নূরুল আমীন ও তার ভ্রান্ত রাষ্ট্রভাষা নীতি- এমএ বার্ণিক

প্রত্যেক চিন্তাশীল ব্যক্তিই এইভাবে বুঝিতে পারেন যে, বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হইবে কিনা প্রকৃত প্রশ্ন মোটেই তা ছিল না। বরং সরকার একদল লোককে সাফল্যের সঙ্গে দেশের শান্তি ও শৃক্মখলা বিপন্ন করিতে দিতে পারেন কিনা তাহাই ছিল সত্যিকার প্রশ্ন।
এরূপ জরুরী অবস্থায় সরকার কি করিবেন বলিয়া আপনারা আশা করিয়াছিলেন, আমি তাহাই বিজ্ঞাসা করিতে চাই। এই ধরনের দুষ্টবুদ্ধি প্রণোদিত কোন ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হইলে যে কোন সরকার কি করিতেন? এখানকার খুব অল্পসংখ্যক লোক ব্যবস্থা পরিষদের প্রতিনিধিও মুসলিম লীগ সরকারকে পদত্যাগ করার জন্য বল প্রয়োগ ও ভীতি প্রদর্শন করার প্রয়াস পাইতেছেন। এইরূপ ঘটিতে দেওয়া হইলে আমার সরকার দেশবাসীর সহিত বিশ্বাস ভঙ্গ করিতেন; কারণ, ইহার ফলে সমগ্র পাকিস্তান ও প্রকৃতপ েইসলাম বিপদগ্রস্ত হইয়া পড়িত। আমার সহকমর্ীগণ ও আমি যদি এই ভীতি প্রদর্শনের ফলে আমাদের কর্তব্যকার্যে সম্পাদনে বিরত হইতাম এবং এই বিশৃক্মখলা দমনে দৃঢ়তা অবলম্বন না করিতাম তবে আমরা দেশবাসী ও ইসলামের প্রতি কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হইয়াছি বলিয়া আপনাদের এবং ভবিষ্যত বংশধরগণের কাছে অপরাধী হইতাম, একমাত্র শাসনতান্ত্রিক উপায়েই সরকারের পতন ঘটানো যাইতে পারে। আইন পরিষদের সদস্যগণ নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছানুযায়ী ভোটের দ্বারাই সরকারের পতন ঘটাতেই পারে। আইন পরিষদের এই সদস্যগণ যাহাতে কোন ব্যাপারে স্থিরভাবে নিজেদের মতামত প্রদান করিতে পারেন তজ্জন্য তাহাদিগকে নির্বিঘ্নে ও বিপদ-আপদশূন্য পরিবেশের মধ্যে কাজ করিতে দেওয়া উচিত। অন্যথায়, গণতন্ত্র সুষ্ঠুভাবে কাজ করিতে পারে না এবং বিশৃক্মখলার রাজত্ব শুরু হয়।
সরকার যে সকল ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছেন তাহার ফলে যদি শান্তিভঙ্গের আশু বিপদাশঙ্কা দূরীভূত হইয়াছে তথাপি আমাদের আজাদীর বিপদ এখনও সম্পূর্ণভাবে কাটে নাই।
প্রদেশের শান্তি ও নিরাপত্তা অব্যাহত রাখিতে হইবেই। আমার সরকারের দৃঢ় বিশ্বাস, এই ব্যাপারে আমরা পাকিস্তানের যে কোন দরদির আন্তরিক সমর্থন লাভ করিব।
সরকারকে সমর্থন করার জন্য এবং প্রদেশে আইন ও শৃক্মখলা বজায় রাখার ব্যাপারে এবং মিথ্যা গুজব ও আতঙ্ক রটানে লিপ্ত দুষ্কৃতকারীগণকে দমন করার ব্যাপারে সরকারকে সাহায্য করার জন্য আমি সকল পাকিস্তানীর নিকট আবেদন জানাইতেছি।
আপনারা আমাদের সীমান্তের অপর পারের প্রতি ল্য করুন এবং বর্তমানে আমাদের সম্মুখে কি বিপদ রহিয়াছে তাহা অনুধাবন করুন। কেবল পাকিস্তান নয়, এমন কি ইসলামও এখন এক মহাপরীার সম্মুখীন। আমরা এই দাবি করিতেছি যে, ইসলাম কোন ধমর্ীয় ভৌগোলিক, জাতিগত, অর্থনৈতিক ও ভাষাগত বৈষম্য বা বাধা স্বীকার করে না এবং ইহার অতীতের সুবর্ণ যুগের ন্যায় বর্তমান সময়েও বিশ্বে শান্তি, সুখ ও সমৃদ্ধি আনয়ন করিতে পারে। আর আমাদের এই পাকিস্তানেই আমরা ইহা প্রমাণ করতে চাহিতেছি। ইসলামকে বাঁচাইয়া রাখার জন্য লাখ লাখ লোকের আত্মত্যাগের ফলে পাকিস্তান কায়েম হইয়াছে। বিভিন্ন ভাষাভাষী ও ধর্মাবলম্বীদের বাসভূমি এই পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশকে এক মাত্র ইসলামই একত্রিত রাখিতেছে।
আমাদের দৃঢ় সংহতি আমাদের শত্রু ও মিত্রের বিস্ময় সৃষ্টি করিয়াছে। ইহা সারা মুসলিম জাহানকে জাগরিত করিয়া তুলিয়াছে এবং ইহা ইসলামের পুনরুত্থানশীল শক্তিকে জাগাইতে সাহায্য করিয়াছে।
দুনিয়ার নিকট আমাদের প্রতিপন্ন করিতে হইবে যে, ইসলাম আমাদিগকে ঐক্যবদ্ধ রাখিতে এবং মরহুম কায়েদে আজম ও কায়েদে মিল্লাতের প্রত্য পরিচালনা হইতে বঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের মহান ল্যে পৌঁছাইতে সম। এই ব্যাপারে পাকিস্তানের অন্য বাসিন্দাদের চেয়ে আমাদের ওপরই অধিকতর দায়িত্ব অর্পিত হইয়াছে। পূর্বপাকিস্তানে যত মুসলমানের বাস, দুনিয়ার আর কোথাও এত বেশি সংখ্যক মুসলমান বাস করেন না। সুতরাং বিশ্ব মুসলিম সংহতির বন্ধন বজায় রাখার এবং ইহাকে আরও দৃঢ়তর করার অন্য পাকিস্তানের এবং মুসলিম জাহানের নেতৃত্ব করার দায়িত্ব আমাদেরই।
মুসলিম জাহানের এই সঙ্কট মুহূর্তে আমরা কি পাকিস্তান ও ইসলামের প্রতি আমাদের এই গুরুদায়িত্ববহন করিতে অসমর্থ হইব? নিশ্চয়ই না। ইনশাল্লাহ, ইসলাম, পাকিস্তান ও মুসলিম জাহানের প্রতি আমাদের পবিত্র কর্তব্য পালনে আমারা কোনদিনই পশ্চাদপদ হইব না।" _এপিপি
(সূত্র : দৈনিক আজাদ, ৪ মার্চ ১৯৫২)
নূরুল আমীনের বেতার বক্তৃতার সমালোচনা করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদর্ী একটি বিবৃতি প্রদান করেন। এ সম্পর্কে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো :
করাচী, ৬ মার্চ_ ঢাকায় ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণ ও উহার পরবতর্ী ঘটনাবলী সম্পর্কে জনাব নূরুল আমীন যে বেতার বক্তৃতা দেন জনাব এইচএস সোহরাওয়াদর্ী তাহার তীব্র সমালোচনা করিয়াছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, জনাব নূরুল আমীনের সাম্প্রতিক বেতার বক্তৃতা তাঁহার দমননীতি এবং তাঁহার মন্ত্রিসভার বিরোধীদের গ্রেফতারের প েওকালতী ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁহার মনের ভাবটা এই রকম যে, তিনি যদি স্বেচ্ছায় বা পরিস্থিতির চাপে পদত্যাগ করেন এবং মুসলিম লীগ যদি মতাচু্যত হয় তাহা হইলে ইসলাম ও পাকিস্তান বিলুপ্ত হইয়া যাইবে। তিনি এবং তাহার দলই যেন শুধু ইসলামের পতাকা সমুন্নত রাখিয়াছেন এবং পাকিস্তানকে রা করিয়াছেন এবং করিতে পারেন।
তিনি বলেন, জনাব নুরুল আমীন জনসাধারণকে বোকা বানাইবার সেই পুরাতন নীতিই অবলম্বন করিয়া চলিয়াছেন। তাঁহার অজুহাত এই যে, তিনি যদি সভাসমিতি করিতে দেন বা বিরোধীদলকে মাথাচাড়া দিয়া উঠিতে দেন, তাহা হইলে রাষ্ট্র বিপদাপন্ন হইবে, কেবলমাত্র স্বেচ্ছাচারিতায় যাহা সম্ভব তিনি সেই চরমতম দমননীতিই অবলম্বন করিয়াছেন। তিনি বলেন যে, রাষ্ট্রবিরোধী লোকেরা পাকিস্তানে প্রবেশ করিয়ছে, গত কিছুদিন হইতে তাহারা রাষ্ট্রবিরোধী কার্য চালাইতেছে এবং এণে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেও বিােভের সুযোগ গ্রহণ করিতেছে, কিন্তু তিনি ইচ্ছা করিয়াই একথা ভুলিয়া গিয়াছেন যে, খাজা নাজিমুদ্দিন অসময়োচিত এবং প্ররোচনামূলক বিবৃতি না দিলে এই ধরনের বিােভ কোন দিনই দেখা দিত না। এবং দেয়ও নাই। জনাব নূরুল আমীন একটি শান্তিপূর্ণভাবে বিােভ প্রদর্শন বন্ধ করেন এবং ১৪৪ ধারা জারি করেন। কিন্তু ইহার দ্বারা কিছুতেই প্রমাণ হয় না যে, তিনি রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ বন্ধের জন্যই ইহা করিয়াছিলেন। তা ছাড়া আমরা সকলেই জানি, এই প্রথমবারই যে তিনি ১৪৪ ধারা জারি করিলেন তা নয়, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হইতে বিােভ প্রদর্শনের বন্ধের জন্যই ইহা করিয়াছিলেন। তা ছাড়া আমরা সকলেই জানি, এই প্রথমবারই যে তিনি ১৪৪ ধারা জারী করিলেন তা নয়, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হইতে বিােভ প্রদর্শনের বা মিছিল বাহির করিবার অনুমতি লওয়া চলিত একথাও সম্পূর্ণ অর্থহীন। ইহা সম্পূর্ণ মৌখিক।
এই কথার দ্বারা সরকার মুক্তির জাল বুনিতে পারেন এবং সরকার সমর্থকরাই কেবল ইচ্ছামত সভাসমিতির অনুষ্ঠান করিয়া ইহা কাজে লাগাইতে পারেন। পকাল পূর্বে যদি তিনি সভাসমিতির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ নাই করিয়া থাকেন, তাহা হইলে মনে করিতে হইবে যে, তাঁহার মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে রোষ ও বিরোধিতা কতটা তীব্র হইয়া উঠিয়াছিল, তাহা তিনি বুঝিতেই পারেন নাই। ইহার পরই আসে লাঠিচার্জ, গুলিবর্ষণ ও প্রাণহানির প্রশ্ন।
জনাব সোহরাওয়াদর্ী বলেন, জনাব নূরুল আমীন এখন এই মর্মে বুলি আওড়াইতেছেন যে, রাষ্ট্রভাষাই যদি আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হইতো তাহা হইলে পরিষদে ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই উহা বন্ধ হইত। কিন্তু তাহা হয় নাই। সুতরাং বুঝিতে হইবে যে, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য। এই কারণে জনসাধারণের রোষ বা বিােভ প্রদর্শনের কোন হেতু নাই। প্রস্তাব দেশের দ্বারা তিনি প্রমাণ করিতে চাহিয়াছেন যে, আন্দোলনের মধ্যে আন্তরিকতা নাই। কিন্তু অন্যেরা সাফল্যজনকভাবেই প্রমাণ করিতে পারেন যে, মন্ত্রিসভাকে পতনের হাত হইতে রা করিবার জন্যই তিনি ব্যবস্থা পরিষদে প্রস্তাব পেশ করিয়াছিলেন।
বিবৃতিতে আরও বলা হইয়াছে, 'তিনি বলিয়াছেন যে, ভাষা আন্দোলনে তাঁহার কোন আপত্তি ছিল না। শুধু ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত লোককের বিরুদ্ধে দমননীতি অবলম্বন করা হইয়াছে। কিন্তু একটি এশতেহার হইতে তাঁহার উক্তির অসারতা প্রমাণিত হইতেছে। উহাতে প্রকাশ, ভাষা-আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে তাড়াই নয় বেড়ান হইতেছে, এবং যাঁহারা আত্মগোপন করিত বাধ্য হইয়াছেন, তাহারাও ভাষা-আন্দোলনের নেতা। যৌক্তিকতাহীন গুলিবর্ষণ ও ধরপাকড়ের আসল কারণ পূর্ববঙ্গবাসীদের সুপরিজ্ঞাত। উহার ফলে নিষ্ক্রিয় পরিষদ সদস্যগণও জনাব নূরুল আমীনের বিরোধিতা করিতে বাধ্য হইয়াছেন। ভাষা আন্দোলনের অজুহাতে বিরোধীদলের নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করিয়া বিরোধীদলকে দমন করার সুযোগ লাভ করিয়াছেন। এছলাম বিপন্ন, কমু্যনিস্ট ও বদলোকেরা পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করিতেছে বলিয়া ভাঁওতা দিয়া সর্বত্র জনসভার উদ্যোক্তাদিগকে গ্রেফতার করা হইতেছে, বস্তুত সর্বত্র আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করিয়া বিরোধী দলগুলোকে দমন করা হইতেছে।
'তাঁহার বর্তমান ব্যবস্থাকে সমর্থন করিয়া তিনি যে বিবৃতি দান করিয়াছেন তাহার একটি পরিচ্ছেদ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি পুনরায় অখণ্ড বঙ্গের রব তুলিয়াছেন, নারায়ণগঞ্জে অনুষ্ঠিত শত শত সভার মধ্যে কোন এক সভায় নাকি অখণ্ড বঙ্গের ধ্বনি তোলা হইয়াছিল। আমি বিনাদ্বিধায় বলিতে পারি কোন পাকিস্তানীই উহার সমর্থক নহেন। গোয়েন্দা বিভাগের ফাইলে যদি উহা উল্লেখ করা হইয়া থাকে বা জনাব নূরুল আমীন যদি এই ধ্বনি শুনিয়া থাকেন, তাহা হইলে বলিতে হইবে যে, প্ররোচনা দানকারী দালালরাই উহার জন্য দায়ী অথবা জনাব নূরুল আমীনকে যথেষ্ট চণ্ডনীতি প্রয়োগের সুযোগ দানের জন্য সরকারী দালালরাই এই ধ্বনি তুলিয়াছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে অখণ্ড বঙ্গের ধ্বনি তোলা হইলে তাহা আত্মহত্যারই শামিল এবং তাহা সহ্য করা যাইতে পারে না। উহা দেশদ্রোহিতার পর্যায়ভুক্ত। কাহারও প েএই ধ্বনি তোলা সম্ভব বলিয়া আমার মনে হয় না। ভারত বিভাগের সহিত বঙ্গ-আসাম ও পাঞ্জাবের বিভাগও সম্পন্ন হইয়াছে এবং উহা চিরস্থায়ী হইবে।'
উপসংহারে জনাব সোহরাওয়াদর্ী বলেন, ব্যাপক ধরপাকড় করিয়া বাংলার অধিবাসী ও অন্যান্য লোকদের মধ্যে ত্রাস সঞ্চার করার এবং একমাত্র নিয়মতান্ত্রিক বিরোধীদলকে দমন করার যে চেষ্টা চালিতেছে, আমি ন্যায়নীতি, পাকিস্তান ও সরকারের সুনামের দোহাই দিয়া তাহার প্রতিবাদ জানাইতেছি।"
(সূত্র : দৈনিক আজাদ, ৯ মার্চ ১৯৫২)। _এপিপি
নূরুল আমীন ভাষার দাবির গূঢ় অর্থ অনুধাবনে সর্বদাই ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি বাঙালীভাষী হয়েও বাংলাভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকারীদের গুলি করে হত্যা করেছেন। তিনি এ আন্দোলনকে সরকারের পতন ঘটানোর ষড়যন্ত্র বলেই চালিয়ে দেয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা চালান। পূর্ব-বাংলা ব্যবস্থা পরিষদে ২৪ মার্চ তিনি যে ভাষাণ দেন সে সম্পর্কে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে নূরুল আমীনের ভাষানীতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। প্রতিবেদনটি নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো :
ঢাকা, ২৪ মার্চ। _ আজ প্রাদেশিক ব্যবস্থা পরিষদে এক দীর্ঘ বিবৃতি প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব নূরুল আমীন বলেন, বাংলা ভাষার অনুকূলে পরিচালিত আন্দোলন ব্যাহত : নির্দোষ ও বিধিসঙ্গত বলিয়া প্রতীয়মান হইলেও আসলে উহা বলপ্রয়োগের দ্বারা সরকারের পতন ঘটানোর সঙ্কল্পবদ্ধ প্রচেষ্টার আবরণ মাত্র।
প্রায় এক মাস মুলতবি থাকার পর আজ পরিষদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয়। এই অধিবেশনে জনাব নূরুল আমীন ঢাকার সাম্প্রতিক হাঙ্গামার কারণ এবং প্রকৃতি সম্পর্কে এক সুদীর্ঘ বিবৃতি দান করেন।
তিনি বলেন, ভীতি দর্শন, চাপ প্রয়োগ এবং প্রয়োজন হইলে বলপ্রয়োগের দ্বারা সরকারের পতন ঘটানোই হাঙ্গামার উদ্যোক্তাদের আসল মতলব ছিল। শান্তি ও শৃক্মখলা ফিরাইয়া আনার জন্য তিনি পুলিশ ও সৈন্যদলের উচ্ছ্বসিত ভাষায় প্রশংসা করেন।
জনাব নূরুল আমীন বলেন, ধ্বংসাত্মক কার্যে লিপ্ত ব্যক্তিগণ সংবাদপত্র ও আইন সভার সদস্যদের ভীতি প্রদর্শন, স্বাভাবিক জীবনযাত্রার বাধা সৃষ্টি, ট্রেন চলাচল বন্ধের চেষ্টা, মিথ্যাগুজব সংবলিত এশতেহার বিতরণ প্রভৃতিকে তাহাদের কর্মপন্থা হিসাবে গ্রহণ করিয়াছিল।
তিনি বলেন, এই সমস্ত এশতেহার বাহির হইতে আসিয়াছে সরকারের প েএইরূপ বিশ্বাস করার কারণ আছে।
তিনি বলেন যে, সরকার সময়োচিত ব্যবস্থা অবলম্বনের দ্বারা পাকিস্তানের শক্তিবৃদ্ধি করিয়াছেন এবং এক ভয়ঙ্কর বিপদের হাত হইতে গণতন্ত্রকে রা করিয়াছেন।
তিনি ঘোষণা করেন, প্রদেশের শান্তি বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দূর হইলেও আমাদের আজাদী বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা সম্পূর্ণরূপে কাটিয়া যায় নাই। এমতাবস্থায় আমাদের প েআত্মসন্তুষ্টির কোন অবকাশ নাই।
পরিষদে জনাব নূরুল আমীন বলেন, 'বাজেট অধিবেশন চলিতে থাকাকালে অনেকটা অস্বাভাবিকভাবে পরিষদের অধিবেশন মূলতবি রাখা হয়। ইহার কারণ ও ঘটনাবলী সম্পর্কে পরিষদ সদস্যগণকে অবহিত করা আমার কর্তব্য বলিয়া মনে করি। কেন যে সরকারের এই ব্যবস্থা অবলম্বন করার দরকার হইয়াছিল, সেই সম্পর্কে বর্তমানে যতটুকু প্রকাশ করা যায়, আমি ততটুকু করিব। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় যে গোলযোগ ঘটে, তাহার মূল কারণ ও ধরন এবং পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার জন্য সরকার কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কেও আমি আলোচনা করিব। এইরূপ করিতে হইলে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ও ৩ মার্চ তারিখে আমি বেতার ভাষণে যে সকল তথ্য প্রকাশ করিয়াছিলাম, তাহার কিছুটা উল্লেখ করিতে হইবে। তবে ইতোপূর্বে আমি যে সকল তথ্য প্রকাশ করি নাই, সে সব সম্পর্কেও অদ্য আলোচনা করিব।
প্রথমত, আমি পরিষদকে জানাইতে চাই যে, বাংলা ভাষার অনুকূলে যে আন্দোলন পরিচালিত হইয়াছিল, তাহা বাহ্যত নির্দোষ ও যুক্তিসঙ্গত বলিয়া প্রতীয়মান হইলেও প্রকৃতপ েতাহা ছিল বলপূর্বক সরকারের পতন ঘটাইয়া প্রদেশের সর্বত্র বিশৃক্মখলা সৃষ্টি ও পাকিস্তানের নিরাপত্তার মূলে কুঠারাঘাত করার একটি সংকল্পবদ্ধ প্রচেষ্টার আবরণ মাত্র।
(চলবে)

No comments

Powered by Blogger.