ধর্ষকদের একজন তুষার
গারো নারী ধর্ষণকারীদের ফাঁসির দাবিতে শনিবার রাজধানীর ভাটারায় আদিবাসী সমাজের মৌন মিছিল |
কর্মস্থল
থেকে বাড়ি ফেরার পথে গণধর্ষণের শিকার ২২ বছর বয়সী গারো জাতিগোষ্ঠীর তরুণী
দুর্ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা দিয়েছেন পুলিশের কাছে। তবে শুধু একজনের নামই
বলতে পেরেছেন তিনি। তা হল ‘তুষার’। নামটি তিনি জানতে পারেন ওই সময়ে আসা
একটি ফোনকল থেকে। আর মাত্র এক যুবকের চেহারার বর্ণনাই দিয়েছেন তিনি।
পুলিশের মতে, এই সামান্যই এখন তদন্তের ভরসা। তা নিয়েই তারা শুরু করেছেন
তদন্ত।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শনিবার তরুণীর ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এতে গণধর্ষণের আলামত পেয়েছে ফরেনসিক বিভাগ।
বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর কুড়িল থেকে উত্তরা যাওয়ার পথে মাইক্রোবাসে ওই তরুণীকে তুলে নেয় দুর্বৃত্তরা। চলন্ত মাইক্রোবাসেই তার ওপর চালায় পাশবিকতা। এর প্রতিবাদে শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে মশাল মিছিল, মিছিল, প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধন হয়েছে। তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে আদিবাসীদের সংগঠনসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি।
পুলিশের মতে, ঘটনার শিকার তরুণী জানিয়েছে, কয়েক দিন ধরেই বাংলাদেশী এক যুবকের সঙ্গে কৃষ্ণাজ্ঞ এক যুবকও তাকে অনুসরণ করত। কর্মস্থল থেকে ফেরার সময়ও। এ দু’জন তার কর্মস্থলে এসেও কটু দৃষ্টিতে তাকে দেখেছে। তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। তবে নিশ্চিত নন। তবে একজনেরই চেহারার মোটামুটি বর্ণনা দিয়েছেন ওই তরুণী।
তদন্ত সূত্র বলছে, তবে এ ঘটনায় একটি ফোনকলই মূল সূত্র। কলটির স্থান ছিল কুড়িল ও উত্তরার মাঝামাঝি এলাকা। কলটি মাইক্রোবাসের চালকের কাছে আসে। তখন চালক একজনের নাম বলে দেন। তা হচ্ছে তুষার। পুলিশ ওই ফোনকলের পিনপয়েন্ট ও কল ডিটেইলস সংগ্রহ করে পর্যালোচনা শুরু করেছে। সেই ‘তুষার’কে গ্রেফতারে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে। এই তুষার গণধর্ষণের নেতৃত্বদাতাও হতে পারে। তবে পুলিশের আশংকা, এটি তার ছদ্মনামও হতে পারে। কে এই তুষার- তা শনাক্ত করতে চলছে প্রযুক্তির ব্যবহার।
তদন্ত সূত্র আরও জানায়, এরই মধ্যে ঘটনাস্থল কুড়িল বিশ্বরোডের সিনহা সিএনজি মোটর্সের সামনে ও ফ্লাইওভারে গমনাগমনের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে তারা। এখান থেকে সম্ভাব্য ১০ থেকে ১২টি মাইক্রোবাসের গতিবিধি ও এর তথ্য-উপাত্ত নিয়ে পর্যালোচনা চলছে।
শনিবার পুলিশের তদন্ত দল তরুণীর কর্মস্থল ও যে স্থান থেকে তাকে তুলে নেয়া হয়, সে স্থান পরিদর্শন করেছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী ওই তরুণী পুলিশ কর্মকর্তাদের জানান, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তিনি কর্মস্থল থেকে বের হয়ে উত্তরার বাসায় যাওয়ার জন্য কুড়িল রোডে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন। ওই সময় সেখানে হঠাৎ একটি মাইক্রোবাস এসে দাঁড়ায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দরজা খুলে দু’জন যুবক নেমে এসে তাকে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। পরে তার চোখ-মুখ বেঁধে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের একপর্যায় গাড়িতে থাকা যুবকের একজন বলে তার (তরুণী) মুখ খুলে দাও। তবে চোখ বন্ধ রাখো। পরে তারা চোখ বন্ধ রেখে ধর্ষণ করে। এ সময় তাকে অস্ত্র দিয়ে গুলি করার ভয় দেখানো হয়।
তরুণীর তথ্য অনুযায়ী, পেছন থেকে কেউ তাকে আগেই অনুসরণ করে গাড়ির জন্য তার অপেক্ষার স্থানে আসে। তার সেখানে আসার আনুমানিক মাত্র তিন মিনিটের মধ্যেই মাইক্রোবাসটি সেখানে আসে। দ্রুত গাড়িতে তুলে নিয়ে দরজা না লাগিয়েই চালক রওনা হয়। সামান্য পথ যেতেই মুখ বেঁধে তাকে বিবস্ত্র করা হয়। পরে গাড়িটির মাঝখানের সিট থেকে তাকে পেছনের সিটে নেয়া হয়। সেখানে একে একে তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে পাঁচজন।
তরুণী পুলিশকে আরও জানান, তাকে বহন করা গাড়িটি দু’বার ফ্লাইওভারে ওঠছে। প্রথমে ফ্লাইওভারে ওঠার পর আনুমানিক ২০ মিনিট পরই আবার ফ্লাইওভারে ওঠে গাড়িটি। এ সময় গাড়ির চালকের কাছে ফোন আসে। গারো তরুণী জানান, তাকে ধর্ষণের পর তার ঠিকানা জেনে নেয় দুর্বৃত্তরা। পরে তার ঠিকানা অনুযায়ী উত্তরার জসিমউদ্দিন রোডের দলিপাড়ায় রাস্তায় তাকে নামিয়ে দেয়া হয়।
গারো তরুণী গণধর্ষণের ঘটনা তদন্ত করছেন ভাটারা থানার ওসি (তদন্ত) সাজ্জাদ হোসেন। এছাড়াও এ ঘটনায় পুলিশের গুলশান বিভাগে একটি পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন গুলশানের এডিসি মাহবুব হাসান, এসি রফিকুল ইসলাম ও ভাটারা থানার ওসি নুরুল মুত্তাকিন।
পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনারের দায়িত্বে থাকা এডিশনাল ডিআইজি খন্দকার লুৎফুল কবির যুগান্তরকে বলেন, আমরা একটি ফোনকলকে প্রাধান্য দিচ্ছি। প্রযুক্তিগত তদন্তের মাধ্যমে এ ঘটনার ক্লু বের করতে সব ধরনের প্রচেষ্টা চলছে। লুৎফুল কবির আরও বলেন, ঘটনাস্থল ও আশপাশের গমনাগমনের পথে থাকা সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে কয়েকটি গাড়িকে বাছাই করা হয়েছে। এর মধ্যে থেকে ধর্ষকদের গাড়িটি চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।
গুলশান বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি) রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমরা দুটি সূত্রকে কাজে লাগিয়ে তদন্ত করছি। একটি হল তরুণীর দেয়া সম্ভাব্য তথ্য, অন্যটি গাড়ি এবং ফোনকল। আশা করছি খুব দ্রুত এ ঘটনায় জড়িত দু-একজনকে গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, অপরাধীরা তরুণীকে আগে থেকে অনুসরণ করেছিল। এ কারণে তারা অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে গাড়িতে তুলে নিতে সক্ষম হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র দাবি করে, পুলিশ প্রাথমিকভাবে দুইজনকে চিহ্নিত করেছে। তাদের অবস্থান উত্তরা এলাকায়। এদের একজনের নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তার নাম প্রকাশ করতে চায়নি সূত্রটি। দ্বিতীয় নামটি হচ্ছে তুষার।
এর আগে দুপুরে নিজ কার্যালয়ে খন্দকার লুৎফুল কবির বলেন, ধর্ষণকারীরা তরুণীর পূর্ব পরিচিত না। তাই নাম জানা গেলেও সরাসরি বলতে পারছে সে কে। ওই তরুণীকে গাড়িতে তোলার পর ধর্ষণকারীদের কাছে একটি ফোন এলে একজন অপরজনকে নাম সম্বোধন করে ফোনে কথা বলে। সেই নামটিই আমরা পেয়েছি।
তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনার পর ভুক্তভোগীদের মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় ঘটে থাকে। তাই ওই তরুণীকে আমরা কাউন্সিলিং থেকে শুরু করে সব ধরনের সহযোগিতা করছি। খুব শিগগিরই ধর্ষণকারীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
শনিবার সকালে তরুণীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাক্তার হাবিবুজ্জামান গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। সাত দিনের মধ্যে এ বিষয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে।
তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের সিনিয়র সহকারী কমিশনার লাকী আক্তার জানান, শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ওই তরুণীর ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য ঢামেক হাসপাতালে নেয়া হয়। পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা আইনি ব্যবস্থা নেবেন। ওই তরুণীকে শুক্রবার রাত ১২টার দিকে ভাটারা থানা থেকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠানো হয়।
ঢামেক সূত্র জানায়, তরুণীকে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়েছে। চিকিৎসা ও ডিএনএ টেস্টের জন্য তাকে সেখানে ভর্তি করা হয়। ওসিসির সমন্বয়ক ডা. বিলকিস বেগম বলেন, গারো ওই তরুণীর চিকিৎসাসেবা ও ডিএনএ টেস্টের জন্য ওসিসিতে ভর্তি করা হয়েছে।
তরুণী নির্যাতনের ঘটনায় আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জিব দ্রং ঢাকা মেডিকেলে সাংবাদিকদের জানান, তিনি তরুণীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি যাতে ভয় না পান- অভয় দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা তরুণীর পাশে আছি।
নারী সংহতি, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও আদিবাসী ফোরাম বিবৃতি দিয়ে এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে। শনিবার বিকালে রাজধানীর কুড়িল রোড থেকে আদিবাসীদের একটি প্রতিবাদ মিছিল ভাটারা থানাার দিকে যায়। সংক্ষিপ্ত সমাবেশে মিলিত হয়ে নেতারা দ্রুত অভিযুক্তদের গ্রেফতার ও এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধের দাবি জানান।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক জানান, গারো তরুণীর গণধর্ষণের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন ও মশাল মিছিল করেছে যৌন-নিপীড়নবিরোধী নির্দলীয় ছাত্র জোট। শনিবার সন্ধ্যায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন করেন তারা। মানববন্ধন শেষে টিএসসি থেকে মশাল মিছিল বের হয়। মিছিলটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘুরে টিএসসিতে এসে শেষ হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী শিবলী হাসানের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির, উদীচীর সহ-সাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতা ইমাম, ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি খান আসাদুজ্জামান মাসুম, জোটের সদস্য রিয়াজুল আলম ভূঁইয়াসহ প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। মানববন্ধন থেকে মঙ্গলবার বিকালে ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত শাস্তির দাবিতে ছাত্র-শিক্ষক-জনতা সংহতি সমাবেশের ঘোষণা দেয়া হয়।
বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ দিনে দিনে ধর্ষণ ও নারী-নিপীড়নের অভয়ারণ্যে পরিণত হচ্ছে। আর এই ধর্ষক, নারী-নিপীড়করা প্রশাসনের উপযুক্ত পদক্ষেপ না নেয়ার ফলে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। পহেলা বৈশাখে টিএসসিতে নারী নিপীড়নের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। আবার ওই ঘটনার প্রতিবাদ করতে গেলে পুলিশই অবতীর্ণ হয়েছে নিপীড়কের ভূমিকায়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শনিবার তরুণীর ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এতে গণধর্ষণের আলামত পেয়েছে ফরেনসিক বিভাগ।
বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর কুড়িল থেকে উত্তরা যাওয়ার পথে মাইক্রোবাসে ওই তরুণীকে তুলে নেয় দুর্বৃত্তরা। চলন্ত মাইক্রোবাসেই তার ওপর চালায় পাশবিকতা। এর প্রতিবাদে শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে মশাল মিছিল, মিছিল, প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধন হয়েছে। তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে আদিবাসীদের সংগঠনসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি।
পুলিশের মতে, ঘটনার শিকার তরুণী জানিয়েছে, কয়েক দিন ধরেই বাংলাদেশী এক যুবকের সঙ্গে কৃষ্ণাজ্ঞ এক যুবকও তাকে অনুসরণ করত। কর্মস্থল থেকে ফেরার সময়ও। এ দু’জন তার কর্মস্থলে এসেও কটু দৃষ্টিতে তাকে দেখেছে। তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। তবে নিশ্চিত নন। তবে একজনেরই চেহারার মোটামুটি বর্ণনা দিয়েছেন ওই তরুণী।
তদন্ত সূত্র বলছে, তবে এ ঘটনায় একটি ফোনকলই মূল সূত্র। কলটির স্থান ছিল কুড়িল ও উত্তরার মাঝামাঝি এলাকা। কলটি মাইক্রোবাসের চালকের কাছে আসে। তখন চালক একজনের নাম বলে দেন। তা হচ্ছে তুষার। পুলিশ ওই ফোনকলের পিনপয়েন্ট ও কল ডিটেইলস সংগ্রহ করে পর্যালোচনা শুরু করেছে। সেই ‘তুষার’কে গ্রেফতারে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে। এই তুষার গণধর্ষণের নেতৃত্বদাতাও হতে পারে। তবে পুলিশের আশংকা, এটি তার ছদ্মনামও হতে পারে। কে এই তুষার- তা শনাক্ত করতে চলছে প্রযুক্তির ব্যবহার।
তদন্ত সূত্র আরও জানায়, এরই মধ্যে ঘটনাস্থল কুড়িল বিশ্বরোডের সিনহা সিএনজি মোটর্সের সামনে ও ফ্লাইওভারে গমনাগমনের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে তারা। এখান থেকে সম্ভাব্য ১০ থেকে ১২টি মাইক্রোবাসের গতিবিধি ও এর তথ্য-উপাত্ত নিয়ে পর্যালোচনা চলছে।
শনিবার পুলিশের তদন্ত দল তরুণীর কর্মস্থল ও যে স্থান থেকে তাকে তুলে নেয়া হয়, সে স্থান পরিদর্শন করেছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী ওই তরুণী পুলিশ কর্মকর্তাদের জানান, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তিনি কর্মস্থল থেকে বের হয়ে উত্তরার বাসায় যাওয়ার জন্য কুড়িল রোডে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন। ওই সময় সেখানে হঠাৎ একটি মাইক্রোবাস এসে দাঁড়ায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দরজা খুলে দু’জন যুবক নেমে এসে তাকে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। পরে তার চোখ-মুখ বেঁধে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের একপর্যায় গাড়িতে থাকা যুবকের একজন বলে তার (তরুণী) মুখ খুলে দাও। তবে চোখ বন্ধ রাখো। পরে তারা চোখ বন্ধ রেখে ধর্ষণ করে। এ সময় তাকে অস্ত্র দিয়ে গুলি করার ভয় দেখানো হয়।
তরুণীর তথ্য অনুযায়ী, পেছন থেকে কেউ তাকে আগেই অনুসরণ করে গাড়ির জন্য তার অপেক্ষার স্থানে আসে। তার সেখানে আসার আনুমানিক মাত্র তিন মিনিটের মধ্যেই মাইক্রোবাসটি সেখানে আসে। দ্রুত গাড়িতে তুলে নিয়ে দরজা না লাগিয়েই চালক রওনা হয়। সামান্য পথ যেতেই মুখ বেঁধে তাকে বিবস্ত্র করা হয়। পরে গাড়িটির মাঝখানের সিট থেকে তাকে পেছনের সিটে নেয়া হয়। সেখানে একে একে তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে পাঁচজন।
তরুণী পুলিশকে আরও জানান, তাকে বহন করা গাড়িটি দু’বার ফ্লাইওভারে ওঠছে। প্রথমে ফ্লাইওভারে ওঠার পর আনুমানিক ২০ মিনিট পরই আবার ফ্লাইওভারে ওঠে গাড়িটি। এ সময় গাড়ির চালকের কাছে ফোন আসে। গারো তরুণী জানান, তাকে ধর্ষণের পর তার ঠিকানা জেনে নেয় দুর্বৃত্তরা। পরে তার ঠিকানা অনুযায়ী উত্তরার জসিমউদ্দিন রোডের দলিপাড়ায় রাস্তায় তাকে নামিয়ে দেয়া হয়।
গারো তরুণী গণধর্ষণের ঘটনা তদন্ত করছেন ভাটারা থানার ওসি (তদন্ত) সাজ্জাদ হোসেন। এছাড়াও এ ঘটনায় পুলিশের গুলশান বিভাগে একটি পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন গুলশানের এডিসি মাহবুব হাসান, এসি রফিকুল ইসলাম ও ভাটারা থানার ওসি নুরুল মুত্তাকিন।
পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনারের দায়িত্বে থাকা এডিশনাল ডিআইজি খন্দকার লুৎফুল কবির যুগান্তরকে বলেন, আমরা একটি ফোনকলকে প্রাধান্য দিচ্ছি। প্রযুক্তিগত তদন্তের মাধ্যমে এ ঘটনার ক্লু বের করতে সব ধরনের প্রচেষ্টা চলছে। লুৎফুল কবির আরও বলেন, ঘটনাস্থল ও আশপাশের গমনাগমনের পথে থাকা সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে কয়েকটি গাড়িকে বাছাই করা হয়েছে। এর মধ্যে থেকে ধর্ষকদের গাড়িটি চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।
গুলশান বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি) রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমরা দুটি সূত্রকে কাজে লাগিয়ে তদন্ত করছি। একটি হল তরুণীর দেয়া সম্ভাব্য তথ্য, অন্যটি গাড়ি এবং ফোনকল। আশা করছি খুব দ্রুত এ ঘটনায় জড়িত দু-একজনকে গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, অপরাধীরা তরুণীকে আগে থেকে অনুসরণ করেছিল। এ কারণে তারা অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে গাড়িতে তুলে নিতে সক্ষম হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র দাবি করে, পুলিশ প্রাথমিকভাবে দুইজনকে চিহ্নিত করেছে। তাদের অবস্থান উত্তরা এলাকায়। এদের একজনের নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তার নাম প্রকাশ করতে চায়নি সূত্রটি। দ্বিতীয় নামটি হচ্ছে তুষার।
এর আগে দুপুরে নিজ কার্যালয়ে খন্দকার লুৎফুল কবির বলেন, ধর্ষণকারীরা তরুণীর পূর্ব পরিচিত না। তাই নাম জানা গেলেও সরাসরি বলতে পারছে সে কে। ওই তরুণীকে গাড়িতে তোলার পর ধর্ষণকারীদের কাছে একটি ফোন এলে একজন অপরজনকে নাম সম্বোধন করে ফোনে কথা বলে। সেই নামটিই আমরা পেয়েছি।
তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনার পর ভুক্তভোগীদের মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় ঘটে থাকে। তাই ওই তরুণীকে আমরা কাউন্সিলিং থেকে শুরু করে সব ধরনের সহযোগিতা করছি। খুব শিগগিরই ধর্ষণকারীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
শনিবার সকালে তরুণীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে ঢামেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাক্তার হাবিবুজ্জামান গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। সাত দিনের মধ্যে এ বিষয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে।
তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের সিনিয়র সহকারী কমিশনার লাকী আক্তার জানান, শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ওই তরুণীর ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য ঢামেক হাসপাতালে নেয়া হয়। পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা আইনি ব্যবস্থা নেবেন। ওই তরুণীকে শুক্রবার রাত ১২টার দিকে ভাটারা থানা থেকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠানো হয়।
ঢামেক সূত্র জানায়, তরুণীকে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়েছে। চিকিৎসা ও ডিএনএ টেস্টের জন্য তাকে সেখানে ভর্তি করা হয়। ওসিসির সমন্বয়ক ডা. বিলকিস বেগম বলেন, গারো ওই তরুণীর চিকিৎসাসেবা ও ডিএনএ টেস্টের জন্য ওসিসিতে ভর্তি করা হয়েছে।
তরুণী নির্যাতনের ঘটনায় আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জিব দ্রং ঢাকা মেডিকেলে সাংবাদিকদের জানান, তিনি তরুণীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি যাতে ভয় না পান- অভয় দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা তরুণীর পাশে আছি।
নারী সংহতি, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও আদিবাসী ফোরাম বিবৃতি দিয়ে এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে। শনিবার বিকালে রাজধানীর কুড়িল রোড থেকে আদিবাসীদের একটি প্রতিবাদ মিছিল ভাটারা থানাার দিকে যায়। সংক্ষিপ্ত সমাবেশে মিলিত হয়ে নেতারা দ্রুত অভিযুক্তদের গ্রেফতার ও এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধের দাবি জানান।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক জানান, গারো তরুণীর গণধর্ষণের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন ও মশাল মিছিল করেছে যৌন-নিপীড়নবিরোধী নির্দলীয় ছাত্র জোট। শনিবার সন্ধ্যায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন করেন তারা। মানববন্ধন শেষে টিএসসি থেকে মশাল মিছিল বের হয়। মিছিলটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘুরে টিএসসিতে এসে শেষ হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী শিবলী হাসানের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির, উদীচীর সহ-সাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতা ইমাম, ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি খান আসাদুজ্জামান মাসুম, জোটের সদস্য রিয়াজুল আলম ভূঁইয়াসহ প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। মানববন্ধন থেকে মঙ্গলবার বিকালে ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত শাস্তির দাবিতে ছাত্র-শিক্ষক-জনতা সংহতি সমাবেশের ঘোষণা দেয়া হয়।
বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ দিনে দিনে ধর্ষণ ও নারী-নিপীড়নের অভয়ারণ্যে পরিণত হচ্ছে। আর এই ধর্ষক, নারী-নিপীড়করা প্রশাসনের উপযুক্ত পদক্ষেপ না নেয়ার ফলে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। পহেলা বৈশাখে টিএসসিতে নারী নিপীড়নের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। আবার ওই ঘটনার প্রতিবাদ করতে গেলে পুলিশই অবতীর্ণ হয়েছে নিপীড়কের ভূমিকায়।
No comments