আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে- বকুলতলায়, রবীন্দ্র সরোবরে দিনভর উসব আয়োজন
দক্ষিণ হাওয়ায় কুসুম বনের বুকের কাঁপনে, উৎরোল মৌমাছিদের ডানায় ডানায়, পল্লব মর্মরে, নিরাভরণ বৃৰে কচি কিশলয় জেগে ওঠার আভাসে আর বনতলে কোকিলের কুহুতান জানান দিচ্ছে ঃ 'আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে...।'
অথবা 'ওরে গৃহবাসী খোল, দ্বার খোল, লাগল যে দোল!/ স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল!/ দ্বার খোল, দ্বার খোল...।' দক্ষিণা হাওয়ায় দোল জাগিয়ে বসন্ত এল আবার আমাদের প্রকৃতি ও জীবনে। আজ পয়লা ফাল্গুন। কবির ভাষায় 'ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক/ আজ বসন্ত।'সাগর, নদী, ভূভাগ গ্রীষ্মের তাপ বাষ্পে নিশ্বাস নেবার আগে এ বসন্তের ফাল্গুনে পায় শেষ পরিতৃপ্তি। নৈসর্গিক প্রকৃতি বর্ণচ্ছটায় বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। ফুল ফুঠবার পুলকিত এই দিনে বন-বনানত্মে কাননে কাননে পারিজাতের রঙের কোলাহলে ভরে ওঠে চারদিক। কচি পাতার আলোর নাচনের মতোই বাঙালীর মনে লাগে দোলা। হৃদয় হয় উচাটন। পাতার আড়ালে-আবডালে লুকিয়ে থাকা বসনত্মের দূত কোকিলের মধুর কুহুকুহু ডাক, আবার ব্যাকুল করে তোলে অনেক বিরহী অনত্মর। শুধু মিলনই তো নয়, প্রেমের সঙ্গে আবার জড়িয়ে থাকে নানা রকম শঙ্কা_ সন্দেহও। তাই এমনও মধুর দিনে এমন শঙ্কাও কি জাগে না অধীর প্রতীৰায় থাকা কোন মনে_ সে কি আমায় নেবে চিনে/ এই নব ফাল্গুনের দিনে_ জানিনে...? তবে বসনত্মের এই সমীরণ বলছে আজ মিলনের দিন। নিখিলব্যাপী গুনজরিত হচ্ছে সেই সুর_ আজি দখিন ধুয়ার খোল-/ এসো হে এসো হে এসো হে আমার বসনত্ম।/ দেব হৃদয়দোলায় দোলা...। এই আশ্বাসেই প্রণয় কাতর হিয়া ব্যাকুল হয়ে আছে প্রিয়মুখের দু'একটি কথা শোনার জন্য, একটু স্পর্শের জন্য। মন বলছে_ তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী/ কিছু পলাশের নেশা, কিছুবা চাঁপায় মেশা,/ তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি...।
শীতের জীর্ণতা সরিয়ে ফুলে ফুলে সেজে উঠছে এখন প্রকৃতি। গাছে গাছে নতুন পাতা, সি্নগ্ধ সবুজ ছোট কচি পাতা। ধীর গতিতে বাতাসের বয়ে চলা জানান দিচ্ছে নতুন কিছুর। আজ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিষেক হলো ফাল্গুন মাসের। ঋতুরাজ বসনত্মের। শীতে খোলসে ঠুকে থাকা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নাগলিঙ্গম এখন অলৌকিক স্পর্শে জেগে উঠেছে। পলাশ, শিমুল গাছে লেগেছে আগুন রঙের খেলা। প্রকৃতিতে চলছে মধুর বসনত্মের সাজ সাজ রব। আর এ সাজে মন রাঙিয়ে অনেকেই গুন গুন করে গেয়ে উঠছেন_ মনেতে ফাগুন এলো...।
তবে বাসত্মবতার পাথর চাপা হদয়ের সবুজ বিবর্ণ হওয়া চোখে, প্রকৃতি দেখার সুযোগ পাননা নগরবাসী। কোকিলের ডাক, রঙিন কৃষ্ণচূড়া, আর আমের মুকুলের কথা বইয়ের পাতায় পড়ে এলেও আজকের তরম্নণ-তরম্নণীরা বসে থাকতে রাজি নন। গায়ে হলুদ আর বাসনত্মি রঙের শাড়ি জড়িয়ে হাতে হাত রেখে বেরিয়ে পড়ে তারা। এদিন পাঞ্জাবি পরা তরম্নণেরাও নিজেদের রঙিন সাজে সাজাতেও বাদ যান না। বসনত্ম তারম্নণ্যের প্রতিনিধি, তাই সবারই মনে বেজে ওঠে_ 'বসনত্ম ছুঁয়েছে আমাকে। ঘুমনত্ম মন তাই জেগেছে, পয়লা ফাল্গুন আনন্দের দিনে।'
নাগরিক সৌন্দর্যে বসনত্মের ফুল খুব কম দেখা গেলেও পথে-ঘাটে দু'একটা চোখে পড়ে। কিন্তু কোকিলের ডাক সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে শোনা গেলেও ঢাকা শহরে সেই কুহু ডাক শোনা কিছুটা হলেও দুষ্কর। খুব যদি মন চায় কারো কুহু ডাক শোনার, তবে যেতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, ন তো বাংলা একাডেমীতে। খুব সহজেই গাছের ফাঁকে অবস্থান নেয়া কোকিল আগনত্মুকের মন ভরিয়ে দেবে। পয়লা ফাল্গুন অথর্াৎ আজকের দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারম্নকলার বকুলতলায় ও ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবরে বাঙালী অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মিলিত হয়ে ফাগুন প্রাণে আগুন জ্বালাবে।
তাই জাতীয় বসনত্ম উৎসব উদযাপন পরিষদ এই দিনটিকে বরণ করতে দিনব্যাপী উৎসবের আয়োজন করেছে। উৎসব শুরম্ন হবে (আজ শনিবার) সকাল সাতটায় চারম্নকলার বকুলতলায়, প্রিয়াংকা গোপের রাগ সঙ্গীতের সুর মূর্ছনায়। দর্শক শিল্পীর সরাসরি অংশগ্রহণের জন্য থাকছে ফুল আর আবির বিনিময়, প্রীতিবন্ধনী ও বসনত্মের বিশেষ কার্ড বিনিময়। থাকছে বসনত্ম কথন পর্ব। এতে আলোচনা করবেন নাট্যজন আলী যাকের, আবৃত্তি শিল্পী কাজী আরিফ ও স্থপতি সফিউদ্দিন আহমেদ। উৎসবের ঘোষণা পাঠ করবেন মানজারম্নল ইসলাম চৌধুরী সুইট। সকাল ১০টায় বসনত্ম শোভাযাত্রার মধ্যদিয়ে শেষ হবে প্রথম পর্ব। পর্বটি সরাসরি সম্প্রচার করবে চ্যানেল আই। বিকেল সাড়ে তিনটায় চারম্নকলার বকুলতলায় ও রবীন্দ্র সরোবরে একযোগে শুরম্ন হবে উৎসবের দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠান। চলবে রাত অবধি। বিশেষ পরিবেশনা হিসেবে থাকবে আদিবাসীদের মনিপুরী নৃত্য। বিকেলের চারম্নকলার পর্বটি দেশ টিভি, আর রবীন্দ্র সরোবরের পর্বটি এনটিভি সরাসরি সম্প্রচার করবে।
গ্রামে গ্রামে বসন্তের বার্তা
বগুড়া থেকে সমুদ্র হক জানাচ্ছেন, বাঙালী সংস্কৃতিতে বসন্ত আসে সবার মধ্যে। কেউ চেতনে কেউ অবচেতনে তা অনুভব করে। বাঙালী ললনারা এই দিনে যে বাসনত্মি রঙের শাড়ি ও খোঁপায় হলুদ ফুল এটে দেয় তাও এসেছে রং খেলার উৎসবের বিবর্তনের পালায় রং ছিটানো হয়ে। এ দেশে ছায়ানট বসনত্ম উৎসব শুরম্ন করে ৬২ সালে। দিনে দিনে তা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। বগুড়ায় বসনত্ম উৎসবের আয়োজন করেছে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। এর মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী আয়োজন সংশপ্তক থিয়েটারের। তারা এবার দশ প্রেমিক যুগলকে দেবে সম্মাননা, যারা প্রেমের বিয়ে টিকিয়ে রেখেছেন দীর্ঘ সময় ধরে। ইতোমধ্যে গ্রামে গ্রামেও বসনত্মের আগমনী বার্তা সুস্পষ্ট। গ্রামের পথে পা বাড়ালে দেখা যায সেখানেও পড়েছে ফাগুনের ছোঁয়া। গাঁয়ের বধূরা আঙ্গিনা লেপে নিয়েছে ফাল্গুনের দিন বরণের। তুলে রাখা হলদে শাড়িও বের করেছে তারা। গ্রামে শুরম্ন হয়েছে বোরো চারা রোপণের পালা। মাঘের তীব্র শীতে আবাদের মাঠে যেতে পারেনি কৃষক ফাগুনের দিনে তারা স্বাচ্ছন্দ্যেই যেতে পারছে। বসনত্মের দিনে সবার হৃদয়ে এনে দিচ্ছে ফাগুনের দোলা। হাইটেকের এই যুগে প্রেমিকরা যতই প্রযুক্তির মধ্যে থাকুক বাঙালীর গর্বের সংস্কৃতি বলে কথা- ফাগুনের রঙ হৃদয়ে এঁকে দেবে নিসর্গেরই এক অনুভূতি। যা ফুরায় না হৃদয় থেকে।
No comments