থাইল্যান্ডে গণকবর ও ‘ফোরটুয়েন্টি’ ধারা by মো. খুরশীদ আলম খান
থাইল্যান্ডের
গণকবরে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশির সন্ধানলাভের হৃদয়বিদারক খবর আমাদের প্রচলিত
আইনের আওতায় প্রতারণা ও জালজালিয়াতির বিচারের কার্যকারিতাকে জ্বলন্ত
প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। কারণ, গণকবর ট্র্যাজেডি ইঙ্গিত করছে যে মানব
পাচার চক্র, যাদের সচেতন মহল ‘ফোরটুয়েন্টি’ হিসেবেই জানে, তারা নিরীহ
মানুষকে ধোঁকা দিয়ে নিরাপদ থাকার এক স্বর্গরাজ্য রচনা করেছে। এ প্রসঙ্গে
আমি ২০১৩ সালে দুদক তফসিলে দণ্ডবিধির ৪২০ ধারাটি অন্তর্ভুক্ত করার ওপর
বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। এ ধারা এখন মৃতবৎ, থেকেও নেই। আদালতে
প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন আইনি ব্যাখ্যার সম্মুখীন। ৪২০ ধারায় মামলা কার্যত
বন্ধই হয়ে গেছে। সর্বস্তরের প্রতারকেরা তাই উল্লাসে নৃত্য করছে। কারণ,
প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির কোনো মামলা নিচ্ছে না থানা ও মহানগর দায়রা আদালত।
প্রতারণা, ঘুষ, জমি জাল-জালিয়াতির অভিযোগ আমলে নেওয়ার সব দায় দুদকের, অথচ
লোকবিহীন সংস্থাটি বাস্তবে নিধিরাম সর্দার।
যেসব ধারা দুদক আইনের তফসিলভুক্ত করা হয়েছে, সেগুলো হলো সরকারি কর্মচারী হয়ে ঘুষ নেওয়া, ঘুষ দেওয়া, ঘুষ নিয়ে প্রভাব সৃষ্টি, বেআইনিভাবে নিলাম ডাকসংক্রান্ত অপরাধ। কাউকে বাঁচাতে সরকারি কর্মচারীদের আইন ভঙ্গ বা ভুয়া দলিল প্রণয়ন করা, সরকারি কর্মচারীদের বিশ্বাস ভঙ্গ, ব্যাংক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অবহেলা, প্রতারণার মাধ্যমে দলিল জাল করা ও তার ব্যবহার। এর সবটাই জামিন অযোগ্য করা হয়েছে।
দেশে থানায় যত মামলা হয়, তার এক-তৃতীয়াংশই জমির দলিল জালিয়াতি, মানব চোরাচালান ও ভুয়া চাকরিসংক্রান্ত। থাইল্যান্ডের গণকবরের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে এসব আইনের কার্যকর প্রয়োগ কতটা জরুরি। পুলিশ বা সিআইডি এসব বিষয়ে তাদের আইনের আওতায় তদন্ত করবে কি না, তা নিয়ে বিভ্রান্তি চলছে। কারণ সংশোধিত দুদক আইন বলছে, এসব কাজ করবে দুদক। কিন্তু তদন্ত করার মতো পর্যাপ্ত জনবল দুদকের নেই। এতে একমাত্র লাভবান হচ্ছে আসামিরা আর বিভ্রান্ত হচ্ছেন অভিযোগকারীরা।
এই দ্বৈত ব্যবস্থা মামলা দায়েরে ও তদন্তে জটিলতা তৈরি করেছে। যদিও থানার এসব মামলা নিতে আইনি বাধা নেই। আবার ২০১৩ সালের সংশোধনীর আগেও থানা এসব মামলা নিয়ে তদন্তের জন্য দুদকেই পাঠাত। যেমন: ৪০৮, ৪০৯, ৪২০, ৪৬২ ধারার মামলা। তাহলে এখন দুদক আইনের তফসিলের অজুহাতে কেন পুলিশ মামলা গ্রহণ করবে না? উভয় পক্ষ মিলেমিশে কাজ করলে অবশ্য বিদ্যমান অচলাবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটতে পারে।
বেশ কিছুদিন আগে সোনা উদ্ধারের একটি মামলা রেকর্ড করে দুদকে পাঠিয়ে দেওয়ার উদাহরণও আছে। সুতরাং বলা যায়, মামলা নেওয়া না-নেওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট থানার কর্মকর্তাদের ওপর। এর জন্য দুদক আইন বা ফৌজদারি আইন মুখ্য নয়, থানার কর্মকর্তাদের ইচ্ছাই প্রধান। যদিও আইনে কোন পর্যায়ে এসে মামলা হস্তান্তর করা হবে, তার কোনো নীতিমালা নেই। বিপত্তিটা এখানেই। দেখা যাবে, এতে জটিলতা না কমে বরং তা বেড়ে যাবে বহুগুণে।
দুদক আইন অনুযায়ী এসব মামলার বিচারের এখতিয়ার এখন বিশেষ জজ আদালতের। এর ফলে এ ধরনের মামলায় হাকিম আদালতগুলো জামিন ও হাজিরা গ্রহণ করছেন না। এমনকি উচ্চ আদালত থেকে অন্তর্বর্তী জামিনে থাকা আসামির জামিনের আবেদনও অনেক ক্ষেত্রে গ্রহণ করছেন না হাকিম আদালত। কারণ, বতর্মান আইনে কোনো আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার মহানগর হাকিমদের রাখা হয়নি। প্রতারণার মাধ্যমে ৫০০ টাকা কিংবা ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ—এ দুই ধরনের অভিযোগের বিষয়েই এখন দুদকের আশ্রয় নিতে হবে, আর জটিলতা সেখানেই।
সংশোধিত আইনের ফলে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে মামলাগুলো দায়রা জজ আদালতে চলে যাবে। ফলে দায়রা আদালতে মামলার সংখ্যা বাড়বে। এ কারণে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির কাজ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তা ছাড়া দায়রা জজ আদালতেও মামলার সংখ্যা বাড়বে।
সামগ্রিক দিক বিবেচনায় এ বিষয় নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা অত্যন্ত জরুরি এবং বিষয়টি জনগুরুত্বসম্পন্ন। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার বিরাট সর্বনাশ ঘটছে। এখন অধিকাংশ ঘটনায় জালিয়াতি ও প্রতারক চক্রকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হচ্ছে। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দর এলাকায় জাল-জালিয়াতি ও প্রতারক চক্রকে নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। সর্বশেষে চোরাই সোনা ও পুলিশের তিন সদস্যসহ চারজনকে গ্রেপ্তারের পর মামলা করতে দুদকের কাছে লিখিত অনুমতি চায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। অনুমতি না পাওয়ায় ওই চারজনকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এটা তো চলতে পারে না।
জালিয়াতি করে বিদেশে গমনে ইচ্ছুকদের হাতেনাতে গ্রেপ্তারের পরও তাৎক্ষণিক দুদকের অনুমতি না পাওয়ায় এখন অনেক ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় করে ৫৪ ধারা ব্যবহার করে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে পুলিশ। বিমানবন্দরে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থা এসব ব্যক্তিকে আটক করে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের জন্য দুদকে চিঠি দেওয়া হয়। এখনো বিমানবন্দরে গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের ব্যাপারে দুদক কোনো মতামত দেয়নি। অনুমতি পাওয়ার অপেক্ষার জন্য তো আসামি হাতে রাখা যায় না, তাই বাধ্য হয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এ কারণে জালিয়াতি ও প্রতারণা করেও ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় আসামি হওয়ায় তারা সুবিধা পাচ্ছে। অনেকে জামিনে ছাড়াও পাচ্ছে।
ঢাকা মহানগরে বর্তমানে তদন্তাধীন সাড়ে তিন হাজারের বেশি মামলার মধ্যে ১ হাজার ২০০ মামলাই জালিয়াতি ও প্রতারণাসংক্রান্ত ধারায়। এসব মামলার তদন্তের ভার দুদকের ওপর ন্যস্ত হওয়ায় এটি প্রতিষ্ঠানটির মূল স্পিরিটের সঙ্গেও মানানসই নয়। এমনকি প্রতিনিয়ত শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে জালিয়াতি ও প্রতারণার ঘটনা ঘটে, অথচ সর্বত্র দুদকের নেটওয়ার্ক নেই। তাই এসব ধারায় মামলা নিয়ে গ্রামের বাসিন্দারা বেশি ভোগান্তিতে পড়ছে ও পড়বে।
এতে লক্ষণ ফুটে উঠেছে যে সংসদ ও সরকারব্যবস্থা কার্যকারিতা হারিয়েছে। তা-ই যদি না হবে, তাহলে যে দেশে প্রতিদিন গড়ে ৪২০-এর আওতায় কমপক্ষে হাজারের বেশি মামলা হয়, সে দেশের সংসদ কী করে পুলিশের এখতিয়ার রহিত করে তা দুদককে দিতে পারে? সন্দেহ নেই যে ২০১৩ সালের নভেম্বরে দুদক আইনে সংশোধনী এনে তুঘলকি নীতি অনুসরণ করা হয়েছে।
তবে বলা হচ্ছে, ওই পদক্ষেপের পরেই উল্লিখিত অভিযোগ ও মামলা নিয়ে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, ওই সংশোধনীর আগেও এ ধরনের অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া গতিসম্পন্ন ছিল, তা বলা যাবে না।
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী কয়েক দিন আগেই বলেছিলেন, বিষয়টি তিনি অবগত আছেন। কিন্তু এরই মধ্যে অনেক সময় চলে গেছে। বিষয়টির এখনই সুরাহা প্রয়োজন। দণ্ডবিধির ৪২০ ধারা দুদক তফসিলে থাকবে কি না, থাকলে কতটুকু থাকবে, সেটার সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। দিন যতই যাচ্ছে, ততই আইনি জটিলতা বাড়ছে। ইদানীং নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলায়ও দণ্ডবিধির ৪২০ ধারা সংযুক্ত করা হচ্ছে, সেখানেও আইনি নানা ব্যাখ্যার উদ্ভব হচ্ছে। কাজেই বিষয়টির এখনই সমাধান দরকার। কারণ আদালতের প্রতিটি কার্যদিবসেই এ নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে দুদক আইনজীবীদের।
এবার ৪০৮ ধারা নিয়ে বলি। যে ব্যক্তি কেরানি বা চাকর হয়ে বা অনুরূপ ক্ষমতায় কোনো সম্পত্তির ওপর কোনো প্রকার আধিপত্যের ভারপ্রাপ্ত হয়ে ওই সম্পত্তি সম্পর্কে অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ করেন, তাঁর অনূর্ধ্ব সাত বছর জেল হবে। এই অপরাধ দুদক আইন, ২০০৪ আসার আগে আদালতের অনুমতি নিয়ে আপসযোগ্য ছিল। একজন কর্মচারী অর্থ আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার পর যদি আদালতে বিচার চলাকালে দোষ স্বীকার করে টাকা ফিরিয়ে দিত, তাহলে আদালত রাজি হতেন। কারণ মামলার বাদী টাকা ফেরত পেলে তাঁরও কোনো অভিযোগ থাকত না। কিন্তু এখন ধারাটি দুদকের তফসিলভুক্ত হওয়ার কারণে আর মামলা আপসের সুযোগ নেই। এখন এ ধারার মামলার তদন্ত করছে দুদক, বিচার চলে বিশেষ আদালতগুলোয়। অথচ আপস না হলেও মামলার বাদীরা আগের মতোই টাকা ফেরত পেলে তিনি আর মামলায় সাক্ষ্য দিতে বা মামলার তদবিরও করতে চান না। অভিযুক্ত ব্যক্তিরও অব্যাহতি পাওয়ার সুযোগ নেই।
একটি কার্যকর বিচারব্যবস্থায় অপরাধীকে শোধরানোরও সুযোগ দিতে হবে। সার্বিক দিক বিবেচনায় অবিলম্বে ৪২০ ও ৪০৮ ধারা দুদকের তফসিল থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানাই।
মো. খুরশীদ আলম খান: জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, দুদক ও সম্পাদক, ডিএলআর।
যেসব ধারা দুদক আইনের তফসিলভুক্ত করা হয়েছে, সেগুলো হলো সরকারি কর্মচারী হয়ে ঘুষ নেওয়া, ঘুষ দেওয়া, ঘুষ নিয়ে প্রভাব সৃষ্টি, বেআইনিভাবে নিলাম ডাকসংক্রান্ত অপরাধ। কাউকে বাঁচাতে সরকারি কর্মচারীদের আইন ভঙ্গ বা ভুয়া দলিল প্রণয়ন করা, সরকারি কর্মচারীদের বিশ্বাস ভঙ্গ, ব্যাংক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অবহেলা, প্রতারণার মাধ্যমে দলিল জাল করা ও তার ব্যবহার। এর সবটাই জামিন অযোগ্য করা হয়েছে।
দেশে থানায় যত মামলা হয়, তার এক-তৃতীয়াংশই জমির দলিল জালিয়াতি, মানব চোরাচালান ও ভুয়া চাকরিসংক্রান্ত। থাইল্যান্ডের গণকবরের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে এসব আইনের কার্যকর প্রয়োগ কতটা জরুরি। পুলিশ বা সিআইডি এসব বিষয়ে তাদের আইনের আওতায় তদন্ত করবে কি না, তা নিয়ে বিভ্রান্তি চলছে। কারণ সংশোধিত দুদক আইন বলছে, এসব কাজ করবে দুদক। কিন্তু তদন্ত করার মতো পর্যাপ্ত জনবল দুদকের নেই। এতে একমাত্র লাভবান হচ্ছে আসামিরা আর বিভ্রান্ত হচ্ছেন অভিযোগকারীরা।
এই দ্বৈত ব্যবস্থা মামলা দায়েরে ও তদন্তে জটিলতা তৈরি করেছে। যদিও থানার এসব মামলা নিতে আইনি বাধা নেই। আবার ২০১৩ সালের সংশোধনীর আগেও থানা এসব মামলা নিয়ে তদন্তের জন্য দুদকেই পাঠাত। যেমন: ৪০৮, ৪০৯, ৪২০, ৪৬২ ধারার মামলা। তাহলে এখন দুদক আইনের তফসিলের অজুহাতে কেন পুলিশ মামলা গ্রহণ করবে না? উভয় পক্ষ মিলেমিশে কাজ করলে অবশ্য বিদ্যমান অচলাবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটতে পারে।
বেশ কিছুদিন আগে সোনা উদ্ধারের একটি মামলা রেকর্ড করে দুদকে পাঠিয়ে দেওয়ার উদাহরণও আছে। সুতরাং বলা যায়, মামলা নেওয়া না-নেওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট থানার কর্মকর্তাদের ওপর। এর জন্য দুদক আইন বা ফৌজদারি আইন মুখ্য নয়, থানার কর্মকর্তাদের ইচ্ছাই প্রধান। যদিও আইনে কোন পর্যায়ে এসে মামলা হস্তান্তর করা হবে, তার কোনো নীতিমালা নেই। বিপত্তিটা এখানেই। দেখা যাবে, এতে জটিলতা না কমে বরং তা বেড়ে যাবে বহুগুণে।
দুদক আইন অনুযায়ী এসব মামলার বিচারের এখতিয়ার এখন বিশেষ জজ আদালতের। এর ফলে এ ধরনের মামলায় হাকিম আদালতগুলো জামিন ও হাজিরা গ্রহণ করছেন না। এমনকি উচ্চ আদালত থেকে অন্তর্বর্তী জামিনে থাকা আসামির জামিনের আবেদনও অনেক ক্ষেত্রে গ্রহণ করছেন না হাকিম আদালত। কারণ, বতর্মান আইনে কোনো আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার মহানগর হাকিমদের রাখা হয়নি। প্রতারণার মাধ্যমে ৫০০ টাকা কিংবা ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ—এ দুই ধরনের অভিযোগের বিষয়েই এখন দুদকের আশ্রয় নিতে হবে, আর জটিলতা সেখানেই।
সংশোধিত আইনের ফলে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে মামলাগুলো দায়রা জজ আদালতে চলে যাবে। ফলে দায়রা আদালতে মামলার সংখ্যা বাড়বে। এ কারণে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির কাজ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তা ছাড়া দায়রা জজ আদালতেও মামলার সংখ্যা বাড়বে।
সামগ্রিক দিক বিবেচনায় এ বিষয় নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা অত্যন্ত জরুরি এবং বিষয়টি জনগুরুত্বসম্পন্ন। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার বিরাট সর্বনাশ ঘটছে। এখন অধিকাংশ ঘটনায় জালিয়াতি ও প্রতারক চক্রকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হচ্ছে। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দর এলাকায় জাল-জালিয়াতি ও প্রতারক চক্রকে নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। সর্বশেষে চোরাই সোনা ও পুলিশের তিন সদস্যসহ চারজনকে গ্রেপ্তারের পর মামলা করতে দুদকের কাছে লিখিত অনুমতি চায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। অনুমতি না পাওয়ায় ওই চারজনকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এটা তো চলতে পারে না।
জালিয়াতি করে বিদেশে গমনে ইচ্ছুকদের হাতেনাতে গ্রেপ্তারের পরও তাৎক্ষণিক দুদকের অনুমতি না পাওয়ায় এখন অনেক ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় করে ৫৪ ধারা ব্যবহার করে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে পুলিশ। বিমানবন্দরে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থা এসব ব্যক্তিকে আটক করে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের জন্য দুদকে চিঠি দেওয়া হয়। এখনো বিমানবন্দরে গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের ব্যাপারে দুদক কোনো মতামত দেয়নি। অনুমতি পাওয়ার অপেক্ষার জন্য তো আসামি হাতে রাখা যায় না, তাই বাধ্য হয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এ কারণে জালিয়াতি ও প্রতারণা করেও ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় আসামি হওয়ায় তারা সুবিধা পাচ্ছে। অনেকে জামিনে ছাড়াও পাচ্ছে।
ঢাকা মহানগরে বর্তমানে তদন্তাধীন সাড়ে তিন হাজারের বেশি মামলার মধ্যে ১ হাজার ২০০ মামলাই জালিয়াতি ও প্রতারণাসংক্রান্ত ধারায়। এসব মামলার তদন্তের ভার দুদকের ওপর ন্যস্ত হওয়ায় এটি প্রতিষ্ঠানটির মূল স্পিরিটের সঙ্গেও মানানসই নয়। এমনকি প্রতিনিয়ত শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে জালিয়াতি ও প্রতারণার ঘটনা ঘটে, অথচ সর্বত্র দুদকের নেটওয়ার্ক নেই। তাই এসব ধারায় মামলা নিয়ে গ্রামের বাসিন্দারা বেশি ভোগান্তিতে পড়ছে ও পড়বে।
এতে লক্ষণ ফুটে উঠেছে যে সংসদ ও সরকারব্যবস্থা কার্যকারিতা হারিয়েছে। তা-ই যদি না হবে, তাহলে যে দেশে প্রতিদিন গড়ে ৪২০-এর আওতায় কমপক্ষে হাজারের বেশি মামলা হয়, সে দেশের সংসদ কী করে পুলিশের এখতিয়ার রহিত করে তা দুদককে দিতে পারে? সন্দেহ নেই যে ২০১৩ সালের নভেম্বরে দুদক আইনে সংশোধনী এনে তুঘলকি নীতি অনুসরণ করা হয়েছে।
তবে বলা হচ্ছে, ওই পদক্ষেপের পরেই উল্লিখিত অভিযোগ ও মামলা নিয়ে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, ওই সংশোধনীর আগেও এ ধরনের অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া গতিসম্পন্ন ছিল, তা বলা যাবে না।
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী কয়েক দিন আগেই বলেছিলেন, বিষয়টি তিনি অবগত আছেন। কিন্তু এরই মধ্যে অনেক সময় চলে গেছে। বিষয়টির এখনই সুরাহা প্রয়োজন। দণ্ডবিধির ৪২০ ধারা দুদক তফসিলে থাকবে কি না, থাকলে কতটুকু থাকবে, সেটার সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। দিন যতই যাচ্ছে, ততই আইনি জটিলতা বাড়ছে। ইদানীং নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলায়ও দণ্ডবিধির ৪২০ ধারা সংযুক্ত করা হচ্ছে, সেখানেও আইনি নানা ব্যাখ্যার উদ্ভব হচ্ছে। কাজেই বিষয়টির এখনই সমাধান দরকার। কারণ আদালতের প্রতিটি কার্যদিবসেই এ নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে দুদক আইনজীবীদের।
এবার ৪০৮ ধারা নিয়ে বলি। যে ব্যক্তি কেরানি বা চাকর হয়ে বা অনুরূপ ক্ষমতায় কোনো সম্পত্তির ওপর কোনো প্রকার আধিপত্যের ভারপ্রাপ্ত হয়ে ওই সম্পত্তি সম্পর্কে অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ করেন, তাঁর অনূর্ধ্ব সাত বছর জেল হবে। এই অপরাধ দুদক আইন, ২০০৪ আসার আগে আদালতের অনুমতি নিয়ে আপসযোগ্য ছিল। একজন কর্মচারী অর্থ আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার পর যদি আদালতে বিচার চলাকালে দোষ স্বীকার করে টাকা ফিরিয়ে দিত, তাহলে আদালত রাজি হতেন। কারণ মামলার বাদী টাকা ফেরত পেলে তাঁরও কোনো অভিযোগ থাকত না। কিন্তু এখন ধারাটি দুদকের তফসিলভুক্ত হওয়ার কারণে আর মামলা আপসের সুযোগ নেই। এখন এ ধারার মামলার তদন্ত করছে দুদক, বিচার চলে বিশেষ আদালতগুলোয়। অথচ আপস না হলেও মামলার বাদীরা আগের মতোই টাকা ফেরত পেলে তিনি আর মামলায় সাক্ষ্য দিতে বা মামলার তদবিরও করতে চান না। অভিযুক্ত ব্যক্তিরও অব্যাহতি পাওয়ার সুযোগ নেই।
একটি কার্যকর বিচারব্যবস্থায় অপরাধীকে শোধরানোরও সুযোগ দিতে হবে। সার্বিক দিক বিবেচনায় অবিলম্বে ৪২০ ও ৪০৮ ধারা দুদকের তফসিল থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানাই।
মো. খুরশীদ আলম খান: জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, দুদক ও সম্পাদক, ডিএলআর।
No comments