বাঙালি সংস্কৃতির নতুন দিগন্ত by আবু দায়েন

একুশ আমাদের দিয়েছে জাতীয় চৈতন্যের দীক্ষা। আমাদের নিজেকে চেতনার মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করেছে একুশ। সেই একুশকে উপলক্ষ ও সম্মান করে বাঙালির সমূহ আয়োজন আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অহঙ্কারে নিত্যনতুন পালক সংযুক্ত করে দিয়েছে। এমনি এক গর্বিত পালক 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা'।
১৯৭০ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন উপলক্ষে প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সাহার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মুক্তধারা বাংলা একাডেমীর প্রধান ফটকে কমিশনে বই বিক্রির প্রথম আয়োজন করে। ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ নিজস্ব চত্বরে প্রথম বইমেলার আয়োজন করে। এরপর মেলার আয়োজন অনিয়মিতভাবে চললেও ১৯৮৪ সালে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে বাংলা একাডেমী মেলার আয়োজন করে। এ আয়োজনের নামকরণ করা হয় 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা'। এরপর থেকে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বাংলা একাডেমী গ্রন্থমেলার আয়োজন করে আসছে। এ আয়োজন আজ বাঙালি সংস্কৃতি, মনন ও মনীষার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে সমর্থ হয়েছে। এত বছর পর বাংলা একাডেমীর সুযোগ-সুবিধা ও তার নিয়োজিত কর্তা ও কর্মীদের প্রতি ব্যক্তিগত অনুরাগ-বিরাগ থেকে কেউ কেউ দাবি তুলেছেন মেলা অন্যত্র সরিয়ে নিতে। কিন্তু মেলার প্রয়োজন, সর্বজনীনতা স্বীকৃত ও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
গ্রন্থমেলা সত্যিকার অর্থে আমাদের কী দিয়েছে_ তা গভীর অভিনিবেশের ব্যাপার। একুশের গ্রন্থমেলা বাংলাদেশের মানুষের পাঠাভ্যাস সৃষ্টির ক্ষেত্রে নতুন প্রণোদনা সৃষ্টি করেছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, ঈদ-পূজা ও পালাপার্বণের মতো একুশের গ্রন্থমেলার জন্য বিশেষ শ্রেণীর মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। এ শ্রেণী নিশ্চয়ই সমাজের অগ্রসর মানুষকে নিয়ে। দেশের উচ্চশিক্ষিত অভিজাত মানুষ থেকে শুরু করে মধ্য ও স্বল্পশিক্ষিত সংবেদনশীল শ্রেণী ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য সারা বছর ধরে প্রস্তুতি নেয়। সারা বছর ধরে কেউ বই লেখায়, কেউ প্রকাশে-বিপণনে, কেউ সংগ্রহের জন্য অর্থ সংগ্রহে বিশেষ মনোযোগী থাকে। এ প্রবণতা বইকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা জাতীয় সংস্কৃতির নতুন দিক। প্রতিদিন বইমেলায় গেলে দেখা যাবে প্রবেশপথে মানুষের দীর্ঘ সারি। মেলাভ্যন্তরে উপচেপড়া ভিড়। কোনো অস্থিরতা-উচ্ছৃঙ্খলা নেই। কারো বিশেষ কোনো তাড়া নেই। মনে হতে পারে, বেশিরভাগ মানুষ হয়তো আড্ডা দিতেই আসে। কিন্তু প্রকাশকের সঙ্গে কথা বললে কিংবা একেকটা স্টলে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে ধারণা পাল্টাবে। মানুষ প্রচুর পরিমাণে বই কিনছে। কোনো ধরনের বই বাদ যাচ্ছে না। কবিতা-প্রবন্ধ ও গবেষণাকর্মের মতো গুরুগম্ভীর বিষয়ে বইয়ের কাটতি বিস্ময়ের উদ্রেক করবে। অবশ্য আড্ডা মুখ্য হলেও এরূপ নির্মল, মননশীল ও স্বাদু আড্ডায় আমাদের আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ থাকে। জায়গায় জায়গায় লেখক-পাঠকের আড্ডা, নতুন নতুন বইয়ের অভিষেক, আলোচনা, সঙ্গীত মেলার বাড়তি আকর্ষণেরই অংশ। মজার ব্যাপার, গ্রন্থমেলা উপলক্ষে দুর্গম গ্রাম-মফস্বল থেকে দলে দলে মানুষ ঢাকা ছুটে আসেন। প্রবাসীদের অনেকেই ঈদ-পালাপার্বণ বাদ দিয়ে কেবল গ্রন্থমেলা উপলক্ষে দেশে আসেন। বাঙালির এ বই সংস্কৃতি প্রাণে প্রাণে উত্তাপ ছড়ায়। সৃষ্টিশীলতার নান্দনিক প্রণোদনায় জেগে ওঠে মানুষ। এ জাগরণ চৈতন্য, মনন ও মনীষার। এ জাগরণ সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির। এ জাগরণ আমাদের স্বপ্ন দেখায় 'আরাধ্য স্বদেশ' নির্মাণের, স্বপ্ন পূরণের। সদ্য সমাপ্ত 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা' বাঙালির সাংস্কৃতিক চৈতন্যে এমন এক অভিঘাত সৃষ্টি করেছে, যা আমাদের জাতীয় অগ্রগতির নতুন উপলক্ষ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এ চিহ্নায়ন আমাদের নতুন প্রেরণা। 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা' বাঙালি জাতিসত্তার, জীবনসূত্রে ইতিবাচকতার, চেতনা-মননে অগ্রসরতার এক মহাদিগন্ত। ইতিবাচক এ ধারার যথোপযুক্ত পরিচর্যা হলে আমাদের মাননিক ঐতিহ্যে নতুন সূর্যের উদয় ঘটবে, আমরা আশাবাদী।
dayenju@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.