এক জিনিয়াসের মহাপ্রয়াণ
সড়ক
দুর্ঘটনা বিদায় নিলেন গণিতবিদ জন ফোর্বস ন্যাশ জুনিয়র। বিশ্ববিখ্যাত এ
গণিতবিদের অসামান্য জীবন-কাহিনী নিয়েই নির্মিত হয়েছে অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র
‘অ্যা বিউটিফুল মাইন্ড’। নোবেলজয়ী ফোর্বস ন্যাশ ছিলেন আমেরিকার প্রিন্সটন
বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষক। শনিবার ওই দুর্ঘটনায় জন ফোর্বস ন্যাশের
সঙ্গে তার স্ত্রীও পরলোকগমন করেন। ন্যাশ (৮৬) ও তার স্ত্রী অ্যালিসিয়া
ন্যাশ (৮২) ট্যাক্সিতে করে মনরো টাউনশিপের কাছে ঘুরছিলেন। সে সময়ই ঘটে যায়
দুর্ঘটনা। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় উভয়ের। এ খবর দিয়েছে সিএনএন। বিংশ শতাব্দীর
অন্যতম সেরা গণিতবিদ হিসেবে ভাবা হয় ফোর্বস ন্যাশকে। ‘গেইম থিওরি’ নিয়ে
তার অবদানের জন্যই তিনি বিশ্বখ্যাত। নিজের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৪ সালে
নোবেল পান ফোর্বস। ১৯২৮ সালে জন্মগ্রহণকারী ফোর্বস ন্যাশের বাবা ছিলেন একজন
প্রকৌশলি ও লাতিন ভাষা শিক্ষক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায়ই গণিতে
নিজের মেধার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেন ফোর্বস। তিনি ছিলেন জর্জ
ওয়েস্টিংহাউস অ্যাওয়ার্ডজয়ী ১০ জনের একজন। ফলে কার্নেগি ইন্সটিটিউট অফ
টেকনোলোজিতে স¤পূর্ন বৃত্তি পেতে তার কোনো অসুবিধাই হয়নি। সেখানেই তিনি
প্রথমবারের মতো ‘জিনিয়াস’ খ্যাতি লাভ করেন। বাস্তবিক অর্থে তিনি ছিলেন
সত্যিই জিনিয়াস। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে তার হয়ে এক অধ্যাপক যখন
সুপারিশপত্র লেখেন, সেখানে লেখা ছিল মাত্র একটি লাইন। সে লাইনে লেখা ছিল:
এই লোকটি জিনিয়াস! ১৯৫০ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও
অর্থনীতির ওপর গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ১৯৫১ সালে
ক্যামব্রিজের ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলোজিতে যোগ দেন তিনি।
সেখানেই তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে অ্যালিসিয়ার। অ্যালিসিয়া ছিলেন তার
অ্যাডভান্সড ক্যালকুলাস ক্লাসের শিক্ষার্থী। এরপর বহুদিন আড্ডা, দীর্ঘ
প্রেম; অত:পর বিয়ে। কিন্তু এরই মাঝে তাকে আঁকড়ে ধরে জটিল মানসিক রোগ।
জীবনের একটি বড় অংশ ফোর্বস ন্যাশ লড়াই করেছেন প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া
নামের জটিল ওই রোগের বিরুদ্ধে। ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় স্তরে থাকার
সময়ই রোগে আক্রান্ত হন তিনি। এ সময় তার পাশে ছিলেন পদার্থবিদ স্ত্রী
অ্যালিসিয়া ন্যাশ। জন ফোর্বসের জীবন রক্ষার জন্য এ নারীকেই তাই বেশি
কৃতিত্ব¡ দেয়া হয়। তার আত্মজীবনীকার তাই বলেছেন, ফোর্বস বুঝেছিলেন, বেঁচে
থাকার জন্য প্রয়োজনীয় এক নারীর দরকার। এবং তিনি সেরা নারীটিকেই বেছে নিতে
সক্ষম হয়েছিলেন। রোগে আক্রান্ত থাকা অবস্থায় ক্রমাগত ঘরেই থাকতে হচ্ছিল
ফোর্বসকে। এক পর্যায়ে ১৯৬৩ সালে অ্যালিসিয়া ও ফোর্বসের ঘর ভেঙ্গে যায়।
অবশ্য পরে আবার ফিরে আসেন তিনি। এরপর ফোর্বসকে আর কখনই ছেড়ে যাননি
অ্যালিসিয়া। নিজের আত্মজীবনি অ্যা বিউটিফুল মাইন্ড-এ জীবনের এ অংশটি ফুটে
উঠলেও, হলিউড মুভিতে ফুটে উঠেনি। একপর্যায়ে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই শেষে ফিরে
আসেন ফোর্বস। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন নিজের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে
প্রভাবশালী একজন গণিতবিদ হিসেবে। নোবেল ছাড়াও ১৯৭৮ সালে মর্যাদাবান জন ভোন
নিউম্যান থিওরি পুরষ্কার, ১৯৯৯ সালে আমেরিকান ম্যাথম্যাটিক্যাল সোসাইটির
স্টিলে পুরষ্কার লাভ করেন তিনি। গত সপ্তাহেই তিনি মর্যাদাপূর্ন অ্যাবেল
পুরষ্কার লাভ করেন। কিন্তু সপ্তাহ না যেতেই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেন তিনি।
২০০১ সালে তার জীবনকাহিনী নিয়ে নির্মিত অস্কারজয়ী চলচ্চিত্রটি ছুঁয়ে
নিয়েছিল অগনতি মানুষের হৃদয়। ছবিটিতে ফোর্বসের চরিত্রে রাসেল ক্রো ও
অ্যালিসিয়ার চরিত্রে জেনিফার কোনেলে অভিনয় করেন। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ
করেছেন অনেকে। কিন্তু বহুদিনের এক সহকর্মীই হয়তো যথার্থভাবে শোক প্রকাশ
করতে পেরেছেন। তিনি লিখেছেন, পৃথিবী এক জিনিয়াসের মহাপ্রয়াণ চাক্ষুষ করেছে।
পৃথিবীর জন্য এ এক ভয়াবহ ক্ষতি।
No comments