কল্পকথার গল্প-মাথায় ছোট বহরে বড় বাঙালি সন্তান by আলী হাবিব

তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নৈতিক লড়াই শুরু হয়ে গেছে। 'কেহ কারে নাহি জিনে' অবস্থা। সবার চাওয়া তালগাছ। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তাদের চিড়ে-চ্যাপ্টা হওয়ার জোগাড়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক আমলের একটা জোক বলে একটু হালকা হওয়া যাক। জোকটি অনেকেই জানেন।
জানা জোক নতুন করে শোনানো হচ্ছে, এ অপরাধ নিজগুণে ক্ষমা করবেন। যে সময় জোকটি খুব চালু ছিল বাংলাদেশে তখন প্রবল প্রতাপে ক্ষমতায় ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই সময় রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আজকের প্রেসিডেন্ট পুতিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তখন বহুল আলোচিত জুনিয়র বুশ। বুশ-পুতিনের নামের সঙ্গে আমাদের বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান ফখরুদ্দীন আহমদের নাম এলো কেন? কারণটি ব্যাখ্যার দাবি রাখে। কারণটি হলো, প্রত্যেকেই ঈশ্বরের আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ঈশ্বর তাঁদের দেখা দিতে রাজি হয়েছিলেন। শুভ দিন দেখে তিনজনই হাজির হলেন ঈশ্বরের দরবারে। ঈশ্বর প্রত্যেককে একটি করে প্রশ্ন করার সুযোগ দিলেন। একটির বেশি প্রশ্ন করা যাবে না। নো সম্পূরক প্রশ্ন! নো প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন! শর্ত মেনে তিনজনই হাজির হলেন ঈশ্বর সমীপে। কিংবা এভাবেও বলা যায়, তাঁদের তিনজনকেই হাজির করা হলো। ক্ষমতা সবখানেই সবাইকে এগিয়ে রাখে। কাজেই জুনিয়র বুশ প্রথমে প্রশ্ন করার সুযোগ পেলেন। তিনি ঈশ্বরকে প্রশ্ন করলেন, তাঁর দেশ, অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শান্তি আসবে কবে? ঈশ্বর কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থেকে জবাব দিলেন, ৫০ বছর পর। ঈশ্বরের জবাব শুনে বুশ সাহেব কাঁদতে শুরু করলেন। কাছাকাছি ঈশ্বরের অনুচর বা দেবতা যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কান্নার কারণ জানতে চাইলেন। বুশ বললেন, তিনি তো আর সেই শান্তিময় আমেরিকা দেখে যেতে পারবেন না। এবার পুতিন সাহেবের পালা। বুশের প্রশ্ন, ঈশ্বরের উত্তর ও সেই জবাব শুনে ভদ্রলোকের কান্না দেখে পুতিন সাহেব বোধহয় একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তিনিও একই প্রশ্ন করে বসলেন। তাঁর রাশিয়ায় শান্তি আসবে কবে? পুতিনের প্রশ্নের জবাবে ঈশ্বর জানালেন, ১০০ বছর পর। জবাব শুনে পুতিনও একদিকে গিয়ে অঝোরে কাঁদতে শুরু করলেন। কী হবে? তিনিও তো একটি শান্তিময় রাশিয়া দেখে যেতে পারবেন না। এবার ফখরুদ্দীন সাহেবের পালা। তিনি বেশ বুক টান করে ঈশ্বরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। একই প্রশ্ন করলেন, বাংলাদেশে কবে শান্তি আসবে? বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রশ্ন শুনে ঈশ্বর নিজেই কাঁদতে শুরু করলেন। ঈশ্বরের দরবারে উপস্থিত সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করে দিল। এক্ষণে আবারও নতুন করে বলে রাখতে চাই, এই জোকটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।
ঈশ্বরকে নিয়ে শুরু যে লেখার, সে লেখায় পাগলের আগমন ঘটল কেন? একটু খোলাসা করে তাহলে বলাই যাক। ঈশ্বর স্বর্গের হিসাবরক্ষক চিত্রগুপ্তকে বহুবার মর্ত্যে পাঠিয়েছেন। কল্পকথার গল্পে বাংলাদেশেও চিত্রগুপ্তের শুভাগমন ঘটেছে বহুবার। তিনি আবারও এসেছেন এই বঙ্গে। এবার তিনি এসেছেন নতুন এক মিশন নিয়ে। ঈশ্বরের কাছে কোনোভাবে খবর গেছে বাংলাদেশে উন্মাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। খবর পেয়ে তিনি চিন্তিত হয়েছেন। যে দেশকে নিয়ে পশ্চিমারা এত আশার কথা শোনাচ্ছে, বিড়াল থেকে বাঘ হতে যাচ্ছে যে দেশটি, অচিরেই উন্নতির একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে উচ্চারিত হবে যে দেশের নাম- সেই দেশে উন্মাদের সংখ্যাবৃদ্ধির কারণ কী, এই ভেবে ঈশ্বর বড়ই উতলা। এর সত্যাসত্য উদ্ঘাটনেই তিনি চিত্রগুপ্তকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন। তাঁর এবারের আগমন খুব গোপনীয় হলেও শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটি আর গোপন থাকেনি। গোপন থাকেনি চিত্রগুপ্তের রিপোর্টও। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে আজকাল সবকিছু লিক হয়ে যায়। সেই লিক হওয়া রিপোর্ট চলে এসেছে, এখন হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসছে। কী আছে চিত্রগুপ্তের রিপোর্টে? চিত্রগুপ্ত লিখছেন, 'পরমেশ্বর অন্তর্যামী, আপনি সবই জানেন। কোনো কিছুই তো আপনার দৃষ্টি এড়ায় না। বাংলাদেশে একটি পাগলাগারদ আছে। সেখানে পাগলদের চিকিৎসা করা হয়। ওদিকে পা বাড়ায়নি। এমনিতেই এখানে মানুষের চলাফেরার মধ্যে কোনো অসংগতি খুঁজে পাওয়া যায়নি। রাজধানী ঢাকায় আগের মতোই যানজট আছে। রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্রমসময় নষ্ট হচ্ছে। এখানে রাজনীতি আছে। সরকারি ও বিরোধী দল নিজেদের অবস্থানে বেশ ভালোই আছে বলে মনে হয়। হ্যাঁ, উন্মাদনার কথা যদি বলেন, তাহলে বলতে হয়, উন্মাদনা যথেষ্ট বেড়েছে বাংলাদেশে। বিশেষ করে ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনার শেষ নেই। রাজনৈতিক উন্মাদনাও কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি পেয়েছে বা পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এরই মধ্যে কারো কারো কথা ও কাজের বিবেচনা করে সেটাকে উন্মাদের কাজ বলে বিবেচনা করা যায় কি না, তা ভেবে দেখার বিষয়।
পরমেশ্বর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে এক কবি সম্পর্কে জানেন। বাঙালির কাব্যকলার এই ঠাকুর তাঁর এক কবিতায় লিখেছেন, 'ভদ্র মোরা, শান্ত বড়ো,/পোষ-মানা এ প্রাণ/বোতাম-আঁটা এ জামার নিচে/শান্তিতে শয়ান।/দেখা হলেই মিষ্ট অতি/মুখের ভাব শিষ্ট অতি/ অলস দেহ ক্লিষ্টগতি- /গৃহের প্রতি টান।/তৈল-ঢালা সিগ্ধ তনু/নিদ্ররসে ভরা,/মাথায় ছোটো বহরে বড়ো বাঙালি সন্তান।' কবির এই কবিতাটি আমার বোধের অগম্য। না, সবটুকু নয়। কেবল ওই মাথায় ছোট- এই দুটি শব্দের অর্থ বুঝতে আমি অপারগ। কী বোঝাতে চেয়েছেন কবি? মাথায় ছোট মানে কি বেঁটে, নাকি তাঁর মাথার আকৃতি ছোট, নাকি মাথার ভেতর বস্তুর আকাল?
আমি এটুকু বুঝি পরমেশ্বর, কেবল উন্মাদরাই অন্যকে উন্মাদ বিবেচনা করে। পাকিস্তানের প্রতাপশালী এক ফিল্ড মার্শাল প্রেসিডেন্টেকে নাকি তেমন এক পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছিল। বাংলাদেশে আজকাল মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যস্ফীতি- এসব শব্দ খুব চলছে। শরীরের মধ্যপ্রদেশ স্ফীত হওয়ার মতোই এসব স্ফীতি নাকি জনস্বার্থবিরোধী। জেনেশুনে যাঁরা এসব স্ফীতি ডেকে আনেন, তাঁদের কি উন্মাদ বলা যায় পরমেশ্বর?'
চিত্রগুপ্তের এই রিপোর্ট কোনো কাজে লেগেছে কি না, সে বিষয়ে কোনো লিক হওয়া খবর আপাতত নেই।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.