জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে প্রতিবাদের ঝড় by ড. এম শামসুল আলম
৫ জানুয়ারি দিবাগত রাতে দেশ টেলিভিশনের 'সোজা কথা' অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। সঞ্চালক অনুষ্ঠানের শুরুতেই বলেছেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। এ ঝড়ের গতি বাড়ছে। তার প্রকৃতি উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কারণ না হয়ে পারে না।
অস্বাভাবিক দ্রুততম গতিতে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। যদি এ মূল্য বাড়ে, ঝড়ের গতি আরো বাড়বে, তাহলে তার প্রকৃতি এমনও হতে পারে যে মহাজোটকে আগামী নির্বাচনে বিপর্যয় মোকাবিলা করতে হবে। তেলের এই মূল্যবৃদ্ধিতে ২.৫ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হলেও ৬ জানুয়ারির এক দিনের হরতালে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হওয়ার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে, তার পরিমাণ এই সাশ্রয়ী অর্থ থেকে অনেক বেশি। বর্তমান সরকারি দলের রাজনৈতিক ক্ষতি কতটা হয়েছে, ৭ জানুয়ারি প্রথম আলোয় পাঠকের মন্তব্যে প্রকাশিত পাঠকদের বক্তব্যে তা বোঝা যায়। ওই মন্তব্যে পাঠকদের যেসব বক্তব্য ছিল, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ১. 'তেলের দাম বাড়ানোর প্রভাব এখন সারা দেশের সব সেবামূলক খাত বা পণ্যের দামের গতিশীলতাকে ত্বরান্বিত করবে। এর সুফল আগামী নির্বাচনে দেখতে পারবে সরকার!' ২. 'সরকার আইএমএফের মাত্র ১০০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষ ও কৃষকের ঘরে আগুন দিল।' এবং ৩. 'জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সরকার জনগণের জীবনকে গজবে পরিণত করেছে।' এমন রাজনৈতিক ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষার্থে সরকারের শরিক দল জাতীয় পার্টি বিএনপি জোটের ওই হরতালকে যৌক্তিক অভিহিত করে সরকারকে মূল্যবৃদ্ধির এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বলেছে এবং মহাজোটের অন্যতম অন্য শরিক দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি বলেছে, 'কোনো কারণ ছাড়াই আইএমএফকে তুষ্ট করতে আবারও হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।' জ্বালানি তেলের বৃদ্ধি করা মূল্য প্রত্যাহার এবং বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া বন্ধের দাবিতে বাম দলগুলো হরতালসহ নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ওই একই দাবিতে কর্মসূচি দিয়েছে। ৫ জানুয়ারি কালের কণ্ঠের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, 'অজুহাত ভর্তুকি কমানো, আর নেপথ্যে দাতাসংস্থার চাপ। সেই চাপের কাছে নতি স্বীকার করেই নির্বাহী আদেশে আবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়াল সরকার।'
মুদ্রাস্ফীতির মতো অভিঘাত থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য চলমান অর্থবছরে বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছে সরকার। তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও প্রক্রিয়াধীন বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি সরকারের এ অঙ্গীকারকে অর্থহীন করে ফেলেছে। অথচ এ মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে বলতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী যা কিছু বলেছেন, তাতে মনে হয়েছে, তিনি বিকারগ্রস্ত। তাই প্রলাপ বকছেন। জ্বালানি মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সমালোচনা করে বলেছে, তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকারের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তারা গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর সুপারিশ করেছে (৭ জানুয়ারি, কালের কণ্ঠ)।
ভোক্তা সংগঠন 'ক্যাব' ৫ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, বিইআরসি-আইন অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির একক এখতিয়ার বিইআরসির। সুতরাং নির্বাহী আদেশে জ্বালানি মন্ত্রণালয় কর্তৃক জ্বালানি তেলের এ মূল্যবৃদ্ধি আইনসম্মত হয়নি। তারা এ সিদ্ধান্ত স্থগিত করে তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিপিসির মাধ্যমে বিইআরসিতে পাঠানোর প্রস্তাব করেছে। নইলে পরিত্রাণ ও প্রতিকারের জন্য তারা আইনের আশ্রয় নেবে। ভোক্তারা অতি উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে। এখন তাদের পিঠ ঠেকে গেছে। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, ২০০৮ সালের ১৫ অক্টোবর জ্বালানিসচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় সভায় বিইআরসি আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, 'যেসব এনার্জি আমদানিনির্ভর এবং অথবা যেসব এনার্জির ট্যারিফ নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভর্তুকি প্রদান করে, সেসব এনার্জি যেমন- সিএনজির ট্যারিফ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হবে।' সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিআরসি আইনে এসব এনার্জির ট্যারিফ নির্ধারণের একক এবং একমাত্র এখতিয়ার বিইআরসির। এ ক্ষমতা খর্ব করার জন্য আইনের এ ধারা উক্তরূপ সংশোধনী প্রস্তাব ওই সভায় গৃহীত হয়। সভার ওই সিদ্ধান্তে আরো বলা হয়, ওই সংশোধনী অপরিহার্য বিবেচিত না হলে সরকার জরুরি প্রয়োজনে বিইআরসির সঙ্গে আলোচনাক্রমে এসব এনার্জির ট্যারিফ নির্ধারণ করতে পারবে। আইনের এ সংশোধনী প্রস্তাব উপদেষ্টা পরিষদের বিবেচনার জন্য প্রেরণের সিদ্ধান্তও ওই সভায় গৃহীত হয়।
অর্থ উপদেষ্টার সভাপতিত্বে ২০০৮ সালের ৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সভায় জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাসের যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, সে সিদ্ধান্তের ওপর বিইআরসির সম্মতি চেয়ে ১৬ অক্টোবর অর্থাৎ আইনের সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণের ঠিক এক দিন পর জ্বালানি মন্ত্রণালয় বিইআরসিকে ৫৮১ নম্বর পত্র দেয়। এ পত্রে ১ জুলাই থেকে গেজেটের মাধ্যমে কার্যকর করা তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনোত্তর সম্মতিও চাওয়া হয়। ওই আন্তমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্তের সঙ্গে এ পত্রের একটি নিবিড় যোগসূত্র আছে বোঝা যায়। এ পত্রের জবাবে ২০ অক্টোবর বিইআরসি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনোত্তর সম্মতি এবং মূল্য হ্রাসের সিদ্ধান্তে সম্মতি প্রদান করে যা বলেছে, তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য :
১. বিইআরসি-আইন অনুযায়ী বিইআরসি একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ রেগুলেটরি কমিশন।
২. এ আইনের ২২(খ) এবং অধ্যায় ৬ ও অধ্যায় ৭ মতে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থ বা জ্বালানি তেলের বিক্রয়মূল্য বা ট্যারিফ নির্ধারণের একক ও একমাত্র ক্ষমতা বিইআরসির।
৩. আইনের ২(খ) ও (ল) এবং ২৭(২) ধারা অনুযায়ী, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এই কমিশনের লাইসেন্সি।
৪. আইনের ২২(খ) এবং ৩১ ধারা অনুযায়ী- বিপিসি কর্তৃক দক্ষ, সুচারুভাবে, সমন্বিত এবং স্বল্প ব্যয়ে পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থের সঞ্চালন, বিপণন, বিতরণ ও সরবরাহ নিশ্চিত করার দায়িত্ব একমাত্র বিইআরসির, অর্থ উপদেষ্টা বা জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের নয়।
৫. আইনের ৩৪(৬) ধারামতে, বিপিসি গত ৪ মে জ্বালানি তেলের বিক্রয়মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব কমিশনের কাছে প্রেরণ করে।
৬. আইনি প্রক্রিয়ায় মূল্যবৃদ্ধির এই প্রস্তাবটি বিবেচনার প্রয়োজনে কমিশন কিছু তথ্য-উপাত্ত চেয়ে ১৩ মে বিপিসিকে এক পত্র দেয়।
৭. উক্ত তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ না করে বিইআরসির কাছে গত ৪ মে দাখিলকৃত তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিপিসি ৩০ জুন ২০০৮ সালের ৩০ জুন প্রত্যাহার করে এবং সরকার তেলের মূল্যবৃদ্ধি করে।
আন্তমন্ত্রণালয় সভার ওই সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়ে ক্যাবের পক্ষ থেকে ৫ নভেম্বর একটি লেখা জ্বালানিসচিব ও বিইআরসি চেয়ারম্যানকে পাঠানো হয়। চেয়ারম্যান এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। ওই লেখার ওপর উভয়েরই অভিমত পাওয়া যায়। চেয়ারম্যান তাঁর অভিমতে জানান, বিইআরসি আইনের ওই সংশোধনীটি সভায় গৃহীত হয়নি। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অভিমতে জানা যায়, বিইআরসির চেয়ারম্যানের প্রদত্ত মতামতের কারণে ওই সংশোধনীটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে।
তার পর থেকে আইনের ওই সংশোধনী ছাড়াই জ্বালানি মন্ত্রণালয় নির্বাহী আদেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে। ফলে ক্যাব কর্তৃক জ্বালানি মন্ত্রণালয় বিইআরসি-আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার, ২০০৮ সালে গ্যাসের আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলায় গ্যাসের মূল্য ৬৭ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসিতে আনা হয়। গণশুনানিতে প্রমাণিত হয়, গ্যাস খাতে আর্থিক ঘাটতি নেই। ববং এ খাত লাভজনক। ফলে এ প্রস্তাব বিইআরসি খারিজ করে। জ্বালানি তেলে যে পরিমাণ আর্থিক ঘাটতি দেখানো হচ্ছে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সে সন্দেহ নিরসন ছাড়াই গণশুনানি এড়িয়ে আইন অমান্য করে মন্ত্রণালয় বিপিসির সঙ্গে যোগসাজশে বারবার নির্বাহী আদেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি কেন করে? কেন এ মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসিতে আসে না?
জ্বালানি মন্ত্রণালয় তার ওই অভিমতে আরো বলেছে, বিইআরসি আইনে জ্বালানি তেলের মূল্য বছরে একবার পুনর্নির্ধারণের বিধান রাখা হয়েছে। এ বিধান বিদ্যুতের মূল্যের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। তথাপি বছরে চারবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি বিইআরসি করেছে। আবার ভূতাপেক্ষভাবে ২০১২ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে গণশুনানি ছাড়াই এডহক ভিত্তিতে বিদ্যুতের মূল্য একবারে গড়ে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। তার পরপরই ওই বৃদ্ধি আইনানুগ না করে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির নতুন প্রস্তাবগুলো সরাসরি গণশুনানিতে আনা হয়েছে এবং তা প্রক্রিয়াধীন থাকা অবস্থায় মূলবৃদ্ধির পক্ষে বিইআরসি প্রচার অব্যাহত রেখেছে। ফলে এ মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া আইনসম্মত না হওয়ার অভিযোগ এনে ক্যাব ৫ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে বলেছে :
২৭-১২-১২-এর পূর্বাহ্নে আরইবির ৯ শতাংশ, ৩০-১২-১২ পিডিবির ১২ শতাংশ ও ওজোপাডিকোর ৯.৫৯ শতাংশ এবং ৩১-১২-১২ ডেসকোর ১১.৬৯ শতাংশ ও ডিপিডিসির ১১.৩১ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবগুলোর ওপর বিইআরসিতে গণশুনানি হয়েছে। ওই গণশুনানিতে ক্যাব এ মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে তীব্র বিরোধিতা করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় শুনানি-পরবর্তী ৩ জানুয়ারি বিইআরসিতে দাখিল করা লিখিত মতামতে ক্যাব বলছে :
১. অস্বাভাবিক স্বল্পতম সময়ে পাঁচটি ইউটিলিটির মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি হয়েছে। ফলে তা অসংগতিপূর্ণ ও ন্যায়বিচারের উপযোগী নয়।
২. প্রস্তাব প্রমাণের দায়িত্ব প্রস্তাবকারীর। আরইবির প্রস্তাবের যৌক্তিকতা প্রমাণ হয়নি। গণশুনানিতে তাদের আর্থিক ঘাটতি নেই প্রমাণ হয়েছে। বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, আরইবির মূল্যবৃদ্ধির অবকাশ নেই।
৩. গণশুনানিতে জানা যায়, এ অর্থবছরে তেল-বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য তেল-বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্লান্ট-ফ্যাক্টর বেশি ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বর্তমানে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির ফলে গ্যাস-বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি হচ্ছে। ফলে তেল সাশ্রয় হচ্ছে। তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমেছে। ভবিষ্যতে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বিধায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাবে। সুতরাং পিডিবির রেভিনিউ চাহিদা কমে আসবে। আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলায় উদ্বৃত্ত রেভিনিউ ব্যবহার হলে মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হবে না। পিডিবির ক্ষেত্রে ৪.৮৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির সুপারিশে এ বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি।
৪. ওজোপাডিকোর জনবল ব্যয় খুবই বেশি। এ ব্যয় তারা হ্রাস করেনি। বরং চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণীর বিপুল পরিমাণ কর্মচারী সম্প্রতি নিয়োগ দিয়েছে। ফলে জনবল ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে আরো বেশি। ওজোপাডিকো বিদ্যুৎ উৎপাদনে লাইসেন্সি নয়। তা সত্ত্বেও এ কম্পানি অধিক মূল্যে মনপুরায় তেল-বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ কিংবা পিডিবিকে হস্তান্তর করার জন্য অতীতে বলা হলেও তারা তা করেনি। তাদের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটি গণশুনানিতে তারা প্রমাণ করতে পারেনি। কারিগরি কমিটির সুপারিশে তাদের জন্য ৪.১৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। জনবল এবং তেল-বিদ্যুৎ উৎপাদন বাবদ বাড়তি অযৌক্তিক ব্যয় যদি না গ্রহণ করা হয়, তাহলে তাদের জন্য বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হবে না।
৫. কারিগরি কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, ডেসকোর আর্থিক ঘাটতি নেই। তাদের মুনাফার সুযোগ অব্যাহত রাখার জন্য ৩.৩০ শতাংশ বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। গণশুনানিতে ডেসকো তার মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটি প্রমাণ করতে পারেনি। তা ছাড়া স্লাব-পদ্ধতি বিভ্রাটের কারণে ডেসকোর যে বাড়তি আয় হয়েছে, তা হিসাবে আনা হয়নি। অননুমোদিত বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প ডেসকো হাতে নিয়েছে। এসব বিষয়ে তাদের নিরুৎসাহ করা জরুরি। তাই তাদের মুনাফার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে মূল্যবৃদ্ধি সমীচীন হবে না।
৬. কারিগরি কমিটির সুপারিশে ডিপিডিসির জন্য ৩.৩৬ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। ডিপিডিসি গণশুনানিতে তাদের প্রস্তাব প্রমাণ করতে পারেনি। গণশুনানিতে প্রমাণ পাওয়া যায়, লাইসেন্সি না হওয়া সত্ত্বেও ১৩২ কেভি বেশ কয়েকটি সঞ্চালন লাইন ডিপিডিসি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। হিসাবে সিস্টেমলস গণনায় ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইনের লস যুক্ত করা হয়েছে। আবার ৩৩ কেভি ভোল্টেজ লেভেল থেকে বিতরণ ব্যয় হিসাবে নিয়ে রেভিনিউ চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে গণশুনানিতে ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন পিজিসিবির কাছে হস্তান্তর করতে বলা হয়েছে। সিস্টেমলস ৩৩ কেভি থেকে ডাউনওয়ার্ড বিবেচনায় নিয়ে ১০ শতাংশের পরিবর্তে ৯ শতাংশ ধরতে বলা হয়েছে। তাহলে ৩৩ কেভি থেকে বিতরণ ব্যয় হিসাব করা যৌক্তিক হবে এবং রেভিনিউ চাহিদা কমে আসবে। তাতে ডিপিডিসির আর্থিক ঘাটতি থাকবে না। মূল্যবৃদ্ধিরও প্রয়োজন হবে না।
৭. এসব মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবগুলো বিভিন্ন দিক দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ ছিল। ফলে তা আমলযোগ্য ছিল না। উন্মুক্ত সভায় বিবেচনার জন্য এসব প্রস্তাব যদি তোলা হতো, তাহলে এমন সব ত্রুটির কারণে এসব প্রস্তাব গণশুনানির জন্য গৃহীত হতো না। উন্মুক্ত সভায় না তুলে এসব প্রস্তাবের ওপর সরাসরি গণশুনানি অসংগতিপূর্ণ এবং বিধিবহির্ভূত।
৮. এসব মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসির কাছে বিচারিক প্রক্রিয়াধীন থাকা অবস্থায় বিইআরসি মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে মিডিয়ায় প্রচার অব্যাহত রেখেছে। তাতে বিইআরসির নিরপেক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ওপরে বর্ণিত প্রেক্ষাপটে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কোনো আইনি অবকাশ নেই। তাই এ মূল্যবৃদ্ধি না করার জন্য ভোক্তাদের পক্ষ থেকে ক্যাব বিইআরসিকে অনুরোধ জানিয়েছে। সেই সঙ্গে ইতিপূর্বে আরইবির জন্য ২২০ কোটি টাকা ভর্তুকির যে সুপারিশ বিইআরসি করেছিল, তা বাস্তবায়নের জন্য বিইআরসিকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছে।
বিদ্যমান সংকটময় পরিস্থিতি নিরসনের জন্য ক্যাব নিম্নে বর্ণিত সুপারিশ করেছে:
* বিইআরসি-আইন অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির একক এখতিয়ার বিইআরসির। সুতরাং নির্বাহী আদেশে জ্বালানি মন্ত্রণালয় কর্তৃক জ্বালানি তেলের এ মূল্যবৃদ্ধি আইনসম্মত হয়নি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পরিবহনের ভাড়া না বাড়ানোর জন্য পরিবহন মালিকদের অনুরোধ জানিয়েছে।
* খুচরা বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবগুলো বিইআরসির কাছ থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য পিডিবি, আরইবি, ডেসকো, ডিপিডিসি ও ওজোপাডিকোকে অনুরোধ জানিয়েছে।
* জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির নির্বাহী আদেশ স্থগিত রেখে গণশুনানির জন্য বিপিসির দ্বারা জ্বালানি তেল এবং গ্যাস খাতের নিজ নিজ ইউটিলিটির দ্বারা সিএনজির মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবগুলো বিইআরসিতে প্রেরণের জন্য জ্বালানি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির নানামুখী অভিঘাতগুলো এখন স্পষ্ট। তা উপসমের জন্য কৌশলগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। সরকারের পক্ষ থেকে সে ব্যাপারে ত্বরিত উদ্যোগ নেওয়া দরকার। সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্ত হবে গণমুখী ও কল্যাণমুখী। এটাই স্বতঃসিদ্ধ। আলোচ্য ক্ষেত্রে তা হয়নি। বরং হয়েছে গণস্বার্থবিরোধী এবং আইনবিরোধী। আলোচনা ও সমালোচনার মধ্য দিয়েই সরকারকে চলতে হয়। জনগণের মুখ ও মনের ভাষা বুঝতে হয়। তার অভিপ্রায় জানতে হয়। এ ব্যাপারে আর সব ক্ষেত্রে সরকার সফল হলেও এ ক্ষেত্রে ঘটে গেছে বিপত্তি। এর আগে কোনো এক লেখায় আমি বলেছিলাম, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নতি জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর যদি নির্ভর করে, তাহলে এ সরকারের ভাগ্যে সুনাম লেখা নেই। আমার এ কথা সত্য হোক তা মনেপ্রাণে চাইনি বলেই এসব কথা পত্রিকায় লিখেছি। এ জাতীয় কথা প্রায় পত্রিকায় লিখে থাকি, যদি সরকার তাতে সজাগ হয়। এই মূল্যবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে আমার সে কথা এমন নির্মমভাবে সত্য হবে, তা ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা এবং তার উন্নতি ঘটানোর সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তাই জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের প্রতি নয়, সরকারের প্রতি আমার একান্ত অনুরোধ, ক্যাবের সুপারিশগুলোর প্রতি সরকার যেন মনোযোগী হয়।
লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
মুদ্রাস্ফীতির মতো অভিঘাত থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য চলমান অর্থবছরে বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছে সরকার। তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও প্রক্রিয়াধীন বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি সরকারের এ অঙ্গীকারকে অর্থহীন করে ফেলেছে। অথচ এ মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে বলতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী যা কিছু বলেছেন, তাতে মনে হয়েছে, তিনি বিকারগ্রস্ত। তাই প্রলাপ বকছেন। জ্বালানি মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সমালোচনা করে বলেছে, তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকারের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তারা গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর সুপারিশ করেছে (৭ জানুয়ারি, কালের কণ্ঠ)।
ভোক্তা সংগঠন 'ক্যাব' ৫ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, বিইআরসি-আইন অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির একক এখতিয়ার বিইআরসির। সুতরাং নির্বাহী আদেশে জ্বালানি মন্ত্রণালয় কর্তৃক জ্বালানি তেলের এ মূল্যবৃদ্ধি আইনসম্মত হয়নি। তারা এ সিদ্ধান্ত স্থগিত করে তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিপিসির মাধ্যমে বিইআরসিতে পাঠানোর প্রস্তাব করেছে। নইলে পরিত্রাণ ও প্রতিকারের জন্য তারা আইনের আশ্রয় নেবে। ভোক্তারা অতি উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে। এখন তাদের পিঠ ঠেকে গেছে। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, ২০০৮ সালের ১৫ অক্টোবর জ্বালানিসচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় সভায় বিইআরসি আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, 'যেসব এনার্জি আমদানিনির্ভর এবং অথবা যেসব এনার্জির ট্যারিফ নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভর্তুকি প্রদান করে, সেসব এনার্জি যেমন- সিএনজির ট্যারিফ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হবে।' সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিআরসি আইনে এসব এনার্জির ট্যারিফ নির্ধারণের একক এবং একমাত্র এখতিয়ার বিইআরসির। এ ক্ষমতা খর্ব করার জন্য আইনের এ ধারা উক্তরূপ সংশোধনী প্রস্তাব ওই সভায় গৃহীত হয়। সভার ওই সিদ্ধান্তে আরো বলা হয়, ওই সংশোধনী অপরিহার্য বিবেচিত না হলে সরকার জরুরি প্রয়োজনে বিইআরসির সঙ্গে আলোচনাক্রমে এসব এনার্জির ট্যারিফ নির্ধারণ করতে পারবে। আইনের এ সংশোধনী প্রস্তাব উপদেষ্টা পরিষদের বিবেচনার জন্য প্রেরণের সিদ্ধান্তও ওই সভায় গৃহীত হয়।
অর্থ উপদেষ্টার সভাপতিত্বে ২০০৮ সালের ৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সভায় জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাসের যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, সে সিদ্ধান্তের ওপর বিইআরসির সম্মতি চেয়ে ১৬ অক্টোবর অর্থাৎ আইনের সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণের ঠিক এক দিন পর জ্বালানি মন্ত্রণালয় বিইআরসিকে ৫৮১ নম্বর পত্র দেয়। এ পত্রে ১ জুলাই থেকে গেজেটের মাধ্যমে কার্যকর করা তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনোত্তর সম্মতিও চাওয়া হয়। ওই আন্তমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্তের সঙ্গে এ পত্রের একটি নিবিড় যোগসূত্র আছে বোঝা যায়। এ পত্রের জবাবে ২০ অক্টোবর বিইআরসি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনোত্তর সম্মতি এবং মূল্য হ্রাসের সিদ্ধান্তে সম্মতি প্রদান করে যা বলেছে, তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য :
১. বিইআরসি-আইন অনুযায়ী বিইআরসি একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ রেগুলেটরি কমিশন।
২. এ আইনের ২২(খ) এবং অধ্যায় ৬ ও অধ্যায় ৭ মতে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থ বা জ্বালানি তেলের বিক্রয়মূল্য বা ট্যারিফ নির্ধারণের একক ও একমাত্র ক্ষমতা বিইআরসির।
৩. আইনের ২(খ) ও (ল) এবং ২৭(২) ধারা অনুযায়ী, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এই কমিশনের লাইসেন্সি।
৪. আইনের ২২(খ) এবং ৩১ ধারা অনুযায়ী- বিপিসি কর্তৃক দক্ষ, সুচারুভাবে, সমন্বিত এবং স্বল্প ব্যয়ে পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থের সঞ্চালন, বিপণন, বিতরণ ও সরবরাহ নিশ্চিত করার দায়িত্ব একমাত্র বিইআরসির, অর্থ উপদেষ্টা বা জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের নয়।
৫. আইনের ৩৪(৬) ধারামতে, বিপিসি গত ৪ মে জ্বালানি তেলের বিক্রয়মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব কমিশনের কাছে প্রেরণ করে।
৬. আইনি প্রক্রিয়ায় মূল্যবৃদ্ধির এই প্রস্তাবটি বিবেচনার প্রয়োজনে কমিশন কিছু তথ্য-উপাত্ত চেয়ে ১৩ মে বিপিসিকে এক পত্র দেয়।
৭. উক্ত তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ না করে বিইআরসির কাছে গত ৪ মে দাখিলকৃত তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিপিসি ৩০ জুন ২০০৮ সালের ৩০ জুন প্রত্যাহার করে এবং সরকার তেলের মূল্যবৃদ্ধি করে।
আন্তমন্ত্রণালয় সভার ওই সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়ে ক্যাবের পক্ষ থেকে ৫ নভেম্বর একটি লেখা জ্বালানিসচিব ও বিইআরসি চেয়ারম্যানকে পাঠানো হয়। চেয়ারম্যান এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। ওই লেখার ওপর উভয়েরই অভিমত পাওয়া যায়। চেয়ারম্যান তাঁর অভিমতে জানান, বিইআরসি আইনের ওই সংশোধনীটি সভায় গৃহীত হয়নি। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অভিমতে জানা যায়, বিইআরসির চেয়ারম্যানের প্রদত্ত মতামতের কারণে ওই সংশোধনীটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে।
তার পর থেকে আইনের ওই সংশোধনী ছাড়াই জ্বালানি মন্ত্রণালয় নির্বাহী আদেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে। ফলে ক্যাব কর্তৃক জ্বালানি মন্ত্রণালয় বিইআরসি-আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার, ২০০৮ সালে গ্যাসের আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলায় গ্যাসের মূল্য ৬৭ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসিতে আনা হয়। গণশুনানিতে প্রমাণিত হয়, গ্যাস খাতে আর্থিক ঘাটতি নেই। ববং এ খাত লাভজনক। ফলে এ প্রস্তাব বিইআরসি খারিজ করে। জ্বালানি তেলে যে পরিমাণ আর্থিক ঘাটতি দেখানো হচ্ছে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সে সন্দেহ নিরসন ছাড়াই গণশুনানি এড়িয়ে আইন অমান্য করে মন্ত্রণালয় বিপিসির সঙ্গে যোগসাজশে বারবার নির্বাহী আদেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি কেন করে? কেন এ মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসিতে আসে না?
জ্বালানি মন্ত্রণালয় তার ওই অভিমতে আরো বলেছে, বিইআরসি আইনে জ্বালানি তেলের মূল্য বছরে একবার পুনর্নির্ধারণের বিধান রাখা হয়েছে। এ বিধান বিদ্যুতের মূল্যের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। তথাপি বছরে চারবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি বিইআরসি করেছে। আবার ভূতাপেক্ষভাবে ২০১২ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে গণশুনানি ছাড়াই এডহক ভিত্তিতে বিদ্যুতের মূল্য একবারে গড়ে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। তার পরপরই ওই বৃদ্ধি আইনানুগ না করে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির নতুন প্রস্তাবগুলো সরাসরি গণশুনানিতে আনা হয়েছে এবং তা প্রক্রিয়াধীন থাকা অবস্থায় মূলবৃদ্ধির পক্ষে বিইআরসি প্রচার অব্যাহত রেখেছে। ফলে এ মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া আইনসম্মত না হওয়ার অভিযোগ এনে ক্যাব ৫ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে বলেছে :
২৭-১২-১২-এর পূর্বাহ্নে আরইবির ৯ শতাংশ, ৩০-১২-১২ পিডিবির ১২ শতাংশ ও ওজোপাডিকোর ৯.৫৯ শতাংশ এবং ৩১-১২-১২ ডেসকোর ১১.৬৯ শতাংশ ও ডিপিডিসির ১১.৩১ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবগুলোর ওপর বিইআরসিতে গণশুনানি হয়েছে। ওই গণশুনানিতে ক্যাব এ মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে তীব্র বিরোধিতা করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় শুনানি-পরবর্তী ৩ জানুয়ারি বিইআরসিতে দাখিল করা লিখিত মতামতে ক্যাব বলছে :
১. অস্বাভাবিক স্বল্পতম সময়ে পাঁচটি ইউটিলিটির মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি হয়েছে। ফলে তা অসংগতিপূর্ণ ও ন্যায়বিচারের উপযোগী নয়।
২. প্রস্তাব প্রমাণের দায়িত্ব প্রস্তাবকারীর। আরইবির প্রস্তাবের যৌক্তিকতা প্রমাণ হয়নি। গণশুনানিতে তাদের আর্থিক ঘাটতি নেই প্রমাণ হয়েছে। বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, আরইবির মূল্যবৃদ্ধির অবকাশ নেই।
৩. গণশুনানিতে জানা যায়, এ অর্থবছরে তেল-বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য তেল-বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্লান্ট-ফ্যাক্টর বেশি ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বর্তমানে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির ফলে গ্যাস-বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি হচ্ছে। ফলে তেল সাশ্রয় হচ্ছে। তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমেছে। ভবিষ্যতে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বিধায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাবে। সুতরাং পিডিবির রেভিনিউ চাহিদা কমে আসবে। আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলায় উদ্বৃত্ত রেভিনিউ ব্যবহার হলে মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হবে না। পিডিবির ক্ষেত্রে ৪.৮৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির সুপারিশে এ বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি।
৪. ওজোপাডিকোর জনবল ব্যয় খুবই বেশি। এ ব্যয় তারা হ্রাস করেনি। বরং চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণীর বিপুল পরিমাণ কর্মচারী সম্প্রতি নিয়োগ দিয়েছে। ফলে জনবল ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে আরো বেশি। ওজোপাডিকো বিদ্যুৎ উৎপাদনে লাইসেন্সি নয়। তা সত্ত্বেও এ কম্পানি অধিক মূল্যে মনপুরায় তেল-বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ কিংবা পিডিবিকে হস্তান্তর করার জন্য অতীতে বলা হলেও তারা তা করেনি। তাদের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটি গণশুনানিতে তারা প্রমাণ করতে পারেনি। কারিগরি কমিটির সুপারিশে তাদের জন্য ৪.১৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। জনবল এবং তেল-বিদ্যুৎ উৎপাদন বাবদ বাড়তি অযৌক্তিক ব্যয় যদি না গ্রহণ করা হয়, তাহলে তাদের জন্য বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হবে না।
৫. কারিগরি কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, ডেসকোর আর্থিক ঘাটতি নেই। তাদের মুনাফার সুযোগ অব্যাহত রাখার জন্য ৩.৩০ শতাংশ বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। গণশুনানিতে ডেসকো তার মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটি প্রমাণ করতে পারেনি। তা ছাড়া স্লাব-পদ্ধতি বিভ্রাটের কারণে ডেসকোর যে বাড়তি আয় হয়েছে, তা হিসাবে আনা হয়নি। অননুমোদিত বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প ডেসকো হাতে নিয়েছে। এসব বিষয়ে তাদের নিরুৎসাহ করা জরুরি। তাই তাদের মুনাফার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে মূল্যবৃদ্ধি সমীচীন হবে না।
৬. কারিগরি কমিটির সুপারিশে ডিপিডিসির জন্য ৩.৩৬ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। ডিপিডিসি গণশুনানিতে তাদের প্রস্তাব প্রমাণ করতে পারেনি। গণশুনানিতে প্রমাণ পাওয়া যায়, লাইসেন্সি না হওয়া সত্ত্বেও ১৩২ কেভি বেশ কয়েকটি সঞ্চালন লাইন ডিপিডিসি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। হিসাবে সিস্টেমলস গণনায় ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইনের লস যুক্ত করা হয়েছে। আবার ৩৩ কেভি ভোল্টেজ লেভেল থেকে বিতরণ ব্যয় হিসাবে নিয়ে রেভিনিউ চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে গণশুনানিতে ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন পিজিসিবির কাছে হস্তান্তর করতে বলা হয়েছে। সিস্টেমলস ৩৩ কেভি থেকে ডাউনওয়ার্ড বিবেচনায় নিয়ে ১০ শতাংশের পরিবর্তে ৯ শতাংশ ধরতে বলা হয়েছে। তাহলে ৩৩ কেভি থেকে বিতরণ ব্যয় হিসাব করা যৌক্তিক হবে এবং রেভিনিউ চাহিদা কমে আসবে। তাতে ডিপিডিসির আর্থিক ঘাটতি থাকবে না। মূল্যবৃদ্ধিরও প্রয়োজন হবে না।
৭. এসব মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবগুলো বিভিন্ন দিক দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ ছিল। ফলে তা আমলযোগ্য ছিল না। উন্মুক্ত সভায় বিবেচনার জন্য এসব প্রস্তাব যদি তোলা হতো, তাহলে এমন সব ত্রুটির কারণে এসব প্রস্তাব গণশুনানির জন্য গৃহীত হতো না। উন্মুক্ত সভায় না তুলে এসব প্রস্তাবের ওপর সরাসরি গণশুনানি অসংগতিপূর্ণ এবং বিধিবহির্ভূত।
৮. এসব মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসির কাছে বিচারিক প্রক্রিয়াধীন থাকা অবস্থায় বিইআরসি মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে মিডিয়ায় প্রচার অব্যাহত রেখেছে। তাতে বিইআরসির নিরপেক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ওপরে বর্ণিত প্রেক্ষাপটে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কোনো আইনি অবকাশ নেই। তাই এ মূল্যবৃদ্ধি না করার জন্য ভোক্তাদের পক্ষ থেকে ক্যাব বিইআরসিকে অনুরোধ জানিয়েছে। সেই সঙ্গে ইতিপূর্বে আরইবির জন্য ২২০ কোটি টাকা ভর্তুকির যে সুপারিশ বিইআরসি করেছিল, তা বাস্তবায়নের জন্য বিইআরসিকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছে।
বিদ্যমান সংকটময় পরিস্থিতি নিরসনের জন্য ক্যাব নিম্নে বর্ণিত সুপারিশ করেছে:
* বিইআরসি-আইন অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির একক এখতিয়ার বিইআরসির। সুতরাং নির্বাহী আদেশে জ্বালানি মন্ত্রণালয় কর্তৃক জ্বালানি তেলের এ মূল্যবৃদ্ধি আইনসম্মত হয়নি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পরিবহনের ভাড়া না বাড়ানোর জন্য পরিবহন মালিকদের অনুরোধ জানিয়েছে।
* খুচরা বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবগুলো বিইআরসির কাছ থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য পিডিবি, আরইবি, ডেসকো, ডিপিডিসি ও ওজোপাডিকোকে অনুরোধ জানিয়েছে।
* জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির নির্বাহী আদেশ স্থগিত রেখে গণশুনানির জন্য বিপিসির দ্বারা জ্বালানি তেল এবং গ্যাস খাতের নিজ নিজ ইউটিলিটির দ্বারা সিএনজির মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবগুলো বিইআরসিতে প্রেরণের জন্য জ্বালানি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির নানামুখী অভিঘাতগুলো এখন স্পষ্ট। তা উপসমের জন্য কৌশলগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। সরকারের পক্ষ থেকে সে ব্যাপারে ত্বরিত উদ্যোগ নেওয়া দরকার। সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্ত হবে গণমুখী ও কল্যাণমুখী। এটাই স্বতঃসিদ্ধ। আলোচ্য ক্ষেত্রে তা হয়নি। বরং হয়েছে গণস্বার্থবিরোধী এবং আইনবিরোধী। আলোচনা ও সমালোচনার মধ্য দিয়েই সরকারকে চলতে হয়। জনগণের মুখ ও মনের ভাষা বুঝতে হয়। তার অভিপ্রায় জানতে হয়। এ ব্যাপারে আর সব ক্ষেত্রে সরকার সফল হলেও এ ক্ষেত্রে ঘটে গেছে বিপত্তি। এর আগে কোনো এক লেখায় আমি বলেছিলাম, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নতি জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর যদি নির্ভর করে, তাহলে এ সরকারের ভাগ্যে সুনাম লেখা নেই। আমার এ কথা সত্য হোক তা মনেপ্রাণে চাইনি বলেই এসব কথা পত্রিকায় লিখেছি। এ জাতীয় কথা প্রায় পত্রিকায় লিখে থাকি, যদি সরকার তাতে সজাগ হয়। এই মূল্যবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে আমার সে কথা এমন নির্মমভাবে সত্য হবে, তা ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা এবং তার উন্নতি ঘটানোর সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তাই জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের প্রতি নয়, সরকারের প্রতি আমার একান্ত অনুরোধ, ক্যাবের সুপারিশগুলোর প্রতি সরকার যেন মনোযোগী হয়।
লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
No comments