সাংবাদিকতায় নিবেদিত হাসানুজ্জামান খান by সৈয়দ আবুল মকসুদ
বাংলাদেশের
সাংবাদিকতার প্রথম পর্বের শেষ সদস্য হাসানুজ্জামান খান ৯০ বছর বয়সে ১৮ মে
মারা গেছেন। পাকিস্তান অবজারভার, বঙ্গবার্তাসহ বিভিন্ন দৈনিকের
গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। তিনি যে মাপের সাংবাদিক ছিলেন সে পরিমাণে
সুপরিচিত ছিলেন না। অবসর নেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক
হিসেবে। দীর্ঘদিন সেখানে ছিলেন প্রধান বার্তা সম্পাদক। গত ৩০ বছরে
বাংলাদেশে আধুনিক সাংবাদিকতায় ইংরেজি ও বাংলা দুটি ভাষাতেই—অনেক উজ্জ্বল
তরুণ-তরুণীর প্রবেশ ঘটেছে। কিন্তু হাসানুজ্জামানের মতো পরিশ্রমী ও মেধাবী
সাংবাদিক বিরল।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় ঢাকা থেকে কোনো দৈনিক প্রকাশিত হতো না। হাসানুজ্জামান খানের সাংবাদিকতার শুরু কলকাতায় দৈনিক আজাদ-এ, ১৯৪৫ সালে। এই পত্রিকার সাম্প্রদায়িক নীতির সঙ্গে তাঁর মেলেনি। তিনি যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক স্বাধীনতায়। স্বাধীনতায় তিনি কাজ করেছেন রেসিডেন্ট এডিটর নৃপেন চক্রবর্তীর সঙ্গে। রাতে একসঙ্গে ডিউটি করতেন। থাকতেন অফিসের একই ঘরে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কলকাতা থেকে ঢাকা আসছিলেন। ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে একজন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীও ছিলেন। তাঁর জিনিসপত্রের মধ্যে ছিল একটি কাগজের প্যাকেট। সেকালের গোয়েন্দা পুলিশ চাট্টিখানি মানুষ ছিল না। কমরেডও সতর্কতায় কম নন। ফুলবাড়িয়া স্টেশনে পৌঁছাতেই কমরেড প্যাকেটটি হাসানুজ্জামানের জিম্মায় রেখে সটকে পড়েন। পুলিশ এসে জিজ্ঞেস করে, ‘এটার মধ্যে কী? চলো আমার সঙ্গে শ্রীঘরে।’ ওতে ছিল কমিউনিস্ট পার্টির একটি প্রচারপত্র। হেনা দাসও একই সঙ্গে গ্রেপ্তার হন। হাসানুজ্জামান খানকে মুক্ত করার জন্য আইনি লড়াই করার কেউ ছিল না। বিনা বিচারে পাঁচ বছর জেল খাটেন।
এর মধ্যে বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ রক্তে প্লাবিত হয়। মাওলানা ভাসানীসহ বহু রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিক কর্মী ও ছাত্র-যুবককে নিরাপত্তাবন্দী হিসেবে কারাগারে নেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে গাজীউল হক, মুনীর চৌধুরী প্রমুখ ছিলেন। জেলের মধ্যে বন্দীদের একত্র হওয়ার সুযোগ হতো শুক্রবারে জুমার নামাজের সময়। তখন তাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন। মুনীর চৌধুরী ইংরেজিতে এমএ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করতেন। জেলে গিয়ে তিনি বাংলায় এমএ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকী সামনে। একদিন জুমার নামাজের পর হাসানুজ্জামানসহ অনেকেই মুনীর চৌধুরীকে ভাষাশহীদদের বিষয়ে একটি নাটক লেখার পরামর্শ দেন। বস্তুত এক রাতে দ্রুত তিনি লিখে ফেলেন কবর। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সেটি অভিনীত হয়। পুরো আয়োজকদের অন্যতম প্রধান কর্মী ছিলেন হাসানুজ্জামান।
এ কালের বাম নেতারা জানেন না আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় কমরেড মণি সিংহ ও অনিমা বউদি তাঁর বাসায় যেতেন। তাঁর পীরজঙ্গি মাজার বা নিউ কলোনি বা বাবর রোডের বাসায় কমিউনিস্ট নেতাদের বৈঠক হতো। অনিল মুখার্জির প্রধান ঠিকানা ছিল নারীনেত্রী মালেকা বেগমের লারমিনি স্ট্রিটের বাড়ি। কিন্তু তিনি আত্মগোপনে থাকার সময় কখনো হাসানুজ্জামানের বাসায় থাকতেন।
পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির আদি পর্বের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু হাসানুজ্জামানের জানাজায় কোনো বাম নেতাকে দেখা যায়নি। প্রেসক্লাব চত্বরে জানাজায় জনাকয়েক মানুষের মধ্যে ছিলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, প্রবীণ সাংবাদিক কামাল লোহানী ও সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাজনৈতিক মতাদর্শের তিনি ছিলেন একজন মার্ক্সবাদী। আক্ষরিক অর্থে সেক্যুলার বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তা-ই। সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করতেন। ধর্মীয় রাজনীতিকে তিনি বিষদৃষ্টিতে দেখতেন। বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনীতির উত্থানে তিনি শঙ্কিত ছিলেন। তবে নিজের মতাদর্শের সঙ্গে সাংবাদিকতাকে মেলাননি কখনো। সর্বোচ্চ বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষা করেছেন।
কমরেড মোজাফফর আহমদসহ অনেকের সঙ্গেই তাঁর পরিচয় ছিল। আইপিটিএর শিল্পীদের সঙ্গেও। পরিচয় ছিল কংগ্রেস নেতা অজয় মুখার্জির বোন কল্যাণী কুমারমঙ্গলামের সঙ্গেও। ছাত্রী ফেডারেশনের নেতা কল্যাণী মুখার্জি কেরালার এক যুবককে বিয়ে করে কল্যাণী কুমারমঙ্গলাম হন। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের সময় হাসানুজ্জামান কাজ করতেন স্বাধীনতায়। স্মৃতিকথায় তিনি লেখেন:
‘১৯৪৭ সালের দাঙ্গার পর মুক্তাগাছার মহারাজা শীতাংশু আচার্য চৌধুরীকে তাঁর লোয়ার সার্কুলার রোডের বাড়ি থেকে অল্পকালের জন্যে নিরাপদ এলাকায় সরে যেতে হয়েছিল। তাঁর বাড়িটি ছিল হিন্দু-মুসলিম দু এলাকার সঙ্গমস্থলে। কিন্তু খালি বাড়ি পেলে স্কোয়াটাররা দখল নিতে পারে এ বিবেচনায় তাঁর ভাই ব্যারিস্টার স্নেহাংশু আচার্য চৌধুরী কাকা বাবুকে [কমরেড মোজাফফর আহমদ] তাঁর মুসলমান বন্ধুবান্ধব নিয়ে সে বাড়িতে বিনা ভাড়ায় থাকতে অনুরোধ করলেন যত দিন না তাঁর ভাই ফিরে আসেন।
‘প্রকাণ্ড দোতলা বাড়ি। তা ছাড়া কর্মচারীদের জন্য একটি দোতলা আউট হাউস, কয়েকটি গাড়ির গ্যারেজ ও তার ওপর ড্রাইভারদের থাকার ঘর। সেখানে অন্যান্য অনেকের সঙ্গে আমিও গিয়ে উঠলাম। ওপর-নিচ দুই তলাতেই মাঝখানে বিশাল হলঘর আর তার চারপাশে শোবার ঘর। নিচতলায় এক ঘরে (নৃত্যশিল্প) বুলবুল চৌধুরী সস্ত্রীক থাকতেন। আর কে কে নিচতলায় ছিলেন আজ তা মনে নেই। ওপর তলায় এক ঘরে সস্ত্রীক মনসুর হাবিব (পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার স্পিকার ও মন্ত্রী), এক ঘরে কবি গোলাম কুদ্দুস, আমানুল্লাহ সৈয়দ (মনসুর হাবিবের ছোট ভাই) ও আমি। গাড়ি বারান্দার ওপর আবদুল হালিম ও তাঁর স্ত্রী অশ্রু হালিম। আউট হাউসের উভয় তলায় পাঁচ-ছয়টি পরিবার থাকতেন। তার মধ্যে কেবল ইসরায়েল ভাই, গরিমা ভাবির কথা মনে আছে।’
উপমহাদেশের মহাপণ্ডিত বামপন্থী বহুভাষাবিদ অবাঙালি রাহুল সাংকৃত্যায়নের ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন মহাদেব প্রসাদ সাহা। সাহাও ছিলেন বড় পণ্ডিত। লেখালেখিও করেছেন। তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল হাসানুজ্জামানের। কলকাতা, দিল্লি থেকে মহাদেব সাহা তাঁকে চিঠি লিখতেন। বেশির ভাগই পোস্টকার্ড। তাঁর চিঠি এলেই তা আমাকে পড়তে দিতেন।
জেল থেকে বেরিয়ে যোগ দেন মর্নিং নিউজ-এ। সেখানে আমাদের এক ভাই সৈয়দ শামসুদ্দোজা কাজ করতেন। সেখানে যেতাম। সেখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। স্বাধীনতার পরে বাসস-এ সে ঘনিষ্ঠতা নিবিড়তর হয়। প্রায় ৩০ বছর আমি তাঁর সঙ্গে এক ঘরে বসেছি। দেখেছি তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে কারা আসতেন। খোকা রায় প্রমুখ প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা আসতেন, আসতেন জয়নুল আবেদিন, কলিম শরাফী প্রমুখ। তাঁর বাড়ির সদস্যের মতো ছিলেন চিত্রশিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুন্ডু প্রমুখ। দেবুদা, সালেহা ভাবি, নিতুনদাদের সঙ্গে সারা দিন এমনকি সারা রাতও হাসান ভাইয়ের বাড়িতে আড্ডা দিয়েছি। সালেহা ভাবির সঙ্গে দেবুদার পরিচয় ও প্রেম হাসান ভাইয়ের বাসাতেই। তিনি ভালো বাজার করতেন। ভাবি আয়েশা সিদ্দিকার রান্না চমৎকার। সুতরাং সারা দিন তাঁর বাড়িতে কাটাতে অসুবিধা হতো না?
প্রচারবিমুখতা ও লেখালেখি না করার প্রবণতা তিনি পেয়ে থাকবেন তাঁর মামা অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের থেকে। তাঁর মতো পাঠক আমি বেশি দেখিনি। বিচিত্র বিষয়ে পড়ে আনন্দ পেতেন। পঠিত কোনো আকর্ষণীয় বিষয় অন্যের সঙ্গে আলোচনা করতেও পছন্দ করতেন। কিন্তু কোনো বিষয়ে লেখার আগ্রহ ছিল না। পোশাক-পরিচ্ছদে উদাসীন। সাংবাদিক হিসেবে বিদেশভ্রমণে একেবারেই অনাগ্রহ, অবশ্য ঠেলাঠেলি করে আমরা তাঁকে দু-একবার পাঠিয়েছি। নৃপেন চক্রবর্তী বহুদিন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। হাসান ভাইকে বলেছি, সেখানে ঘুরে আসতে। যাননি। বৈষয়িক ব্যাপারে বিরক্তিকর উদাসীন।
আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে খুব কমই যেতেন। তাঁকে তিনটি স্থানের যেকোনো একটিতে পাওয়া যেতই। একটি তাঁর বাসা, যেখানে তিনি দিনের কম সময়ই থাকতেন। আর দুটি বাসস অফিস ও প্রেসক্লাব। এই দুটিতে থাকতেন দিনের ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা। ব্রিজ ও হাউসি খেলায় ছিলেন দক্ষ। জাতীয় প্রেসক্লাবের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা; ছিলেন তার সেক্রেটারি।
এক নাগাড়ে ৩০ ঘণ্টার বেশি টেবিলে বসে কাজ করতে আমি তাঁকে দেখেছি বিভিন্ন অস্বাভাবিক ঘটনার সময়। কাজ না থাকলে চেয়ারে পা গুটিয়ে বই বা পত্রিকা পড়তেন। মার্ক্সবাদী সাহিত্য ছিল তাঁর খুব প্রিয় বিষয়।
হাসান ভাইদের মতো কর্মী, সৎ ও নির্লোভ মানুষ চলে গেলে সমাজে শূন্যতার সৃষ্টি হয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় ঢাকা থেকে কোনো দৈনিক প্রকাশিত হতো না। হাসানুজ্জামান খানের সাংবাদিকতার শুরু কলকাতায় দৈনিক আজাদ-এ, ১৯৪৫ সালে। এই পত্রিকার সাম্প্রদায়িক নীতির সঙ্গে তাঁর মেলেনি। তিনি যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক স্বাধীনতায়। স্বাধীনতায় তিনি কাজ করেছেন রেসিডেন্ট এডিটর নৃপেন চক্রবর্তীর সঙ্গে। রাতে একসঙ্গে ডিউটি করতেন। থাকতেন অফিসের একই ঘরে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কলকাতা থেকে ঢাকা আসছিলেন। ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে একজন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীও ছিলেন। তাঁর জিনিসপত্রের মধ্যে ছিল একটি কাগজের প্যাকেট। সেকালের গোয়েন্দা পুলিশ চাট্টিখানি মানুষ ছিল না। কমরেডও সতর্কতায় কম নন। ফুলবাড়িয়া স্টেশনে পৌঁছাতেই কমরেড প্যাকেটটি হাসানুজ্জামানের জিম্মায় রেখে সটকে পড়েন। পুলিশ এসে জিজ্ঞেস করে, ‘এটার মধ্যে কী? চলো আমার সঙ্গে শ্রীঘরে।’ ওতে ছিল কমিউনিস্ট পার্টির একটি প্রচারপত্র। হেনা দাসও একই সঙ্গে গ্রেপ্তার হন। হাসানুজ্জামান খানকে মুক্ত করার জন্য আইনি লড়াই করার কেউ ছিল না। বিনা বিচারে পাঁচ বছর জেল খাটেন।
এর মধ্যে বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ রক্তে প্লাবিত হয়। মাওলানা ভাসানীসহ বহু রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিক কর্মী ও ছাত্র-যুবককে নিরাপত্তাবন্দী হিসেবে কারাগারে নেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে গাজীউল হক, মুনীর চৌধুরী প্রমুখ ছিলেন। জেলের মধ্যে বন্দীদের একত্র হওয়ার সুযোগ হতো শুক্রবারে জুমার নামাজের সময়। তখন তাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন। মুনীর চৌধুরী ইংরেজিতে এমএ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করতেন। জেলে গিয়ে তিনি বাংলায় এমএ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকী সামনে। একদিন জুমার নামাজের পর হাসানুজ্জামানসহ অনেকেই মুনীর চৌধুরীকে ভাষাশহীদদের বিষয়ে একটি নাটক লেখার পরামর্শ দেন। বস্তুত এক রাতে দ্রুত তিনি লিখে ফেলেন কবর। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সেটি অভিনীত হয়। পুরো আয়োজকদের অন্যতম প্রধান কর্মী ছিলেন হাসানুজ্জামান।
এ কালের বাম নেতারা জানেন না আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় কমরেড মণি সিংহ ও অনিমা বউদি তাঁর বাসায় যেতেন। তাঁর পীরজঙ্গি মাজার বা নিউ কলোনি বা বাবর রোডের বাসায় কমিউনিস্ট নেতাদের বৈঠক হতো। অনিল মুখার্জির প্রধান ঠিকানা ছিল নারীনেত্রী মালেকা বেগমের লারমিনি স্ট্রিটের বাড়ি। কিন্তু তিনি আত্মগোপনে থাকার সময় কখনো হাসানুজ্জামানের বাসায় থাকতেন।
পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির আদি পর্বের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু হাসানুজ্জামানের জানাজায় কোনো বাম নেতাকে দেখা যায়নি। প্রেসক্লাব চত্বরে জানাজায় জনাকয়েক মানুষের মধ্যে ছিলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, প্রবীণ সাংবাদিক কামাল লোহানী ও সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাজনৈতিক মতাদর্শের তিনি ছিলেন একজন মার্ক্সবাদী। আক্ষরিক অর্থে সেক্যুলার বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তা-ই। সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করতেন। ধর্মীয় রাজনীতিকে তিনি বিষদৃষ্টিতে দেখতেন। বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনীতির উত্থানে তিনি শঙ্কিত ছিলেন। তবে নিজের মতাদর্শের সঙ্গে সাংবাদিকতাকে মেলাননি কখনো। সর্বোচ্চ বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষা করেছেন।
কমরেড মোজাফফর আহমদসহ অনেকের সঙ্গেই তাঁর পরিচয় ছিল। আইপিটিএর শিল্পীদের সঙ্গেও। পরিচয় ছিল কংগ্রেস নেতা অজয় মুখার্জির বোন কল্যাণী কুমারমঙ্গলামের সঙ্গেও। ছাত্রী ফেডারেশনের নেতা কল্যাণী মুখার্জি কেরালার এক যুবককে বিয়ে করে কল্যাণী কুমারমঙ্গলাম হন। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের সময় হাসানুজ্জামান কাজ করতেন স্বাধীনতায়। স্মৃতিকথায় তিনি লেখেন:
‘১৯৪৭ সালের দাঙ্গার পর মুক্তাগাছার মহারাজা শীতাংশু আচার্য চৌধুরীকে তাঁর লোয়ার সার্কুলার রোডের বাড়ি থেকে অল্পকালের জন্যে নিরাপদ এলাকায় সরে যেতে হয়েছিল। তাঁর বাড়িটি ছিল হিন্দু-মুসলিম দু এলাকার সঙ্গমস্থলে। কিন্তু খালি বাড়ি পেলে স্কোয়াটাররা দখল নিতে পারে এ বিবেচনায় তাঁর ভাই ব্যারিস্টার স্নেহাংশু আচার্য চৌধুরী কাকা বাবুকে [কমরেড মোজাফফর আহমদ] তাঁর মুসলমান বন্ধুবান্ধব নিয়ে সে বাড়িতে বিনা ভাড়ায় থাকতে অনুরোধ করলেন যত দিন না তাঁর ভাই ফিরে আসেন।
‘প্রকাণ্ড দোতলা বাড়ি। তা ছাড়া কর্মচারীদের জন্য একটি দোতলা আউট হাউস, কয়েকটি গাড়ির গ্যারেজ ও তার ওপর ড্রাইভারদের থাকার ঘর। সেখানে অন্যান্য অনেকের সঙ্গে আমিও গিয়ে উঠলাম। ওপর-নিচ দুই তলাতেই মাঝখানে বিশাল হলঘর আর তার চারপাশে শোবার ঘর। নিচতলায় এক ঘরে (নৃত্যশিল্প) বুলবুল চৌধুরী সস্ত্রীক থাকতেন। আর কে কে নিচতলায় ছিলেন আজ তা মনে নেই। ওপর তলায় এক ঘরে সস্ত্রীক মনসুর হাবিব (পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার স্পিকার ও মন্ত্রী), এক ঘরে কবি গোলাম কুদ্দুস, আমানুল্লাহ সৈয়দ (মনসুর হাবিবের ছোট ভাই) ও আমি। গাড়ি বারান্দার ওপর আবদুল হালিম ও তাঁর স্ত্রী অশ্রু হালিম। আউট হাউসের উভয় তলায় পাঁচ-ছয়টি পরিবার থাকতেন। তার মধ্যে কেবল ইসরায়েল ভাই, গরিমা ভাবির কথা মনে আছে।’
উপমহাদেশের মহাপণ্ডিত বামপন্থী বহুভাষাবিদ অবাঙালি রাহুল সাংকৃত্যায়নের ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন মহাদেব প্রসাদ সাহা। সাহাও ছিলেন বড় পণ্ডিত। লেখালেখিও করেছেন। তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল হাসানুজ্জামানের। কলকাতা, দিল্লি থেকে মহাদেব সাহা তাঁকে চিঠি লিখতেন। বেশির ভাগই পোস্টকার্ড। তাঁর চিঠি এলেই তা আমাকে পড়তে দিতেন।
জেল থেকে বেরিয়ে যোগ দেন মর্নিং নিউজ-এ। সেখানে আমাদের এক ভাই সৈয়দ শামসুদ্দোজা কাজ করতেন। সেখানে যেতাম। সেখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। স্বাধীনতার পরে বাসস-এ সে ঘনিষ্ঠতা নিবিড়তর হয়। প্রায় ৩০ বছর আমি তাঁর সঙ্গে এক ঘরে বসেছি। দেখেছি তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে কারা আসতেন। খোকা রায় প্রমুখ প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা আসতেন, আসতেন জয়নুল আবেদিন, কলিম শরাফী প্রমুখ। তাঁর বাড়ির সদস্যের মতো ছিলেন চিত্রশিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুন্ডু প্রমুখ। দেবুদা, সালেহা ভাবি, নিতুনদাদের সঙ্গে সারা দিন এমনকি সারা রাতও হাসান ভাইয়ের বাড়িতে আড্ডা দিয়েছি। সালেহা ভাবির সঙ্গে দেবুদার পরিচয় ও প্রেম হাসান ভাইয়ের বাসাতেই। তিনি ভালো বাজার করতেন। ভাবি আয়েশা সিদ্দিকার রান্না চমৎকার। সুতরাং সারা দিন তাঁর বাড়িতে কাটাতে অসুবিধা হতো না?
প্রচারবিমুখতা ও লেখালেখি না করার প্রবণতা তিনি পেয়ে থাকবেন তাঁর মামা অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের থেকে। তাঁর মতো পাঠক আমি বেশি দেখিনি। বিচিত্র বিষয়ে পড়ে আনন্দ পেতেন। পঠিত কোনো আকর্ষণীয় বিষয় অন্যের সঙ্গে আলোচনা করতেও পছন্দ করতেন। কিন্তু কোনো বিষয়ে লেখার আগ্রহ ছিল না। পোশাক-পরিচ্ছদে উদাসীন। সাংবাদিক হিসেবে বিদেশভ্রমণে একেবারেই অনাগ্রহ, অবশ্য ঠেলাঠেলি করে আমরা তাঁকে দু-একবার পাঠিয়েছি। নৃপেন চক্রবর্তী বহুদিন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। হাসান ভাইকে বলেছি, সেখানে ঘুরে আসতে। যাননি। বৈষয়িক ব্যাপারে বিরক্তিকর উদাসীন।
আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে খুব কমই যেতেন। তাঁকে তিনটি স্থানের যেকোনো একটিতে পাওয়া যেতই। একটি তাঁর বাসা, যেখানে তিনি দিনের কম সময়ই থাকতেন। আর দুটি বাসস অফিস ও প্রেসক্লাব। এই দুটিতে থাকতেন দিনের ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা। ব্রিজ ও হাউসি খেলায় ছিলেন দক্ষ। জাতীয় প্রেসক্লাবের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা; ছিলেন তার সেক্রেটারি।
এক নাগাড়ে ৩০ ঘণ্টার বেশি টেবিলে বসে কাজ করতে আমি তাঁকে দেখেছি বিভিন্ন অস্বাভাবিক ঘটনার সময়। কাজ না থাকলে চেয়ারে পা গুটিয়ে বই বা পত্রিকা পড়তেন। মার্ক্সবাদী সাহিত্য ছিল তাঁর খুব প্রিয় বিষয়।
হাসান ভাইদের মতো কর্মী, সৎ ও নির্লোভ মানুষ চলে গেলে সমাজে শূন্যতার সৃষ্টি হয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments