মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস by মুহম্মদ জাফর ইকবাল
২৫ মার্চের বিভীষিকার কোন শেষ নেই। পাকিসত্মান সেনাবাহিনীর একটি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এসে ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরম্নল হক হল) আর জগন্নাথ হলের সব ছাত্রকে হত্যা করল।
হত্যার আগে তাদের দিয়েই জগন্নাথ হলের সামনে একটি গর্ত করা হয়, যেখানে তাদের মৃতদেহকে মাটিচাপা দেয়া হয়। এই নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের দৃশ্যটি বুয়েটের প্রফেসর নুরম্নল উলা তাঁর বাসা থেকে যে ভিডিও করতে পেরেছিলেন, সেটি এখন ইন্টারনেটে মুক্তিযুদ্ধের আর্কাইভে সংরৰিত আছে, পৃথিবীর মানুষ চাইলেই নিজের চোখে সেটি দেখতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ছাত্রদের নয়_ সাধারণ কর্মচারী এমনকি শিৰকদেরকেও তারা হত্যা করে। আশপাশে যে বসত্মিগুলো ছিল সেগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে মেশিনগানের গুলিতে অসহায় মানুষগুলোকে হত্যা করে। এরপর তারা পুরনো ঢাকার হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলো আক্রমণ করে, মন্দিরগুলো গুঁড়িয়ে দেয়, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। যারা পালানোর চেষ্টা করেছে সবাইকে পাকিসত্মান মিলিটারি গুলি করে হত্যা করেছে। ২৫ মার্চ ঢাকা শহর ছিল নরকের মতো, যেদিকে তাকানো যায় সেদিকে আগুন আর আগুন, গোলাগুলির শব্দ আর মানুষের আর্তচিৎকার।অপারেশন সার্চলাইটের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা, পাকিসত্মান সেনাবাহিনীর একটি কমান্ডো দল এসে তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। আগেই খবর পেয়ে তিনি তাঁর দলের সব নেতাকে সরে যাবার নির্দেশ দিয়ে নিজে বসে রইলেন নিশ্চিত মৃতু্যকে আলিঙ্গন করার জন্য।
স্বাধীন বাংলাদেশ
কমান্ডো বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে যাবার আগে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণায় তিনি পাকিসত্মান সেনাবাহিনীর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে গেলেন। তাঁর ঘোষণাটি তৎকালীন ই.পি.আর-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ল। যখন ঘোষণাটি প্রচারিত হয় তখন মধ্যরাত পার হয়ে ২৬ মার্চ হয়ে গেছে, তাই আমাদের স্বাধীনতা দিবস হচ্ছে ২৬ মার্চ।
পূর্ব পাকিসত্মান নামক রাষ্ট্রটি পৃথিবীর মানচিত্র থেকে চিরদিনের জন্য মুছে গেল, জন্ম নিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। কিন্তু সেই বাংলাদেশ তখনও ব্যথাতুর, যন্ত্রণাকাতর। তার মাটিতে তখনও রয়ে গেছে পাকিসত্মান সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর দানবেরা।
প্রতিরোধ আর প্রতিরোধ
ঢাকা শহরে পৃথিবীর একটি নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ২৭ মার্চ সকাল আটটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যনত্ম কারফিউ শিথিল করা হলে শহরের ভয়ার্ত নারী-পুরম্নষ-শিশু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য গ্রামের দিকে ছুটে যেতে লাগল। জেনারেল টিক্কা খান ভেবেছিল সে যেভাবে ঢাকা শহরকে দখল করেছে, এভাবে সারা বাংলাদেশকে এপ্রিলের দশ তারিখের মাঝে দখল করে নেবে। কিন্তু বাসত্মবে সেটি হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন_ বিভিন্ন এলাকা থেকে পালিয়ে আসা বাঙালী সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা, এই দেশের ছাত্র-জনতা সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তার কোন তুলনা নেই।
চট্টগ্রামে বাঙালী সেনাবাহিনী এবং ইপিআর বিদ্রোহ করে শহরের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পৰে আবার স্বাধীনতার ঘোষণা পড়ে শোনান। এই ঘোষণাটি সেই সময় বাংলাদেশের সবার ভেতরে নতুন একটি অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছিল। চট্টগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য পাকিসত্মান সেনাবাহিনীকে যুদ্ধ জাহাজ থেকে গোলাবর্ষণ করতে হয় এবং বিমান আক্রমণ চালাতে হয়। বাঙালী যোদ্ধাদের হাত থেকে চট্টগ্রাম শহরকে পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পাকিসত্মান সেনাবাহিনীর এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ হয়ে যায়। পাকিসত্মান সেনাবাহিনী কুষ্টিয়া এবং পাবনা শহর প্রথমে দখল করে নিলেও বাঙালী সৈন্যরা তাদের সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে শহরগুলোর পুনদর্খল করে এপ্রিলের মাজামাঝি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। বগুড়া, দিনাজপুরেও একই ঘটনা ঘটে_ বাঙালী সৈন্যরা পাকিসত্মান সেনাবাহিনীর হাত থেকে শহরগুলোকে পুনর্দখল করে নেয়। যশোরে বাঙালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করার সময় তারা বিদ্রোহ করে, প্রায় অর্ধেক সৈন্য পাকিসত্মান সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ হারালেও বাকিরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্ত হয়ে আসতে পারে। কুমিলস্না, খুলনা, ও সিলেট শহর পাকিসত্মান সেনাবাহিনী নিজেদের দখলে রাখলেও বাঙালী সৈন্যরা তাদের আক্রমণ করে ব্যতিব্যসত্ম করে রাখে। (চলবে)
No comments