকে প্রবৃদ্ধি নিম্নগতিসম্পন্ন হতে দেখা যায়। ২০১১-১২ বছরে এটা ৬.৫ শতাংশ আগামী মার্চে সমাপ্য অর্থবছরে এই হার ৬ শতাংশে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতের খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে যাওয়া নিয়ে বাইরে থেকে যাঁরা বিশ্লেষণ করছেন, তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু আগামী দুই দশকে যে ভারতের প্রবৃদ্ধিতে নতুন মাত্রা যোগ হতে যাচ্ছে, তা কিন্তু ওই পর্যবেক্ষকদের ধারণাকে ভুল বলে প্রমাণিত করতে সক্ষম হবে।
গত বছর সেপ্টেম্বরে ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করে সরকার। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সে ৪৯ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে এই কর্মসূচির আওতায়, বীমায় তাঁদের বিনিয়োগসীমা ৪৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, টেলিযোগাযোগে সিগন্যাল ব্যবস্থায়ও বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বিদেশিদের। আশা করা হয়েছে, এই পদক্ষেপ অর্থনীতির গতি বাড়াতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য কতটা অর্জন হবে তা বলা যাচ্ছে না। কারণ ভারতের জড়তাসম্পন্ন নীতিনির্ধারণী-প্রক্রিয়ায় এসব সংস্কারের দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল কী হবে তা বলা মুশকিল।
১৯৮৯ সালের পর নব্বইয়ের দশকে মাত্র আড়াই বছর ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠতাহীন অথবা জোট সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছে। যে কারণে নীতিনির্ধারণের সময় সরকারকে যতটা না সংস্কারের কথা ভাবতে হয়েছে, তার চেয়ে বিশি ভাবতে হয়েছে জোটের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার কথা। এ দিক দিয়ে বিবেচনা করলে মনে হবে, বর্তমান সরকার অর্থনৈতিক মন্দার চেয়ে বড় মন্দার মধ্যে বিরাজমান। কিন্তু সেপ্টেম্বরের সংস্কার কর্মসূচির ঘোষণাকে সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা যায়। পার্লামেন্টে যাদের নিয়ে জোট বাঁধা হয়েছে এমন দ্বিতীয় বৃহত্তম দলটি সম্পর্ক ছিন্ন করে এই কর্মসূচির প্রতিবাদে। কিন্তু তারা বাইরে থেকে সরকার টিকিয়ে রাখার জন্য সমর্থন প্রদানের ঘোষণাও দেয়। সংস্কারের পক্ষে রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ের জন্য সরকার কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। টেলিযোগাযোগের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য নিলামের আয়োজন করেছে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সহযোগিতা করার লক্ষ্যে ব্যাংক আইনেরও সংস্কার করছে তারা। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভর্তুকির অর্থ সরাসরি প্রদানের সুবিধা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আবার ভর্তুকির হার কমিয়ে আনারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে যখন বার্ষিক বাজেট ঘোষণা করা হবে, তখন আরো কিছু সংস্কারের ঘোষণা আসতে পারে তা বোঝা যায়।
যারা ভারত সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখতে চান, তাদের জন্য বড় উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য যে রাজনৈতিক অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে সেগুলো।
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিবর্তন হিসেবে উল্লেখ করা যায় এখানকার রাজ্যগুলোর নির্বাচনকে (ভারতের ২৮ রাজ্যে নির্বাচিত সরকার শাসন পরিচালনা করছে)। মানুষ পরিষ্কার করে দিয়েছে, ফাঁকা বুলির দিন টেকসই হয় না। অথবা শুধু আশ্বাস দিয়েও পার পাওয়া যাবে না। যা অতীতে হয়ে আসছিল। নেতাদের সুশাসন ও উন্নয়নে মনোনিবেশ করতে হচ্ছে। যারা সফল হতে পারবে তাদেরই পরবর্তী সময়ে পুনরায় ফিরে আসা সম্ভব হবে। যারা ব্যর্থ হবে তাদের নির্বাচনেই বিদায় হতে হবে।
ভারতের রাজনীতি প্রথাগতভাবেই পৃষ্ঠপোষকতার। একেকটি জনগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় নেতা নির্বাচিত হয়ে থাকেন এখানে। নতুন রাজনৈতিক অর্থনীতি এমন নেতাকেই পৃষ্ঠপোষকতা করছে যিনি এই নতুন গতিপথ তৈরি করতে সক্ষম, নগরায়ণে যিনি ভূমিকা রাখতে পারবেন, শিল্পায়নের জন্য ভূমির ব্যবস্থা করতে নীতিনির্ধারণ করতে পারেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করতে পারেন, চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। ভারতের প্রতিটি রাজ্যে এখন বিনিয়োগকারীদের বার্ষিক মেলার আয়োজন করা হয়। যাতে করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সেখানে বিনিয়োগে উৎসাহী হতে পারেন।
প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এমন পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে, যাতে করে সেখানে দুর্নীতি দূর করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়েছে। নতুন মাইনিং বিল খনি নিলামের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সমর্থ হবে। কয়লা খনির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ কমিয়ে আনা হয়েছে। এতে করে কয়লা খনিতে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর এই খাতটি দেশের জ্বালানি ঘাটতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে। এবং দেশের ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সহায়ক হবে। সেন্ট্রাল অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের একটি রুলের কারণে প্রতিটি রাজ্য ইলেকট্রিসিটি রেগুলেটররা বছরে একবার বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করবে। ইলেকট্রিসিটি রেগুলেটরদের বাধার কারণে এর আগে বিদেশ থেকে অধিক মূল্যে কয়লা আমদানি করতে হতো। যে কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় হতো অনেক বেশি।
সুসংবাদ হচ্ছে, ভারত এখন ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। ফলে বিদ্যুতের অভাবে এখন আর ভারতের গ্রামাঞ্চলেও শিল্প-কারখানায় দিনের বেলায় উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে না (রাতের বেলা কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ সঞ্চালনে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। এই সময় গ্রামাঞ্চলের কৃষকরা তাঁদের সেচযন্ত্রগুলো চালিয়ে থাকেন)। একবার যদি ভারতের পল্লী অঞ্চলে বিদ্যুতের পূর্ণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়, তখন ভারতের গ্রামগুলো অবকাঠামোগত সুপরিবর্তনে বিশাল অবস্থানে পেঁৗছাতে সক্ষম হবে। নতুন কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠা হবে, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব নিরসন হবে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া থেকে কৃষকরা উৎপাদনশীলতাকে রক্ষা করতে সক্ষম হবেন, স্থানীয় শিল্পের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে কৃষিজাত পণ্য সংরক্ষণ করে তাঁরা অধিক মুনাফা লাভে সক্ষম হবেন। সরকারি মালিকানাধীন ভারত ব্রডব্যান্ড করপোরেশন দুই লাখ ৫০ হাজার গ্রামে ফাইবার অপটিক ক্যাবল সংযোগের কাজ করছে (ভারতে গ্রামের সংখ্যা ছয় লাখের কিছু বেশি)। কয়েক বছরের মধ্যে ভারতের প্রায় সবাই হাইস্পিড ডাটা জগতে প্রবেশের সুবিধা পাবে। টেলিযোগাযোগের অকল্পনীয় সম্প্রসারণ ও আধুনিক কম্পিউটার ডিভাইসের সুবিধা অর্জন ইত্যাদি কারণে অবশ্যই প্রশংসা পাওয়ার মতো কাজ হয়েছে এখানে। একই সঙ্গে নূ্যনতম ব্যয়ে এসব সেবা পাওয়াও নিশ্চিত হয়েছে।
সরকার নাগরিকদের জন্য অত্যন্ত আধুনিক পরিচিতি নম্বর প্রদানের একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই নম্বর বায়োমেট্রিকস ডাটা ও সফটওয়্যারে নিয়ন্ত্রিত হবে, যা কোনোভাবেই নকল করা সম্ভব হবে না। যাদের কোনো ব্যাংক হিসাব নেই তাদেরও ব্যাংক হিসাব খোলার জন্য সহযোগিতা করবে এই নম্বর। এই হিসাব মাধ্যমে ভর্তুকির অর্থ পরিশোধ করা হবে। এতে করে ভর্তুকির টাকা সরাসরি ভোক্তার হাতে সহজে পেঁৗছে যাবে। ব্যয় হ্রাসে সহযোগিতা করবে। উৎপাদন-সহায়ক হিসেবেও এই পদ্ধতি বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় হিসেবে খাদ্যের উৎপাদনস্ফীতি প্রশংসনীয় বলে গণ্য। বিশেষ করে খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে দুধ, ডিম, মাছ, মাংস, ফল ও ডালের উৎপাদন ক্রমবৃদ্ধি পাচ্ছে। উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এসব দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পল্লীজীবনে সমৃদ্ধি আসছে। এটা মানুষের দৈনন্দিন চাহিদায় অধিক প্রোটিন গ্রহণের সুযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। দারিদ্র্য কমে আসছে গ্রামীণ জীবনে। গত পাঁচ বছরে ২ শতাংশ হারে দারিদ্র্য নিরসন সম্ভব হচ্ছে।
কিন্তু রুপির মূল্যস্ফীতি এখনো রয়ে গেছে। তবে প্রতিটি দুর্বলতা থেকেই সুযোগও তৈরি হতে পারে। গত পাঁচ বছরে চায়নিজ রেনমিনবির তুলনায় ৫০ শতাংশ রুপির মূল্য কমেছে। কিন্তু এই সময়ে ভারতে উৎপাদিত দ্রব্য রপ্তানি ক্ষেত্রে চীনের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে। ভারতের জনসংখ্যা এখন সম্ভাবনার প্রতীক। আর এটা হচ্ছে প্রবৃদ্ধির কথা। যা বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারে। তবে অবশ্যই বিদেশি পুঁজি নির্ভরশীল হওয়াকে অবশ্যম্ভাবী করে নয়।
লেখক : দিল্লি থেকে প্রকাশিত দি ইকোনমিক টাইমসের সম্পাদক
ভাষান্তর : মোস্তফা হোসেইন
No comments