মুদ্রানীতি-মুদ্রানীতির রাজনৈতিক অর্থনীতি by ফারুক মঈনউদ্দীন
একটা ইংরেজি দৈনিকের সাম্প্রতিক সংখ্যার একটা প্রতিবেদনে জানা যায়, ব্যাংকিং খাত থেকে অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা এবং সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির পাশাপাশি একটা রক্ষণশীল রাজস্বনীতি অনুসরণ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে।
ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণের কারণে বেসরকারি খাতের ঋণ সংকুচিত হয়ে প্রবৃদ্ধির গতি মন্থর হয়ে যেতে পারে বলেও সরকারকে সতর্ক করা হয়েছে। এই সতর্কবাণীর দুটো তাৎপর্য আছে: প্রথমত, দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থবাজার, মুদ্রানীতি ইত্যকার বিষয়ে সরকারকে সুপরামর্শ দেওয়ার দায়িত্বটি পালন করছে; দ্বিতীয়ত, ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের অত্যধিক ঋণ গ্রহণ দেশের অর্থনীতিতে যে অনর্থ ঘটাতে পারে, সেই সত্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্কবাণীর মাধ্যমে পত্রিকা মারফত সাধারণ জনগণও জানতে পারছে।
সরকারের প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্কবাণী কিংবা সুপরামর্শ দেওয়ার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানটির স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমেরিকান অর্থনীতিবিদ মিলটন ফ্রিডম্যান (১৯১২-২০০৬) যথার্থই বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা বলতে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সরকারের যে সম্পর্ক বোঝায়, তাকে তুলনা করা চলে সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যকার সম্পর্কের সঙ্গে। ফ্রিডম্যান অবশ্য ব্যঙ্গ করে এ কথাও বলেছেন যে সুদূরতম সম্ভাবনায় স্বাধীন এমন কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি থেকেও থাকে, সেটি স্বাধীন থাকবে যদি সরকারের অন্য কোনো শাখার সঙ্গে তার বিরোধ না থাকে। যদি তেমন বিরোধ থাকে, তাহলে অবশ্যই তাকে রাজস্ব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আপস করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা কিংবা স্বায়ত্তশাসন নিয়ে এই গুরুগম্ভীর রচনায় সরকারের ঋণ গ্রহণসম্পর্কিত বিষয়টি সাধারণ পাঠকদের কাছে ব্যাখ্যা করা উচিত; কারণ সাধারণ মানুষের ধারণা, ঋণ গ্রহণ করে কেবল দরিদ্র মানুষ ও ব্যবসায়ীরা। তাই সরকারের ঋণ গ্রহণের বিষয়টি অনেকের কাছে প্রশ্নসাপেক্ষ মনে হতে পারে। এর সঙ্গে ঘাটতি বাজেট প্রসঙ্গটিও সংগতভাবেই চলে আসবে এবং এই শব্দগুচ্ছও পত্রপত্রিকার কল্যাণে সাধারণ মানুষের কাছে খুব পরিচিত হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।
ঘাটতি বাজেট বলতে কী বোঝায়, আমরা নিশ্চয়ই অনেকে জানি। যে বাজেটে সরকারের আয় থেকে ব্যয় বেশি ধরা হয়, তাকে ঘাটতি বাজেট বলে। অন্যদিকে, যে বাজেটে সরকারি ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি ধরা হয়, সেটা হচ্ছে উদ্বৃত্ত বাজেট। সাধারণত অর্থনীতিতে মন্দাভাব থাকলে ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করা হয়, যাতে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতিতে প্রাণের সঞ্চার হয়। বাজেটের এই ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকারকে অভ্যন্তরীণ ঋণ, বিদেশি সাহায্য, বিদেশি ঋণ ইত্যাদি গ্রহণ করতে হয়। অভ্যন্তরীণ ঋণ ব্যাংক থেকে নেওয়া যেতে পারে, আবার জনগণের কাছ থেকেও নেওয়া হতে পারে। ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রচলিত পন্থা হচ্ছে ট্রেজারি বিল ইস্যু করে এর বিপরীতে ব্যাংক থেকে টাকা নেওয়া। সরকারের পক্ষ হয়ে কাজটি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে একেবারে সরাসরি স্বাভাবিক পন্থায়ও ঋণ নিতে পারে সরকার। যেমন সরকারের একটা খুব বড় খরচ যায় জ্বালানি তেল আমদানিতে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ঋণপত্র খুলে তেল আমদানি করে আমদানি-উত্তর ঋণ নিয়ে থাকে সরকার। আবার জনগণের কাছ থেকেও সরকার ঋণ নিতে পারে বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্পের মাধ্যমে। আমাদের দেশে যে কয়েক ধরনের সরকারি সঞ্চয়পত্র চালু আছে, সেসব জনসাধারণের কাছে সঞ্চয়পত্র হলেও সরকারের জন্য একধরনের ঋণপত্র। এসব সঞ্চয়পত্র মানুষের কাছে বিভিন্ন মেয়াদে বিক্রি করে জনসাধারণের কাছ থেকে সরকার ঋণ গ্রহণ করে।
ঘাটতির পরিমাণ বেশি হলে, অর্থাৎ সরকারের অর্থের চাহিদা বেশি হলে বিভিন্ন সরকারি বন্ড বা সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার বাড়িয়ে দিতে হয়, যাতে ক্রেতারা বেশি পরিমাণে এসব কাগজ কিনতে উৎসাহী হয়। অতি সম্প্রতি এই সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। এতে করে সরকারের সুদের খরচ বেড়ে যায়, আর এই সুদের খরচ মেটাতে গিয়ে বাজেট ঘাটতি আরও বাড়ে, আর তার জন্য রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারকে কর ও শুল্কের হার বাড়াতে হয়। এতে করে আবার মানুষের সঞ্চয় ও ব্যয়সক্ষমতার ওপর চাপ পড়ে।
তবে চূড়ান্ত বিবেচনায় অভ্যন্তরীণ ঋণের অর্থে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিকে বেগবান করতে পারে, যদি এই ব্যয় শিল্প ও অবকাঠামো স্থাপনের জন্য নির্বাহ করা হয়। যেমন সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ করলে অর্থনীতিতে সরবরাহব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটে, প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হয়। ঘাটতি বাজেটের মাধ্যমে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির আরও একটা অর্থনৈতিক সুফল হচ্ছে, এর মাধ্যমে চাহিদার অভাবে মন্দাক্রান্ত অর্থনীতিতে মোট চাহিদা বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিকে দ্রুততর করে, বেকারত্ব হ্রাস করে।
ঘাটতি বাজেটের আপাতত সুফলের বিপরীত চিত্রও আছে। সরকারের ঋণের বোঝা যত বাড়বে, তত বাড়বে তার সুদ বাবদ খরচ। অথচ এই সুদ বাবদ খরচটি যদি সরকারকে করতে না হয়, তাহলে সেই অর্থ ব্যয় করা যায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে। ঘাটতি বাজেটের মাধ্যমে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির আরেকটা নেতিবাচক প্রভাব হচ্ছে যে এসব ব্যয়ে সরকারের সহজাত অদক্ষতা ও অপচয়। এ কথা স্বীকৃত সত্য যে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে বেসরকারি খাত সরকারি খাতের চেয়ে অনেক দক্ষ ও সাশ্রয়ী। তাই ঋণ নিয়ে সরকারি বিনিয়োগে এই খাতের অদক্ষতা, দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে বিশাল অঙ্কের অর্থ প্রকৃত বিনিয়োগের বাইরে থেকে যায়।
ঘাটতি বাজেটে সরকারের ব্যয় বেশি হয় বলে একটা মুদ্রাস্ফীতিপ্রবণ অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাত্ত্বিকভাবেও মন্দাকালীন নিদান হচ্ছে, ঘাটতি বাজেট আর মুদ্রাস্ফীতির সময়ের জন্য দরকার উদ্বৃত্ত বাজেট।
এখানে একটা বিষয়ে মানুষের মনে কৌতূহল জাগতে পারে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে রাখার জন্য এত সমালোচনার মুখোমুখি হয়েও মুদ্রা সংকোচননীতি অনুসরণ করে যাচ্ছে, তখন সরকার বিশাল ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিপরীত কাজ করছে কেন?
ঠিক এই প্রশ্নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি উঠে আসে। প্রথম আলোয় অতিসম্প্রতি প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে জানা যায় যে রাজনৈতিক চাপের মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি অনেকাংশে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। অথচ অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যের স্থিতিশীলতা রক্ষা করার জন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা এত গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এ কে এন আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের বহু পরিমাপ আছে, যথা: এটি সরকারকে ঋণ দিতে অস্বীকার করতে পারে কি না, সরকারের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে এটি নিজস্ব ব্যয় নির্বাহ করতে পারে কি না, এটির পরিচালনা পর্ষদ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে কি না, গভর্নর স্বাধীনভাবে মুদ্রানীতি অনুসরণ করে চলতে পারে কি না ইত্যাদি। এসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক হচ্ছে, এটি সরকারকে ঋণ দিতে অস্বীকার করতে পারে কি না। শুরুতেই ইংরেজি দৈনিকের বরাত দিয়ে যা বলা হয়েছিল, তার পরবর্তী প্রতিবেদনে প্রকাশিত খবরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা সম্পর্কে সেই আশাবাদ আর অবশিষ্ট থাকে না। কারণ সরকারি ব্যয় এবং ঋণ নিয়ন্ত্রণে যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো স্বাধীন ভূমিকা না থাকে, তাহলে দেশের মুদ্রা ব্যবস্থাপনা হয়ে পড়বে অদক্ষ এবং ভেঙে পড়বে মূল্য নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। মূল্যস্তর স্থিতিশীল রাখার উদ্দেশ্যে যে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়, সেটি একদিকে যেমন টেকনিক্যাল, অন্যদিকে স্পর্শকাতরও বটে। তাই এটিকে এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া নিরাপদ। এবং সরকারের উচিত এই বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানটির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করা। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দক্ষতা ও বিচক্ষণতা শেষাবধি সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থানকেই সুদৃঢ় করে।
কিছুদিন আগে পত্রিকার আরেকটি খবরে জানা যায় যে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, সরকার কিছুদিনের মধ্যে নতুন ব্যাংকের জন্য দরখাস্ত গ্রহণ করবে। অথচ আইন অনুযায়ী নতুন ব্যাংক স্থাপনের জন্য অনুমতি দেওয়ার কাজটি একান্তভাবেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখতিয়ারাধীন, এখানে সরকার বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কিছু করণীয় নেই। আমাদের দেশের মতো একটা ছোট অর্থনীতিতে অর্ধশতাধিক ব্যাংকের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও আরও নতুন ব্যাংক খোলার যৌক্তিকতা আছে কি না, সেটা বিচারের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতেই থাকা উচিত। এটিকে রাজনৈতিকভাবে চালনা করা বাঞ্ছনীয় নয়।
এ কে এন আহমেদ লেখেন, ১৯৭৫-এর আগের সরকারের সময় তাঁর সুযোগ হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ আস্থা নিয়ে কাজ করার। সেই আস্থা এবং স্বাধীনতার কারণে ছয় থেকে আট মাস সময়ের মধ্যে টাকার বিনিময় মূল্য পরিবর্তন, ৫০০ টাকার নোট বাতিল ঘোষণা, ঋণ সংকোচন, সরকারকে সীমাহীন ঋণদানে অস্বীকার, লোকসানি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ বন্ধ করা—এগুলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতেই বোঝা যায় যে রাজনৈতিক বা সরকারের উচ্চতম পর্যায়ের সমর্থন না পেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে দেশের ওয়ার্যান্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নরের অবস্থান কোথায়। নেহরুর জবাব ছিল, রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর হচ্ছেন রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর। তাঁর এই জবাবেই বলে দেওয়া হয়েছিল, গভর্নরের অবস্থানটি কত স্বতন্ত্র এবং অনন্যসাধারণ।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা যে মূল্যস্তর বা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার একমাত্র নিয়ামক—এটাকে স্বতঃসিদ্ধ মনে করার কোনো গ্রহণযোগ্য ভিত্তি নেই। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির আইনগত স্বাধীনতার ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও অগ্রহণযোগ্য। আমাদের মতো রাজনীতিপ্রবণ দেশে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অস্তিত্ব হয়তো অবাস্তব, কিন্তু একটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান প্রত্যাশা করা নিশ্চয়ই অযৌক্তিক নয়।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
ই-মেইল: fmainuddin@hotmail.com
সরকারের প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্কবাণী কিংবা সুপরামর্শ দেওয়ার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানটির স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমেরিকান অর্থনীতিবিদ মিলটন ফ্রিডম্যান (১৯১২-২০০৬) যথার্থই বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা বলতে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সরকারের যে সম্পর্ক বোঝায়, তাকে তুলনা করা চলে সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যকার সম্পর্কের সঙ্গে। ফ্রিডম্যান অবশ্য ব্যঙ্গ করে এ কথাও বলেছেন যে সুদূরতম সম্ভাবনায় স্বাধীন এমন কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি থেকেও থাকে, সেটি স্বাধীন থাকবে যদি সরকারের অন্য কোনো শাখার সঙ্গে তার বিরোধ না থাকে। যদি তেমন বিরোধ থাকে, তাহলে অবশ্যই তাকে রাজস্ব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আপস করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা কিংবা স্বায়ত্তশাসন নিয়ে এই গুরুগম্ভীর রচনায় সরকারের ঋণ গ্রহণসম্পর্কিত বিষয়টি সাধারণ পাঠকদের কাছে ব্যাখ্যা করা উচিত; কারণ সাধারণ মানুষের ধারণা, ঋণ গ্রহণ করে কেবল দরিদ্র মানুষ ও ব্যবসায়ীরা। তাই সরকারের ঋণ গ্রহণের বিষয়টি অনেকের কাছে প্রশ্নসাপেক্ষ মনে হতে পারে। এর সঙ্গে ঘাটতি বাজেট প্রসঙ্গটিও সংগতভাবেই চলে আসবে এবং এই শব্দগুচ্ছও পত্রপত্রিকার কল্যাণে সাধারণ মানুষের কাছে খুব পরিচিত হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।
ঘাটতি বাজেট বলতে কী বোঝায়, আমরা নিশ্চয়ই অনেকে জানি। যে বাজেটে সরকারের আয় থেকে ব্যয় বেশি ধরা হয়, তাকে ঘাটতি বাজেট বলে। অন্যদিকে, যে বাজেটে সরকারি ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি ধরা হয়, সেটা হচ্ছে উদ্বৃত্ত বাজেট। সাধারণত অর্থনীতিতে মন্দাভাব থাকলে ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করা হয়, যাতে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতিতে প্রাণের সঞ্চার হয়। বাজেটের এই ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকারকে অভ্যন্তরীণ ঋণ, বিদেশি সাহায্য, বিদেশি ঋণ ইত্যাদি গ্রহণ করতে হয়। অভ্যন্তরীণ ঋণ ব্যাংক থেকে নেওয়া যেতে পারে, আবার জনগণের কাছ থেকেও নেওয়া হতে পারে। ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রচলিত পন্থা হচ্ছে ট্রেজারি বিল ইস্যু করে এর বিপরীতে ব্যাংক থেকে টাকা নেওয়া। সরকারের পক্ষ হয়ে কাজটি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে একেবারে সরাসরি স্বাভাবিক পন্থায়ও ঋণ নিতে পারে সরকার। যেমন সরকারের একটা খুব বড় খরচ যায় জ্বালানি তেল আমদানিতে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ঋণপত্র খুলে তেল আমদানি করে আমদানি-উত্তর ঋণ নিয়ে থাকে সরকার। আবার জনগণের কাছ থেকেও সরকার ঋণ নিতে পারে বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্পের মাধ্যমে। আমাদের দেশে যে কয়েক ধরনের সরকারি সঞ্চয়পত্র চালু আছে, সেসব জনসাধারণের কাছে সঞ্চয়পত্র হলেও সরকারের জন্য একধরনের ঋণপত্র। এসব সঞ্চয়পত্র মানুষের কাছে বিভিন্ন মেয়াদে বিক্রি করে জনসাধারণের কাছ থেকে সরকার ঋণ গ্রহণ করে।
ঘাটতির পরিমাণ বেশি হলে, অর্থাৎ সরকারের অর্থের চাহিদা বেশি হলে বিভিন্ন সরকারি বন্ড বা সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার বাড়িয়ে দিতে হয়, যাতে ক্রেতারা বেশি পরিমাণে এসব কাগজ কিনতে উৎসাহী হয়। অতি সম্প্রতি এই সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। এতে করে সরকারের সুদের খরচ বেড়ে যায়, আর এই সুদের খরচ মেটাতে গিয়ে বাজেট ঘাটতি আরও বাড়ে, আর তার জন্য রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারকে কর ও শুল্কের হার বাড়াতে হয়। এতে করে আবার মানুষের সঞ্চয় ও ব্যয়সক্ষমতার ওপর চাপ পড়ে।
তবে চূড়ান্ত বিবেচনায় অভ্যন্তরীণ ঋণের অর্থে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিকে বেগবান করতে পারে, যদি এই ব্যয় শিল্প ও অবকাঠামো স্থাপনের জন্য নির্বাহ করা হয়। যেমন সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ করলে অর্থনীতিতে সরবরাহব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটে, প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হয়। ঘাটতি বাজেটের মাধ্যমে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির আরও একটা অর্থনৈতিক সুফল হচ্ছে, এর মাধ্যমে চাহিদার অভাবে মন্দাক্রান্ত অর্থনীতিতে মোট চাহিদা বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিকে দ্রুততর করে, বেকারত্ব হ্রাস করে।
ঘাটতি বাজেটের আপাতত সুফলের বিপরীত চিত্রও আছে। সরকারের ঋণের বোঝা যত বাড়বে, তত বাড়বে তার সুদ বাবদ খরচ। অথচ এই সুদ বাবদ খরচটি যদি সরকারকে করতে না হয়, তাহলে সেই অর্থ ব্যয় করা যায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে। ঘাটতি বাজেটের মাধ্যমে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির আরেকটা নেতিবাচক প্রভাব হচ্ছে যে এসব ব্যয়ে সরকারের সহজাত অদক্ষতা ও অপচয়। এ কথা স্বীকৃত সত্য যে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে বেসরকারি খাত সরকারি খাতের চেয়ে অনেক দক্ষ ও সাশ্রয়ী। তাই ঋণ নিয়ে সরকারি বিনিয়োগে এই খাতের অদক্ষতা, দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে বিশাল অঙ্কের অর্থ প্রকৃত বিনিয়োগের বাইরে থেকে যায়।
ঘাটতি বাজেটে সরকারের ব্যয় বেশি হয় বলে একটা মুদ্রাস্ফীতিপ্রবণ অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাত্ত্বিকভাবেও মন্দাকালীন নিদান হচ্ছে, ঘাটতি বাজেট আর মুদ্রাস্ফীতির সময়ের জন্য দরকার উদ্বৃত্ত বাজেট।
এখানে একটা বিষয়ে মানুষের মনে কৌতূহল জাগতে পারে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে রাখার জন্য এত সমালোচনার মুখোমুখি হয়েও মুদ্রা সংকোচননীতি অনুসরণ করে যাচ্ছে, তখন সরকার বিশাল ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিপরীত কাজ করছে কেন?
ঠিক এই প্রশ্নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি উঠে আসে। প্রথম আলোয় অতিসম্প্রতি প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে জানা যায় যে রাজনৈতিক চাপের মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি অনেকাংশে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। অথচ অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যের স্থিতিশীলতা রক্ষা করার জন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা এত গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এ কে এন আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের বহু পরিমাপ আছে, যথা: এটি সরকারকে ঋণ দিতে অস্বীকার করতে পারে কি না, সরকারের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে এটি নিজস্ব ব্যয় নির্বাহ করতে পারে কি না, এটির পরিচালনা পর্ষদ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে কি না, গভর্নর স্বাধীনভাবে মুদ্রানীতি অনুসরণ করে চলতে পারে কি না ইত্যাদি। এসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক হচ্ছে, এটি সরকারকে ঋণ দিতে অস্বীকার করতে পারে কি না। শুরুতেই ইংরেজি দৈনিকের বরাত দিয়ে যা বলা হয়েছিল, তার পরবর্তী প্রতিবেদনে প্রকাশিত খবরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা সম্পর্কে সেই আশাবাদ আর অবশিষ্ট থাকে না। কারণ সরকারি ব্যয় এবং ঋণ নিয়ন্ত্রণে যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো স্বাধীন ভূমিকা না থাকে, তাহলে দেশের মুদ্রা ব্যবস্থাপনা হয়ে পড়বে অদক্ষ এবং ভেঙে পড়বে মূল্য নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। মূল্যস্তর স্থিতিশীল রাখার উদ্দেশ্যে যে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়, সেটি একদিকে যেমন টেকনিক্যাল, অন্যদিকে স্পর্শকাতরও বটে। তাই এটিকে এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া নিরাপদ। এবং সরকারের উচিত এই বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানটির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করা। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দক্ষতা ও বিচক্ষণতা শেষাবধি সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থানকেই সুদৃঢ় করে।
কিছুদিন আগে পত্রিকার আরেকটি খবরে জানা যায় যে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, সরকার কিছুদিনের মধ্যে নতুন ব্যাংকের জন্য দরখাস্ত গ্রহণ করবে। অথচ আইন অনুযায়ী নতুন ব্যাংক স্থাপনের জন্য অনুমতি দেওয়ার কাজটি একান্তভাবেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখতিয়ারাধীন, এখানে সরকার বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কিছু করণীয় নেই। আমাদের দেশের মতো একটা ছোট অর্থনীতিতে অর্ধশতাধিক ব্যাংকের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও আরও নতুন ব্যাংক খোলার যৌক্তিকতা আছে কি না, সেটা বিচারের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতেই থাকা উচিত। এটিকে রাজনৈতিকভাবে চালনা করা বাঞ্ছনীয় নয়।
এ কে এন আহমেদ লেখেন, ১৯৭৫-এর আগের সরকারের সময় তাঁর সুযোগ হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ আস্থা নিয়ে কাজ করার। সেই আস্থা এবং স্বাধীনতার কারণে ছয় থেকে আট মাস সময়ের মধ্যে টাকার বিনিময় মূল্য পরিবর্তন, ৫০০ টাকার নোট বাতিল ঘোষণা, ঋণ সংকোচন, সরকারকে সীমাহীন ঋণদানে অস্বীকার, লোকসানি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ বন্ধ করা—এগুলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতেই বোঝা যায় যে রাজনৈতিক বা সরকারের উচ্চতম পর্যায়ের সমর্থন না পেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে দেশের ওয়ার্যান্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নরের অবস্থান কোথায়। নেহরুর জবাব ছিল, রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর হচ্ছেন রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর। তাঁর এই জবাবেই বলে দেওয়া হয়েছিল, গভর্নরের অবস্থানটি কত স্বতন্ত্র এবং অনন্যসাধারণ।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা যে মূল্যস্তর বা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার একমাত্র নিয়ামক—এটাকে স্বতঃসিদ্ধ মনে করার কোনো গ্রহণযোগ্য ভিত্তি নেই। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির আইনগত স্বাধীনতার ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও অগ্রহণযোগ্য। আমাদের মতো রাজনীতিপ্রবণ দেশে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অস্তিত্ব হয়তো অবাস্তব, কিন্তু একটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান প্রত্যাশা করা নিশ্চয়ই অযৌক্তিক নয়।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
ই-মেইল: fmainuddin@hotmail.com
No comments