সংসদে না গিয়েও সুবিধা নিচ্ছেন সাংসদেরা
সংসদ বর্জন করলেও বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ঠিকমতোই নিয়েছেন বিএনপির সাংসদেরা। এমনকি সংসদে না গিয়ে দৈনন্দিন যাতায়াত ভাতা পর্যন্ত তুলে নেওয়া হয়েছে। অতীতে সংসদ বর্জন আওয়ামী লীগও করেছে। তবে এ ক্ষেত্রে এবার রেকর্ড করেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।
নবম জাতীয় সংসদে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের সদস্যসংখ্যা ৩৭। এর মধ্যে ৩৪ জন বিএনপির, দুজন জামায়াতে ইসলামীর ও একজন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি)।চলতি সংসদের চার বছরে মোট ৩৩৭ কার্যদিবসের মধ্যে বিএনপি উপস্থিত ছিল মাত্র ৫৪ দিন। অনুপস্থিত ছিল ২৮৩ কার্যদিবস। আর অষ্টম সংসদের পুরো মেয়াদে ৩৭৩ কার্যদিবসের মধ্যে আওয়ামী লীগ অনুপস্থিত ছিল ২২৩ দিন, উপস্থিত ছিল ১৫০ দিন।
সপ্তম সংসদে ৩৮২ দিনের মধ্যে ওই সময়ের বিরোধী দল বিএনপি অনুপস্থিত ছিল ১৬৩ দিন। পঞ্চম সংসদের ৪০০ কার্যদিবসে আওয়ামী লীগ বর্জন করে ১৩৫ কার্যদিবস।
বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে সংসদে অনুপস্থিতির দিক থেকেও এগিয়ে আছেন খালেদা জিয়া। তিনি চার বছরে সংসদে উপস্থিত ছিলেন মাত্র আট কার্যদিবস। অষ্টম সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন ৪৫ কার্যদিবস। সপ্তম সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন ২৮ কার্যদিবস আর পঞ্চম সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন ১৩৫ কার্যদিবস। সংসদ সচিবালয় থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি বিশেষজ্ঞ নিজামউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সংসদে না গিয়ে অর্থ নেওয়ার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক কোনো বাধা নেই। এটা অবৈধও নয়। কিন্তু এটা ঠিক নয়। তিনি বলেন, আইন করে সংসদ বর্জন বন্ধ করতে হবে। সাংসদদের নৈতিকতা জাগ্রত করে এটা হবে না।
সচিবালয়ের হিসাব শাখা থেকে জানা যায়, নবম জাতীয় সংসদের একজন সাংসদ প্রতি মাসে বেতন পান দেড় লাখ টাকা। এর মধ্যে ৪০ হাজার টাকা পান গাড়ির খরচ বাবদ। এর বাইরে প্রতিদিনের অধিবেশন ভাতা উপস্থিত থাকলে এক হাজার আর অনুপস্থিত থাকলে ৩৭৫ টাকা, বার্ষিক বিমানভাড়া বাবদ এক লাখ টাকা, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থিত হলে যাতায়াত ভাতাও পেয়ে থাকেন। প্রত্যেক সাংসদ একটি করে শুল্কমুক্ত গাড়ি পান। বিদেশ সফরও করেছেন তাঁরা।
জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৮ মাসে বিরোধী দলের সাংসদেরা বেতন বাবদ ১৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা পেয়েছেন।
মন্ত্রী পদমর্যাদার বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া অতিরিক্ত কিছু সুযোগ-সুবিধাও পেয়েছেন। বিমানভাড়া বাবদ পাওয়ার কথা এক কোটি ৩৮ লাখ টাকা। সংসদে অনুপস্থিত থেকেও তাঁরা ভাতা তুলেছেন ৪১ লাখ ১২ হাজার টাকা। এ ছাড়া সংসদে উপস্থিত থাকার ভাতা বাবদ প্রায় ১৬ লাখ টাকা তুলেছেন। স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সদস্য হিসেবে যাতায়াত ভাতাও নিয়েছেন কমিটির বৈঠক অনুযায়ী। সংসদের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত চার বছরে বিরোধীদলীয় সাংসদদের পেছনে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। বাকি এক বছরে আরও অন্তত পাঁচ-ছয় কোটি টাকা ব্যয় হবে।
তবে বিরোধীদলীয় সাংসদদের মধ্যে শুধু বিজেপির আন্দালিব রহমান ব্যতিক্রম। অনুপস্থিত ভাতা তিনি নেননি, বিদেশ সফরেও যাননি। আর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার বিএনপির সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও বিদেশে চিকিৎসাধীন কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ সব বেতন-ভাতা তুলতে পারেননি। অন্যরা ইতিমধ্যে সব টাকা তুলে নিয়েছেন।
অষ্টম সংসদের পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগের ৫৮ জন সাংসদ বেতন-ভাতা, গাড়ি বাবদ সব খরচ মিলিয়ে প্রায় ২৬ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। শুল্কমুক্ত গাড়িও নিয়েছেন তাঁরা। এঁদের কেউ কেউ পোরশের মতো বিলাসবহুল গাড়ি এনে বিক্রি করেছেন। তবে এবার এত দামি গাড়ি আনা থেকে বিরত রাখতে নীতিমালা করা হয়।
জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আব্দুস শহীদ প্রথম আলোকে বলেন, সংসদে না এসে বিরোধীদলীয় সাংসদেরা বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। এটাকে বেআইনি বলা যাবে না, তবে অনৈতিক।
সংসদের হিসাব শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন ভাতা তোলার জন্য বিল তৈরি করে তাঁরা সাংসদদের কাছে পাঠান। সাংসদেরা ওই বিলে সই করে তা তোলেন। বিরোধী দলের কোনো সাংসদ বিল তোলেননি এমন নজির নেই। ওই কর্মকর্তা বলেন, ২০১০ সালে সাংসদদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি-সংক্রান্ত বিল পাস হয়। গত ৩৭ বছরে সাংসদদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়েছে ১২ বার। এ সময়ে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বাড়ানো হয়েছে সাতবার।
বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, বিএনপি অতিরিক্ত বা অনৈতিক কোনো সুবিধা নিচ্ছে না। সংবিধান অনুযায়ী যা প্রাপ্য, সেটাই নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি আওয়ামী লীগ চালু করেছে।
১৯৯৫ সালে সংসদে না গিয়ে বেতন-ভাতা নেওয়াকে অনৈতিক ও অবৈধ বলে রায় দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। ওই সময়ের বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি এর বিরুদ্ধে আপিল করে। এর পর থেকে হাইকোর্টের রায় স্থগিত হয়ে আছে।
No comments