ফাইল ছুড়ে ওয়াকআউট- প্রথম দিনেই উত্তপ্ত জাতীয় সংসদ- '২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচন অদ্ভুত কারসাজির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন'- 'ইয়াজউদ্দিন আজিজ মার্কা নির্বাচন করতে পারেনি বলেই বিশাল ভরাডুবি'
চিরচেনা রূপে ফিরে এসেছে জাতীয় সংসদ। টানা ৬৪ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকার পর জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বৃহস্পতিবার সংসদে যোগ দিয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট।
বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিরোধী দল সংসদে যোগ দেয়ায় প্রায় দশ মাস পর নিষপ্রাণ জাতীয় সংসদ আবারও উত্তপ্ত ও প্রাণবনত্ম হয়ে উঠেছে। সংসদে যোগ দিয়ে প্রথম দিনেই সংসদ থেকে ওয়াক-আউট করেছে বিরোধী দল। সরকার ও বিরোধী দলের পাল্টাপাল্টি উত্তপ্ত বিতর্ক ও একে অপরকে ঘায়েল করতে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণাত্মক বক্তব্যে এক ঘণ্টারও বেশি সময় রীতিমতো উত্তাল হয়ে উঠেছিল সংসদ অধিবেশন। মাঝপথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতি দিতে গিয়ে জিয়া-মোশতাককে 'খুনী' বলায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ফোর দাবি করে বিরোধী দল। স্পীকার বিধিবহিভর্ূতভাবে বক্তব্যের সুযোগ না দিলে বিরোধী দলের সকল সংসদ সদস্য দাঁড়িয়ে তীব্র হৈ-চৈ, ফাইল চাপড়িয়ে সংসদকে উত্তপ্ত করে তোলে। এক পর্যায়ে ফাইল ও দিনের কার্যসূচীর কাগজপত্র ছিঁড়ে, শূন্যে ছুড়ে ফেলে সন্ধ্যা সাতটায় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিরোধী দল সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে। এরপর তাঁরা আর সংসদে ফিরে আসেননি।অনায্য দাবিতে ফোর না পেয়ে বিরোধী দলের সংসদ থেকে ওয়াক আউট করায় অসনত্মোষ প্রকাশ করে স্পীকার এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বলেন, আমি সবাইকে কথা বলার সুযোগ দিতে চাই। অনেকদিন পর বিরোধী দল সংসদে এসেছে, তাই বিধির ব্যত্যয় হলেও বিরোধীদলীয় চীফ হুইপ যতৰণ ইচ্ছা কথা বলেছেন, আমি সুযোগ দিয়েছি। কিন্তু ৩০০ বিধিতে কোন মন্ত্রীর বক্তব্যের বিরম্নদ্ধে বা এ পর্যায়ে পয়েন্ট অব অর্ডারে বক্তব্য রাখার সুযোগ নেই। সংসদ অনেকদিন চলবে, প্রয়োজনে আরও বাড়ানো হবে। কিন্তু সংসদে অচলাবস্থা সৃষ্টি করা কারোর কাম্য নয়।
এর আগে সংসদ অধিবেশনে প্রবেশ করেই বিরোধী দলের চীফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারম্নক তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতায় গত ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনকে 'অদ্ভুত কারসাজির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন' আখ্যায়িত করে বলা হয়, অদ্ভুত কারসাজি ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ৰমতায় এসে বর্তমান সরকার দেশের গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। সংসদে কথা বলতে না দিলে কতদিন থাকব জানি না।
জবাবে সরকারী দলের চীফ হুইপ উপাধ্যৰ আবদুস শহীদ বলেন, ইয়াজউদ্দিন-আজিজ মার্কা ভুয়া নির্বাচন করতে পারেনি বলেই বিশাল ভরাডুবিতে তাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ৰমতার মসনদে চিরস্থায়ীভাবে থাকতেই ১ কোটি ২০ লাখ ভুয়া ভোটার অনত্মভর্ুক্ত করে বিএনপি-জামায়াত জোট প্রহসনের নির্বাচন করতে চেয়েছিল। জনগণ তা হতে দেয়নি। ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অবাধ, নিরপেৰ ও শানত্মিপূর্ণ হয়েছে দাবি করে তাঁরা বলেন, শুধু দেশেই নয়, বিশ্বের সকল দেশেই এ নির্বাচন প্রশংসিত হয়েছে। মিথ্যাচার করে জনগণকে বিভ্রানত্ম করলেও বিরোধী দল ওই নির্বাচনের কোথাও ছিটেফোঁটা প্রমাণিত অভিযোগ দেখাতে পারেনি।
বিকেল ৩টা ৫ মিনিটে স্পীকার এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরম্ন হয়। এর মাত্র দশ মিনিট পরই খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা সংসদ অধিবেশন কৰে প্রবেশ করেন। যোগ দেন বিএনপির শরিক জামায়াতে ইসলামীর দুই সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপির এক সংসদ সদস্য। এ সময় স্পীকার দীর্ঘদিন পর সংসদে আসা বিরোধী দলকে স্বাগত জানান, সরকারী দলের সদস্যরাও টেবিল চাপড়িয়ে বিরোধী দলকে স্বাগত জানায়। সদস্য পদ রৰা আর বিভিন্ন ইসু্যতে সরকারকে চাপে ফেলতেই সংসদে ফেরার প্রশ্নে দেয়া ১০ দফা দাবি বাদ রেখেই বিরোধী দল সংসদে যোগ দিল।
দশ মাস পর বিরোধী দলের যোগদান উপলৰে সংসদের চিত্রও ছিল ভিন্ন। সরকার ও বিরোধী দলের উপস্থিতিতে দীর্ঘদিন পর সংসদ অধিবেশনের চেয়ারগুলো যেমন ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ, তেমনি দর্শক গ্যালারিতেও তিলধারণের ঠাঁই ছিল না। সরকার ও বিরোধী দলের প্রাণবনত্ম বিতর্ক উপভোগ করতে দর্শক গ্যালারির একটি পাসের জন্য প্রতিযোগিতাও দেখা গেছে সংসদের প্রবেশমুখে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল উলেস্নখ করার মতো। আছর ও মাগরিবের নামাজের দু'দফা বিরতীতে সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যরা মেতে উঠেন একে অপরের কুশলাদী বিনিময়ে, হাত মিলিয়ে খ- আড্ডায় মেতে ওঠেন সবাই।
বিরোধী দল সংসদে যোগ দেয়ায় বিএনপির দু'জন সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও সাবেক স্পীকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের অভিষেক হলো নবম জাতীয় সংসদে। প্রায় দশ মাস আগে খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেয়া বগুড়ার দুটি আসনের উপ-নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তাঁরা শপথ নিলেও বিএনপির সংসদ বর্জনের কারণে একটি দিনের জন্যও সংসদে বসতে পারেননি।
এদিকে বিএনপির আসনবন্টনে প্রমোশন হয়েছে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের, ডিমোশন হয়েছে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর। প্রথম অধিবেশনে তিনি দুই নম্বর আসনে বসলেও বৃহস্পতিবার তাঁর আসন নির্ধারিত হয় চার নম্বর । বিরোধী দলের প্রথম সারির পাঁচটি আসনে পর্যায়ক্রমে বসেন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও সর্বশেষ এম কে আনোয়ার। বিরোধী দলের সংসদে যোগদানের সময় প্রধানমন্ত্রী অনুপস্থিত থাকলেও আসরের নামাজের বিরতির আগে বিকাল ৪ টা ২০ মিনিটে তিনি সংসদে যোগ দেন।
বিরোধী দলের উপস্থিতিতে সংসদ আরও বেশি প্রাণবনত্ম হয়ে ওঠে স্পীকারের দৃঢ়তার কারণে। সেদিন তাঁর সংসদ পরিচালনা ছিল প্রশংসনীয়। তিনি সরকারী দল থেকে মনোনীত হলেও সংসদ সদস্যদের ফোর দেয়ার ব্যাপারে ছিলেন পুরোপুরি নিরপেৰ। এক পর্যায়ে সরকারী দলের চীফ হুইপ উপাধ্যৰ আবদুস শহীদ স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এমনও বলেন, আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময়ে তৎকালীন স্পীকার বিরোধী দলকে যথাযথভাবে ফোর দিতেন না।
গত বছরের ৭ এপ্রিল সর্বশেষ সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোটের সংসদ সদস্যরা। সেই হিসাব অনুযায়ী তাঁরা টানা ৬৪ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকেন। আর মাত্র ২৬টি কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকলে সবার সংসদ সদস্যপদ শূন্য হয়ে যেত। কেননা সংবিধান অনুযায়ী টানা ৯০ কার্যদিবস সংসদে অনুপস্থিত থাকলে এমনিতেই সংসদ সদস্যপদ শূন্য হওয়ার সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। এদিক থেকে জনগণের সমালোচনা এড়াতেই বিরোধী দল ২৬ কার্যদিবস আগেই সংসদে যোগ দিয়ে একদিকে যেমন সদস্যপদ রৰা করল, তেমনি বিভিন্ন ইসু্যতে সরকারের সমালোচনার মারণাস্ত্র হানতে রাজপথের পরিবর্তে সংসদকেই বেছে নিল।
No comments