মিনি পিক মৌসুম ॥ সার সঙ্কট- ০ কৃষিমন্ত্রীর দ্রুত হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে- ০ পিক মৌসুমে চাহিদা সামাল দিতে জরুরী পদক্ষেপ দরকার by কাওসার রহমান
দেশের সার পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। টানা তিন বছর সুষ্ঠুভাবে চলার পর এবার মিনি পিক মৌসুমেই দেশে সার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তিন বছরের মধ্যে এবার মজুদ সর্বনিম্ন অবস্থায় নেমে আসায় গত ঈদের পর সার সঙ্কট পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করে। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সারের জন্য রাস্তায় নেমে আসে কৃষক।
তবে কৃষিমন্ত্রীর দ্রুত হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু সার নিয়ে এখনও টানাটানি চলছে। চাহিদা অনুযায়ী শিল্প মন্ত্রণালয় সার দিতে পারছে না। কিছু মজুদ থাকায় উত্তরাঞ্চলের বাফার গুদাম থেকে সার নিয়ে কৃষকদের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা চলছে। এ অবস্থায় দ্রুত সার আমদানি শুরু করা না হলে আগামী ডিসেম্বর মাস থেকে শুরু হওয়া পিক মৌসুমে সার পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটতে পারে।
জানা যায়, টানা প্রায় পাঁচ মাস ধরে সার উৎপাদন ও বিদেশ থেকে ইউরিয়া সার আমদানি বন্ধ থাকায় দেশের সার পরিস্থিতির এবার মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। চলতি শুষ্ক মৌসুমে বিদ্যুত উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে গত মার্চ মাসের শেষ দিকে দেশের সাতটি সার কারখানার পাঁচটিতেই গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এই কারখানাগুলো হলো কাফকো, আশুগঞ্জ সার কারখানা, চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা, ঘোড়াশাল ইউরিয়া সার কারখানা এবং পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা। একই সঙ্গে সার আমদানির কার্যক্রমও বন্ধ করে দিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে। ফলে দেশের সার কারখানা ও বাফার গুদামগুলোর সারের মজুদ নিম্নপর্যায়ে নেমে আসে। একপর্যায়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বাফার গুদামগুলো সারশূন্য হয়ে পড়ে। এর বিপরীতে এবার আমনের ‘মিনি পিক’ মৌসুমে হঠাৎ করেই দেশে সারের চাহিদা বেড়ে গেলে বিভিন্ন এলাকায় সার সঙ্কট দেখা দেয়। বাফার গুদাম সারশূন্য হয়ে পড়ায় গত রোজার ঈদের পর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এই সার সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে। সার না পেয়ে ক্ষুব্ধ কৃষক রাস্তায় নেমে আসে। পরিস্থিতি সামাল দিতে স্থানীয় এমপি ও ডিসিরাও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে দ্রুত সার পাঠানোর জন্য তাগিদ দেন । একই অবস্থার সৃষ্টি হয় দেশের ময়মনসিংহ অঞ্চলের জেলাগুলোতে। এ অবস্থায় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী দ্রুত হস্তক্ষেপ করেন। তাঁর হস্তক্ষেপে একদিনের নোটিসে ‘শর্ট টেন্ডার’ করে দেশের উত্তরাঞ্চলের বাফার গুদাম থেকে সার নিয়ে যাওয়া হয় দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে। এতে কিছু সার পাওয়ার পর কৃষকদের ক্ষোভ আপাতত প্রশমিত হয়েছে। কিন্তু এখনও শিল্প মন্ত্রণালয় চাহিদা অনুযায়ী কৃষকদের সার দিতে পারছে না।
গত অর্থবছরে বোরোর পিক মৌসুমে দেশে নির্ধারিত চাহিদা অনুযায়ী সারের প্রয়োজন হয়নি। বিশেষ করে ইউরিয়ার মূল্য বৃদ্ধির পর কৃষক অযথা ইউরিয়ার ব্যবহার বন্ধ করে দিয়ে সুষম সার ব্যবহারের দিকে নজর দেয়। ফলে গত বোরো মৌসুমে ইউরিয়ার চাহিদা কমে যায়। এ কারণে শিল্প মন্ত্রণালয় গত অর্থবছরের মার্চ থেকে সার আমদানিও বন্ধ করে দেয়। এ সময় স্থানীয় ইউরিয়া সার কারখানাগুলোও গ্যাস সঙ্কটের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সারের প্রাপ্তি কমে যায়। এ সময় দুটি কারখানা উৎপাদনে থাকলেও কার্যত যমুনা সার কারখানাতেই উৎপাদন অব্যাহত থাকে। ফলে পাঁচ লাখ টনের বেশি মজুদ নিয়ে এ বছর যাত্রা শুরু হলেও প্রাপ্তির বিপরীতে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় সারের মজুদ দ্রুত কমতে থাকে।
আমন মৌসুম হচ্ছে ইউরিয়া সারের মিনি পিক মৌসুম। আর পিক মৌসুম হচ্ছে বোরো আবাদের সময়। গত তিন বছর ধরে সার কৃষকের পেছনে ছুটলেও এবার পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এবার আগস্ট মাস থেকে ইউরিয়া সারের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় সার সঙ্কট দেখা দেয়। পাঁচ লাখ টন মজুদের বিপরীতে এ বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে সরকার নির্ধারিত সারের চাহিদাই ছিল প্রায় ছয় লাখ টন। এই চাহিদা মেটাতে গিয়ে কারখানা গুদাম ও বাফার গুদামের মজুদ একেবারেই নিম্নপর্যায়ে নেমে আসে। বিশেষ করে যে সকল কারখানা বন্ধ ছিল সে কারখানাগুলোর মজুদ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে যায়। ফলে ওই কারখানাগুলোর কমান্ড এরিয়ায়ই সার সঙ্কট দেখা দেয়। একমাত্র যমুনা সার কারখানা খোলা থাকায় উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর বাফার গুদামে সারের মজুদ কিছুটা ছিল। ফলে সঙ্কট এলাকাগুলোর চাহিদা উত্তরাঞ্চলের বাফার গুদামগুলো থেকেই এখন মেটানো হচ্ছে।
কর্মকর্তারা জানান, গত দেড় মাস ধরেই সার নিয়ে টানাটানির অবস্থা চলছে। এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে নিয়ে গিয়ে সারের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। তারপরও কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী সার দেয়া যাচ্ছে না। ৫০ শতাংশ বাফার গুদাম থেকে এবং ৫০ শতাংশ যমুনা সার কারখানা থেকে নিয়ে চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। গ্যাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বহুজাতিক সার কারখানা কাফাকো উৎপাদনে যাওয়ায় এবং আমদানিকৃত ৩০ হাজার টন সার বন্দরে চলে আসায় পরিস্থিতি দ্রুত সামাল দেয়া যাচ্ছে।
জানা যায়, বরাবরের মতোই কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সক্রিয় থাকায় সঙ্কটের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি হস্তক্ষেপ করেন। মূলত তাঁর হস্তক্ষেপেই বর্তমানে সার সঙ্কট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। এক্ষেত্রে তাঁকে পূর্ণ সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এ্যাসোসিয়েশন। সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে ঈদের পরপরই বিদ্যুত উৎপাদন বন্ধ রেখে সার কারখানায় গ্যাস প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে। ইতোমধ্যে বন্ধ কারখানাগুলোতে গ্যাস প্রদান শুরু হলেও, একমাত্র কাফকো ছাড়া অন্য কোন সার কারখানা এখনও উৎপাদনে যেতে পারেনি। রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে কারখানাগুলোর উৎপাদনে যেতে সময় লাগছে। তার ওপর গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় যমুনা সার কারখানায়ও উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সার নিয়ে এবার এক আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর দুই মাস পরই ইউরিয়ার পিক মৌসুম শুরু হবে। ওই সময়ে অর্থাৎ নবেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে দেশে প্রায় ১৫ লাখ টন সারের প্রয়োজন হবে। এই বিপুল পরিমাণ সারের চাহিদা মেটানোর জন্য কারখানাগুলোতে পূর্ণোদ্যমে উৎপাদন চালু করার পাশাপাশি সার আমদানি দ্রুত কার্যকর করা প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান কামরুল আশরাফ খান বলেন, এবার মিনি পিক মৌসুমে দেশের কোন কোন স্থানে সার সঙ্কট দেখা দিলেও কৃষিমন্ত্রীর দ্রুত হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি সামাল দেয়া গেছে। তারপরও এখন ‘দিন আনি দিন খাইয়ের’ মতো অবস্থা চলছে। তাই বোরোর পিক মৌসুমকে সামনে রেখে এখন থেকেই সতর্ক হতে হবে। দেশে সারের মজুদ গড়ে তোলার জন্য জরুরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি বলেন, “এবার যেহেতু মিনি পিক মৌসুমেই সারের টান পড়েছে, তাই পিক মৌসুমেও সারের চাহিদা থাকবে। ফলে দেশীয় কারখানাগুলোর উৎপাদনের পাশাপাশি সার আমদানির কার্যক্রম দ্রুত করতে হবে। যেহেতু দেশে সার উৎপাদন ভাল অবস্থায় নেই, তাই এখন থেকেই একটানা সার আমদানি অব্যাহত রাখতে হবে। কোনভাবেই একটি টেন্ডারেও ব্যর্থ হওয়া যাবে না। তাহলেই সারের মজুদ কার্যক্রম ব্যাহত হবে না। ”
জানা যায়, ইতোমধ্যে দুই লাখ টন সার আমদানির জন্য টেন্ডার করা হয়েছে। কিন্তু ওই সার আমদানির জন্য কাকে কার্যাদেশ দেয়া হবে এ নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় গড়িমসি করছে। গত বছর সুইস সিঙ্গাপুর নামে একটি কোম্পানির আমদানি করা ইউরিয়া নিয়ে বিপত্তি ঘটেছিল। নিম্নমানের কারণে দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর ওই কোম্পানির সার সরকার গ্রহণ করেছিল। বর্তমানে সান্তাহার বাফার গুদামে সেই সার জমাট বেঁধে পাথরে পরিণত হয়েছে। সেগুলো এখন মেশিন দিয়ে গুড়া করে ডিলারদের দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ডিলাররা সেই সার নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এবারও সার আমদানির ক্ষেত্রে সেই একই কোম্পানিকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোন কারণে দ্রুত সার আমদানি কার্যক্রম ব্যাহত হলে সার পরিস্থিতি খারাপ অবস্থায় চলে যাবে।
উল্লেখ্য, এ বছর দেশে ইউরিয়া সারের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ লাখ টন। এর মধ্যে ২৪ লাখ টন মাঠ পর্যায়ের চাহিদা এবং এক লাখ টন তীব্র আপৎকালীন চাহিদা। এ চাহিদার সার স্থানীয় উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হবে। এর মধ্যে দেশীয় কারখানাগুলোতে ১০ লাখ টন সার উৎপাদন করা হবে। আর আমদানি করা হবে ১২ লাখ টন। আর তিন লাখ টন ছিল এ বছরের প্রারম্ভিক মজুদ। আমদানির ১২ লাখ টনের মধ্যে চার লাখ টন সার কাফকো থেকে সংগ্রহ করা হবে। তবে গ্যাস সঙ্কটের কারণে প্রায় পাঁচ মাস উৎপাদন বন্ধ থাকায় দেশীয় কারখানাগুলোর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এবার সার উৎপাদন সম্ভব নাও হতে পারে।
জানা যায়, টানা প্রায় পাঁচ মাস ধরে সার উৎপাদন ও বিদেশ থেকে ইউরিয়া সার আমদানি বন্ধ থাকায় দেশের সার পরিস্থিতির এবার মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। চলতি শুষ্ক মৌসুমে বিদ্যুত উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে গত মার্চ মাসের শেষ দিকে দেশের সাতটি সার কারখানার পাঁচটিতেই গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এই কারখানাগুলো হলো কাফকো, আশুগঞ্জ সার কারখানা, চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা, ঘোড়াশাল ইউরিয়া সার কারখানা এবং পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা। একই সঙ্গে সার আমদানির কার্যক্রমও বন্ধ করে দিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে। ফলে দেশের সার কারখানা ও বাফার গুদামগুলোর সারের মজুদ নিম্নপর্যায়ে নেমে আসে। একপর্যায়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বাফার গুদামগুলো সারশূন্য হয়ে পড়ে। এর বিপরীতে এবার আমনের ‘মিনি পিক’ মৌসুমে হঠাৎ করেই দেশে সারের চাহিদা বেড়ে গেলে বিভিন্ন এলাকায় সার সঙ্কট দেখা দেয়। বাফার গুদাম সারশূন্য হয়ে পড়ায় গত রোজার ঈদের পর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এই সার সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে। সার না পেয়ে ক্ষুব্ধ কৃষক রাস্তায় নেমে আসে। পরিস্থিতি সামাল দিতে স্থানীয় এমপি ও ডিসিরাও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে দ্রুত সার পাঠানোর জন্য তাগিদ দেন । একই অবস্থার সৃষ্টি হয় দেশের ময়মনসিংহ অঞ্চলের জেলাগুলোতে। এ অবস্থায় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী দ্রুত হস্তক্ষেপ করেন। তাঁর হস্তক্ষেপে একদিনের নোটিসে ‘শর্ট টেন্ডার’ করে দেশের উত্তরাঞ্চলের বাফার গুদাম থেকে সার নিয়ে যাওয়া হয় দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে। এতে কিছু সার পাওয়ার পর কৃষকদের ক্ষোভ আপাতত প্রশমিত হয়েছে। কিন্তু এখনও শিল্প মন্ত্রণালয় চাহিদা অনুযায়ী কৃষকদের সার দিতে পারছে না।
গত অর্থবছরে বোরোর পিক মৌসুমে দেশে নির্ধারিত চাহিদা অনুযায়ী সারের প্রয়োজন হয়নি। বিশেষ করে ইউরিয়ার মূল্য বৃদ্ধির পর কৃষক অযথা ইউরিয়ার ব্যবহার বন্ধ করে দিয়ে সুষম সার ব্যবহারের দিকে নজর দেয়। ফলে গত বোরো মৌসুমে ইউরিয়ার চাহিদা কমে যায়। এ কারণে শিল্প মন্ত্রণালয় গত অর্থবছরের মার্চ থেকে সার আমদানিও বন্ধ করে দেয়। এ সময় স্থানীয় ইউরিয়া সার কারখানাগুলোও গ্যাস সঙ্কটের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সারের প্রাপ্তি কমে যায়। এ সময় দুটি কারখানা উৎপাদনে থাকলেও কার্যত যমুনা সার কারখানাতেই উৎপাদন অব্যাহত থাকে। ফলে পাঁচ লাখ টনের বেশি মজুদ নিয়ে এ বছর যাত্রা শুরু হলেও প্রাপ্তির বিপরীতে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় সারের মজুদ দ্রুত কমতে থাকে।
আমন মৌসুম হচ্ছে ইউরিয়া সারের মিনি পিক মৌসুম। আর পিক মৌসুম হচ্ছে বোরো আবাদের সময়। গত তিন বছর ধরে সার কৃষকের পেছনে ছুটলেও এবার পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এবার আগস্ট মাস থেকে ইউরিয়া সারের চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় সার সঙ্কট দেখা দেয়। পাঁচ লাখ টন মজুদের বিপরীতে এ বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে সরকার নির্ধারিত সারের চাহিদাই ছিল প্রায় ছয় লাখ টন। এই চাহিদা মেটাতে গিয়ে কারখানা গুদাম ও বাফার গুদামের মজুদ একেবারেই নিম্নপর্যায়ে নেমে আসে। বিশেষ করে যে সকল কারখানা বন্ধ ছিল সে কারখানাগুলোর মজুদ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে যায়। ফলে ওই কারখানাগুলোর কমান্ড এরিয়ায়ই সার সঙ্কট দেখা দেয়। একমাত্র যমুনা সার কারখানা খোলা থাকায় উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর বাফার গুদামে সারের মজুদ কিছুটা ছিল। ফলে সঙ্কট এলাকাগুলোর চাহিদা উত্তরাঞ্চলের বাফার গুদামগুলো থেকেই এখন মেটানো হচ্ছে।
কর্মকর্তারা জানান, গত দেড় মাস ধরেই সার নিয়ে টানাটানির অবস্থা চলছে। এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে নিয়ে গিয়ে সারের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। তারপরও কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী সার দেয়া যাচ্ছে না। ৫০ শতাংশ বাফার গুদাম থেকে এবং ৫০ শতাংশ যমুনা সার কারখানা থেকে নিয়ে চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। গ্যাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বহুজাতিক সার কারখানা কাফাকো উৎপাদনে যাওয়ায় এবং আমদানিকৃত ৩০ হাজার টন সার বন্দরে চলে আসায় পরিস্থিতি দ্রুত সামাল দেয়া যাচ্ছে।
জানা যায়, বরাবরের মতোই কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সক্রিয় থাকায় সঙ্কটের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি হস্তক্ষেপ করেন। মূলত তাঁর হস্তক্ষেপেই বর্তমানে সার সঙ্কট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। এক্ষেত্রে তাঁকে পূর্ণ সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এ্যাসোসিয়েশন। সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে ঈদের পরপরই বিদ্যুত উৎপাদন বন্ধ রেখে সার কারখানায় গ্যাস প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে। ইতোমধ্যে বন্ধ কারখানাগুলোতে গ্যাস প্রদান শুরু হলেও, একমাত্র কাফকো ছাড়া অন্য কোন সার কারখানা এখনও উৎপাদনে যেতে পারেনি। রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে কারখানাগুলোর উৎপাদনে যেতে সময় লাগছে। তার ওপর গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় যমুনা সার কারখানায়ও উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সার নিয়ে এবার এক আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর দুই মাস পরই ইউরিয়ার পিক মৌসুম শুরু হবে। ওই সময়ে অর্থাৎ নবেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে দেশে প্রায় ১৫ লাখ টন সারের প্রয়োজন হবে। এই বিপুল পরিমাণ সারের চাহিদা মেটানোর জন্য কারখানাগুলোতে পূর্ণোদ্যমে উৎপাদন চালু করার পাশাপাশি সার আমদানি দ্রুত কার্যকর করা প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান কামরুল আশরাফ খান বলেন, এবার মিনি পিক মৌসুমে দেশের কোন কোন স্থানে সার সঙ্কট দেখা দিলেও কৃষিমন্ত্রীর দ্রুত হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি সামাল দেয়া গেছে। তারপরও এখন ‘দিন আনি দিন খাইয়ের’ মতো অবস্থা চলছে। তাই বোরোর পিক মৌসুমকে সামনে রেখে এখন থেকেই সতর্ক হতে হবে। দেশে সারের মজুদ গড়ে তোলার জন্য জরুরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি বলেন, “এবার যেহেতু মিনি পিক মৌসুমেই সারের টান পড়েছে, তাই পিক মৌসুমেও সারের চাহিদা থাকবে। ফলে দেশীয় কারখানাগুলোর উৎপাদনের পাশাপাশি সার আমদানির কার্যক্রম দ্রুত করতে হবে। যেহেতু দেশে সার উৎপাদন ভাল অবস্থায় নেই, তাই এখন থেকেই একটানা সার আমদানি অব্যাহত রাখতে হবে। কোনভাবেই একটি টেন্ডারেও ব্যর্থ হওয়া যাবে না। তাহলেই সারের মজুদ কার্যক্রম ব্যাহত হবে না। ”
জানা যায়, ইতোমধ্যে দুই লাখ টন সার আমদানির জন্য টেন্ডার করা হয়েছে। কিন্তু ওই সার আমদানির জন্য কাকে কার্যাদেশ দেয়া হবে এ নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় গড়িমসি করছে। গত বছর সুইস সিঙ্গাপুর নামে একটি কোম্পানির আমদানি করা ইউরিয়া নিয়ে বিপত্তি ঘটেছিল। নিম্নমানের কারণে দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর ওই কোম্পানির সার সরকার গ্রহণ করেছিল। বর্তমানে সান্তাহার বাফার গুদামে সেই সার জমাট বেঁধে পাথরে পরিণত হয়েছে। সেগুলো এখন মেশিন দিয়ে গুড়া করে ডিলারদের দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ডিলাররা সেই সার নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এবারও সার আমদানির ক্ষেত্রে সেই একই কোম্পানিকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোন কারণে দ্রুত সার আমদানি কার্যক্রম ব্যাহত হলে সার পরিস্থিতি খারাপ অবস্থায় চলে যাবে।
উল্লেখ্য, এ বছর দেশে ইউরিয়া সারের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ লাখ টন। এর মধ্যে ২৪ লাখ টন মাঠ পর্যায়ের চাহিদা এবং এক লাখ টন তীব্র আপৎকালীন চাহিদা। এ চাহিদার সার স্থানীয় উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হবে। এর মধ্যে দেশীয় কারখানাগুলোতে ১০ লাখ টন সার উৎপাদন করা হবে। আর আমদানি করা হবে ১২ লাখ টন। আর তিন লাখ টন ছিল এ বছরের প্রারম্ভিক মজুদ। আমদানির ১২ লাখ টনের মধ্যে চার লাখ টন সার কাফকো থেকে সংগ্রহ করা হবে। তবে গ্যাস সঙ্কটের কারণে প্রায় পাঁচ মাস উৎপাদন বন্ধ থাকায় দেশীয় কারখানাগুলোর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এবার সার উৎপাদন সম্ভব নাও হতে পারে।
No comments