এনার্জি ড্রিঙ্কসের মধ্যে ভায়াগ্রার উপাদান, সাবধান!- সাতটি কোমল পানীয়তে মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইন by গাফফার খান চৌধুরী
শিশুদের জন্য তৈরি অনেক কোমল পানীয়তে
ভায়াগ্রা উৎপাদনকারী পদার্থের অস্তিত্বও মিলেছে। এ নিয়ে রীতিমতো তোলপাড়
শুরু হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর এনার্জি ড্রিংকসের পাশাপাশি
শিশুদের জন্য তৈরি কোমল পানীয়রও পরীক্ষা শুরু করে।
আর
তাতেই মেলে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। এরপরই বাজারে পাওয়া যায় এমন প্রায় সব
শিশুখাদ্য ও কোমল পানীয় নিয়ে নতুন করে কাজ শুরু হয়েছে। সম্প্রতি ক্ষতিকর
পদার্থ থাকায় যে সাতটি কোমল পানীয়র বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে
ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে সেগুলো দিব্যি বাজারে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি ৬ মাস
পর পর বিএসটিআই অনুমোদিত পণ্যের মনিটরিং করার কথা থাকলেও তা মানা হয় না।
অনেক সময় টাকার জোরে নিয়মকানুন না মেনেই অনেক কোম্পানি কোমল পানীয় উৎপাদনের
লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছে। আর অনুমোদন পাওয়ার পরই ইচ্ছেমতো মাদকজাতীয় দ্রব্য
দিয়ে এনর্জি ড্রিংকস তৈরি করছে। এমন বিশটি এনার্জি ড্রিংকস বিষয়ে তদন্ত
শুরু হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোমল পানীয় দেশ বিদেশে দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এক সময় পেপসি, ফান্টা, সেভেনআপসহ নামকরা কিছু বিশ্বমানের কোমল পানীয়রই প্রচলন ছিল। এখন এসব বিশ্বখ্যাত কোমল পানীয়র পাশাপাশি দেশী অনেক কোমল পানীয় বাজার দখল করে নিয়েছে।
‘দেশী পণ্য খেয়ে হও ধন্য বা দেশের টাকা দেশে রাখতে, দেশের তৈরি পণ্য ব্যবহার করি।’ এমন নানা চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে দেশের প্রতি মমত্ববোধ জাগিয়ে তুলে অসাধু ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যেই হাতিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
অথচ বিএসটিআইয়ের নিয়মানুযায়ী, পণ্য উৎপাদনের মেয়াদ, মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ, মূল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম ও ঠিকানা, সর্বোচ খুচরা মূল্য, পণ্যের গুণগতমানের চিহ্ন বা উৎপাদক ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নাম এবং ঠিকানা অবশ্যই পণ্যের গায়ে থাকতে হবে। খাদ্য ও পানীয়র ক্ষেত্রে পণ্যের লেবেল বা মোড়ক থাকতে হবে। মোড়কে পানীয়র রং, ফ্লেভার, প্রিজারভেটিভ ও আর্টিফিশিয়াল সুইটনার লিপিবদ্ধ থাকা বাধ্যতামূলক। পানীয়তে কোন তেজস্ক্রিয় আছে কিনা তাও লিখতে হবে। পানীয় সঠিক পরিবেশে উৎপাদিত হচ্ছে কি-না এবং উৎপাদনের ক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কি-না তা মনিটরিং করবে বিএসটিআই।
সরাসরি কারখানা থেকে কোমল পানীয় সংগ্রহ করে বিএসটিআই তা তাদের নিজস্ব পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করবে। প্রতিটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই কেবলমাত্র বিএসটিআই ওই পানীয় বা পণ্যের লাইসেন্স দিতে পারবে। অন্যথায় দেয়ার ন্যূনতম কোন সুযোগ নেই।
কোমল পানীয়র ক্ষেত্রে বাৎসরিক ন্যূনতম লাইসেন্স ফি ১৮৭৫ টাকা। আর সর্বোচ্চ লাইসেন্স ফি ১৫ লাখ টাকা। বিএসটিআইর লাইসেন্স পাওয়ার আগে কোনক্রমেই কোন কোমল পানীয় বা অন্য কোন পণ্য বাজারজাত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আইন অমান্যকারীদের বিষয়ে বিধি মোতাবেক কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রয়েছে। এমনকি পণ্যের উৎপাদনসহ পুরো কোম্পানি সিলগালা করে দেয়ার বিধান আছে। প্রতি ৩ বছর পর পণ্যের মান যাচাইপূর্বক লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে।
বিএসটিআই সূত্রে জানা গেছে, বাজারে কি পরিমাণ কোমল পানীয় ও শিশুদের কোমল পানীয় আছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই তাদের কাছে। এর কোন সঠিক মনিটরিং হয় না। শুধু মনিটরিংয়ের নামে বিএসটিআইয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাদের পকেট ভারি হয়। ৩ বছর পর পর রীতিমতো লাইসেন্স নবায়ন করার কথা। লাইসেন্স নবায়নের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদিত পণ্যের বিষয়েও মনিটরিং হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। দীর্ঘ বছর পরেও অনেক পণ্যের মনিটরিং হয় না। প্রয়োজনও হয় না। কারণ নির্ধারিত সময়ের আগেই বিএসটিআইয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের কাছে চলে যায় মোটা অঙ্কের নজরানা। ফলে মনিটরিংয়ের আর প্রয়োজন পড়ে না।
বিএসটিআইয়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বাজারে প্রচলিত অধিকাংশ পণ্যের গায়ে বিএসটিআই অনুমোদিত লেখা যে সিল দেয়া থাকে তা নকল। এসব নকল সিলও আসল সিলের মতো তৈরি করে বিএসটিআইয়ের কোন কোন অসাধু কর্মকর্তা তা ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করে থাকেন। আবার অনেক অখ্যাত কোমল পানীয়র মালিক নিজেরাই বিএসটিআইয়ের সিল লাগিয়ে দেয়। যতদিন বিষয়টি বিএসটিআইয়ের নজরে আসে ততদিনে ওই কোম্পানি হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা।
সবচেয়ে অবাক বিষয় কোন কোন শিশু খাদ্যের গায়ে যে বিএসটিআইয়ের হলোগ্রাম লাগানো থাকে তা নকল। বাজারে কম করে হলেও অন্তত ৫শ’ প্রকার শিশুখাদ্য রয়েছে যাদের কোন লাইসেন্সই নেই। অনেক পণ্যের উৎপাদনের মেয়াদ ও উত্তীর্ণ মেয়াদও লেখা থাকে না। অধিকাংশ পণ্যের গায়ে থাকা বিএসটিআইয়ের লাইসেন্সের ছাপ এতই দুর্বল যে দেখেই বোঝা যায় এটি নকল বিএসটিআইয়ের সিল।
অথচ প্রতিটি শিশু খাদ্যের গায়েই ‘বিএসটিআই কর্তৃক অনুমোদিত’ লেখা আছে। এ ধরনের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিএসটিআইয়ের উর্ধতন কর্মকর্তা এবং ফিল্ড অফিসারদের যোগসাজশ রয়েছে। কারণ মাঠ পর্যায়ে বিক্রীত পণ্য বিএসটিআইর অনুমোদিত কি-না তা দেখভালের দায়িত্ব থাকে ফিল্ড অফিসারের। কোন কোন পণ্য বাজারে ব্যাপকহারে চালু হলে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষাই হয় না। কারণ ফিল্ড অফিসার কোম্পানিতে যাওয়া মাত্র তার সব পকেট টাকায় ভরে যায়! আবার পকেটে টাকা ধরার মতো জায়গা না থাকলে চেক ইস্যু হয়ে যায়!
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, কোমল পানীয়র ক্ষেত্রে এ চিত্র আরও ভয়াবহ। বাজারে এমন অনেক কোমল পানীয় আছে যা যৌনশক্তি বর্ধক বৃদ্ধি পায়। অথচ এসব কোমল পানীয়র গায়ে বিএসটিআইয়ের সিল আছে, যা রীতিমতো আতঙ্কের বিষয়। এসব কোমল পানীয় দীর্ঘ দিন সেবন করলে সেবনকারী মারাত্মক জটিল রোগে আক্রান্ত হতে বাধ্য। যদিও নিয়মানুযায়ী বিএসটিআই অনুমোদিত প্রতিটি পণ্যের প্রতি ৬ মাস পর মান মনিটরিং করার কথা।
পণ্যের গুণগতমান প্রতি ৬ মাস পর পর মনিটরিং করা হয় কি-না জানতে চেয়েছিলাম বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এ কে ফজলুল আহাদের কাছে। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, বিএসটিআইয়ে প্রয়োজনীয় জনবল নেই। তাই ইচ্ছে থাকলেও অনেক সময়ই নিয়মমাফিক সবকিছু মেনটেন করা সম্ভব হয় না। ৩ বছর পর পর লাইসেন্স নবায়ন করা কথা। লাইসেন্স নবায়নের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদিত পণ্যের গুণগতমানও দেখা হয়। বর্তমানে প্রতি ৬ মাস পর বিএসটিআই অনুমোদিত প্রতিটি পণ্যের মান যাচাই করা হয়ে থাকে। তবে প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় হয়ত অনেক সময় তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে কোনক্রমেই তা মাস পেরোয় না।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি সাতটি কোমল পানীয় সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এর মধ্যে রয়েছে ভিগো-বি, ম্যানপাওয়ার, হর্স ফিলিংস, রয়েল টাইগার, ব্ল্যাক হর্স ও স্পিডসহ ৭টি। এসব পানীয় এনার্জি ড্রিংকস হিসেবে বাজারে চলছে। এরমধ্যে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর পদার্থ আছে। এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব কোমল পানীয় বাজারে দিব্যি চলছে। এমনকি এসব কোমল পানীয়র অহরহ বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বিএসটিআই মহাপরিচালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জনকণ্ঠুকে বলেন, এ ধরনের পানীয় যে বাজারে আছে, তা আমার জানা নেই। অবশ্যই দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, প্রাণের জুস সম্পর্কে অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিএসটিআইয়ের তরফ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, সারাদেশে প্রাণের ম্যাংগো জুসসহ সব ধরনের কোমল পানীয় দেদার বিক্রি হচ্ছে। মহাপরিচালক আরও জানান, অনেক সময় কোমল পানীয় বা অন্যান্য দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নিয়ম মেনেই বিএসটিআইয়ের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়। কিন্তু অনুমোদন নেয়ার পর তারা নিজেদের মতো ভেজাল পণ্য উৎপাদন শুরু করে। বিষয়টি বিএসটিআইয়ের জানা। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে সব সময়ই তা ভালভাবে মনিটরিং করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে ভবিষ্যতে মনিটরিং আরও জোরদার করা হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের যে ল্যাবরেটরিতে কোমল পানীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে সেই ল্যাবরেটরির মান নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর নিজেই পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয়। আর রিপোর্টটি অন্তত ৭ থেকে ৮ মাস আগে তৈরি।
এ বিষয়ে একমত পোষণ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল জনকণ্ঠকে জানান, তাদের ল্যাবরেটরি আন্তর্জাতিকমানের নয়। তবে আন্তর্জাতিকমানের করে গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি যে সাতটি এনার্জি ড্রিংকস সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে তাতে উচ্চ মাত্রার ক্যাফেইন আছে, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। আন্তর্জাতিকমান অনুযায়ী প্রতি মিলিলিটারে যদি ২৫ ভাগ ক্যাফেইন থাকে তাও উচ্চ মাত্রার। কিন্ত যে ৭টি এনার্জি ড্রিংকস সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে তাতে শতকরা ৮০ ভাগের মতো ক্যাফেইন আছে। যা মানবদেহের জন্য রীতিমতো হুমকিস্বরূপ।
তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে অতি আগ্রহের সঙ্গে জনকণ্ঠকে আরও জানান, বাজারে প্রচলিত শিশুদের জন্য তৈরি কোমল পানীয়ও সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে থাকি আমরা। সম্প্রতি বাজার থেকে সংগৃহীত একটি শিশুদের কোমল পানীয়তে ভায়াগ্রা উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত কেমিক্যাল পাওয়া গেছে। অনেক সময় কেউ কেউ অসৎ উদ্দেশ্যে এসব কেমিক্যালযুক্ত কোমল পানীয় শিশু বা কিশোরদের পান করাতে পারে। ওসব কোমল পানীয় পান করার পর শিশু কিশোররা অস্বাভাবিক অচরণ করতে পারে। বাজার থেকে এনার্জি ড্রিংকস সংগ্রহ করা হচ্ছে। এসব ড্রিংকস আমাদের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। তবে তিনি জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপচারিতায় অবলীলায় স্বীকার করেছেন, তাদের কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি আন্তর্জাতিকমানের হয়ে গড়ে ওঠেনি। তবে চেষ্টা অব্যাহত আছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, কোমল পানীয়র বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হলে অদূর ভবিষ্যতে মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে।
বাজারে প্রচলিত কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিংকস সম্পর্কে আন্তর্জাতিকমানের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, কোমলপানীয় বেশি পরিমাণে পান করলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে। শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের কোমলপানীয় সেবন না করাই ভাল। এতে তারা দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা থেকে রক্ষা পাবে। যেসব কোমলপানীয়তে মাদক বা মাদক জাতীয় দ্রব্যাদি থাকে সেসব মাদকে অতিমাত্রায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে। এ স্বাস্থ্য ঝুঁকি দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। যেসব কোমলপানীয়তে মাদক জাতীয় বা নেশাজাতীয় দ্রব্যাদি থাকে সেসব মাদকে এসিডিটি, গ্যাস্ট্রিক, আলসারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া আরও জটিলরোগে আক্রান্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে এ ধরনের পানীয়তে লিভার ও কিডনিসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোমল পানীয় দেশ বিদেশে দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এক সময় পেপসি, ফান্টা, সেভেনআপসহ নামকরা কিছু বিশ্বমানের কোমল পানীয়রই প্রচলন ছিল। এখন এসব বিশ্বখ্যাত কোমল পানীয়র পাশাপাশি দেশী অনেক কোমল পানীয় বাজার দখল করে নিয়েছে।
‘দেশী পণ্য খেয়ে হও ধন্য বা দেশের টাকা দেশে রাখতে, দেশের তৈরি পণ্য ব্যবহার করি।’ এমন নানা চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে দেশের প্রতি মমত্ববোধ জাগিয়ে তুলে অসাধু ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যেই হাতিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
অথচ বিএসটিআইয়ের নিয়মানুযায়ী, পণ্য উৎপাদনের মেয়াদ, মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ, মূল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম ও ঠিকানা, সর্বোচ খুচরা মূল্য, পণ্যের গুণগতমানের চিহ্ন বা উৎপাদক ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নাম এবং ঠিকানা অবশ্যই পণ্যের গায়ে থাকতে হবে। খাদ্য ও পানীয়র ক্ষেত্রে পণ্যের লেবেল বা মোড়ক থাকতে হবে। মোড়কে পানীয়র রং, ফ্লেভার, প্রিজারভেটিভ ও আর্টিফিশিয়াল সুইটনার লিপিবদ্ধ থাকা বাধ্যতামূলক। পানীয়তে কোন তেজস্ক্রিয় আছে কিনা তাও লিখতে হবে। পানীয় সঠিক পরিবেশে উৎপাদিত হচ্ছে কি-না এবং উৎপাদনের ক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কি-না তা মনিটরিং করবে বিএসটিআই।
সরাসরি কারখানা থেকে কোমল পানীয় সংগ্রহ করে বিএসটিআই তা তাদের নিজস্ব পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করবে। প্রতিটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই কেবলমাত্র বিএসটিআই ওই পানীয় বা পণ্যের লাইসেন্স দিতে পারবে। অন্যথায় দেয়ার ন্যূনতম কোন সুযোগ নেই।
কোমল পানীয়র ক্ষেত্রে বাৎসরিক ন্যূনতম লাইসেন্স ফি ১৮৭৫ টাকা। আর সর্বোচ্চ লাইসেন্স ফি ১৫ লাখ টাকা। বিএসটিআইর লাইসেন্স পাওয়ার আগে কোনক্রমেই কোন কোমল পানীয় বা অন্য কোন পণ্য বাজারজাত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আইন অমান্যকারীদের বিষয়ে বিধি মোতাবেক কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রয়েছে। এমনকি পণ্যের উৎপাদনসহ পুরো কোম্পানি সিলগালা করে দেয়ার বিধান আছে। প্রতি ৩ বছর পর পণ্যের মান যাচাইপূর্বক লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে।
বিএসটিআই সূত্রে জানা গেছে, বাজারে কি পরিমাণ কোমল পানীয় ও শিশুদের কোমল পানীয় আছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই তাদের কাছে। এর কোন সঠিক মনিটরিং হয় না। শুধু মনিটরিংয়ের নামে বিএসটিআইয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাদের পকেট ভারি হয়। ৩ বছর পর পর রীতিমতো লাইসেন্স নবায়ন করার কথা। লাইসেন্স নবায়নের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদিত পণ্যের বিষয়েও মনিটরিং হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। দীর্ঘ বছর পরেও অনেক পণ্যের মনিটরিং হয় না। প্রয়োজনও হয় না। কারণ নির্ধারিত সময়ের আগেই বিএসটিআইয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের কাছে চলে যায় মোটা অঙ্কের নজরানা। ফলে মনিটরিংয়ের আর প্রয়োজন পড়ে না।
বিএসটিআইয়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বাজারে প্রচলিত অধিকাংশ পণ্যের গায়ে বিএসটিআই অনুমোদিত লেখা যে সিল দেয়া থাকে তা নকল। এসব নকল সিলও আসল সিলের মতো তৈরি করে বিএসটিআইয়ের কোন কোন অসাধু কর্মকর্তা তা ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করে থাকেন। আবার অনেক অখ্যাত কোমল পানীয়র মালিক নিজেরাই বিএসটিআইয়ের সিল লাগিয়ে দেয়। যতদিন বিষয়টি বিএসটিআইয়ের নজরে আসে ততদিনে ওই কোম্পানি হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা।
সবচেয়ে অবাক বিষয় কোন কোন শিশু খাদ্যের গায়ে যে বিএসটিআইয়ের হলোগ্রাম লাগানো থাকে তা নকল। বাজারে কম করে হলেও অন্তত ৫শ’ প্রকার শিশুখাদ্য রয়েছে যাদের কোন লাইসেন্সই নেই। অনেক পণ্যের উৎপাদনের মেয়াদ ও উত্তীর্ণ মেয়াদও লেখা থাকে না। অধিকাংশ পণ্যের গায়ে থাকা বিএসটিআইয়ের লাইসেন্সের ছাপ এতই দুর্বল যে দেখেই বোঝা যায় এটি নকল বিএসটিআইয়ের সিল।
অথচ প্রতিটি শিশু খাদ্যের গায়েই ‘বিএসটিআই কর্তৃক অনুমোদিত’ লেখা আছে। এ ধরনের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিএসটিআইয়ের উর্ধতন কর্মকর্তা এবং ফিল্ড অফিসারদের যোগসাজশ রয়েছে। কারণ মাঠ পর্যায়ে বিক্রীত পণ্য বিএসটিআইর অনুমোদিত কি-না তা দেখভালের দায়িত্ব থাকে ফিল্ড অফিসারের। কোন কোন পণ্য বাজারে ব্যাপকহারে চালু হলে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষাই হয় না। কারণ ফিল্ড অফিসার কোম্পানিতে যাওয়া মাত্র তার সব পকেট টাকায় ভরে যায়! আবার পকেটে টাকা ধরার মতো জায়গা না থাকলে চেক ইস্যু হয়ে যায়!
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, কোমল পানীয়র ক্ষেত্রে এ চিত্র আরও ভয়াবহ। বাজারে এমন অনেক কোমল পানীয় আছে যা যৌনশক্তি বর্ধক বৃদ্ধি পায়। অথচ এসব কোমল পানীয়র গায়ে বিএসটিআইয়ের সিল আছে, যা রীতিমতো আতঙ্কের বিষয়। এসব কোমল পানীয় দীর্ঘ দিন সেবন করলে সেবনকারী মারাত্মক জটিল রোগে আক্রান্ত হতে বাধ্য। যদিও নিয়মানুযায়ী বিএসটিআই অনুমোদিত প্রতিটি পণ্যের প্রতি ৬ মাস পর মান মনিটরিং করার কথা।
পণ্যের গুণগতমান প্রতি ৬ মাস পর পর মনিটরিং করা হয় কি-না জানতে চেয়েছিলাম বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এ কে ফজলুল আহাদের কাছে। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, বিএসটিআইয়ে প্রয়োজনীয় জনবল নেই। তাই ইচ্ছে থাকলেও অনেক সময়ই নিয়মমাফিক সবকিছু মেনটেন করা সম্ভব হয় না। ৩ বছর পর পর লাইসেন্স নবায়ন করা কথা। লাইসেন্স নবায়নের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদিত পণ্যের গুণগতমানও দেখা হয়। বর্তমানে প্রতি ৬ মাস পর বিএসটিআই অনুমোদিত প্রতিটি পণ্যের মান যাচাই করা হয়ে থাকে। তবে প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় হয়ত অনেক সময় তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে কোনক্রমেই তা মাস পেরোয় না।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি সাতটি কোমল পানীয় সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এর মধ্যে রয়েছে ভিগো-বি, ম্যানপাওয়ার, হর্স ফিলিংস, রয়েল টাইগার, ব্ল্যাক হর্স ও স্পিডসহ ৭টি। এসব পানীয় এনার্জি ড্রিংকস হিসেবে বাজারে চলছে। এরমধ্যে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর পদার্থ আছে। এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব কোমল পানীয় বাজারে দিব্যি চলছে। এমনকি এসব কোমল পানীয়র অহরহ বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বিএসটিআই মহাপরিচালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জনকণ্ঠুকে বলেন, এ ধরনের পানীয় যে বাজারে আছে, তা আমার জানা নেই। অবশ্যই দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, প্রাণের জুস সম্পর্কে অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিএসটিআইয়ের তরফ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, সারাদেশে প্রাণের ম্যাংগো জুসসহ সব ধরনের কোমল পানীয় দেদার বিক্রি হচ্ছে। মহাপরিচালক আরও জানান, অনেক সময় কোমল পানীয় বা অন্যান্য দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নিয়ম মেনেই বিএসটিআইয়ের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়। কিন্তু অনুমোদন নেয়ার পর তারা নিজেদের মতো ভেজাল পণ্য উৎপাদন শুরু করে। বিষয়টি বিএসটিআইয়ের জানা। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে সব সময়ই তা ভালভাবে মনিটরিং করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে ভবিষ্যতে মনিটরিং আরও জোরদার করা হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের যে ল্যাবরেটরিতে কোমল পানীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে সেই ল্যাবরেটরির মান নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর নিজেই পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয়। আর রিপোর্টটি অন্তত ৭ থেকে ৮ মাস আগে তৈরি।
এ বিষয়ে একমত পোষণ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল জনকণ্ঠকে জানান, তাদের ল্যাবরেটরি আন্তর্জাতিকমানের নয়। তবে আন্তর্জাতিকমানের করে গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি যে সাতটি এনার্জি ড্রিংকস সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে তাতে উচ্চ মাত্রার ক্যাফেইন আছে, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। আন্তর্জাতিকমান অনুযায়ী প্রতি মিলিলিটারে যদি ২৫ ভাগ ক্যাফেইন থাকে তাও উচ্চ মাত্রার। কিন্ত যে ৭টি এনার্জি ড্রিংকস সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে তাতে শতকরা ৮০ ভাগের মতো ক্যাফেইন আছে। যা মানবদেহের জন্য রীতিমতো হুমকিস্বরূপ।
তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে অতি আগ্রহের সঙ্গে জনকণ্ঠকে আরও জানান, বাজারে প্রচলিত শিশুদের জন্য তৈরি কোমল পানীয়ও সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে থাকি আমরা। সম্প্রতি বাজার থেকে সংগৃহীত একটি শিশুদের কোমল পানীয়তে ভায়াগ্রা উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত কেমিক্যাল পাওয়া গেছে। অনেক সময় কেউ কেউ অসৎ উদ্দেশ্যে এসব কেমিক্যালযুক্ত কোমল পানীয় শিশু বা কিশোরদের পান করাতে পারে। ওসব কোমল পানীয় পান করার পর শিশু কিশোররা অস্বাভাবিক অচরণ করতে পারে। বাজার থেকে এনার্জি ড্রিংকস সংগ্রহ করা হচ্ছে। এসব ড্রিংকস আমাদের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। তবে তিনি জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপচারিতায় অবলীলায় স্বীকার করেছেন, তাদের কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি আন্তর্জাতিকমানের হয়ে গড়ে ওঠেনি। তবে চেষ্টা অব্যাহত আছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, কোমল পানীয়র বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হলে অদূর ভবিষ্যতে মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে।
বাজারে প্রচলিত কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিংকস সম্পর্কে আন্তর্জাতিকমানের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, কোমলপানীয় বেশি পরিমাণে পান করলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে। শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের কোমলপানীয় সেবন না করাই ভাল। এতে তারা দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা থেকে রক্ষা পাবে। যেসব কোমলপানীয়তে মাদক বা মাদক জাতীয় দ্রব্যাদি থাকে সেসব মাদকে অতিমাত্রায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে। এ স্বাস্থ্য ঝুঁকি দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। যেসব কোমলপানীয়তে মাদক জাতীয় বা নেশাজাতীয় দ্রব্যাদি থাকে সেসব মাদকে এসিডিটি, গ্যাস্ট্রিক, আলসারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া আরও জটিলরোগে আক্রান্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে এ ধরনের পানীয়তে লিভার ও কিডনিসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
No comments