বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উন্নয়ন পরিকল্পনা জনস্বার্থে হতে হবে by ড. এম শামসুল আলম
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১১-১৫) দলিলে জ্বালানি খাতভিত্তিক খসড়া অধ্যায়ের ওপর পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আয়োজিত 'Resolving the Energy Crises to Support Higher Growth and Employment' শীর্ষক জাতীয় সংলাপে আমি উপস্থিত ছিলাম।
এই খসড়া পরিকল্পনার ওপর আমি আমার লিখিত মতামত ও পরামর্শ সংবলিত একটি প্রতিবেদন পরিকল্পনা কমিশনে দাখিল করেছি। বিদ্যমান সংকট নিরসনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে, যাকে এই খাতের দীর্ঘমেয়াদি টেকসই আর্থিক সমৃদ্ধির পরিপন্থী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। তাই স্বল্পমূল্যে টেকসই বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন এবং বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যবহারের কৌশলগত বিষয়টি এ পরিকল্পনায় গুরুত্ব পেয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরিকল্পনা প্রস্তাবটি নিম্নরূপে খতিয়ে দেখা দরকার।
১. জ্বালানি কৌশল : বিদ্যুৎ উৎপাদন মূলত গ্যাসনির্ভর। তাই গ্যাসস্বল্পতার কারণে এই বিদ্যুৎ স্বল্পতা ও সংকট। সার, শিল্প ও কলকারখানাসহ বিভিন্ন খাতে গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি আর সম্ভব নয়। তাই বিকল্প জ্বালানি হিসেবে এলএনজি এবং বিদ্যুৎ আমদানি এই পরিকল্পনায় প্রাধান্য পেয়েছে। তা ছাড়া সম্ভাব্য সব প্রাথমিক জ্বালানি (পানি-বিদ্যুৎ, গ্যাস, কয়লা ও সৌরবিদ্যুৎ) অনুসন্ধান ও ব্যবহারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সাল নাগাদ চাহিদার ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ যেন নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পাওয়া যায়, পরিকল্পনায় সে বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
২. বিনিয়োগ কৌশল : ২০১৫ সাল নাগাদ ১১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজন ৯.০ বিলিয়ন ডলারের (৬৩ হাজার কোটি টাকা) বিনিয়োগ। পরিকল্পনায় প্রত্যাশা করা হয়েছে, এই বিনিয়োগের সিংহভাগ, অর্থাৎ ৮.০ বিলিয়ন ডলার হবে ব্যক্তি খাতের। বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য কম থাকায় একদিকে এই খাতে আশানুরূপ ব্যক্তিভিত্তিক বিনিয়োগ হয়নি, অন্যদিকে সরকারি মালিকানাধীন বিদ্যুৎ খাত ঘাটতিতে থাকে। তাই ব্যক্তিভিত্তিক বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য পর্যাপ্ত মুনাফা লাভের সুযোগ থাকতে হয়। সে জন্য সরকারি খাতের ঘাটতি পূরণ এবং ব্যক্তি খাতের মুনাফার সুযোগ সৃষ্টির জন্য গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যহার পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধিকে বিনিয়োগ-কৌশল হিসেবে এই পরিকল্পনায় দেখা হয়েছে। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক উদাহরণ অনুশীলনে বিদ্যুতের যথাযথ মূল্য নির্ধারণ নিশ্চিত করার জন্য এই পরিকল্পনায় নীতিগত সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। তা ছাড়া কয়লা উত্তোলন পদ্ধতির ব্যাপারে এবং ব্যক্তি খাতে বিদ্যুৎ বিতরণের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখার কথা বলা হয়েছে।
৩. পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ব্যয় : পরিকল্পনায় পাঁচ বছর মেয়াদি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়ন ব্যয় বাবদ বরাদ্দকৃত মোট অর্থের পরিমাণ ২০১১ সালের মূল্যমানে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরে গড়ে এক হাজার কোটি টাকা। এতে বোঝা যায়, এই অর্থ ব্যয়-বিনিয়োগ হবে সরকারি খাতে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগকৃত অর্থের হিসাব এই পরিকল্পনায় অনুপস্থিত। তা ছাড়া কী কী কার্যক্রমে সরকারি-ব্যক্তি খাতের অর্থ ব্যবহার হবে, তার বিবরণ এই পরিকল্পনায় অসম্পূর্ণ/খণ্ডিত/আংশিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে অনুপস্থিত।
৪. বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন কার্যক্রম : ব্যক্তি, সরকারি এবং ব্যক্তি-সরকারি যৌথ মালিকানায় বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন কার্যক্রম এই পরিকল্পনায় দেখানো হয়েছে। পরিকল্পনা মেয়াদে উৎপাদন হবে ৯ হাজার ৪২৬ মেগাওয়াট। তন্মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুৎ তিন হাজার ১২০ মেগাওয়াট, তেল-বিদ্যুৎ এক হাজার পাঁচ মেগাওয়াট, দ্বৈত জ্বালানি (তেল/গ্যাস) বিদ্যুৎ এক হাজার ২৭০ মেগাওয়াট এবং কয়লা-বিদ্যুৎ দুই হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। নবায়নযোগ্য জ্বালানি (বায়ু+সৌর) বিদ্যুৎ ১১৪ (১০০+১৪) মেগাওয়াট। এই বিদ্যুতের এক হাজার ১৭০ মেগাওয়াট উৎপাদন হবে সরকারি খাতে। বাদ বাকি ব্যক্তি খাতে। পাশাপাশি ৪০০ ও ২৩০ কেভি ভোল্টেজ লেভেলে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ হবে যথাক্রমে ৬৮৪ কিলোমিটার ও ২২০ কিলোমিটার। বিতরণসহ অন্য কার্যক্রমের বিবরণ এই পরিকল্পনায় নেই। কোনো ক্ষেত্রেই ব্যয় বিভাজন উল্লেখ নেই।
৫. জ্বালানি খাত উন্নয়ন কার্যক্রম : বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন কার্যক্রমের মতো গ্যাস খাত উন্নয়ন কার্যক্রমেও অসংগতি দেখা যায়। কয়লা-বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা থাকলেও সেই উৎপাদনে কয়লার উৎস উল্লেখ নেই। কয়লা খাত উন্নয়নে কর্মপরিকল্পনা ও ব্যয় বিভাজন অনুপস্থিত। নিউক্লিয়ার এনার্জি এবং রিনিউয়্যাব্ল এনার্জির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
৬. বিদ্যুৎ খাত সংস্কার : চলমান সংস্কার অব্যাহত ও টেকসই করার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক এবং এডিবির অর্থায়নে এই সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থা বিভাজন এবং বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ব্যক্তি খাত বিনিয়োগ আকর্ষণে এই খাত লাভজনক করার লক্ষ্যে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে এই পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সে লক্ষ্যে সরকার এই পরিকল্পনায় সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্লেষণ : অতএব জ্বালানিভিত্তিক ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রস্তাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে জ্বালানি সংকট নিরসন এবং স্বল্প খরচে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রয়োজনে এই পরিকল্পনা। এই প্রশ্নে পরিকল্পনায় প্রস্তাবিত জ্বালানি-কৌশল ও বিনিয়োগ-কৌশল অসংগতিপূর্ণ এবং সামঞ্জস্যহীন বলে মনে হয়। ব্যক্তি খাত বিনিয়োগ আকর্ষণে এই পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কৌশল গ্রহণের কথা বলা হয়েছে, তা যৌক্তিক বলা চলে না। গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্নে সরকারের ভর্তুকি দেওয়া এবং গ্যাস ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল গঠনের সিদ্ধান্তে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আসলে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ আকর্ষণের অন্যতম নিয়ামক নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ এবং সেই সম্পদ ব্যবহারে ব্যক্তি খাতের অবাধ সুযোগের নিশ্চয়তা। বাংলাদেশে এখন তা বড়ই অনিশ্চিত। ফলে ব্যক্তি খাতের বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতিমালা-২০০৮ ফলপ্রসূ হয়নি। কারণ স্ব-উদ্যোগে জ্বালানি সংগ্রহ করে ব্যক্তি খাত বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হয়নি। তা ছাড়া উৎপাদিত বিদ্যুতের ক্রেতাও সংগ্রহ করতে পারেনি। ফলে ব্যক্তি খাতের অযাচিত এই বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিজের উৎপাদন ব্যাহত করে সরকারকে ভর্তুকিতে জ্বালানি সরবরাহ করতে হচ্ছে; এবং উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরকার যেন কিনতে পারে, সে জন্য এই নীতিমালাও সংশোধন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সরবরাহকৃত জ্বালানি এবং উৎপাদিত বিদ্যুতের ইন্ডিকেটিভ বেঞ্চমার্ক প্রাইসও নির্ধারণ করা হয়েছে। নিজস্ব জ্বালানি সরবরাহের পাশাপাশি সরকার এ খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমদানি করে জ্বালানি সরবরাহ করছে। এমতাবস্থায় বিনিয়োগ-কৌশল হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ফলপ্রসূ হচ্ছে না। তা ছাড়া এই পরিকল্পনায় প্রস্তাবিত জ্বালানি-কৌশলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে গ্যাস ও তেল প্রাধান্য পেয়েছে। অথচ বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে আগামীতে অতিরিক্ত গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আবার আমদানঅকৃত তেলের মূল্য বৃদ্ধি আগামীতে অব্যাহত থাকবে বলে মনে হয়। এই দুই কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট নিরসনে এই পরিকল্পনা কোনো কাজে আসবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া ২০২১ সাল নাগাদ চাহিদার ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনাও বাস্তবসম্মত নয়। কারণ ব্যক্তি খাতের উৎপাদিত এই বিদ্যুৎ কেনার ব্যাপারে সরকারের কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা নেই। আমদানীকৃত বিদ্যুৎ এই পরিকল্পনা মেয়াদে পাওয়া যাবে কি না, তা জানা নেই। নিউক্লিয়ার বিদ্যুতের সম্ভাবনা আছে, তবে প্রাপ্তির নিশ্চয়তা নেই। তা ছাড়া এই পরিকল্পনা মেয়াদে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে ১১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ বর্তমানের তুলনায় দুই গুণেরও বেশি। এত বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানি এবং উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বিলি-বণ্টনের জন্য যে বিশাল সঞ্চালন, বিতরণ ও বণ্টনে ভৌত অবকাঠামো দরকার, তা তৈরি এবং উন্নয়নে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য কোনো পরিকল্পনা এ পরিকল্পনায় নেই। তদুপরি পরিকল্পনায় প্রদর্শিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়ন বাজেটে দেখা যায়, ২০১১-২০১৫ সাল নাগাদ মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ গড়ে বছরে এক হাজার কোটি টাকা। এই বরাদ্দকৃত অর্থ শুধু সরকারি খাতের কার্যক্রমের জন্য; ব্যক্তি খাতের নয়। এতেই প্রতীয়মান হয়, এই সময়ে গ্যাস ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন_এই উভয় তহবিলে সংগ্রহকৃত অর্থ পুরোপুরি ব্যবহার হবে না। তা ছাড়া সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কার্যক্রমে এই খাতের জন্য বছরে বাজেট বরাদ্দ থাকে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থসহ গ্যাস ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিলের অর্থ ও ভর্তুকি মিলিয়ে এই খাত উন্নয়নে সরকারের বিনিয়োগ হতে পারে বছরে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। এই পরিকল্পনায় এসব অর্থ ব্যবহারের কোনো কার্যক্রম খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখানেই এই পরিকল্পনার ভয়াবহ অসংগতি ও ত্রুটি। তদুপরি আরইবি চলমান বিদ্যুৎ সংস্কার বহির্ভূত। কারণ লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বিদ্যুৎ খাতের আমূল পরিবর্তন বা বদলে বিদ্যুৎ খাত ভেঙেচুরে খণ্ড-বিখণ্ড করে বাণিজ্যিকীকরণ করা হচ্ছে। এই পরিকল্পনায় নীতিমালা সংস্কারের মাধ্যমে মূল্য বৃদ্ধি করে বিদ্যুৎ খাত লাভজনক করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তা যে সম্ভব হবে না, সম্প্রতি এ খাতে সরকারের ভর্তুকি প্রদানের সিদ্ধান্ত এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল গঠনে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রফেশনাল খাত। তাই এ খাত পরিচালনায় দক্ষ ও অভিজ্ঞ পেশাজীবীদের প্রাধান্য পাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে দক্ষ পেশাভিত্তিক জনশক্তি গড়ে তোলা অপরিহার্য। কিন্তু চলমান সংস্কারে এ বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। এই পরিকল্পনায়ও তা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়নি। অবশ্য বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে অনেকটা মনোযোগী। পিডিবির উন্নতি দেখে তা-ই মনে হয়।
বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে ব্যক্তি খাত : এটা ঠিক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যক্তি খাতকে সম্পৃক্ত করার একটি ভালো দিক আছে। সরকারি খাত যেন যা খুশি তা-ই করতে না পারে, অর্থাৎ যাতে তাদের প্রভাব একচেটিয়া না হয়ে উঠতে পারে, সে জন্য ব্যক্তি খাতের অংশগ্রহণ ইতিবাচকভাবে দেখা হয়। দুটি পক্ষ থাকলে প্রতিযোগিতা হবে। কারা উৎপাদন ব্যয় কমাতে পারে, তা বোঝা যাবে_এই প্রত্যাশায় ব্যক্তি খাতের যৌক্তিকতা মেনে নেওয়া হয়। তবে ব্যক্তি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনার সময় যেন ভোক্তা এবং সরকারি ও ব্যক্তি খাত_সবার স্বার্থ সমানভাবে রক্ষা করা যায়, তা নিশ্চিত হতে হবে। কিন্তু তা নিশ্চিত করা যায়নি। বাস্তবে দেখা যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যক্তি খাতের উপস্থিতি সত্ত্বেও কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়নি। নিজের উৎপাদন (গ্যাসের অভাবে পিডিবির প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ থাকে) ব্যাহত করে সরকার ব্যক্তি খাতে গ্যাস দিচ্ছে_এটা স্বচ্ছ প্রতিযোগিতার উদাহরণ হতে পারে না। ব্যক্তি খাত মোট ব্যয়ের ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ করলেই ৭০ শতাংশ ঋণ পেতে পারে। অন্যদিকে সরকারি খাতে অর্থ বরাদ্দ একটি জটিল বিষয়। আবার প্রয়োজনীয় অর্থ সব সময় পাওয়াও যায় না। এখানেও প্রতিযোগিতা অসম। তা ছাড়া উৎপাদন ক্ষমতা সরকারি খাতে ব্যবহার হয় ৫৩ শতাংশ, আর ব্যক্তি খাতে প্রায় ৮০ শতাংশ। এর পরও পিডিবির প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট গ্যাস-বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় প্রতি এককে ১.৪৯ টাকা। বাল্ক বিদ্যুতের গড় বিক্রয়মূল্য ২.৩৭ টাকা হলে কি বলা যায় বিদ্যুতের মূল্যহার কম এবং বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে তা বৃদ্ধি আবশ্যক? এ অবস্থা দেখে মনে হয়, সরকারি খাতকে পিছিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। অথচ সরকারি খাত স্বাভাবিক গতিতে চললে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কম হতো। অনেক বেশি দামে ব্যক্তি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনার ফলে প্রতিযোগিতা তো তৈরি হয়নি, বরং বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় অনেক বেড়েছে। তাই বিদ্যুৎ সংকটের পাশাপাশি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতায় ভোক্তারা চাপের মধ্যে আছে।
জ্বালানি খরচ বাদ দিলে মুনাফাসহ আইপিপির বিদ্যুৎ যেখানে প্রতি ইউনিটের দাম ৭০ পয়সার ওপরে ওঠে না, সেখানে ব্যক্তি খাতকে সংকটের অজুহাতে যদি ২ টাকা ১১ পয়সা দাম দেওয়া হয়, তাহলে ব্যক্তি খাত যেমন প্রচুর মুনাফা অর্জনের সুযোগ পায়, প্রতিযোগিতার বাজার তেমনি অন্ধকারে খাবি খায়। বাজারে আমদানীকৃত সয়াবিন তেলের যে অবস্থা, বিদ্যুতেরও কি এখন সেই অবস্থা নয়? বিদ্যুৎ খাতকে সরকার তথা জনগণের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে উৎপাদনের একটি বড় অংশ সরকারের মালিকানায় হতে হবে এবং ব্যক্তি খাতের বিদ্যুৎ যৌক্তিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ দামে কিনতে হবে। বিশ্বব্যাংক ব্যক্তি খাতের উৎসাহদাতা। সেই বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়নই হচ্ছে, বাংলাদেশে বিদ্যুতে ব্যক্তি খাত ব্যর্থ। সরকারি খাত দক্ষ ছিল না বলে ব্যক্তি খাতকে আনা হয়। আবার এখন সরকার এবং ব্যক্তি খাত_এই উভয়ের যৌথ অংশীদারিত্ব বা মালিকানায় এই খাত উন্নয়ন হবে, এমন পরামর্শ বিশ্বব্যাংকের। পরিকল্পনায় বিনিয়োগ-কৌশলে এই পরামর্শ অনুসরণ করা হয়েছে। এই পরামর্শ যথাযথ গবেষণা ও পরীক্ষিত না হওয়ায় তার সফলতার ব্যাপারে সংশয় রয়েছে।
(দ্বিতীয় অংশ রবিবার)
লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
১. জ্বালানি কৌশল : বিদ্যুৎ উৎপাদন মূলত গ্যাসনির্ভর। তাই গ্যাসস্বল্পতার কারণে এই বিদ্যুৎ স্বল্পতা ও সংকট। সার, শিল্প ও কলকারখানাসহ বিভিন্ন খাতে গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি আর সম্ভব নয়। তাই বিকল্প জ্বালানি হিসেবে এলএনজি এবং বিদ্যুৎ আমদানি এই পরিকল্পনায় প্রাধান্য পেয়েছে। তা ছাড়া সম্ভাব্য সব প্রাথমিক জ্বালানি (পানি-বিদ্যুৎ, গ্যাস, কয়লা ও সৌরবিদ্যুৎ) অনুসন্ধান ও ব্যবহারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সাল নাগাদ চাহিদার ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ যেন নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পাওয়া যায়, পরিকল্পনায় সে বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
২. বিনিয়োগ কৌশল : ২০১৫ সাল নাগাদ ১১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজন ৯.০ বিলিয়ন ডলারের (৬৩ হাজার কোটি টাকা) বিনিয়োগ। পরিকল্পনায় প্রত্যাশা করা হয়েছে, এই বিনিয়োগের সিংহভাগ, অর্থাৎ ৮.০ বিলিয়ন ডলার হবে ব্যক্তি খাতের। বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য কম থাকায় একদিকে এই খাতে আশানুরূপ ব্যক্তিভিত্তিক বিনিয়োগ হয়নি, অন্যদিকে সরকারি মালিকানাধীন বিদ্যুৎ খাত ঘাটতিতে থাকে। তাই ব্যক্তিভিত্তিক বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য পর্যাপ্ত মুনাফা লাভের সুযোগ থাকতে হয়। সে জন্য সরকারি খাতের ঘাটতি পূরণ এবং ব্যক্তি খাতের মুনাফার সুযোগ সৃষ্টির জন্য গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যহার পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধিকে বিনিয়োগ-কৌশল হিসেবে এই পরিকল্পনায় দেখা হয়েছে। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক উদাহরণ অনুশীলনে বিদ্যুতের যথাযথ মূল্য নির্ধারণ নিশ্চিত করার জন্য এই পরিকল্পনায় নীতিগত সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। তা ছাড়া কয়লা উত্তোলন পদ্ধতির ব্যাপারে এবং ব্যক্তি খাতে বিদ্যুৎ বিতরণের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখার কথা বলা হয়েছে।
৩. পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ব্যয় : পরিকল্পনায় পাঁচ বছর মেয়াদি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়ন ব্যয় বাবদ বরাদ্দকৃত মোট অর্থের পরিমাণ ২০১১ সালের মূল্যমানে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরে গড়ে এক হাজার কোটি টাকা। এতে বোঝা যায়, এই অর্থ ব্যয়-বিনিয়োগ হবে সরকারি খাতে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগকৃত অর্থের হিসাব এই পরিকল্পনায় অনুপস্থিত। তা ছাড়া কী কী কার্যক্রমে সরকারি-ব্যক্তি খাতের অর্থ ব্যবহার হবে, তার বিবরণ এই পরিকল্পনায় অসম্পূর্ণ/খণ্ডিত/আংশিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে অনুপস্থিত।
৪. বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন কার্যক্রম : ব্যক্তি, সরকারি এবং ব্যক্তি-সরকারি যৌথ মালিকানায় বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন কার্যক্রম এই পরিকল্পনায় দেখানো হয়েছে। পরিকল্পনা মেয়াদে উৎপাদন হবে ৯ হাজার ৪২৬ মেগাওয়াট। তন্মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুৎ তিন হাজার ১২০ মেগাওয়াট, তেল-বিদ্যুৎ এক হাজার পাঁচ মেগাওয়াট, দ্বৈত জ্বালানি (তেল/গ্যাস) বিদ্যুৎ এক হাজার ২৭০ মেগাওয়াট এবং কয়লা-বিদ্যুৎ দুই হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। নবায়নযোগ্য জ্বালানি (বায়ু+সৌর) বিদ্যুৎ ১১৪ (১০০+১৪) মেগাওয়াট। এই বিদ্যুতের এক হাজার ১৭০ মেগাওয়াট উৎপাদন হবে সরকারি খাতে। বাদ বাকি ব্যক্তি খাতে। পাশাপাশি ৪০০ ও ২৩০ কেভি ভোল্টেজ লেভেলে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ হবে যথাক্রমে ৬৮৪ কিলোমিটার ও ২২০ কিলোমিটার। বিতরণসহ অন্য কার্যক্রমের বিবরণ এই পরিকল্পনায় নেই। কোনো ক্ষেত্রেই ব্যয় বিভাজন উল্লেখ নেই।
৫. জ্বালানি খাত উন্নয়ন কার্যক্রম : বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন কার্যক্রমের মতো গ্যাস খাত উন্নয়ন কার্যক্রমেও অসংগতি দেখা যায়। কয়লা-বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা থাকলেও সেই উৎপাদনে কয়লার উৎস উল্লেখ নেই। কয়লা খাত উন্নয়নে কর্মপরিকল্পনা ও ব্যয় বিভাজন অনুপস্থিত। নিউক্লিয়ার এনার্জি এবং রিনিউয়্যাব্ল এনার্জির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
৬. বিদ্যুৎ খাত সংস্কার : চলমান সংস্কার অব্যাহত ও টেকসই করার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক এবং এডিবির অর্থায়নে এই সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থা বিভাজন এবং বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ব্যক্তি খাত বিনিয়োগ আকর্ষণে এই খাত লাভজনক করার লক্ষ্যে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে এই পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সে লক্ষ্যে সরকার এই পরিকল্পনায় সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্লেষণ : অতএব জ্বালানিভিত্তিক ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রস্তাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে জ্বালানি সংকট নিরসন এবং স্বল্প খরচে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রয়োজনে এই পরিকল্পনা। এই প্রশ্নে পরিকল্পনায় প্রস্তাবিত জ্বালানি-কৌশল ও বিনিয়োগ-কৌশল অসংগতিপূর্ণ এবং সামঞ্জস্যহীন বলে মনে হয়। ব্যক্তি খাত বিনিয়োগ আকর্ষণে এই পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কৌশল গ্রহণের কথা বলা হয়েছে, তা যৌক্তিক বলা চলে না। গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্নে সরকারের ভর্তুকি দেওয়া এবং গ্যাস ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল গঠনের সিদ্ধান্তে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আসলে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ আকর্ষণের অন্যতম নিয়ামক নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ এবং সেই সম্পদ ব্যবহারে ব্যক্তি খাতের অবাধ সুযোগের নিশ্চয়তা। বাংলাদেশে এখন তা বড়ই অনিশ্চিত। ফলে ব্যক্তি খাতের বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতিমালা-২০০৮ ফলপ্রসূ হয়নি। কারণ স্ব-উদ্যোগে জ্বালানি সংগ্রহ করে ব্যক্তি খাত বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হয়নি। তা ছাড়া উৎপাদিত বিদ্যুতের ক্রেতাও সংগ্রহ করতে পারেনি। ফলে ব্যক্তি খাতের অযাচিত এই বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিজের উৎপাদন ব্যাহত করে সরকারকে ভর্তুকিতে জ্বালানি সরবরাহ করতে হচ্ছে; এবং উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরকার যেন কিনতে পারে, সে জন্য এই নীতিমালাও সংশোধন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সরবরাহকৃত জ্বালানি এবং উৎপাদিত বিদ্যুতের ইন্ডিকেটিভ বেঞ্চমার্ক প্রাইসও নির্ধারণ করা হয়েছে। নিজস্ব জ্বালানি সরবরাহের পাশাপাশি সরকার এ খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমদানি করে জ্বালানি সরবরাহ করছে। এমতাবস্থায় বিনিয়োগ-কৌশল হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ফলপ্রসূ হচ্ছে না। তা ছাড়া এই পরিকল্পনায় প্রস্তাবিত জ্বালানি-কৌশলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে গ্যাস ও তেল প্রাধান্য পেয়েছে। অথচ বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে আগামীতে অতিরিক্ত গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আবার আমদানঅকৃত তেলের মূল্য বৃদ্ধি আগামীতে অব্যাহত থাকবে বলে মনে হয়। এই দুই কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট নিরসনে এই পরিকল্পনা কোনো কাজে আসবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া ২০২১ সাল নাগাদ চাহিদার ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনাও বাস্তবসম্মত নয়। কারণ ব্যক্তি খাতের উৎপাদিত এই বিদ্যুৎ কেনার ব্যাপারে সরকারের কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা নেই। আমদানীকৃত বিদ্যুৎ এই পরিকল্পনা মেয়াদে পাওয়া যাবে কি না, তা জানা নেই। নিউক্লিয়ার বিদ্যুতের সম্ভাবনা আছে, তবে প্রাপ্তির নিশ্চয়তা নেই। তা ছাড়া এই পরিকল্পনা মেয়াদে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে ১১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ বর্তমানের তুলনায় দুই গুণেরও বেশি। এত বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানি এবং উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বিলি-বণ্টনের জন্য যে বিশাল সঞ্চালন, বিতরণ ও বণ্টনে ভৌত অবকাঠামো দরকার, তা তৈরি এবং উন্নয়নে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য কোনো পরিকল্পনা এ পরিকল্পনায় নেই। তদুপরি পরিকল্পনায় প্রদর্শিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়ন বাজেটে দেখা যায়, ২০১১-২০১৫ সাল নাগাদ মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ গড়ে বছরে এক হাজার কোটি টাকা। এই বরাদ্দকৃত অর্থ শুধু সরকারি খাতের কার্যক্রমের জন্য; ব্যক্তি খাতের নয়। এতেই প্রতীয়মান হয়, এই সময়ে গ্যাস ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন_এই উভয় তহবিলে সংগ্রহকৃত অর্থ পুরোপুরি ব্যবহার হবে না। তা ছাড়া সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কার্যক্রমে এই খাতের জন্য বছরে বাজেট বরাদ্দ থাকে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থসহ গ্যাস ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিলের অর্থ ও ভর্তুকি মিলিয়ে এই খাত উন্নয়নে সরকারের বিনিয়োগ হতে পারে বছরে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। এই পরিকল্পনায় এসব অর্থ ব্যবহারের কোনো কার্যক্রম খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখানেই এই পরিকল্পনার ভয়াবহ অসংগতি ও ত্রুটি। তদুপরি আরইবি চলমান বিদ্যুৎ সংস্কার বহির্ভূত। কারণ লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বিদ্যুৎ খাতের আমূল পরিবর্তন বা বদলে বিদ্যুৎ খাত ভেঙেচুরে খণ্ড-বিখণ্ড করে বাণিজ্যিকীকরণ করা হচ্ছে। এই পরিকল্পনায় নীতিমালা সংস্কারের মাধ্যমে মূল্য বৃদ্ধি করে বিদ্যুৎ খাত লাভজনক করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তা যে সম্ভব হবে না, সম্প্রতি এ খাতে সরকারের ভর্তুকি প্রদানের সিদ্ধান্ত এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল গঠনে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রফেশনাল খাত। তাই এ খাত পরিচালনায় দক্ষ ও অভিজ্ঞ পেশাজীবীদের প্রাধান্য পাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে দক্ষ পেশাভিত্তিক জনশক্তি গড়ে তোলা অপরিহার্য। কিন্তু চলমান সংস্কারে এ বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। এই পরিকল্পনায়ও তা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়নি। অবশ্য বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে অনেকটা মনোযোগী। পিডিবির উন্নতি দেখে তা-ই মনে হয়।
বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে ব্যক্তি খাত : এটা ঠিক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যক্তি খাতকে সম্পৃক্ত করার একটি ভালো দিক আছে। সরকারি খাত যেন যা খুশি তা-ই করতে না পারে, অর্থাৎ যাতে তাদের প্রভাব একচেটিয়া না হয়ে উঠতে পারে, সে জন্য ব্যক্তি খাতের অংশগ্রহণ ইতিবাচকভাবে দেখা হয়। দুটি পক্ষ থাকলে প্রতিযোগিতা হবে। কারা উৎপাদন ব্যয় কমাতে পারে, তা বোঝা যাবে_এই প্রত্যাশায় ব্যক্তি খাতের যৌক্তিকতা মেনে নেওয়া হয়। তবে ব্যক্তি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনার সময় যেন ভোক্তা এবং সরকারি ও ব্যক্তি খাত_সবার স্বার্থ সমানভাবে রক্ষা করা যায়, তা নিশ্চিত হতে হবে। কিন্তু তা নিশ্চিত করা যায়নি। বাস্তবে দেখা যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যক্তি খাতের উপস্থিতি সত্ত্বেও কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়নি। নিজের উৎপাদন (গ্যাসের অভাবে পিডিবির প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ থাকে) ব্যাহত করে সরকার ব্যক্তি খাতে গ্যাস দিচ্ছে_এটা স্বচ্ছ প্রতিযোগিতার উদাহরণ হতে পারে না। ব্যক্তি খাত মোট ব্যয়ের ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ করলেই ৭০ শতাংশ ঋণ পেতে পারে। অন্যদিকে সরকারি খাতে অর্থ বরাদ্দ একটি জটিল বিষয়। আবার প্রয়োজনীয় অর্থ সব সময় পাওয়াও যায় না। এখানেও প্রতিযোগিতা অসম। তা ছাড়া উৎপাদন ক্ষমতা সরকারি খাতে ব্যবহার হয় ৫৩ শতাংশ, আর ব্যক্তি খাতে প্রায় ৮০ শতাংশ। এর পরও পিডিবির প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট গ্যাস-বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় প্রতি এককে ১.৪৯ টাকা। বাল্ক বিদ্যুতের গড় বিক্রয়মূল্য ২.৩৭ টাকা হলে কি বলা যায় বিদ্যুতের মূল্যহার কম এবং বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে তা বৃদ্ধি আবশ্যক? এ অবস্থা দেখে মনে হয়, সরকারি খাতকে পিছিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। অথচ সরকারি খাত স্বাভাবিক গতিতে চললে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কম হতো। অনেক বেশি দামে ব্যক্তি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনার ফলে প্রতিযোগিতা তো তৈরি হয়নি, বরং বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় অনেক বেড়েছে। তাই বিদ্যুৎ সংকটের পাশাপাশি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতায় ভোক্তারা চাপের মধ্যে আছে।
জ্বালানি খরচ বাদ দিলে মুনাফাসহ আইপিপির বিদ্যুৎ যেখানে প্রতি ইউনিটের দাম ৭০ পয়সার ওপরে ওঠে না, সেখানে ব্যক্তি খাতকে সংকটের অজুহাতে যদি ২ টাকা ১১ পয়সা দাম দেওয়া হয়, তাহলে ব্যক্তি খাত যেমন প্রচুর মুনাফা অর্জনের সুযোগ পায়, প্রতিযোগিতার বাজার তেমনি অন্ধকারে খাবি খায়। বাজারে আমদানীকৃত সয়াবিন তেলের যে অবস্থা, বিদ্যুতেরও কি এখন সেই অবস্থা নয়? বিদ্যুৎ খাতকে সরকার তথা জনগণের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে উৎপাদনের একটি বড় অংশ সরকারের মালিকানায় হতে হবে এবং ব্যক্তি খাতের বিদ্যুৎ যৌক্তিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ দামে কিনতে হবে। বিশ্বব্যাংক ব্যক্তি খাতের উৎসাহদাতা। সেই বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়নই হচ্ছে, বাংলাদেশে বিদ্যুতে ব্যক্তি খাত ব্যর্থ। সরকারি খাত দক্ষ ছিল না বলে ব্যক্তি খাতকে আনা হয়। আবার এখন সরকার এবং ব্যক্তি খাত_এই উভয়ের যৌথ অংশীদারিত্ব বা মালিকানায় এই খাত উন্নয়ন হবে, এমন পরামর্শ বিশ্বব্যাংকের। পরিকল্পনায় বিনিয়োগ-কৌশলে এই পরামর্শ অনুসরণ করা হয়েছে। এই পরামর্শ যথাযথ গবেষণা ও পরীক্ষিত না হওয়ায় তার সফলতার ব্যাপারে সংশয় রয়েছে।
(দ্বিতীয় অংশ রবিবার)
লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
No comments