'হুমায়ূন স্যার' চিরকালের জন্য ভালো থাকুন by হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ
১৯ জুলাই গত হয়েছেন দেশের সর্বকালের জনপ্রিয় ও জননন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ, যিনি সমান্তরালভাবে জনপ্রিয় ছিলেন নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, এমনকি একজন সুগীতিকার হিসেবে। বর্ণময় জীবনের অধিকারী প্রয়াত এই লেখককে নিয়ে এখনো সারা দেশে চলছে শোকের মাতম। অন্তহীন, অনিঃশেষ আলোচনা উপচে পড়ছে এখনো সর্বত্র।
পত্রিকার পাতা, টেলিভিশনের টক শো, ফেসবুক, ব্লগ বা সামাজিক যোগাযোগের যত মাধ্যম আছে, সবখানেই এখনো আলোচনায় আছেন সদ্যঃপ্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ। নাগরিক আড্ডায় তিনিই মুখ্য শিরোনাম। তাঁর মৃত্যু, কবর, শেষশয্যা, কর্ম, সৃষ্টি আর জীবনাচার নিয়ে আলোচনা চলছে নানা মাত্রায়। তাঁর সাহিত্য, সিনেমা, গান, তৎসঙ্গে জীবনবোধ এবং বৃষ্টি-জ্যোৎস্না-কদমফুল আর অমর সব সৃষ্টি নিয়েও আলোচনার যেন শেষ নেই। বিশেষ করে লেখকের মৃত্যুপূর্ব ঘটনাগুলো, আমেরিকায় তাঁর চিকিৎসা, শেষশয্যা নিয়ে বিতর্ক, দ্বিতীয় স্ত্রী শাওনের কঠোর মনোভাব, অভিমানী সন্তান নোভা, শীলা, বিপাশা, নুহাশের শেষ আবেদন নাকচ হওয়া, লেখকের মা আয়েশা ফয়েজের অশ্রুসিক্ত নয়ন, প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনের ফিরে এসে নীরব-নিঃশব্দ অশ্রুপাত- এসব নিয়ে আলোচনা চলছে অবিরাম। আলোচনায় আছে শাওনের দুই শিশুপুত্র নিষাদ ও নিনিত। তবে সব কিছুর পরও যে আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক চলমান, সেটি হলো- নুহাশপল্লীতে হুমায়ূন আহমেদের কবর নির্বাচনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে স্ত্রী শাওনের কঠোর ও কঠিন অবস্থান, যা ভক্তদের কাছে সৃষ্টি করেছে নানা প্রশ্নের।
নুহাশপল্লীতেই শুয়ে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। ২৪ জুলাই বাদ জোহর তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় তাঁর স্বপ্নের নুহাশপল্লীতে। পরিবারের অন্য সদস্যদের মতামত বিবেচনায় না নিয়ে মেহের আফরোজ শাওন লেখককে এখানে দাফন করতেই কঠোর অবস্থানে ছিলেন। আমেরিকা থেকে ফিরে বিমানবন্দরেই মিডিয়ার কাছে তিনি তাঁর স্বামীকে নুহাশপল্লীতে কবর দেওয়ার কথা জানান। মৃত্যুর আগে লেখক তাঁকে এমনটি নির্দেশনা দিয়ে গেছেন বলে তিনি মিডিয়ার কাছে উল্লেখ করেন। এদিকে হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ, ভাই জাফর ইকবাল, আহসান হাবিব এবং প্রথম স্ত্রীর সন্তান নোভা, শীলা, বিপাশা, নুহাশ হুমায়ূন আহমেদকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা বুদ্ধিজীবী কবরস্থান কিংবা বনানীতে কবর দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। যুক্তি হিসেবে দেখান, জনপ্রিয় এই মানুষটিকে নুহাশপল্লীতে কবর দেওয়া হলে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনে অসুবিধা হবে। আর মিরপুর বা বনানীতে কবর দেওয়া হলে যে কেউ তাঁর প্রতি অতি সহজেই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারবেন। তাঁর কবরের ঘাস-ফুলে হাত রাখতে পারবেন। কিন্তু শাওন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। বিষয়টি বোঝানোর জন্য রাতভর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন জাফর ইকবালসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। সংসদ ভবনসংলগ্ন প্রতিমন্ত্রীর বাড়িতেও মিটিং হয় রাতভর। হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজের আহাজারি-অনুরোধও ব্যর্থ হয়। শেষমেশ হুমায়ূন আহমেদের নিথর দেহটাকে কষ্ট না দেওয়ার কথা চিন্তা করে জাফর ইকবালসহ রক্তের সম্পর্কের স্বজনরা শাওনের সিদ্ধান্তই মেনে নেন। আপাত দৃষ্টিতে জয়ী হন মেহের আফরোজ শাওন। এ ঘটনায় হুমায়ূনের পরিবারের যতটা মানমর্যাদা বেড়েছে বলে প্রতীয়মান হয়, ঠিক ততটাই সামাজিকভাবে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন শাওন। সাধারণ মানুষ মনে করে, হুমায়ূন আহমেদের শেষশয্যা নিয়ে শাওন এবং নেপথ্যে থেকে তাঁর এমপি মা যে প্রেক্ষাপট তৈরি করেন, সেটি অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। শাওন হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী। অবশ্যই তাঁর কথা বলার অধিকার ও এখতিয়ার রয়েছে। কিন্তু এটাই সামাজিক প্রথা যে সন্তানের মা-বাবা বেঁচে থাকলে তাঁদের দেওয়া সিদ্ধান্তই গ্রহণযোগ্য হয়। কিন্তু শাওন হুমায়ূন আহমেদের বৃদ্ধা রত্নগর্ভা মায়ের আবেগ ও ইচ্ছার প্রতি সহানুভূতিশীল না হয়ে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে স্বার্থপরতার পরিচয় দেন। শাওনের এই ইচ্ছার সঙ্গে নেপথ্যে নানা স্বার্থান্বেষী কুশীলবের যোগসূত্র রয়েছে বলেও অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন। বাজারে গুঞ্জন রয়েছে, এই গোষ্ঠীই নুহাশপল্লী দখলে রেখে হুমায়ূন আহমেদের আগের স্ত্রীর সন্তান নোভা, শীলা, নুহাশ, বিপাশাসহ অন্য স্বজনদের দূরে রাখতে চায়।
হুমায়ূন আহমেদ আমাদের তারুণ্যের লেখক। আমরা যখন টগবগে তরুণ, সবে কলেজজীবন চুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছি, তখন হুমায়ূন আহমেদও সাহিত্যজগতে আলো ছড়াতে শুরু করেছেন। আমি বলব, আমাদের মতো তরুণদের ইচ্ছা, ভালোলাগা, ভালোবাসা, স্বপ্ন, সৌন্দর্য সামনে রেখেই তিনি এগিয়েছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও তরতর করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছেন। তাঁর লেখক হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা, নাট্যকার হিসেবে দেশের সব ধরনের দর্শককে মাতিয়ে রাখা, নতুন ধারার সিনেমা বানিয়ে দর্শকদের মাঝে নতুন স্নিগ্ধ এক অন্য রকম বিনোদন যোগ করা- এ সবই আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে। নব্বইয়ের দশকের প্রারম্ভে যখন এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পর নতুন সরকার আসে, সে সময়টায়ই মূলত জনপ্রিয় লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। মনে আছে, '৯৩-৯৪ সালের বইমেলায় তাঁর জনপ্রিয়তা এতটাই তুঙ্গে ওঠে যে তাঁকে একনজর দেখার জন্য বা একটি অটোগ্রাফের জন্য তরুণ-তরুণীরা বইমেলায় হুমড়ি খেয়ে পড়ত। তখনো ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যুগ ছিল না। ছিল কেবল বাংলাদেশ টেলিভিশন। খবর যা পাওয়া যেত প্রিন্ট মিডিয়ার কল্যাণেই। কিন্তু গণমাধ্যমের সেই সীমিত সময়ও দেখেছি, তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। তাঁর জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়ছেই। আমরা দেখেছি, আমাদের আগের প্রজন্মের হাতে নিমাই ভট্টাচার্য, নীহাররঞ্জন, শরৎ, শংকর এবং পরবর্তী সময়ে সুনীল, সমরেশের বই। কিন্তু সব বদলে দিলেন তিনি। তরুণ-তরুণীদের হাতে উঠল তাঁর লেখা বই- 'নন্দিত নরকে', 'শঙ্খনীল কারাগার', 'আমার আছে জল', 'মে ফ্লাওয়ার'- কত নামের বই! তারপর তো মিসির আলী ও হিমুর আগমন। বরাবরই দেখেছি বইমেলায় একচ্ছত্রভাবে চলেছে কেবলই তাঁর লেখা সব বই। নিঃসংকোচেই বলব, সেই ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়নি তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। একই সঙ্গে এও দেখেছি, শুধু তাঁর গল্প-উপন্যাস নয়, তাঁর লেখা টিভি নাটক দেখতে বাড়িতে বাড়িতে প্রস্তুতি পড়ে যেত। ইউনিভার্সিটির হলগুলোতে আগেই ছাত্রছাত্রীরা টিভি রুমের সিট দখল করে রাখত। অসম্ভব জনপ্রিয় এক নাট্যকার হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। এ কথা সত্য, হুমায়ূন আহমেদ দর্শকদের টিভি সেটের সামনে বসাতে পেরেছিলেন। মা-বাবা, ভাই-বোনসহ পরিবারের সবাই তাঁর নাটক দেখেছেন অফুরন্ত আনন্দ নিয়ে।
তিনি একের পর এক জনপ্রিয় সব টেলিভিশন নাটক লিখেছেন, যেখানে মধ্যবিত্ত খুুঁজে পেয়েছে তারই জীবনের সঙ্গে মিলে যাওয়া আবেগ আর ভালোলাগার অজস্র উপাদান। তাঁর লেখা নাটক দেখে মানুষ যেমন কেঁদেছে, তেমনি মন খুলে হেসেছেও। মনে আছে, অসম্ভব ভালোলাগা নিয়ে একসময় দর্শক তাঁর লেখা 'এই সব দিনরাত্রি' ধারাবাহিক নাটকটি দেখেছে। এই নাটকের ছোট্ট মেয়ে টুনির মৃত্যু নিয়ে অনেকেই তখন কেঁদেছে। চোখের জল মুছেছে। আবার 'কোথাও কেউ নেই' নাটকের সেই বাকের ভাই চরিত্র আজও আলাপে-আড্ডায় প্রাণবন্ত আলোচনার খোরাক। নাটকের বাকের ভাইয়ের ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে আমরা রাস্তায় মিছিল করতে দেখেছি। ডলি জহুরকে এখনো অনেকেই 'নীলু ভাবি' হিসেবেই বেশি চেনে। 'বহুব্রীহি' নাটকে ডাক্তার চরিত্রটিকে একটু অন্যভাবে দেখালে দেশের ডাক্তার সমাজ আবেগ ঠেকাতে না পেরে তাঁর বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং পর্যন্ত করেছিল। এ রকম আরো অনেক ঘটনা আছে তাঁর নাটকের চরিত্র নিয়ে। সিনেমায়ও তিনি কম পারদর্শিতা দেখাননি। তাঁর তৈরি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা 'আগুনের পরশমণি' সত্যিকার অর্থেই ঢাকার গেরিলাদের অন্যভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তাঁর পরিচালিত 'শ্রাবণ মেঘের দিনে' দারুণভাবে দর্শকনন্দিত হয়। এই ছবির মুখ্য চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে মেহের আফরোজ শাওন ব্যাপকভাবে দর্শকের কাছাকাছি আসতে সমর্থ হন।
লেখক, নাট্যকার ও পরিচালকের বাইরে হুমায়ূন আহমেদ আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তাঁর সহজ-সাবলীল, সজ্জন পরিচয়ের জন্য। অনেকেই সেলিব্রিটি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন তাঁর কারণেই। একসময় কুদ্দুস বয়াতিকে কেউই চিনত না। কিন্তু তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলেন হুমায়ূন আহমেদ। একইভাবে ভাটি পল্লীর অসম্ভব প্রতিভাধর এক শিল্পী শাহ আবদুল করীমকেও তিনিই নগরে নিয়ে আসেন। বংশীবাদক বারি সিদ্দিকী তাঁর ছবিতে গান গেয়েই হিট হলেন। আনকোরা মাহফুজকে রাতারাতি নায়ক বানিয়ে ফেললেন। আসাদুজ্জামান নূর, জাহিদ হাসান, ডা. এজাজ, মোজাম্মেল, চ্যালেঞ্জার, ফারুক- এসব শিল্পী হুমায়ূন আহমেদের হাতেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।
আলাপে-আড্ডায়, রসিকতায় তিনি ছিলেন এক নিপুণ কারিগর। তিনি ভালোবাসতেন আড্ডা, গান, রসিকতা। প্রকৃতির অপূর্ব রূপ বরাবরই তাঁকে টানত। বৃষ্টি, নীল আকাশ, পূর্ণিমার রাত, জ্যোৎস্না তাঁর কাছে ছিল অতি প্রিয়। জ্যোৎস্নায় ভিজতে তিনি ভালোবাসতেন। আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক গানকে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে গেছেন তিনি দারুণ সৃষ্টিশীলতা দেখিয়ে। 'আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে'- এই গানটি হুমায়ূন আহমেদের নাটকে ব্যবহার করার পর দেখেছি মানুষকে বড় মনোযোগী হয়ে শুনতে।
একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে অন্যদের মতো আমিও চেয়েছিলাম জনপ্রিয় এই মানুষটিকে রাজধানী বা তার সনি্নকটে সমাহিত করলে সাধারণ দর্শনার্থীরা সহজেই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে পারত। কিন্তু নুহাশপল্লীতে তাঁর শেষ ঠাঁই হওয়ার কারণে অনেকেই সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে বলে মনে হচ্ছে। আমার তো মনে হয়, শুধু সাধারণ মানুষ কেন, কর্মব্যস্ত জীবনের অনেক লেখক, কবির পক্ষেও দূরগ্রাম নুহাশপল্লীতে কোনো বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া যাওয়া সম্ভব হবে না। জানি না কী ভেবে, কেন এই সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন মেহের আফরোজ শাওন। আমি মনে করি, হুমায়ূন আহমেদের শেষশয্যা নির্বাচনের বিষয়টি তাঁর বৃদ্ধা মা, দুই ভাই, আগের স্ত্রীর চার সন্তানসহ অন্য সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, একটি স্বার্থান্বেষী চক্র শাওনের পেছনে ক্রিয়াশীল, যারা নোভা, শীলা, বিপাশা, নুহাশকে বঞ্চিত করতে চায়। তারাই চায় শাওনকে মিসগাইড করে মৃত হুমায়ূন আহমেদকে দখলে নিয়ে বাণিজ্য করতে। একসময় শাওন নিজেও যে তাদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হবেন না সে গ্যারান্টিই বা কোথায়? তাই হুমায়ূন আহমেদের পরিবারে বিভক্তির বদলে ঐকমত্যের বন্ধন অটুট থাকুক। শাওন হুমায়ূন আহমেদের বৃদ্ধা মা, ভাই ও আগের স্ত্রীর সন্তানদের সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে পরবর্তীকালে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করি। তাহলেই আমাদের প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ নীল জ্যোৎস্না, কদম আর নিম ফুলের গন্ধে নুহাশপল্লীর লিচুবাগানে মাটির ঘরে শান্তিতে থাকবেন- চিরদিনের জন্য, চিরকালের জন্য।
লেখক : চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি
kirondebate@gmail.com
নুহাশপল্লীতেই শুয়ে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। ২৪ জুলাই বাদ জোহর তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় তাঁর স্বপ্নের নুহাশপল্লীতে। পরিবারের অন্য সদস্যদের মতামত বিবেচনায় না নিয়ে মেহের আফরোজ শাওন লেখককে এখানে দাফন করতেই কঠোর অবস্থানে ছিলেন। আমেরিকা থেকে ফিরে বিমানবন্দরেই মিডিয়ার কাছে তিনি তাঁর স্বামীকে নুহাশপল্লীতে কবর দেওয়ার কথা জানান। মৃত্যুর আগে লেখক তাঁকে এমনটি নির্দেশনা দিয়ে গেছেন বলে তিনি মিডিয়ার কাছে উল্লেখ করেন। এদিকে হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ, ভাই জাফর ইকবাল, আহসান হাবিব এবং প্রথম স্ত্রীর সন্তান নোভা, শীলা, বিপাশা, নুহাশ হুমায়ূন আহমেদকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা বুদ্ধিজীবী কবরস্থান কিংবা বনানীতে কবর দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। যুক্তি হিসেবে দেখান, জনপ্রিয় এই মানুষটিকে নুহাশপল্লীতে কবর দেওয়া হলে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনে অসুবিধা হবে। আর মিরপুর বা বনানীতে কবর দেওয়া হলে যে কেউ তাঁর প্রতি অতি সহজেই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারবেন। তাঁর কবরের ঘাস-ফুলে হাত রাখতে পারবেন। কিন্তু শাওন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। বিষয়টি বোঝানোর জন্য রাতভর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন জাফর ইকবালসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। সংসদ ভবনসংলগ্ন প্রতিমন্ত্রীর বাড়িতেও মিটিং হয় রাতভর। হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজের আহাজারি-অনুরোধও ব্যর্থ হয়। শেষমেশ হুমায়ূন আহমেদের নিথর দেহটাকে কষ্ট না দেওয়ার কথা চিন্তা করে জাফর ইকবালসহ রক্তের সম্পর্কের স্বজনরা শাওনের সিদ্ধান্তই মেনে নেন। আপাত দৃষ্টিতে জয়ী হন মেহের আফরোজ শাওন। এ ঘটনায় হুমায়ূনের পরিবারের যতটা মানমর্যাদা বেড়েছে বলে প্রতীয়মান হয়, ঠিক ততটাই সামাজিকভাবে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন শাওন। সাধারণ মানুষ মনে করে, হুমায়ূন আহমেদের শেষশয্যা নিয়ে শাওন এবং নেপথ্যে থেকে তাঁর এমপি মা যে প্রেক্ষাপট তৈরি করেন, সেটি অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। শাওন হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী। অবশ্যই তাঁর কথা বলার অধিকার ও এখতিয়ার রয়েছে। কিন্তু এটাই সামাজিক প্রথা যে সন্তানের মা-বাবা বেঁচে থাকলে তাঁদের দেওয়া সিদ্ধান্তই গ্রহণযোগ্য হয়। কিন্তু শাওন হুমায়ূন আহমেদের বৃদ্ধা রত্নগর্ভা মায়ের আবেগ ও ইচ্ছার প্রতি সহানুভূতিশীল না হয়ে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে স্বার্থপরতার পরিচয় দেন। শাওনের এই ইচ্ছার সঙ্গে নেপথ্যে নানা স্বার্থান্বেষী কুশীলবের যোগসূত্র রয়েছে বলেও অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন। বাজারে গুঞ্জন রয়েছে, এই গোষ্ঠীই নুহাশপল্লী দখলে রেখে হুমায়ূন আহমেদের আগের স্ত্রীর সন্তান নোভা, শীলা, নুহাশ, বিপাশাসহ অন্য স্বজনদের দূরে রাখতে চায়।
হুমায়ূন আহমেদ আমাদের তারুণ্যের লেখক। আমরা যখন টগবগে তরুণ, সবে কলেজজীবন চুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছি, তখন হুমায়ূন আহমেদও সাহিত্যজগতে আলো ছড়াতে শুরু করেছেন। আমি বলব, আমাদের মতো তরুণদের ইচ্ছা, ভালোলাগা, ভালোবাসা, স্বপ্ন, সৌন্দর্য সামনে রেখেই তিনি এগিয়েছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও তরতর করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছেন। তাঁর লেখক হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা, নাট্যকার হিসেবে দেশের সব ধরনের দর্শককে মাতিয়ে রাখা, নতুন ধারার সিনেমা বানিয়ে দর্শকদের মাঝে নতুন স্নিগ্ধ এক অন্য রকম বিনোদন যোগ করা- এ সবই আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে। নব্বইয়ের দশকের প্রারম্ভে যখন এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পর নতুন সরকার আসে, সে সময়টায়ই মূলত জনপ্রিয় লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। মনে আছে, '৯৩-৯৪ সালের বইমেলায় তাঁর জনপ্রিয়তা এতটাই তুঙ্গে ওঠে যে তাঁকে একনজর দেখার জন্য বা একটি অটোগ্রাফের জন্য তরুণ-তরুণীরা বইমেলায় হুমড়ি খেয়ে পড়ত। তখনো ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যুগ ছিল না। ছিল কেবল বাংলাদেশ টেলিভিশন। খবর যা পাওয়া যেত প্রিন্ট মিডিয়ার কল্যাণেই। কিন্তু গণমাধ্যমের সেই সীমিত সময়ও দেখেছি, তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। তাঁর জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়ছেই। আমরা দেখেছি, আমাদের আগের প্রজন্মের হাতে নিমাই ভট্টাচার্য, নীহাররঞ্জন, শরৎ, শংকর এবং পরবর্তী সময়ে সুনীল, সমরেশের বই। কিন্তু সব বদলে দিলেন তিনি। তরুণ-তরুণীদের হাতে উঠল তাঁর লেখা বই- 'নন্দিত নরকে', 'শঙ্খনীল কারাগার', 'আমার আছে জল', 'মে ফ্লাওয়ার'- কত নামের বই! তারপর তো মিসির আলী ও হিমুর আগমন। বরাবরই দেখেছি বইমেলায় একচ্ছত্রভাবে চলেছে কেবলই তাঁর লেখা সব বই। নিঃসংকোচেই বলব, সেই ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়নি তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। একই সঙ্গে এও দেখেছি, শুধু তাঁর গল্প-উপন্যাস নয়, তাঁর লেখা টিভি নাটক দেখতে বাড়িতে বাড়িতে প্রস্তুতি পড়ে যেত। ইউনিভার্সিটির হলগুলোতে আগেই ছাত্রছাত্রীরা টিভি রুমের সিট দখল করে রাখত। অসম্ভব জনপ্রিয় এক নাট্যকার হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। এ কথা সত্য, হুমায়ূন আহমেদ দর্শকদের টিভি সেটের সামনে বসাতে পেরেছিলেন। মা-বাবা, ভাই-বোনসহ পরিবারের সবাই তাঁর নাটক দেখেছেন অফুরন্ত আনন্দ নিয়ে।
তিনি একের পর এক জনপ্রিয় সব টেলিভিশন নাটক লিখেছেন, যেখানে মধ্যবিত্ত খুুঁজে পেয়েছে তারই জীবনের সঙ্গে মিলে যাওয়া আবেগ আর ভালোলাগার অজস্র উপাদান। তাঁর লেখা নাটক দেখে মানুষ যেমন কেঁদেছে, তেমনি মন খুলে হেসেছেও। মনে আছে, অসম্ভব ভালোলাগা নিয়ে একসময় দর্শক তাঁর লেখা 'এই সব দিনরাত্রি' ধারাবাহিক নাটকটি দেখেছে। এই নাটকের ছোট্ট মেয়ে টুনির মৃত্যু নিয়ে অনেকেই তখন কেঁদেছে। চোখের জল মুছেছে। আবার 'কোথাও কেউ নেই' নাটকের সেই বাকের ভাই চরিত্র আজও আলাপে-আড্ডায় প্রাণবন্ত আলোচনার খোরাক। নাটকের বাকের ভাইয়ের ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে আমরা রাস্তায় মিছিল করতে দেখেছি। ডলি জহুরকে এখনো অনেকেই 'নীলু ভাবি' হিসেবেই বেশি চেনে। 'বহুব্রীহি' নাটকে ডাক্তার চরিত্রটিকে একটু অন্যভাবে দেখালে দেশের ডাক্তার সমাজ আবেগ ঠেকাতে না পেরে তাঁর বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং পর্যন্ত করেছিল। এ রকম আরো অনেক ঘটনা আছে তাঁর নাটকের চরিত্র নিয়ে। সিনেমায়ও তিনি কম পারদর্শিতা দেখাননি। তাঁর তৈরি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা 'আগুনের পরশমণি' সত্যিকার অর্থেই ঢাকার গেরিলাদের অন্যভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তাঁর পরিচালিত 'শ্রাবণ মেঘের দিনে' দারুণভাবে দর্শকনন্দিত হয়। এই ছবির মুখ্য চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে মেহের আফরোজ শাওন ব্যাপকভাবে দর্শকের কাছাকাছি আসতে সমর্থ হন।
লেখক, নাট্যকার ও পরিচালকের বাইরে হুমায়ূন আহমেদ আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তাঁর সহজ-সাবলীল, সজ্জন পরিচয়ের জন্য। অনেকেই সেলিব্রিটি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন তাঁর কারণেই। একসময় কুদ্দুস বয়াতিকে কেউই চিনত না। কিন্তু তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলেন হুমায়ূন আহমেদ। একইভাবে ভাটি পল্লীর অসম্ভব প্রতিভাধর এক শিল্পী শাহ আবদুল করীমকেও তিনিই নগরে নিয়ে আসেন। বংশীবাদক বারি সিদ্দিকী তাঁর ছবিতে গান গেয়েই হিট হলেন। আনকোরা মাহফুজকে রাতারাতি নায়ক বানিয়ে ফেললেন। আসাদুজ্জামান নূর, জাহিদ হাসান, ডা. এজাজ, মোজাম্মেল, চ্যালেঞ্জার, ফারুক- এসব শিল্পী হুমায়ূন আহমেদের হাতেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।
আলাপে-আড্ডায়, রসিকতায় তিনি ছিলেন এক নিপুণ কারিগর। তিনি ভালোবাসতেন আড্ডা, গান, রসিকতা। প্রকৃতির অপূর্ব রূপ বরাবরই তাঁকে টানত। বৃষ্টি, নীল আকাশ, পূর্ণিমার রাত, জ্যোৎস্না তাঁর কাছে ছিল অতি প্রিয়। জ্যোৎস্নায় ভিজতে তিনি ভালোবাসতেন। আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক গানকে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে গেছেন তিনি দারুণ সৃষ্টিশীলতা দেখিয়ে। 'আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে'- এই গানটি হুমায়ূন আহমেদের নাটকে ব্যবহার করার পর দেখেছি মানুষকে বড় মনোযোগী হয়ে শুনতে।
একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে অন্যদের মতো আমিও চেয়েছিলাম জনপ্রিয় এই মানুষটিকে রাজধানী বা তার সনি্নকটে সমাহিত করলে সাধারণ দর্শনার্থীরা সহজেই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে পারত। কিন্তু নুহাশপল্লীতে তাঁর শেষ ঠাঁই হওয়ার কারণে অনেকেই সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে বলে মনে হচ্ছে। আমার তো মনে হয়, শুধু সাধারণ মানুষ কেন, কর্মব্যস্ত জীবনের অনেক লেখক, কবির পক্ষেও দূরগ্রাম নুহাশপল্লীতে কোনো বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া যাওয়া সম্ভব হবে না। জানি না কী ভেবে, কেন এই সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন মেহের আফরোজ শাওন। আমি মনে করি, হুমায়ূন আহমেদের শেষশয্যা নির্বাচনের বিষয়টি তাঁর বৃদ্ধা মা, দুই ভাই, আগের স্ত্রীর চার সন্তানসহ অন্য সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, একটি স্বার্থান্বেষী চক্র শাওনের পেছনে ক্রিয়াশীল, যারা নোভা, শীলা, বিপাশা, নুহাশকে বঞ্চিত করতে চায়। তারাই চায় শাওনকে মিসগাইড করে মৃত হুমায়ূন আহমেদকে দখলে নিয়ে বাণিজ্য করতে। একসময় শাওন নিজেও যে তাদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হবেন না সে গ্যারান্টিই বা কোথায়? তাই হুমায়ূন আহমেদের পরিবারে বিভক্তির বদলে ঐকমত্যের বন্ধন অটুট থাকুক। শাওন হুমায়ূন আহমেদের বৃদ্ধা মা, ভাই ও আগের স্ত্রীর সন্তানদের সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে পরবর্তীকালে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করি। তাহলেই আমাদের প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ নীল জ্যোৎস্না, কদম আর নিম ফুলের গন্ধে নুহাশপল্লীর লিচুবাগানে মাটির ঘরে শান্তিতে থাকবেন- চিরদিনের জন্য, চিরকালের জন্য।
লেখক : চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি
kirondebate@gmail.com
No comments