যুক্তরাজ্যের নির্বাচন থেকে আমরা যা শিক্ষা নিতে পারি by মহিউদ্দিন আহমদ
যুক্তরাজ্যের
সদ্য সমাপ্ত সাধারণ নির্বাচনে ১২ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থী
লড়েছিলেন। এঁদের তিনজন বিজয়ী হয়েছেন—রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক ও রূপা
হক। তিনজনই লেবার পার্টির ও উচ্চশিক্ষিত; রুশনারা পড়েছেন অক্সফোর্ডে, রূপা
কেমব্রিজে এবং টিউলিপ কিংস কলেজে। তাঁদের কেউ সরকারি দল কনজারভেটিভ পার্টির
এমপি নন; কিন্তু তাই বলে তাঁদের প্রতি সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা বৈষম্য
করবেন না। আর দল-নির্বিশেষে তাঁদের নির্বাচনী এলাকার প্রত্যেক নাগরিকই এই
এমপিদের কাছ থেকে সমান সুযোগ-সুবিধা ও সম্মান পাবেন; তাঁরা সমানভাবে আদৃতও
হবেন। কোনো নাগরিক এমপির সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তাঁর দলীয় পরিচয় কখনোই
জানতে চাওয়া হয় না।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকায় প্রত্যেক এমপির অফিস ও স্টাফ থাকে। এমপি সাহেব সপ্তাহের কোন কোন দিন কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত এই অফিসে থাকবেন, তা নির্বাচনী এলাকার সবাইকে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়।
টিউলিপ এই নির্বাচনে জয়ের ব্যবধান বাড়িয়েছেন। ২০১০-এর নির্বাচনে টিউলিপের হ্যাম্পটেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসনে লেবার-দলীয় প্রার্থী অস্কার পুরস্কার বিজয়ী অভিনেত্রী গ্লেন্ডা জ্যাকসন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থীর চেয়ে মাত্র ৪২ ভোট বেশি পেয়েছিলেন। টিউলিপ এবার ১ হাজার ১৩৮ ভোট বেশি পেয়েছেন। এই ব্যবধান বাড়ানোটা তাঁর কৃতিত্ব। রুশনারার ভোটের ব্যবধান এই তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৪ হাজার ৩১৭; আর সবচেয়ে কম রূপার মাত্র ২৭৪ ভোট।
উন্নত গণতন্ত্রে এই ফিগারগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণ করা হয় নির্বাচনের পর। নির্বাচনে সবগুলো আসনে কোন দল জাতীয়ভাবে মোট কত ভোট পেল, মোট ভোটের শতাংশ হারে তা কত, ৬৫০টি আসনের কোনটিতে কত ভোট, এক পার্টি থেকে অন্য পার্টিতে ‘সুইং’ করেছে, কেন এমনটি হলো, কী কী ব্যর্থতা ছিল, পরের নির্বাচনে তা কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যাবে, এমন শত শত প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও বিশ্লেষণ চলতে থাকবে। এমন সব আলোচনা-বিশ্লেষণের জন্য পেশাজীবী বিশ্লেষক, অভিজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যক্তিদেরও সাহায্য নেওয়া হবে।
এবারের নির্বাচনে বড় চমক হলো স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি, স্কটল্যান্ডের জন্য নির্ধারিত ৫৯টি আসনের মধ্যে ৫৬টিতেই বিজয়ী হয়। ২০১০-এর নির্বাচনে তাদের আসনসংখ্যা ছিল মাত্র ৬। গত নির্বাচনে যেখানে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্যসংখ্যা ছিল ৫৭, এবারে নেমে এসেছে ৮-এ। এই আটজনকে বহন করার জন্য মাত্র দুটি ট্যাক্সিই যথেষ্ট, এমন উপহাসও করা হচ্ছে এই দলটিকে নিয়ে।
কিন্তু কট্টর অভিবাসী ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন-বিদ্বেষী যে ‘ইউকিপ’ ‘ইউনাইটেড কিংডম ইনডিপেনডেন্টস পার্টি’ মোট ভোট পেয়েছে প্রায় ৩৯ লাখ, তার প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছে মাত্র একটি আসনে। অথচ তার বিপরীতে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির মোট ভোটসংখ্যা হচ্ছে প্রায় ১৫ লাখ, কিন্তু আসনসংখ্যা ৫৬।
দুই...
রাজনীতি কেমন নিষ্ঠুর ও ‘ব্লাড স্পোর্ট’ হতে পারে, আমরা তা পাকিস্তান আমলে, পরে বাংলাদেশেও অনেকবার দেখেছি। যুক্তরাজ্যের এই নির্বাচনেও তা আবার দেখা গেল। যখন পরিষ্কার হতে থাকল যে সব জনমত জরিপকে ভুল প্রমাণ করে কনজারভেটিভ পার্টির ডেভিড ক্যামেরন আবার প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, স্কটল্যান্ডে লেবার পার্টি নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছে; লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির বিপর্যয় ঘটেছে, ‘ইউকিপ’-এর নেতা নাইজেল ফারাজ নিজেই জিততে পারেননি; তখন থেকেই এই শেষ তিন দলের তিন নেতার পদত্যাগের জল্পনা শুরু হয়। দুপুরের মধ্যেই লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ড লিব-ডেমের নেতা নিক ক্লেগ ও নাইজেল ফারাজ পদত্যাগের ঘোষণা দেন। পদ আঁকড়ে ধরে রাখার সংস্কৃতি একদম নেই সেসব দেশে; যেমন আছে আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। ‘অ্যাপ্রে মোয়া, ল ডিলুজ’, (আমি না থাকলে দেশে মহাপ্লাবন ঘটে যাবে) এই ফরাসি প্রবাদের কোনো স্থান নেই পশ্চিমা দেশগুলোতে, যেমনটি বিশ্বাস করেন এই অঞ্চলের নেতা-নেত্রীরা।
আমাদের নেতা-নেত্রীদের কাছে দলের অন্য সবাই জিম্মি থাকেন। দলের কে কোন পদে থাকবেন, কোন নির্বাচনে দলের কে কোথায় মনোনয়ন পাবেন, তা ঢাকা থেকে নেত্রী-নেতারাই ঠিক করে দেন। কিন্তু যুক্তরাজ্যে তা হয় না। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নেতা-নেত্রীদের বন্দনা থাকে না এমপিদের বক্তৃতার শুরুতে বা শেষে। টিউলিপের আসনে আগের লেবার এমপি গ্লেন্ডা জ্যাকসন তাঁর নেতা প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের প্রকাশ্যে তীব্র বিরোধিতা করে বারবার মনোনয়ন পেয়েছেন। কারণ, তিনি তাঁর কাছে জিম্মি ছিলেন না। গ্লেন্ডা জ্যাকসনকে ওই আসন থেকে মনোনয়ন দিয়েছে লেবার পার্টির ওই নির্বাচনী এলাকার স্থানীয় শাখা, লেবার পার্টির হেড অফিস লন্ডন থেকে নয়। একইভাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে টিউলিপ, রুশনারা ও রূপাকেও তাঁদের নিজ নিজ এলাকার শাখা থেকে। আর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা। এড মিলিব্যান্ড ও নিক ক্লেগের দল দুটি পরাজিত হয়েছে; তাঁরা ইতিমধ্যে পদত্যাগও করেছেন দলের নেতৃত্ব থেকে। কিন্তু নির্বাচনের পরদিন ব্রিটিশ সময় বেলা তিনটায় বিবিসি টিভিতে দেখি, তাঁরা দুজন প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ৭০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে নিহত-আহতদের প্রতি সম্মান জানিয়ে সেন্ট্রাল লন্ডনের একটি স্মৃতিসৌধে ফুল দিলেন। প্রকৃত গণতন্ত্রে জাতীয় ইস্যুতে তো এমনই হওয়ার কথা।
তিন...
যুক্তরাজ্য সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে। আমাদের গণতন্ত্রচর্চা যুক্তরাজ্যের ধারেকাছেও নেই। আমার মনে পড়ছে স্কটল্যান্ডের একটি আসন থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেবার পার্টির প্রার্থী সুমন হকের কথা। মনোনয়ন পাওয়ার পর যখন জানা গেল, সুমন হক মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন, তখন লেবার পার্টি মনোনয়নটি প্রত্যাহার করে নেয়। কোনো আসামি বা দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সেখানে মনোনয়ন দেওয়ার কথা কোনো দল ভাবতেই পারে না। এই সুমন হকের বিপরীতে আমাদের সাংসদদের তুলনা করুন। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় তাঁদের দেওয়া হলফনামাগুলো দেখুন।
কক্সবাজারের এমপি আবদুর রহমান বদি, মিরপুরের এমপি ইলিয়াস মোল্লাহ ও যশোরের এমপি ‘বিড়ি’ আকিজের ছেলে শেখ আফিল উদ্দিন—তিনজনই খোদ পুলিশ পিটিয়েই খবরের শিরোনাম হয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযুক্ত হওয়ার পর এমপি বদি যখন ঢাকা থেকে বিমানে কক্সবাজার যান, তখন তাঁর দল আওয়ামী লীগ থেকেই তাঁকে বিমানবন্দরে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। কক্সবাজার ও টেকনাফ সাম্প্রতিক দিনগুলোতে মানব পাচারের কারণে দেশ-বিদেশের বড় বড় খবরের কাগজে, টিভি-রেডিওতে খবরের শিরোনাম হয়েছে। শত শত নিরীহ বাংলাদেশি বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার গণকবরে ঠাঁই পেয়েছেন। তো, এই মানব পাচার বন্ধে এলাকার এমপি বদির ভূমিকাটা কী?
আমাদের দেশে অনুষ্ঠানে এলাকার স্থানীয় এমপিকে দাওয়াত দিয়ে প্রধান বা বিশেষ অতিথি না করলে তাঁর সন্ত্রাসীরা মঞ্চে ভাঙচুর চালায়, আয়োজকদের মারধর করে। কিন্তু সন্ত্রাস দমনে, মানব পাচার রোধে এই নির্বাচিত প্রতিনিধির ভূমিকাটা কী? যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে স্থানীয় এমপিরা বিপদে–আপদে মানুষের পাশে দাঁড়ান, যদিও সেখানে প্রধান বা বিশেষ অতিথি বানানোর রীতি বা সংস্কৃতি নেই।
পয়লা বৈশাখের সন্ধ্যায় টিএসসির পাশে নারী লাঞ্ছনার প্রতিবাদে ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয় ঘেরাওয়ের মিছিলে পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের পিটিয়েছে। আমাদের এমপিরা পুলিশ পেটান আর পুলিশ পেটায় ছাত্রছাত্রীদের! কিন্তু আমাদের জাতীয় সংসদে তো ৫০ জন সদস্য আছেন মহিলাদের সংরক্ষিত আসনে। তাঁদের একজনও কি পয়লা বৈশাখের টিএসসির লাঞ্ছিত নারীদের পক্ষে গত এক মাসে একটিও কথা উচ্চারণ করেছেন? পিছিয়ে পড়া নারীসমাজের জন্য কাজ করতেই তো বিশেষ বিবেচনায় এই ৫০টি সংরক্ষিত আসন। কিন্তু এই ৫০ জনকে এই ইস্যুতে একেবারে বোবা, বধির ও অন্ধ দেখতে পাচ্ছি। টিউলিপ সিদ্দিকের নির্বাচনী এলাকায় এমন যদি একটি ঘটনাও ঘটত, তিনি তোলপাড় সৃষ্টি করতেন। নির্বাচিত প্রতিনিধির তাই তো কাজ। মনে হচ্ছে নারী লাঞ্ছনার প্রতিকারে এখন আমাদের এই তিন ব্রিটিশ তরুণী এমপির সাহায্য চাইতে হবে।
উদাহরণ আরও আছে। নড়াইলে ববিতা খানমকে হাত-পা বেঁধে, পরে গাছের সঙ্গে আর একবার বেঁধে যারা মারধর করে আহত করেছে, তাদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন আমাদের হাইকোর্ট। তো এই ববিতা খানমেরও তো একজন এমপি আছেন, আছেন একজন উপজেলা চেয়ারম্যান, দু-দুজন ভাইস চেয়ারম্যান—এঁদের মধ্যে একজন কিন্তু নারী, একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানও। প্রশ্ন, এসব নির্বাচিত প্রতিনিধি ববিতা খানমের জন্য কে কী করেছেন? সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তার এত অঙ্গ সংগঠনের নেতা-নেত্রীরা কী করেছেন? আমাদের জেলা প্রশাসক, এমপি, ইউএনও, থানার দারোগা, তাঁদের কে কী করলেন? তাঁদের জবাবদিহি কোথায়? কার কাছে? কোনো নারী সংগঠন বা সহস্র নাগরিক কমিটিও কি ৫০ জন মহিলা এমপিকে তাঁদের দায়িত্ব পালনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে? বা সুশীল সমাজের আর কেউ? কক্সবাজারের হাজার হাজার বিপন্ন মানুষের চেয়ে কম গুরুত্বের এমন কোনো ঘটনা ঘটলে ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হতো।
যুক্তরাজ্যে একজন এমপির কী কী দায়িত্ব, তাঁরা কীভাবে তা পালন করেন, সে সম্পর্কে আমাদের জাতীয় সংসদের সদস্যদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য ওই তিন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপিকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসা যেতে পারে।
আমাদের সাংসদেরা ডিউটি ফ্রি গাড়ি আমদানি করবেন, টেন্ডার ভাগাভাগিতে থাকবেন, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে ভাগ চাইবেন, সংসদের পাঁচ বছর মেয়াদকালে প্রত্যেকে ২০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ পাবেন, এসবের কিছুই যুক্তরাজ্যের এমপিদের নেই। তার পরও নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের সব দায়িত্বই তাঁরা পালন করে থাকেন। এতে ব্যর্থ হলে হয়তো পার্টিই তাঁকে পরের নির্বাচনে মনোনয়ন দেবে না বা দিলেও তিনি নির্বাচিত হবেন না। এমপি পার্লামেন্টে কত দিন উপস্থিত থাকেন, বিভিন্ন সংস্থা তা-ও মনিটর করে পরের নির্বাচনকালে তা প্রকাশ করে।
ওসব দেশে ‘পলিটিকস ইজ ভেরি ক্রুয়েল’।
মহিউদ্দিন আহমদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক।
Mahiuddinahmed1944@yahoo.com
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকায় প্রত্যেক এমপির অফিস ও স্টাফ থাকে। এমপি সাহেব সপ্তাহের কোন কোন দিন কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত এই অফিসে থাকবেন, তা নির্বাচনী এলাকার সবাইকে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়।
টিউলিপ এই নির্বাচনে জয়ের ব্যবধান বাড়িয়েছেন। ২০১০-এর নির্বাচনে টিউলিপের হ্যাম্পটেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসনে লেবার-দলীয় প্রার্থী অস্কার পুরস্কার বিজয়ী অভিনেত্রী গ্লেন্ডা জ্যাকসন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থীর চেয়ে মাত্র ৪২ ভোট বেশি পেয়েছিলেন। টিউলিপ এবার ১ হাজার ১৩৮ ভোট বেশি পেয়েছেন। এই ব্যবধান বাড়ানোটা তাঁর কৃতিত্ব। রুশনারার ভোটের ব্যবধান এই তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৪ হাজার ৩১৭; আর সবচেয়ে কম রূপার মাত্র ২৭৪ ভোট।
উন্নত গণতন্ত্রে এই ফিগারগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণ করা হয় নির্বাচনের পর। নির্বাচনে সবগুলো আসনে কোন দল জাতীয়ভাবে মোট কত ভোট পেল, মোট ভোটের শতাংশ হারে তা কত, ৬৫০টি আসনের কোনটিতে কত ভোট, এক পার্টি থেকে অন্য পার্টিতে ‘সুইং’ করেছে, কেন এমনটি হলো, কী কী ব্যর্থতা ছিল, পরের নির্বাচনে তা কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যাবে, এমন শত শত প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও বিশ্লেষণ চলতে থাকবে। এমন সব আলোচনা-বিশ্লেষণের জন্য পেশাজীবী বিশ্লেষক, অভিজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যক্তিদেরও সাহায্য নেওয়া হবে।
এবারের নির্বাচনে বড় চমক হলো স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি, স্কটল্যান্ডের জন্য নির্ধারিত ৫৯টি আসনের মধ্যে ৫৬টিতেই বিজয়ী হয়। ২০১০-এর নির্বাচনে তাদের আসনসংখ্যা ছিল মাত্র ৬। গত নির্বাচনে যেখানে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্যসংখ্যা ছিল ৫৭, এবারে নেমে এসেছে ৮-এ। এই আটজনকে বহন করার জন্য মাত্র দুটি ট্যাক্সিই যথেষ্ট, এমন উপহাসও করা হচ্ছে এই দলটিকে নিয়ে।
কিন্তু কট্টর অভিবাসী ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন-বিদ্বেষী যে ‘ইউকিপ’ ‘ইউনাইটেড কিংডম ইনডিপেনডেন্টস পার্টি’ মোট ভোট পেয়েছে প্রায় ৩৯ লাখ, তার প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছে মাত্র একটি আসনে। অথচ তার বিপরীতে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির মোট ভোটসংখ্যা হচ্ছে প্রায় ১৫ লাখ, কিন্তু আসনসংখ্যা ৫৬।
দুই...
রাজনীতি কেমন নিষ্ঠুর ও ‘ব্লাড স্পোর্ট’ হতে পারে, আমরা তা পাকিস্তান আমলে, পরে বাংলাদেশেও অনেকবার দেখেছি। যুক্তরাজ্যের এই নির্বাচনেও তা আবার দেখা গেল। যখন পরিষ্কার হতে থাকল যে সব জনমত জরিপকে ভুল প্রমাণ করে কনজারভেটিভ পার্টির ডেভিড ক্যামেরন আবার প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, স্কটল্যান্ডে লেবার পার্টি নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছে; লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির বিপর্যয় ঘটেছে, ‘ইউকিপ’-এর নেতা নাইজেল ফারাজ নিজেই জিততে পারেননি; তখন থেকেই এই শেষ তিন দলের তিন নেতার পদত্যাগের জল্পনা শুরু হয়। দুপুরের মধ্যেই লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ড লিব-ডেমের নেতা নিক ক্লেগ ও নাইজেল ফারাজ পদত্যাগের ঘোষণা দেন। পদ আঁকড়ে ধরে রাখার সংস্কৃতি একদম নেই সেসব দেশে; যেমন আছে আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। ‘অ্যাপ্রে মোয়া, ল ডিলুজ’, (আমি না থাকলে দেশে মহাপ্লাবন ঘটে যাবে) এই ফরাসি প্রবাদের কোনো স্থান নেই পশ্চিমা দেশগুলোতে, যেমনটি বিশ্বাস করেন এই অঞ্চলের নেতা-নেত্রীরা।
আমাদের নেতা-নেত্রীদের কাছে দলের অন্য সবাই জিম্মি থাকেন। দলের কে কোন পদে থাকবেন, কোন নির্বাচনে দলের কে কোথায় মনোনয়ন পাবেন, তা ঢাকা থেকে নেত্রী-নেতারাই ঠিক করে দেন। কিন্তু যুক্তরাজ্যে তা হয় না। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নেতা-নেত্রীদের বন্দনা থাকে না এমপিদের বক্তৃতার শুরুতে বা শেষে। টিউলিপের আসনে আগের লেবার এমপি গ্লেন্ডা জ্যাকসন তাঁর নেতা প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের প্রকাশ্যে তীব্র বিরোধিতা করে বারবার মনোনয়ন পেয়েছেন। কারণ, তিনি তাঁর কাছে জিম্মি ছিলেন না। গ্লেন্ডা জ্যাকসনকে ওই আসন থেকে মনোনয়ন দিয়েছে লেবার পার্টির ওই নির্বাচনী এলাকার স্থানীয় শাখা, লেবার পার্টির হেড অফিস লন্ডন থেকে নয়। একইভাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে টিউলিপ, রুশনারা ও রূপাকেও তাঁদের নিজ নিজ এলাকার শাখা থেকে। আর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা। এড মিলিব্যান্ড ও নিক ক্লেগের দল দুটি পরাজিত হয়েছে; তাঁরা ইতিমধ্যে পদত্যাগও করেছেন দলের নেতৃত্ব থেকে। কিন্তু নির্বাচনের পরদিন ব্রিটিশ সময় বেলা তিনটায় বিবিসি টিভিতে দেখি, তাঁরা দুজন প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ৭০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে নিহত-আহতদের প্রতি সম্মান জানিয়ে সেন্ট্রাল লন্ডনের একটি স্মৃতিসৌধে ফুল দিলেন। প্রকৃত গণতন্ত্রে জাতীয় ইস্যুতে তো এমনই হওয়ার কথা।
তিন...
যুক্তরাজ্য সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে। আমাদের গণতন্ত্রচর্চা যুক্তরাজ্যের ধারেকাছেও নেই। আমার মনে পড়ছে স্কটল্যান্ডের একটি আসন থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেবার পার্টির প্রার্থী সুমন হকের কথা। মনোনয়ন পাওয়ার পর যখন জানা গেল, সুমন হক মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন, তখন লেবার পার্টি মনোনয়নটি প্রত্যাহার করে নেয়। কোনো আসামি বা দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সেখানে মনোনয়ন দেওয়ার কথা কোনো দল ভাবতেই পারে না। এই সুমন হকের বিপরীতে আমাদের সাংসদদের তুলনা করুন। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় তাঁদের দেওয়া হলফনামাগুলো দেখুন।
কক্সবাজারের এমপি আবদুর রহমান বদি, মিরপুরের এমপি ইলিয়াস মোল্লাহ ও যশোরের এমপি ‘বিড়ি’ আকিজের ছেলে শেখ আফিল উদ্দিন—তিনজনই খোদ পুলিশ পিটিয়েই খবরের শিরোনাম হয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযুক্ত হওয়ার পর এমপি বদি যখন ঢাকা থেকে বিমানে কক্সবাজার যান, তখন তাঁর দল আওয়ামী লীগ থেকেই তাঁকে বিমানবন্দরে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। কক্সবাজার ও টেকনাফ সাম্প্রতিক দিনগুলোতে মানব পাচারের কারণে দেশ-বিদেশের বড় বড় খবরের কাগজে, টিভি-রেডিওতে খবরের শিরোনাম হয়েছে। শত শত নিরীহ বাংলাদেশি বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার গণকবরে ঠাঁই পেয়েছেন। তো, এই মানব পাচার বন্ধে এলাকার এমপি বদির ভূমিকাটা কী?
আমাদের দেশে অনুষ্ঠানে এলাকার স্থানীয় এমপিকে দাওয়াত দিয়ে প্রধান বা বিশেষ অতিথি না করলে তাঁর সন্ত্রাসীরা মঞ্চে ভাঙচুর চালায়, আয়োজকদের মারধর করে। কিন্তু সন্ত্রাস দমনে, মানব পাচার রোধে এই নির্বাচিত প্রতিনিধির ভূমিকাটা কী? যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে স্থানীয় এমপিরা বিপদে–আপদে মানুষের পাশে দাঁড়ান, যদিও সেখানে প্রধান বা বিশেষ অতিথি বানানোর রীতি বা সংস্কৃতি নেই।
পয়লা বৈশাখের সন্ধ্যায় টিএসসির পাশে নারী লাঞ্ছনার প্রতিবাদে ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয় ঘেরাওয়ের মিছিলে পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের পিটিয়েছে। আমাদের এমপিরা পুলিশ পেটান আর পুলিশ পেটায় ছাত্রছাত্রীদের! কিন্তু আমাদের জাতীয় সংসদে তো ৫০ জন সদস্য আছেন মহিলাদের সংরক্ষিত আসনে। তাঁদের একজনও কি পয়লা বৈশাখের টিএসসির লাঞ্ছিত নারীদের পক্ষে গত এক মাসে একটিও কথা উচ্চারণ করেছেন? পিছিয়ে পড়া নারীসমাজের জন্য কাজ করতেই তো বিশেষ বিবেচনায় এই ৫০টি সংরক্ষিত আসন। কিন্তু এই ৫০ জনকে এই ইস্যুতে একেবারে বোবা, বধির ও অন্ধ দেখতে পাচ্ছি। টিউলিপ সিদ্দিকের নির্বাচনী এলাকায় এমন যদি একটি ঘটনাও ঘটত, তিনি তোলপাড় সৃষ্টি করতেন। নির্বাচিত প্রতিনিধির তাই তো কাজ। মনে হচ্ছে নারী লাঞ্ছনার প্রতিকারে এখন আমাদের এই তিন ব্রিটিশ তরুণী এমপির সাহায্য চাইতে হবে।
উদাহরণ আরও আছে। নড়াইলে ববিতা খানমকে হাত-পা বেঁধে, পরে গাছের সঙ্গে আর একবার বেঁধে যারা মারধর করে আহত করেছে, তাদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন আমাদের হাইকোর্ট। তো এই ববিতা খানমেরও তো একজন এমপি আছেন, আছেন একজন উপজেলা চেয়ারম্যান, দু-দুজন ভাইস চেয়ারম্যান—এঁদের মধ্যে একজন কিন্তু নারী, একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানও। প্রশ্ন, এসব নির্বাচিত প্রতিনিধি ববিতা খানমের জন্য কে কী করেছেন? সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তার এত অঙ্গ সংগঠনের নেতা-নেত্রীরা কী করেছেন? আমাদের জেলা প্রশাসক, এমপি, ইউএনও, থানার দারোগা, তাঁদের কে কী করলেন? তাঁদের জবাবদিহি কোথায়? কার কাছে? কোনো নারী সংগঠন বা সহস্র নাগরিক কমিটিও কি ৫০ জন মহিলা এমপিকে তাঁদের দায়িত্ব পালনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে? বা সুশীল সমাজের আর কেউ? কক্সবাজারের হাজার হাজার বিপন্ন মানুষের চেয়ে কম গুরুত্বের এমন কোনো ঘটনা ঘটলে ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হতো।
যুক্তরাজ্যে একজন এমপির কী কী দায়িত্ব, তাঁরা কীভাবে তা পালন করেন, সে সম্পর্কে আমাদের জাতীয় সংসদের সদস্যদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য ওই তিন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপিকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসা যেতে পারে।
আমাদের সাংসদেরা ডিউটি ফ্রি গাড়ি আমদানি করবেন, টেন্ডার ভাগাভাগিতে থাকবেন, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে ভাগ চাইবেন, সংসদের পাঁচ বছর মেয়াদকালে প্রত্যেকে ২০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ পাবেন, এসবের কিছুই যুক্তরাজ্যের এমপিদের নেই। তার পরও নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের সব দায়িত্বই তাঁরা পালন করে থাকেন। এতে ব্যর্থ হলে হয়তো পার্টিই তাঁকে পরের নির্বাচনে মনোনয়ন দেবে না বা দিলেও তিনি নির্বাচিত হবেন না। এমপি পার্লামেন্টে কত দিন উপস্থিত থাকেন, বিভিন্ন সংস্থা তা-ও মনিটর করে পরের নির্বাচনকালে তা প্রকাশ করে।
ওসব দেশে ‘পলিটিকস ইজ ভেরি ক্রুয়েল’।
মহিউদ্দিন আহমদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক।
Mahiuddinahmed1944@yahoo.com
No comments