হিমালয়-কন্যা দর্শন by হাসমাত আরা হেলাল

সড়ক পথে নেপালে ভ্রমণের জন্য যে ডবল এন্ট্রি ভিসা প্রয়োজন তা ছিল অজানা। নেপাল দূতাবাস অতি সহজেই দিয়ে দিল ছাড়পত্র কিন্তু আটকে দিল ভারতীয় দূতাবাসের ভিসা দফতর।
ছুটে গেলাম প্রেসকাবের সাধারণ সম্পাদক স্বপন দার কাছে। উনি ভারতীয় দূতাবাসের কাউন্সিলর তথ্য ও সংস্কৃতি রিভা গাঙ্গুলীকে ফোনে বলে দেয়ায় সহজেই মিলে গেল ডবল এন্ট্রি ভিসা। এর মানে হচ্ছে ভারতের ওপর দিয়ে নেপাল গমন এবং ওই ফিরতি পথেই বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন। আকাশ পথে ডবল এন্ট্রির প্রয়োজন পড়ে না।
কিন্তু আকাশপথের চাইতে সড়কপথে ভ্রমণের মাধুর্যই আলাদা। প্রবোধ কুমার সান্যালের মহা প্রস্থানের পথে, অবধূতের মরম্নতীর্থ হিংলাজ ও কালকূটের অমৃত কুম্ভের সন্ধানে যারা পড়েছেন তারা সবাই জানেন সড়কপথে যাত্রার বিচিত্র চমকপ্রদ অভিজ্ঞতার কাহিনী। অকাল বর্ষণের অঝোর ধারা বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালানো ছিল দুঃসাধ্য। কিন্তু সামনে যে আরও ভয়ঙ্কর দুঃসাধ্য পথ পরিক্রণ আমাদের জন্য অপো করছে তা মোটেই ভাবিনি। গোটা রাত কাটল নির্ঘুম। বর্ষণসিক্ত রাতের অন্ধকারে সবই ছিল অদৃশ্য। মনে হচ্ছিল আমরা যেন কোন এক অমানিশার অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। পথের দিশা ছিল অজানা কারণ এর আগে বেনাপোল সীমানত্ম দিয়ে দুবার ভারত ভ্রমণে গেছি। রংপুরের বুরিমারী সীমানত্মে একেবারেই নতুন। গোটা বাসটিই ছিল বিভিন্ন যাত্রীতে ঠাসা। তার মধ্যে কিছু ছিলেন দার্জিলিংগামী যাত্রী। কেউ ছেলে নিয়ে যাচ্ছেন কেউ বা আনতে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ হবার পর আমাদের নব্য বা উঠতি বড়লোকদের মধ্যে দার্জিলিং কালচার দ্রম্নত প্রসার লাভ করছে। যে কোন বিত্তবান পরিবারের সনত্মান এখন দার্জিলিং বা কার্সিয়াংয়ের কনভেন্ট স্কুলের ছাত্র। এখনও ওখানে ব্রিটিশ নিয়মে পড়াশোনা করানো হয় বলে শুনেছি। কলকাতায় বসবাসরত আমার পরলোকগত বড় বোনের ছেলেরা দার্জিলিংয়ের কনভেন্টে পড়ত। ছেলেবেলায় পুজোর দুটিতে ঢাকায় ওরা বেড়াতে এলে অবাক বিস্ময়ে ওদের ইংরেজী বুলি শুনতাম। আর এখন তো চারপাশে দার্জিলিং পড়ুয়া ছেলেদের ছড়াছড়ি। ফিরতি পথে দার্জিলিং ভ্রমণের সুপ্ত ইচ্ছা মনের মধ্যে লালন করছিলাম।
সকাল সাতটায় পেঁৗছলাম বুরিমারী। চারপাশে মেঘভাঙ্গা রোদেলা আকাশের কিরণছটা। বাংলাদেশের সীমানত্মবর্তী গ্রাম। তামাক চাষের জন্য বিখ্যাত। কাছে-পিঠে লোকালয় দেখা গেল না। ওপারে ভারতীয় সীমানত্ম চ্যাংড়াবান্ধা। সীমানত্ম পথটি নতুন। গত ১০/১৫ বছরের মধ্যে এই সীমানত্ম পথটি প্রসার লাভ করেছে। পাকিসত্মান আমলে এর অসত্মিত্ব ছিল না। পরিবহন কোম্পানির নিজস্ব যাত্রীনিবাস। দুটো পাকা ঘর খাটে বিছানা পাতা, ল্যাট্রিন ও বাথরম্নম লাগোয়া। টিউবওয়েলে পর্যাপ্ত পানি। অন্য যাত্রীদের সঙ্গে আমরাও ফ্রেশ হয়ে নিলাম। পরিবহন কোম্পানির কর্মকর্তারা আমাদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা করে দিলেন। সঙ্গে প্রচুর খাবার-দাবার ও পানি। কিছু সদ্ব্যবহার করে বাকিটা আসন্ন বন্ধুর পথের জন্য রেখে ছিলাম। পরিবহন অফিসের একজন কর্মকর্তা আমাদের নিয়ে গেলেন ইমিগ্রেশন ও কাস্টম অফিসে। মালপত্র গেল ভ্যানগাড়িতে আর আমরা হেঁটে। হাঁটাপথে কয়েক পা মাত্র। সীমানত্ম ফাঁড়ি দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে ভারতীয় সীমানত্মরীদের সীমানত্ম পথটি দিয়ে ভুটান থেকে আপেল নিয়ে সারি সারি ট্রাক আসছে। এ পথে দার্জিলিংগামী যাত্রীদের সংখ্যাই অধিক। এখন যেহেতু নেপালে অনুষ্ঠিত হচ্ছে অষ্টম সাফ গেমস তাই নেপালগামী যাত্রীদের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। বেনাপোল সীমানত্মের মতো গ্যাঞ্জাম এখানে অনুপস্থিত। ইমিগ্রেশনের যাবতীয় ঝামেলা মিন্টু ভাই ও লিটি সামাল দিল। আমাদের কাছে অবৈধ কিছু নেই। সাংঘাতিক করিৎকর্মা মেয়ে লিটি। মালাপত্র ভ্যানগাড়িতে চাপিয়ে হেঁটে হেঁটে পার হলাম নোম্যানস ল্যান্ড। বেশ মজাই লাগছিল। হাত বিশেক চওড়া মাটি বিছানো গৈরিক পথ। ওপারে সারি সারি আপেল বোঝাই ট্রাক দাঁড়ানো। পথের ধারে বিশ্রামের জন্য বাঁশের তৈরি চৌচালা। বাঁশের বেঞ্চি পাতা। টিন ও বেড়া নির্মিত ভারতীয় কাস্টম ও ইমিগ্রেশন অফিস। বুরিমারীর মতো পাকা অফিসঘর নয়। আমাদের নাকের ডগা দিয়ে মফস্বলের একদল ক্রীড়া সাংবাদিক বেরিয়ে গেল। ওরা অন্য পরিবহনের যাত্রী ছিল। সামান্য দূরে টিনের ছোট ছোট খুপড়ি ঘরে ডলার ও বাংলাদেশী টাকা বিনিময়ের কাজ সেরে প্রস্তুতি নিলাম পথ পাড়ি দেবার। তখনও পর্যনত্ম শিলিগুড়িতে এক রাত কাটিয়ে পরদিন বিকেলে নেপালের বাস ধরার পস্ন্যান ছিল। বহুদূর পথ এখনও বাকি। আশপাশে নেই কোন লোকালয়। রম্ন প্রকৃতি ও গৈরিক প্রানত্মর। দুপাশে চষা তে। বিবর্ণ আর ধূলিধুসরিত। গনত্মব্য শিলিগুড়ি। সমরেশ মজুমদারের সাত কাহন উপন্যাসের নায়িকা দীপাবলী এই শিলিগুড়িতেই বড় হয়েছে। কত উপন্যাসেই পড়েছি শিলিগুড়ির বর্ণনা। মনের গহন কোণে অজানা শিহরণ। দার্জিলিং তো কাছে। এই বুঝি কাঞ্চন জংঘার আভাস দেখা যায়। কিন্তু পথের বিড়ম্বনা তো অসহ্য জিনিস। ওঁৎ পেতে অপো করছিল অনাকাঙ্ৰিত একটি দুঃখজনক ঘটনা। ঢাকা থেকেই আত্মীয়ার মুখে নেপাল ভ্রমণের খুঁটিনাটি বিশদ বিবরণ শুনে নিয়েছিলাম। প্রতিটি েেত্র লিলিয়ে নিচ্ছিলাম। কিন্তু এই অনাকাঙ্ৰিত ঘটনাটি আমাদের ভ্রমণপথের সব আনন্দকে নিঃশেষে করে দিল। ঘটনাটি ছিল অভাবনীয় ও সঙ্কটজনক। আসন্ন দুর্গা পুজোর চাঁদা আদায়ের ঘটনা। সব জায়গার একই চিত্র। তবু ঢাকায় এই ঘটনার অভিজ্ঞতা ছিল না। ভারতীয় পত্রপত্রিকা ও বলিউডের সাম্প্রতিক সিনেমাহলের লোমহর্ষক চিত্রগুলো ফুটে উঠল মনের কোণে। প্রথমে ব্যাপারটিকে তেমন আমল দিলাম না। বেকার রসবাজ গু-া প্রকৃতির কিছু যুবক আমাদের ভ্যান গাড়ি আটকে দিল। কিছুতেই রেহাই নেই। মিন্টু ভাইয়ের কল্যাণে ঝড়ঝড়ে ভারতীয় এক শ' টাকায় রফা হলো। এরকম একটি পরিস্থিতিতে আমার প্রেসকাবের আইডেনটিটি কার্ড দেখাবার মতো মানসিকতা বা সুযোগ কোনটাই পেলাম না। মিন্টু ভাইয়ের ত্বরিত হসত্মেেপ বিষয়টির নিষ্পত্তি হলো তবে শর্ত হলো পথে আমাদের কাছে আর কোন দল চাঁদা চাইবে না। বাসস্ট্যান্ডে এসে মত পাল্টানো হলো। পরিকল্পনা ছিল শিলিগুড়িতে একরাত কাটাব। সরাসরি নেপাল বর্ডারে যাবার সিদ্ধানত্ম নিলাম। সময় তখন এগারো বারোটার মতো। বাসস্ট্যান্ডের বিকট হট্টগোলের মধ্যে একটি ট্যাক্সি ভাড়া করা হলো ভারতীয় সাত শত টাকায়। অন্যান্য ট্যাক্সি ড্রাইভাররা এই ড্রাইভারকে কিছুতেই ওই ভাড়ায় যেতে দেবে না। প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রম্নপের এই আসন্ন সংঘর্ষ পাশ কাটিয়ে আমরা দ্রম্নত রওনা দিলাম। মাইক্রোবাস ও ট্যাক্সির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এক ধরনের ভারতীয় মাইক্রো তৈরি করা হয়েছে। দুধারে তিনজন করে দুসারি সিট। সামনে ড্রাইভারের পাশে একজনের সিট। আমাদের অনায়াসে বসার ব্যবস্থা হলো। বাঙালী ড্রাইভার কাকরভিটার পথে রওনা দিল। আবারও পথে চাঁদাবাজের উপদ্রব। মোটরসাইকেল নিয়ে আমাদের গাড়ি অনুসরণ করছে। মেয়েদের সংখ্যাধিক্য দেখে বোধহয় ওদের এই উপদ্রব ও উৎসাহ। চাঁদা মেটাবার কোন কথাই ওরা শুনতে চায় না, রসিদও দেখে না। ঠিক হিন্দী সিনেমার ভিলেন স্টাইল। চতুর ড্রাইভার থানার পাশ দিয়ে গলিপথে আমাদের নিয়ে হাইওয়েতে উঠল। একমাত্র আলস্নাহর দয়ায় আমরা সে যাত্রায় বেঁচে গেলাম। কিন্তু ওই দুঃসহ অভিজ্ঞতার স্মৃতি আমাদের বহুদিন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে।
(চলবে)

No comments

Powered by Blogger.