জনস্রোত_ অটোগ্রাফ শিকারিদের কবলে দুই লেখক- বইমেলা প্রতিদিন
প্রত্যাশা যেমন ছিল তাই হয়েছে। ছুটির দিন শুক্রবার অমর একুশের বইমেলায় ঢল নেমেছিল মানুষের। একে জনস্রোত বললেও কম বলা হবে। ছুটির দিন হওয়ায় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন অনেক বাবা-মা।
তরম্নণ-তরম্নণীরা এসেছিল দল বেঁধে। এদিকে টিএসসি, সেদিকে দোয়েল চত্বর থেকে দু'টি করে লম্বা লাইন দিয়ে ঢুকছিল সেই বিকেল চারটা থেকেই। সন্ধ্যার পরে এ লাইন হয়েছে আরও দীর্ঘ। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পাখ-পাখালির কলকাকলি শুনতে শুনতে মৃদু পায়ে হেঁটে হেঁটে মেলায় প্রবেশ করতে এদিন পাঠক-দর্শনার্থীর প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় লেগেছে। নদীর স্রোত যেমন সাগরে এসে পড়ে, তেমনি এদিন মানুষের স্রোত ছিল মেলার দিকে। বারোতম দিন পার হতে না হতেই এমন জনসমাগম আর কখনও দেখা যায়নি। সামনে মেলার চিত্র কি হবে তা এখন বলা মুশকিল। এদিন বাইরের লাইন দেখেই বোঝা গেছে, ভেতরের কি অবস্থা। ভেতরে গিয়ে দেখি মানুষ গায়ে গা লাগিয়ে হাঁটছে। নাম করা স্টলগুলোর সামনে উপচেপড়া ভিড়। সকাল এগারোটায় মেলা শুরম্নর পর থেকেই ছিল উপচেপড়া ভিড়। প্রকাশকরা বেশ খুশি বিক্রি ভাল হচ্ছে বলে। তবে পাঠকদের অভিযোগ সৃজনশীল বই খুব কম। মেলায় এদিন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলনকে সারাৰণই ব্যসত্ম থাকতে দেখা গেছে অটোগ্রাফ দিতে। এদিন মেলায় আরও এসেছিলেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন ও ইংল্যান্ড প্রবাসী লেখক মিথুন। এদিন নতুন বই এসেছে ২১৪টি।ছুটির দিনে মেলার বাইরের চিত্রেও ছিল বেশ বৈচিত্র। হকাররা কি নিয়ে বসেনি এদিন সেখানে। চুড়ি, বালা, মালা, টিপ, লেডিস স্যান্ডেল, ব্যাগ, গৃহস্থালি সামগ্রী, শিশুদের খেলনা, এমনকি পাইরেটেড বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসা হকারে সয়লাব ছিল আণবিক শক্তি কমিশনের গেট থেকে চারম্নকলার গেট পর্যনত্ম। অনেক হকারের মুখেই ছিল যেটা নেন এক শ', যেটা নেন ষাট, যেটা নেন আশি এমন ডাক। এদিন নজরম্নল মঞ্চে তিন ডজনেরও বেশি বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে।
লেখকদের কথা
এদিন মেলায় যে ক'জন জনপ্রিয় লেখক এসেছিলেন তাঁদের প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার ফুরসত ছিল না। ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে দু'চারবার কথা বলার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেও অটোগ্রাফ দিতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছিলেন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল তো ছিলেন আরও ব্যসত্ম। প্রতি বছরের মতো এবারও নজরম্নল মঞ্চে ওঠার এক দিকের সিঁড়ি দখল করে বসেছেন, আর তাঁকে ঘিরে আছে শত শত তরম্নণ পাঠক-পাঠিকা। পাঠকরা তাঁর বইয়েই তাঁর অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য দু'টি দীর্ঘ লাইনেও দাঁড়িয়ে গেছেন। তাঁকে ঘিরে এমন ভিড়ের জন্য এদিকের সিঁড়ি দিয়ে কেউ আর নজরম্নল মঞ্চে যেতে পারেনি। ইংল্যান্ড থেকে আসা প্রবাসী লেখক মিথুনের সঙ্গে কথা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ৩৫ বছর যাবত ইংল্যান্ডে আছি, তবে প্রতি বছরই বইমেলার সময় দেশে আসি। এবার আমার একটি বইও এসেছে মেলায়, উপন্যাস। বাংলায় এটি আমার প্রথম উপন্যাস, নাম 'দিয়ালা'। আমি সাধারণত ডাচ ভাষায় লিখি, তাও ভাষা সাহিত্যের ওপর। বাংলা ভাষায় খুব একটা লেখা নেই আমার। এর আগে কবিতার বই ঐ বসনত্মে এবং ছোটদের স্বর্ণপুরির রাজকুমারী নামে দু'টি বই লিখেছি। দিয়ালা উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা একটি প্রেমের গল্প। অনেক লেখকই ভালবাসার গল্প লিখেছেন, কিন্তু আমি এই বইতে যেভাবে তা উপস্থাপন করেছি, আগে কেউ সেভাবে লেখেনি। বইটি আশা করি পাঠকদের ভাল লাগবে।
প্রকাশকদের কথা
প্রকাশকরা এদিন বেজায় খুশি ছিলেন। বিক্রি হয়েছে প্রচুর। নাম করা স্টলগুলো থেকে বই কিনতে কোন কোন পাঠককে আধা ঘণ্টার ওপরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। শোভা প্রকাশনীর মালিক মিজানুর রহমান বলেন, এবার নতুন বই এনেছি ৪০টিরও বেশি। এর মধ্যে সৃজনশীল বই আছে অনেক। প্রথম থেকেই এবার মেলা জমজমাট। শুরম্নতে বিক্রি মোটামুটি হলেও এখন বেশ ভাল বিক্রি হচ্ছে। পাঠকদের অভিযোগের ভিত্তিতে পালক পাবলিশার্সের মালিক ফোরকান আহমদ বলেন, আমি সব সময়ই সৃজনশীল বই প্রকাশ করি। বাণিজ্যিক চিনত্মা থেকে নয়, সমাজ ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই এ কাজটি করি আমি। অন্য প্রকাশকরাও যদি সৃজনশীল বই প্রকাশে একটু বেশি উদ্যোগী হতো তাহলে পাঠকরা আজ আর অভিযোগ করতে পারত না। তিনিও বিক্রি ভাল হচ্ছে বলে জানালেন।
শিশুদের আবৃত্তি প্রতিযোগিতা
প্রতি বছরের এবারও বাংলা একাডেমী শিশুদের আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল শুক্রবার। শিশুদের তিনটি শাখায় এদিন মোট অংশ নেয় ২৬৮ জন শিশু। সবচেয়ে ছোট ক শাখায় ১২৫ জন শিশু আবৃত্তি করে কাজী নজরম্নলের 'খুকি ও কাঠ বিড়ালী' কবিতাটি। খ শাখায় অংশ নেয়া ১০০ শিশু আবৃত্তি করে আবু জাফর বোয়দুলস্নাহর 'মাগো ওরা বলে' কবিতাটি। আর গ শাখার ৪৩ শিশু সৈয়দ শামসুল হকের আমার পরিচয় আবৃত্তি করে। শিশুদের এই প্রতিযোগিতার প্রাধমিক ফলাফল প্রকাশিত হবে ১৬ ফেব্রম্নয়ারি, ফাইনাল প্রতিযোগিতা হবে ১৯ ফেব্রম্নয়ারি। আর বাংলা একাডেমী পুরস্কার ঘোষণা করা হবে ২০ ফেব্রম্নয়ারি।
নতুন বই
এদিন নতুন বই এসেছে ২১৪টি। এর মধ্যে উপন্যাস ছিল ৫২টি, কবিতা ৪৩টি, গল্প ২৫টি, শিশুসাহিত্য ও রচনাবলী ১৩টি করে উলেস্নখযোগ্য। এদিনের বইগুলোর মধ্যে শওকত আলম সিদ্দিকীর পশুর মেলা, পাখির মেলা ও ঐ যে আকাশ শিশুতোষ তিনটি বই ছিল উলেস্নখযোগ্য। সহজ সরল বাক্যে লেখা এরং রঙিন ও শিশু উপযোগী অলঙ্করণে বেশ আকর্ষণীয়ভাবে তৈরি করা হয়েছে। ছোট ছোট বাক্যের সঙ্গে ছবি যুক্ত করে বইগুলোকে করেছে সহজবোধ্য এবং এই বইয়ের মাধ্যমে শিশুরা সহজে ছবি অাঁকায় অভ্যসত্ম হবে। এদিনের অন্যান্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে আখতার জামানের উপন্যাস মেঘ ছুঁয়েছে একা একা এনেছে ইত্যাদি, আসিনুল ইসলামের ছড়ার বই চিচিংফাঁকের দেশে এনেছে মুক্তচিনত্মা, শিকড় এনেছে রাবেয়া সুলতানার কাউকে কিছু না বলে, বাতিঘরে পাওয়া যাচ্ছে শাহজাহান সাজুর নাম নেই, সিআইডি পুলিশসহ ৬টি বই।
No comments