মানুষও গোলাপ হতে পারে গোলাপের শূন্যতা নেই- সালেহ আহমেদ
বিজয় তুই কেমন আছিস, ভাল তো অবশ্যই। চিঠি হাতে পেয়ে ভাবছিস হঠাৎ কি হলো দীপ্তর! ক'ঘণ্টার ব্যবধানেই বিমানে বসে বিশাল চিঠি লেখা। ভাবতেই পারিস।
ভাবার কারণ যথেষ্ট। বিমানে বসে নয়, দুবাই এয়ারপোর্টের একটা কফিশপে বসে তোকে লিখছি। সাইপ্রাসের কানেকটিং বিমানের অপেৰা করছি এ কফিশপে এসে। সহযাত্রীদের প্রায় সবাই হোটেলে চলে গেছে রেস্ট নিতে আমি যাইনি। হঠাৎ করে কেন এই চিঠি তা জানতে তোকে চিঠির শেষ পর্যন্ত যেতে হবে।সকালে ঢাকা বিমান বন্দরে তোদের বিষণ্ন মুখ আমি দেখেছি। আমার বিষণ্নতা তোরা দেখিসনি। ভেবেছিস আমি পৃথিবীর সুখী মানুষের একজন। আজ এদেশে যাচ্ছি তো কাল আরেক দেশে ভালই কাটছে আমার দিনকাল। তোদের এই ভাবনা ঠিক নয়। আমার বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে ভেতরের পৃথিবীর দূরত্ব অনেক।
দেশের বাইরে যাওয়াটা কখনও ভাল লাগে না। এতে ভাল লাগার কিছু নেই। শুধুই নিজেকে লুকিয়ে রাখা। আমার ধারণা এমনই।
বিজয় তুই কিছুটা জানিস, গত দু'বছর ধরে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায় আমি দংশিত হয়েছি। তোর ভেতর শত টন ওজনের একটা প্রশ্ন হয়ত জেগে গেল, সে যন্ত্রণা কী শেষ হয়েছে? এ প্রশ্নের জবাব পেতেও তোকে লেখাটার শেষতক যেতে হবে।
বিজয়_ তুই, মঞ্জু, বিদীপ, শামীমা, দীপালী বিয়েথা করে সংসারী হয়েছিস। তুই আর খোকন তো বাবা ডাকও শুনছিস। ব্যতিক্রম একজন সে আমি। একটা ছন্নছাড়া জীবনের ঘানি টানাই যেন আমার নিয়তি। বিজয়, তোর মনে আছে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার ক'মাস পরই তরম্নর সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়। এক সময় মনের অজানত্মেই সে বন্ধুত্ব ভালবাসায় রূপ নেয়। তরম্ন তোদেরও বন্ধু ছিল। তার কারণ ছিল তোরা আমার বন্ধু। ভালবাসা বিনিময়ে আমরা যে সময় ব্যয় করেছি, তার কিঞ্চিৎ পড়ালেখার সাথে যোগ হলে তরম্ন আমি যুগ্মভাবে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হতাম। রাজনৈতিক পরিচয় মুখ্য বিবেচিত না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিৰক হতাম। তখন কবি- আবৃত্তিকার হিসেবে আরও গ্রহণযোগ্যতা পেতাম।
কী আনন্দময় সময় আমাদের কেটেছে। জিন্সের সাথে টি-শার্ট পরা দু'জন যুবক-যুবতী বেইলি রোডে নাটক দেখেছে এক সঙ্গে, ক্রিকেট খেলা দেখতে মিরপুর স্টেডিয়ামে রোদে পুড়েছে, বৃষ্টিতে ভিজেছে দিনের পরদিন। টেনিসের ব্যাট হাতেও কম সময় ব্যয় করেনি। চিড়িয়াখানার ময়ূর, কাঠবিড়ালী এমনকি জিরাফের সঙ্গে গদ্য গড়তে কম সময় ব্যয় করেনি।
প্রকৃত অর্থেই আমরা একে আপরকে ভালবেসেছিলাম। চোখ দেখে মনের কথা পড়তে পারতাম। মুখের কথার প্রয়োজনই হতো না। সেই ভালবাসার সুতো আমিই ছিঁড়ে ফেলি। কিন্তু বিজয়, তাতে কি তরম্নকে ভুলতে পেরেছিলাম? পারিনি, এক মুহূর্তের জন্যও নয়। এক পলকের জন্যও নয়। বিজয়, তোর মনে আছে, চূড়ানত্ম পরীৰার আগে নারায়ণগঞ্জে তরম্নর বাসায় গিয়েছিলাম। বেশ আগে থেকেই এ ইচ্ছাটা আমার ছিল। তাই তরম্নর আহ্বান পেয়েই রাজি হয়ে গেলাম। দেখলাম চাঁদের সঙ্গে ওদের বসবাস। তরম্নর ব্যালকনি থেকে হাত বাড়ালেই আকাশ ছোঁয়া যায়। চাঁদের সাথে লুকোচুরি খেলা যায়। তখন আমার কেবলি মনে হচ্ছিল, সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো তরম্ন আমার জন্য নয়। তরম্ন আমার কবিতা আর আবৃত্তির ভক্ত, আমাদের ভালবাসার জন্মও ওখান থেকেই। তো কবিতা আর আকৃতির মোহ কেটে গেলে কী হবে? ভেতর থেকে আসা এমন প্রশ্নের মুখোনখি হই আমি।
আমার মনে হচ্ছিল সোনার পালঙ্কে গা এলিয়ে কবিতা পড়ে, আবৃত্তি শুনে সাময়িক কানত্মি দূর করা যায় তারপর? এই তারপরের জবাব আমি খুঁজে পাইনি বিজয়।
সেদিন আমার নিজেকে মনে হচ্ছিল ঘনকুয়াশায় গভীর সাগরে আটকে যাওয়া হতবিহ্বল এক নাবিক। কুয়াশা ভেদ করে তার পৰে জাহাজ নিয়ে সাগর পাড়ি দেয়া সম্ভব নয়, অথচ জাহাজের রসদও সব শেষ হওয়ার পথে। সিদ্ধানত্ম নিতে পারছিলাম না, কি করব! তরম্নর হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাব, না পিছিয়ে আসব। অদৃশ্য কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পাই। কে যেন আমায় বলছে দীপ্ত পিছিয়ে আস। ভালবাসা দিয়ে সব কিছু জয় করা যায় সিনেমায়, নাটকে। বাসত্মবে নয়, তুমি কি সুকানত্মকে ভুলে গেলে_ ৰুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রম্নটি।
বিজয়, সুকানত্মকে অবহেলা করার স্পর্ধা আমার নেই। পিছিয়ে আসার সিদ্ধানত্ম নিই। ক্রমশ তরম্নর কাছ থেকে দূরে চলে যেতে থাকি। কষ্ট উপশমে আড়াল থেকে তরম্নকে দেখি। তরম্নর দৃষ্টি এড়ায় না। একদিন ও হলে এলো। বলল, তোর কি হয়েছে? পালিয়ে বেড়াচ্ছিস যে!
_ না তো কিছুই হয়নি। পালিয়ে বেড়াতে যাব কেন! সামনে পরীৰা না।
_ পরীৰার কথা বলবিনে, আমি তোকে জানি। তোর ভেতরে কষ্ট বাসা বেঁধেছে। বল কি কষ্ট। আমি তোর সব কষ্ট দূর করে দেব।
_ বিশ্বাস কর, আমার কোনই কষ্ট নেই।
_ তুই কিছু লুকোচ্ছিস।
_ তোকে লুকোবার কিছু আছে আমার?
_ তাহলে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে আমাকে অপমান করছিস কেন?
_ কি বলছিস তুই! তোকে আপমান করব আমি! সেকি সম্ভব?
_ আমাকে দেখেই তুই আড়ালে চলে যাস। মোবাইল বন্ধ রাখিস। লাইব্রেরিতে তোকে পাইনে। টিএসসিতে না। এগুলো কি আমাকে অপমান নয়? বল, তোর কি হয়েছে? পিস্নজ দীপ্ত চুপ করে থাকিসনে।
বিজয় আমি চুপ থাকি। তরম্নর প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারিনি। তুই-ই বল, তরম্নর প্রশ্নের জবাব কি আমার ছিল? আমার জবাব না পেয়ে বিষণ্নমুখে সেদিন তরম্ন চলে গিয়েছিল। ক'দন কাসে আসেনি। পরীৰায় অংশ নিল না। জানলাম তরম্ন হল ছেড়ে দিয়েছে। তরম্ন হারিয়ে গেল। কী সীমাহীন যন্ত্রণায় আমার দিন কাটতে থাকল। তুই সবই জানিস। এসবের মাঝেও তোদের সাথে হেসেছি, ঘুরেছি, বেড়িয়েছি। তরম্ন সশরীরে সাথে ছিল না। কিন্তু অদৃশ্যমান তরম্ন। সে তো সব সময়ই সাথে ছিল, ছায়ার মতো।
সকালে বোর্ডিং কার্ড পেয়ে প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে ঢুকলাম, পেচনে তাকালাম। দেখলাম দরজার ওপাশে তোর, খোকনের বিষণ্ন মুখ। হাত নেড়েও চলে আসলাম না, কিছুৰণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। কেন? আর একটি মুখ দেখার জন্য। সে মুখ তরম্নর। জানি দেখতে পাব না। তবুও প্রতিদিন যেখানে যাই সেখানেই তরম্নর অপেৰা করি। আমার অপেৰার প্রহর শেষ হয় না। জানিনে কখনও শেষ হবে কি না। এমন ভাবনায় সময় থেমে থাকেনি।
আমার ভেতরটা একেবারেই ফাঁকা করে তরম্ন চলে গিয়েছে। এয়ারপোর্টে এই ফাঁকাটা আরও বিশাল মনে হলো। সেখানে আলো নেই, বাতাস নেই। আকাশ নেই, আকাশের তারা নেই, টিএসসি নেই, অপরাজেয় বাংলা নেই। আমার কবিতা নেই, আমার আবৃত্তি নেই। বসে পড়লাম। মনের অজানত্মেই হাত ঢুকে গেল কাঁধে ঝুলানো ব্যাগে। হাতের সঙ্গে বেরিয়ে এল কলম ও লেখার প্যাড। ভাবছি কী লিখব! শুরম্নটা কিভাবে হবে। ভাবতে ভাবতেই লিখে ফেললাম_ 'আমার বিশাল শূন্যতার মাঝেও গোলাপ ফোটে/ গোলাপ সৌরভ ছড়ায়, সৌন্দর্য বাড়ায়। গোলাপের শূন্যতা নেই।' ঠিক এ সময় পেন্সিল হিলের টক টক শব্দ কানে এলো। ভার্সিটির করিডরে এমন শব্দ অনেক শুনেছি। মহিলা সমিতিতেও। আমার কলম থেমে গেল। কবিতার শব্দেরা পিছু হঠল। আমি কান পাতলাম। মনে হলো, ঠিক আমার পেছনে এসে টক টক শব্দ থেমে গেল। আমার কবিতার শব্দগুলো যেন আটকে গেল শব্দহীনতায়। আমি অনুভব করলাম আমার কানের কাছে দ্রম্নত নিশ্বাস পতনের শব্দ। শব্দেরা শ্বাস নেয় এই আমি প্রথম জানলাম। আমাকে চমকে দিয়ে শব্দগুলো কথা বলতে শুরম্ন করল। আমি স্পষ্ট শুনলাম কে একজন হয়ে গেছে শব্দগুলো। সে বলছে উরঢ়ঃড়, ুড়ঁ ধৎব ঃযব ষধংঃ ঢ়ধংংবহমবৎ ড়ভ ঃযরং ভষরমযঃ. ওভ ুড়ঁ ধাধরষ ুড়ঁৎংবষভ ঃযরং ভষরমযঃ ুড়ঁ যধাব ঃড় ৎঁহ ছঁরপশ. আমি আশ্চর্য হলাম, আমার শব্দেরা তো ইংরেজি বলে না। এ তো অন্য কেউ! পেন্সিল হিলের টক টক শব্দ আবার কানে এলো। শব্দ চলে যাচ্ছে যে পথে এসেছিল সে পথেই। মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম। পেন্সিল হিলের সঙ্গে জিন্স আর কালো রঙের টি-শার্ট মাথায় প্রিন্স হ্যাট। আমার চেনা হলো না, কে এই জন। কেনইবা পেস্ননের শেষ সময়ের কথা বলে গেল। সে কি বাঙালী না বিদেশী জানা হলো না। ইউরোপীয় ধাঁচের ইংরেজী জানা আমার কোন বন্ধু আছে কিনা মনে করতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না। তরম্ন এ লেবেল করে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিল। তরম্নর ইংরেজী বলার ধরন এমন। কিন্তু তরম্ন হতে যাবে কেন! আর তরম্নর কণ্ঠ তো আমার চেনা। আমার মাথা কাজ করছে না। কিছুই বুঝতে পারছি না। মেয়েটি কেমন করে জানল আমি এই পেস্ননের যাত্রী! মেয়েটি কি পেস্নন থেকে নেমে এসেছিল! বিজয়, আমার ভেতর থেকে আসা প্রশ্নের জবাব আমি পাইনে।
পেস্ননে উঠেই বুঝতে পারলাম আমিই শেষ যাত্রী ছিলাম। পেস্ননে ওঠামাত্রই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। একজন এয়ার হোস্টেজ চিলের মতো ছোঁ মেরে হাতে ধরা টিকিট নিয়ে নিল। আসন নম্বর দেখে সঙ্গে সঙ্গেই ফেরত দিল। আসন দেখিয়ে দেয়ার সময় তার কণ্ঠে এয়ার হোস্টেজের ভালবাসা মিশ্রণ ছিল না। কয়েকজন যাত্রীকে দেখলাম অসহিষ্ণু দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। কারণটা বুঝতে পেরে আর কারও দিকে তাকাতে পারলাম না।
পেস্ননের মাঝামাঝি অবস্থানে আমার আসন। তিন আসনের সারি। মাঝেরটা আমার। আসনের সামনে দাঁড়ানো মাত্রই অবাক বিস্ময়ে আমার চোখ কপালে ওঠার মতো অবস্থা হলো। বোর্ডিং লাউঞ্জের সেই মেয়েটি বসা। জানলা গলে তার দৃষ্টি বাইরে। হয়ত ঢাকা দেখছে শেষবারের মতো। এখনও প্রিন্স হ্যাট মাথায়, মুখ দেখা যাচ্ছে না। মুখ দেখতেও ইচ্ছে হলো না। লজ্জায় কোনদিকে তাকাতে পারছিনে। মেয়েটির ওপর রাগ হলো। সে আমাকে পেস্ননের সময় মনে করিয়ে না দিলে পেস্নন চলে যেত। কিন্তু এমন অস্বসত্মিকর পরিবেশের সম্মুখীন হতে হতো না।
বিজয়, জানিস প্রায়ই আমার মনে হয় মানুষের মন সবচেয়ে এলোমেলো। একটু আগে মেয়েটার ওপর রাগ হলো। আবার পরৰণেই মনে হলো তাকে একটা ধন্যবাদ দেয়া না হলে বড় ধরনের অসৌজন্য হবে। মেয়েটি সহযোগিতা না করলে নিশ্চিত করেই বিমানে ওঠা আমার হতো না। আমার ধন্যবাদ দেয়া হলো না। যে মুহূর্তে ধন্যবাদ দেয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি শেষ করেছি, তখনই সিট বেল্ট বাঁধার ঘোষণা এলো। ঘোষিকার কণ্ঠ শুনে দেহমন জুড়িয়ে গেল। একজন আবৃত্তিকারের চেয়েও ঘোষিকার কণ্ঠের আবেদন অনেক বেশি_ অনত্মত আমার তাই মনে হলো। এরা যে কেন আবৃত্তিকার হয় না আমার বোধগম্য নয়। তাহলে আবৃত্তি শিল্পের উৎকর্ষ অনেক বেড়ে যেত।
পেস্নন চলতে শুরম্ন করেছে। রাইট টার্ন করার পর পেস্ননের গতি কিছুটা বেড়ে গেল। ইউ টার্ন করার পর গতি দ্রম্নত থেকে দ্রম্নততর হতে থাকল। বুঝতে পারলাম পেস্নন এৰণি টেক অফ করবে। টেক অফ হলো। এ সময়টা আমার কাছে সব সময়ই আকর্ষণীয়। ভাল লাগার।
আপনা আপনি পিঠ সিটের সঙ্গে মিশে যায়। আমার তরম্নর কথা মনে হয়। আজও হলো। বোটানিক্যাল গার্ডেনে, টিএসসির সড়কদ্বীপে, চিড়িয়াখানায় হাতির ওপর বসে তরম্নর পিঠে পিঠ টেকিয়ে প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় কথায় হৃদয় মন হাল্কা করেছি, হেসেছি, বাদাম চিবিয়েছি। মজার ব্যাপার কি জানিস, আমাদের দৃষ্টি থাকত দুই দিগনত্মে কিন্তু দুটো মনের মাঝে কোন স্পেস থাকত না। বিজয়, তোর নিশ্চয় মনে আছে, তুই একদিন বলেছিলি, বিয়ের আগে শরীরের উত্তাপ অনুভব করার পদ্ধতি ভালই শিখেছি। জবাব দিয়েছিল তরম্ন। বলেছিল দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আর কি। তুই তো ছিলি হিউমার মাস্টার। আর তোর হিউমারের জবাব দিত কেবলি তরম্ন।
চলিস্নশ হাজার ফিট ওপরে ওঠে স্বাভাবিক গতিতে চলছে পেস্নন। এয়ার হোস্টেজ নাসত্মার ট্রলি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে, চার তাকের ট্রলি। যাত্রীরা ইচ্ছেমতো নাসত্মা নিচ্ছে। আমার সামনে এসে থেমে গেল ট্রলি। এয়ার হোস্টেজকে দেখলাম। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। এয়ার হোস্টেজের সাবলীল মিষ্টি হাসি। সে বলল, ঝরৎ ও ধঢ়ড়ষড়মু. ও ধিং হড়ঃ সুংবষভ. চষবধংব ৎবসবসনবৎ ংযব রং ঃযব ৎবধংড়হ ুড়ঁ ধৎব রহ ঃযব ঢ়ষধহব. ঞযধশ ুড়ঁ. আমার মনে হলো আমি আবৃত্তি শুনলাম। এয়ার হোস্টেজ চলে গেল পেছনের সারিতে। বার বার আমার মনে হতে থাকল ঝযব রং ঃযব ৎবধংড়হ ুড়ঁ ধৎব রহ ঃযব ঢ়ষধহব. মেয়েটিকে দেখলাম। সে তখনও বাইরে তাকিয়ে আছে। হয়ত মেঘের আনাগোনা দেখছে। ভাবলাম মেয়েটাকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। ধন্যবাদ দেয়ার মুহূর্তে ছোট একটা সমস্যা দেখা দিল। কি বলে তাকে সম্বোধন করব। সে বাঙালী না বিদেশী জানা হয়নি। আমাকে আড়ষ্টতায় পেয়ে বসল। ঠিক এ সময় মেয়েটি নড়ে চড়ে বসল। মাথা থেকে হ্যাট খুলতে গিয়েও খুলল না। কান থেকে এয়ারফোন খুলে হাঁটুর ওপর রাখল। গান জাতীয় কিছু শুনছিল ধারণা করলাম। আমার মনে হলো মেয়েটি কিছু বলবে। প্রার্থনা করলাম মেয়েটি কিছু বলুক। আমার প্রার্থনা মঞ্জুর হলো।
বিজয়, ধৈর্য হারাসনে। মেয়েটি কে এবং কি বলল শোন। চিরচেনা কণ্ঠে বেদনা মিশ্রিত বাক্য কানে আসতেই আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা হলো আমার। আমার মনে হলো বহু কাঙ্ৰিত এভারেস্টের চূড়ায় আমি পেঁৗছে গেছি। আকাশ থেকে চাঁদ এসে যেন আমার হাতের মুঠোয় আশ্রয় নিয়েছে। আমার পাশে বসা মেয়েটি তরম্ন।
বিজয় তোকে বলতে দ্বিধা নেই, তরম্নর কাছ থেকে যত দূরে যেতে চেয়েছি তরম্ন তত কাছে চলে এসেছে। তুই যেদিন বললি, তরম্ন অস্ট্রেলিয়ায় নয়ত ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছে। সেদিন থেকে কত নিঘর্ুম রাত আমি কাটিয়েছি। তা তোরা জানিসনে। তরম্নর অনুপস্থিতিতে আমার একটা কবিতাও কবিতা হয়ে ওঠেনি। আবৃত্তির আবেদন কমেছে প্রতিদিন। বুঝতে পারলাম তরম্ন ছাড়া দীপ্ত একটা বিশালাকার জিরো। শুরম্ন হলো তরম্নকে খোঁজার পালা। ক্রিকেটপাগল তরম্নকে খুঁজেছি সিডনি, মেলবোর্ন, হোবার্টের ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। উইম্বলডনের সেন্ট্রাল কোর্টে খুঁজেছি টেনিসের ভক্ত তরম্নকে। কোথাও পাইনি। তাই তো সিদ্ধানত্ম নিলাম দেশ ছাড়ার। সুযোগ এলো ছোট্ট দেশ সাইপ্রাসে নির্বাস জীবন কাটানোর। যার জন্য দেশ ছাড়া, সে সাইপ্রাসগামী বিমানে আমার পাশে বসা। ভেবে দেখ তো, সে সময় আমার ভেতরে কেমন অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল? একজন কথাসাহিত্যিকই কেবল সে অনুভূতির কথা ব্যক্ত করতে পারে।
তরম্নর প্রথম কথা ছিল, দীপ্ত এভাবে আর কতদিন আমাকে ছেড়ে পালিয়ে বেড়াবি? আমি থ হয়ে গেলাম, নির্বাক হয়ে গেলাম। বিশাল নীরবতার চাদরে আমরা ঢাকা পড়ে গেলাম। শুধু দেখছি দু'জন দু'জনকে। অশ্রম্নসজল তরম্ন। কপোল গড়িয়ে পড়ছে সে জল। মুছিয়ে দিতে ইচ্ছে করল, পারলাম না। হ্যান্ডব্যাগ থেকে টিসু্য পেপার বের করল। আমার চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, অশ্রম্নসিক্ত দীপ্তর চোখ আমার একেবারেই অপছন্দ। কখন যে আমার চোখ অশ্রম্নসিক্ত হয়েছে বুঝতে পারিনি। বললাম, তরম্নর চোখে জল সেটা কী আমার পছন্দ! ছোট্ট করে জবাব দিল, তো ঝরাচ্ছিস কেন? তরম্নর এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারলাম না। আবার নীরবতা নেমে এলো।
চারপাশের যাত্রীরা হাসি তামাশা গল্পে মেতে রয়েছে। আমাদের মুখে কথা নেই। চার চোখ এক বিন্দুতে মিশে গেছে। কিছুৰণ পর বিন্দুটা সরে গেল ঘোষিকার ঘোষণায়। ঘোষিকা বলছে, অঃঃবহঃরড়হ ঢ়ষবধংব, যড়হড়ঁৎধনষব ঢ়ধংংবহমবৎং, বিষপড়সব ঃড় উঁনধর. চষবধংব ভধংঃবহ ুড়ঁৎ ংবধঃ নবষঃ. ঞযব অবৎড়ঢ়ষধহব রিষষ ঃধশব ড়হ রহ ধ ভব িসরহঁঃবং. ঞযধহশরহম ুড়ঁ ধষষ. বিজয়, ঢাকা এয়ারপোর্টে যে কবিতাটা লেখা শুরম্ন করেছিলাম, তার শেষ লাইনটা মাথায় উঁকি ঝুঁকি দিতে শুরম্ন করল। 'কখনও কখনও মানুষও গোলাপ হয়। সৌরভ ছড়ায়, সৌন্দর্য বিতরণ করে, শূন্যতা জয় করে।'
বিজয়, ভাল থাকিস। খুব ভাল।
No comments