আমি ছোট, আমাকে ধাক্কা দেবেন না by মহসীন হাবিব
মহামান্য যুক্তরাষ্ট্র্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, আমাদের বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিশ্চয়ই আপনি চেনেন। কারণ আপনি নিজে ভারতবর্ষের আরেক মহাপুরুষ মহাত্মা গান্ধীর ভক্ত। এর চেয়ে বড় কথা, আপনাদের মুল্লুকে শুধু আত্মীয়তার জোরে বা সম্পদের উত্তরাধিকারীর মতো রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান হওয়ার সুযোগ নেই।
বহু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আপনাদের দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বিশ্বকবিকে না চেনার কোনো কারণ নেই। এই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সভাপতির অভিভাষণে বলেছেন, 'দেশের মধ্যে পরিবর্তন বাহির হইতে আসিলে পুরাতন আশ্রয়টা যখন অব্যবহারে ভাঙিয়া পড়ে এবং নূতন কালের উপযোগী কোনো নতুন ব্যবস্থাও গড়িয়া উঠে না, তখন সেইরূপ যুগান্তকালে বহুতর পুরাতন জাতি পৃথিবী হইতে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। আমরাও কি দিনে দিনে উদাস দৃষ্টির সম্মুখে স্বজাতিকে লুপ্ত হইতে দেখিব?'
মহামান্য প্রেসিডেন্ট, আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই শঙ্কা আমাদের অন্তরে আবার প্রবেশ করছে চারদিকের অবস্থা দেখে। আমাদের দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আপনাদের প্রসারিত হাত এ শঙ্কার প্রধান কারণ। চোখ বুজে অনুভব করলে দেখি অন্ধকার, চোখ খুললে দেখি আরো নিকষ অন্ধকার। ওই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই ব্রিটিশ শাসকদের সম্পর্কে বলেছেন, 'তারা ব্রিটেন চালায় এক নিয়মে, আর ভারতবর্ষ চালায় আরেক নিয়মে' (তাঁর কথাটি হুবহু এ রকম না হলেও অর্থটি তাই)। আপনাদের মূলধারাটি তো সেই ব্রিটেনেরই উত্তরাধিকার। তাই ব্রিটেনের অনুজ, কিন্তু পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্রের আচরণে আমরা সেই একই নীতি দেখে আসছি। আপনারা অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থাকে প্রায় স্বর্গের কাছে নিয়ে গেছেন। কিন্তু বাইরের দেশগুলোকে উল্টো নরকে পরিণত করছেন। প্রাসঙ্গিক একটি কথা বলি। এ দেশের প্রায় সব সাধারণ মানুষ যুক্তরাষ্ট্রকে একটি করে গালি দেয়, কিন্তু সব মানুষই যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বসবাসের স্বপ্ন দেখে। আগে বিষয়টিকে দ্বৈত আচরণ মনে করে নিজের জাতির প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা হতো। এখন এর কারণ বুঝতে পারি। বাইরের যুক্তরাষ্ট্র একটি নরক, তাই তারা গালি দেয়। আর ভেতরের যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বসবাস একটি আইনের শাসনের, নিরাপদ জীবনের হাতছানি। তাই তারা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে চায়। দূর থেকে আমরা বুঝতে পারি, যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিকের সঙ্গে সরকার সত্যিকারের মা-বাবার মতো আচরণ করে। অপরাধী সন্তানকে বাঁচানোর জন্য যেমন মা-বাবা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায়ের ধার ধারেন না, তেমনি আপনারা আপনাদের নাগরিকদের অন্য দেশ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে কোনো আইন, নিয়মের তোয়াক্কা করেন না। এই তো মাত্র কয়েক দিন আগে সিআইএর 'কন্ট্রাকটর' রেমন্ড অ্যালেন ডেভিস পাকিস্তানে সরাসরি গুলি করে দুজন লোককে হত্যা করল। আপনারা ২.৩৪ মিলিয়ন ডলার রক্তের মূল্য দিয়ে তাকে কী সুন্দরভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে গেলেন! মজার ব্যাপার হলো, যে শরিয়াহ আইনের বিরুদ্ধে আপনারা যথার্থই সোচ্চার, সেই শরিয়া আইনকে আপনারা ব্যবহার করলেন ডেভিসকে ছাড়িয়ে নিতে। এমন ঘটনা অসংখ্য আছে। বিগত দিনে আপনারা সবার চোখের আড়ালে আমাদের দেশের জেল থেকেও মাদক আইনে শাস্তি পাওয়া নাগরিককে বের করে নিয়ে গেছেন। আপনাদের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখি, নাগরিকের প্রতি এমন দায়িত্ব পালন ধন্যবাদার্হ। কিন্তু এই আপনারাই আবার দেশে দেশে মায়ের আঁচল, বাবার নিরাপদ কোল শূন্য করে দিচ্ছেন।
মাননীয় প্রেসিডেন্ট, আপনাদেরই পয়সায় জাতিসংঘের মোট ব্যয়ের ৬০ শতাংশ চলে। সুতরাং তারা আপনাদের কথায় ওঠে ও বসে। সেটাই স্বাভাবিক। মহাসচিব বান কি মুনের জন্মস্থান কোরিয়া হলেও তিনি আপনাদের দেশটিকেই নিজের দেশ মনে করেন। এই জাতিসংঘের শান্তি মিশনের ভূমিকা ও উদ্দেশ্য কী মহামান্য প্রেসিডেন্ট? দেখুন, আইভরি কোস্টের প্রেসিডেন্ট লঁরা বাগবো গত নভেম্বরের নির্বাচনে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে যেতে অস্বীকার করায় মিলিশিয়ারা রাজধানী আবিদজানে অভিযান চালাচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে লঁরার পতনের সংবাদ আমরা পেয়ে যাব। যাহোক, বাগবো আপনাদের আস্থা হারিয়েছেন। ওয়াতারার অনুসারী মিলিশিয়ারা আবিদজানের দিকে যাওয়ার সময় ২৭ থেকে ২৯ মার্চ দুই দিনে পশ্চিমাঞ্চলীয় দোকো শহর পার হওয়ার সময় এক হাজার বেসামরিক লোককে হত্যা করেছে। এমন ঘটনাও দেখা গেছে যে মা ও শিশু রাস্তা দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য, মিলিশিয়ারা তাদের পাখির মতো গুলি করে ফেলে দিয়েছে। এ হত্যাযজ্ঞের কাছাকাছি আপনার জাতিসংঘের শান্তি রক্ষাকারী বাহিনী হাত গুটিয়ে বসে ছিল। এর মাজেজা কী?
মাননীয় প্রেসিডেন্ট, লিবিয়ার ঘটনাটি বড়ই আজব। বহুকাল ধরে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে একজন খারাপ ধরনের পাগল বলেই অনেকে মনে করেন। তিনি বিশ্বের বহু অপরাধের সমর্থন দিয়েছেন। তিনিই ১৯৮৫ সালে রোম ও ভিয়েনা এয়ারপোর্টে সন্ত্রাসী হামলার পেছনে ছিলেন, আক্রমণে মদদ বা সমর্থন দিয়েছেন; রেড আর্মি ও রেড ব্রিগেডকে সমর্থনের ঘোষণা দিয়েছেন। ১৯৮৬ সালে পশ্চিম বার্লিনের 'লা বেলে' নাইট ক্লাবে আক্রমণের পেছনে নাকি তিনিই ছিলেন। ১৯৮৮ সালে প্যান অ্যাম বিমানে বোমা হামলা চালিয়ে ২৬৯ জনকে হত্যা করে গাদ্দাফির অনুসারীরা, যা লকারবি বোমা হামলা বলে পরিচিত। তবে ১৯৮৬ সালে আপনারা অপারেশন এলডোরাডো ক্যানিয়ন নামে বিমান হামলা চালিয়েছিলেন মূলত তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানকে 'কুকুর' বলে গালি দেওয়ার কারণে। শুধু কি তাই, গাদ্দাফি আমাদের সঙ্গেও এক ভয়ানক শত্রুতামূলক আচরণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের আশ্রয় দিয়ে। এত কিছুর পরও ৪০টি বছর আপনারা তাঁকে ক্ষমতায় থাকতে দিয়েছেন। হঠাৎ করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে রাতারাতি লিবিয়ায় তৈরি হয়ে গেল মিলিশিয়া বাহিনী। তারা এখন যে শেলগুলো ব্যবহার করছে, সেগুলোতে পরিষ্কার যুক্তরাষ্ট্রে তৈরির সিল-ছাপ্পড় আছে। মুশকিল অন্যত্র_আপনারা গাদ্দাফিকে আক্রমণ করে তাঁর এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ভেঙে দিলেন, আবার তাঁকে উৎখাতও করলেন না! দুই পক্ষের সামরিক ক্ষমতায় একটি ভারসাম্য এনে দিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শুরু করালেন। মাস পার হয়ে গেল, একবার গাদ্দাফি বাহিনী বিদ্রোহীদের শহর দখল করে, একবার বিদ্রোহীরা গাদ্দাফির অনুসারীদের হটিয়ে শহর দখল করে! তাই কেউ কেউ সন্দেহ করছেন তেলসমৃদ্ধ লিবিয়ায় আপনারা 'জাতিসংঘের পিস কিপিং ফোর্স' বসানোর পাঁয়তারা করছেন।
মাননীয় প্রেসিডেন্ট, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর থেকে সর্বত্র আপনারা জয়ী হয়েছেন। শুধু তিনটি জায়গায় আপনারা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। একটি ভিয়েতনাম যুদ্ধ, একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, আরেকটি সম্প্রতি জর্জিয়ার যুদ্ধ বা রাশিয়ার আক্রমণ, যা-ই বলেন। ১৯৭০-৭১-এর ঘটনাবলিতে আপনারা নিজেদের স্বার্থে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া, গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে অস্বীকারকারী পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু আপনাদের কাঙ্ক্ষিত অখণ্ড পাকিস্তান আর থাকেনি। শেষ পর্যন্ত প্রায় এককভাবে এ দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা মানুষটিকে হত্যা করালেন একদল কুকুর-বিড়াল দিয়ে। বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যাঁকে হত্যা করতে পারল না, তাঁকে আপনারা বিনা দ্বিধায় ক্ষমতার পালাবদলের স্বার্থে নৃশংসভাবে হত্যা করালেন।
তাই নানা কারণে ভয় পাচ্ছি। ভয়ের প্রধান কারণ, আপনাদের আধুনিক কিছু নমুনা। অধ্যাপক ইউনূসকে নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। তিনি অনেক বড় মানুষ। এত বড় একটি সফল ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন, নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। হয়তো অধ্যাপক ইউনূসের ব্যাপারে সরকার ছাড় দিতে পারত এবং সেটা না দিয়ে অন্যায়ই করেছে। কিন্তু একটি দেশের একটি ব্যাংকের পদ নিয়ে আপনারা অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট রবার্ট ব্লেককে পাঠিয়ে দিলেন। আপনাদের রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি যেভাবে নাক গলালেন, তাতে শঙ্কা হলো, আপনাদের আরো বড় স্বার্থ এখানে তৈরি হলে আমরা সামাল দেব কী করে? যেমন জানা গেছে, বাংলাদেশে কয়লা উত্তোলনে নিয়োজিত এশিয়া এনার্জির ৬০ শতাংশ বিনিয়োগ নাকি যুক্তরাষ্ট্রের। এশিয়া এনার্জি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনে অধীর হয়ে আছে। কিন্তু দেশের সচেতন সমাজ, পরিবেশবাদী, ভুক্তভোগী লাখ লাখ নাগরিক এ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করতে দেবে না। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি জনগণের স্বার্থ দেখে, পরিবেশের কথা চিন্তা করে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনে সম্মত না হয়, তাহলে আপনারা কোনটা করবেন_সরকার হঠানোর আন্দোলন, নাকি বোম্বিং?
মাননীয় প্রেসিডেন্ট, আমাদের এই ঢাকা শহরে এক ধরনের ছোট সিএনজিচালিত স্কুটার চলে। এগুলো আপনাদের উন্নত দেশের শহরগুলোতে নেই। এই সিএনজিগুলোর পেছনে ট্রাক বা বড় গাড়িকে উদ্দেশ করে লেখা থাকে, 'আমি ছোট, আমাকে ধাক্কা দেবেন না'। তেমনি আমরাও ছোট। আরবের মতো সমুদ্রসম তেল নেই। আছে সামান্য একটু উন্নত জাতের কয়লা ও যৎসামান্য গ্যাস। এটুকুর দিকে নাইবা তাকালেন। স্বার্থ না দেখে এখানে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আপনারা সহায়তা করুন, আমাদের শিক্ষা বিস্তারে সহায়তা করুন। ঈশ্বর যদি কেউ থাকেন, আপনাদের ভালো করবেন।
লেখক : সাংবাদিক mohshinhabib@yahoo.com
মহামান্য প্রেসিডেন্ট, আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই শঙ্কা আমাদের অন্তরে আবার প্রবেশ করছে চারদিকের অবস্থা দেখে। আমাদের দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আপনাদের প্রসারিত হাত এ শঙ্কার প্রধান কারণ। চোখ বুজে অনুভব করলে দেখি অন্ধকার, চোখ খুললে দেখি আরো নিকষ অন্ধকার। ওই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই ব্রিটিশ শাসকদের সম্পর্কে বলেছেন, 'তারা ব্রিটেন চালায় এক নিয়মে, আর ভারতবর্ষ চালায় আরেক নিয়মে' (তাঁর কথাটি হুবহু এ রকম না হলেও অর্থটি তাই)। আপনাদের মূলধারাটি তো সেই ব্রিটেনেরই উত্তরাধিকার। তাই ব্রিটেনের অনুজ, কিন্তু পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্রের আচরণে আমরা সেই একই নীতি দেখে আসছি। আপনারা অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থাকে প্রায় স্বর্গের কাছে নিয়ে গেছেন। কিন্তু বাইরের দেশগুলোকে উল্টো নরকে পরিণত করছেন। প্রাসঙ্গিক একটি কথা বলি। এ দেশের প্রায় সব সাধারণ মানুষ যুক্তরাষ্ট্রকে একটি করে গালি দেয়, কিন্তু সব মানুষই যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বসবাসের স্বপ্ন দেখে। আগে বিষয়টিকে দ্বৈত আচরণ মনে করে নিজের জাতির প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা হতো। এখন এর কারণ বুঝতে পারি। বাইরের যুক্তরাষ্ট্র একটি নরক, তাই তারা গালি দেয়। আর ভেতরের যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বসবাস একটি আইনের শাসনের, নিরাপদ জীবনের হাতছানি। তাই তারা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে চায়। দূর থেকে আমরা বুঝতে পারি, যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিকের সঙ্গে সরকার সত্যিকারের মা-বাবার মতো আচরণ করে। অপরাধী সন্তানকে বাঁচানোর জন্য যেমন মা-বাবা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায়ের ধার ধারেন না, তেমনি আপনারা আপনাদের নাগরিকদের অন্য দেশ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে কোনো আইন, নিয়মের তোয়াক্কা করেন না। এই তো মাত্র কয়েক দিন আগে সিআইএর 'কন্ট্রাকটর' রেমন্ড অ্যালেন ডেভিস পাকিস্তানে সরাসরি গুলি করে দুজন লোককে হত্যা করল। আপনারা ২.৩৪ মিলিয়ন ডলার রক্তের মূল্য দিয়ে তাকে কী সুন্দরভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে গেলেন! মজার ব্যাপার হলো, যে শরিয়াহ আইনের বিরুদ্ধে আপনারা যথার্থই সোচ্চার, সেই শরিয়া আইনকে আপনারা ব্যবহার করলেন ডেভিসকে ছাড়িয়ে নিতে। এমন ঘটনা অসংখ্য আছে। বিগত দিনে আপনারা সবার চোখের আড়ালে আমাদের দেশের জেল থেকেও মাদক আইনে শাস্তি পাওয়া নাগরিককে বের করে নিয়ে গেছেন। আপনাদের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখি, নাগরিকের প্রতি এমন দায়িত্ব পালন ধন্যবাদার্হ। কিন্তু এই আপনারাই আবার দেশে দেশে মায়ের আঁচল, বাবার নিরাপদ কোল শূন্য করে দিচ্ছেন।
মাননীয় প্রেসিডেন্ট, আপনাদেরই পয়সায় জাতিসংঘের মোট ব্যয়ের ৬০ শতাংশ চলে। সুতরাং তারা আপনাদের কথায় ওঠে ও বসে। সেটাই স্বাভাবিক। মহাসচিব বান কি মুনের জন্মস্থান কোরিয়া হলেও তিনি আপনাদের দেশটিকেই নিজের দেশ মনে করেন। এই জাতিসংঘের শান্তি মিশনের ভূমিকা ও উদ্দেশ্য কী মহামান্য প্রেসিডেন্ট? দেখুন, আইভরি কোস্টের প্রেসিডেন্ট লঁরা বাগবো গত নভেম্বরের নির্বাচনে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে যেতে অস্বীকার করায় মিলিশিয়ারা রাজধানী আবিদজানে অভিযান চালাচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে লঁরার পতনের সংবাদ আমরা পেয়ে যাব। যাহোক, বাগবো আপনাদের আস্থা হারিয়েছেন। ওয়াতারার অনুসারী মিলিশিয়ারা আবিদজানের দিকে যাওয়ার সময় ২৭ থেকে ২৯ মার্চ দুই দিনে পশ্চিমাঞ্চলীয় দোকো শহর পার হওয়ার সময় এক হাজার বেসামরিক লোককে হত্যা করেছে। এমন ঘটনাও দেখা গেছে যে মা ও শিশু রাস্তা দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য, মিলিশিয়ারা তাদের পাখির মতো গুলি করে ফেলে দিয়েছে। এ হত্যাযজ্ঞের কাছাকাছি আপনার জাতিসংঘের শান্তি রক্ষাকারী বাহিনী হাত গুটিয়ে বসে ছিল। এর মাজেজা কী?
মাননীয় প্রেসিডেন্ট, লিবিয়ার ঘটনাটি বড়ই আজব। বহুকাল ধরে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে একজন খারাপ ধরনের পাগল বলেই অনেকে মনে করেন। তিনি বিশ্বের বহু অপরাধের সমর্থন দিয়েছেন। তিনিই ১৯৮৫ সালে রোম ও ভিয়েনা এয়ারপোর্টে সন্ত্রাসী হামলার পেছনে ছিলেন, আক্রমণে মদদ বা সমর্থন দিয়েছেন; রেড আর্মি ও রেড ব্রিগেডকে সমর্থনের ঘোষণা দিয়েছেন। ১৯৮৬ সালে পশ্চিম বার্লিনের 'লা বেলে' নাইট ক্লাবে আক্রমণের পেছনে নাকি তিনিই ছিলেন। ১৯৮৮ সালে প্যান অ্যাম বিমানে বোমা হামলা চালিয়ে ২৬৯ জনকে হত্যা করে গাদ্দাফির অনুসারীরা, যা লকারবি বোমা হামলা বলে পরিচিত। তবে ১৯৮৬ সালে আপনারা অপারেশন এলডোরাডো ক্যানিয়ন নামে বিমান হামলা চালিয়েছিলেন মূলত তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানকে 'কুকুর' বলে গালি দেওয়ার কারণে। শুধু কি তাই, গাদ্দাফি আমাদের সঙ্গেও এক ভয়ানক শত্রুতামূলক আচরণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের আশ্রয় দিয়ে। এত কিছুর পরও ৪০টি বছর আপনারা তাঁকে ক্ষমতায় থাকতে দিয়েছেন। হঠাৎ করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে রাতারাতি লিবিয়ায় তৈরি হয়ে গেল মিলিশিয়া বাহিনী। তারা এখন যে শেলগুলো ব্যবহার করছে, সেগুলোতে পরিষ্কার যুক্তরাষ্ট্রে তৈরির সিল-ছাপ্পড় আছে। মুশকিল অন্যত্র_আপনারা গাদ্দাফিকে আক্রমণ করে তাঁর এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ভেঙে দিলেন, আবার তাঁকে উৎখাতও করলেন না! দুই পক্ষের সামরিক ক্ষমতায় একটি ভারসাম্য এনে দিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শুরু করালেন। মাস পার হয়ে গেল, একবার গাদ্দাফি বাহিনী বিদ্রোহীদের শহর দখল করে, একবার বিদ্রোহীরা গাদ্দাফির অনুসারীদের হটিয়ে শহর দখল করে! তাই কেউ কেউ সন্দেহ করছেন তেলসমৃদ্ধ লিবিয়ায় আপনারা 'জাতিসংঘের পিস কিপিং ফোর্স' বসানোর পাঁয়তারা করছেন।
মাননীয় প্রেসিডেন্ট, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর থেকে সর্বত্র আপনারা জয়ী হয়েছেন। শুধু তিনটি জায়গায় আপনারা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। একটি ভিয়েতনাম যুদ্ধ, একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, আরেকটি সম্প্রতি জর্জিয়ার যুদ্ধ বা রাশিয়ার আক্রমণ, যা-ই বলেন। ১৯৭০-৭১-এর ঘটনাবলিতে আপনারা নিজেদের স্বার্থে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া, গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে অস্বীকারকারী পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু আপনাদের কাঙ্ক্ষিত অখণ্ড পাকিস্তান আর থাকেনি। শেষ পর্যন্ত প্রায় এককভাবে এ দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা মানুষটিকে হত্যা করালেন একদল কুকুর-বিড়াল দিয়ে। বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যাঁকে হত্যা করতে পারল না, তাঁকে আপনারা বিনা দ্বিধায় ক্ষমতার পালাবদলের স্বার্থে নৃশংসভাবে হত্যা করালেন।
তাই নানা কারণে ভয় পাচ্ছি। ভয়ের প্রধান কারণ, আপনাদের আধুনিক কিছু নমুনা। অধ্যাপক ইউনূসকে নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। তিনি অনেক বড় মানুষ। এত বড় একটি সফল ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন, নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। হয়তো অধ্যাপক ইউনূসের ব্যাপারে সরকার ছাড় দিতে পারত এবং সেটা না দিয়ে অন্যায়ই করেছে। কিন্তু একটি দেশের একটি ব্যাংকের পদ নিয়ে আপনারা অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট রবার্ট ব্লেককে পাঠিয়ে দিলেন। আপনাদের রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি যেভাবে নাক গলালেন, তাতে শঙ্কা হলো, আপনাদের আরো বড় স্বার্থ এখানে তৈরি হলে আমরা সামাল দেব কী করে? যেমন জানা গেছে, বাংলাদেশে কয়লা উত্তোলনে নিয়োজিত এশিয়া এনার্জির ৬০ শতাংশ বিনিয়োগ নাকি যুক্তরাষ্ট্রের। এশিয়া এনার্জি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনে অধীর হয়ে আছে। কিন্তু দেশের সচেতন সমাজ, পরিবেশবাদী, ভুক্তভোগী লাখ লাখ নাগরিক এ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করতে দেবে না। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি জনগণের স্বার্থ দেখে, পরিবেশের কথা চিন্তা করে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনে সম্মত না হয়, তাহলে আপনারা কোনটা করবেন_সরকার হঠানোর আন্দোলন, নাকি বোম্বিং?
মাননীয় প্রেসিডেন্ট, আমাদের এই ঢাকা শহরে এক ধরনের ছোট সিএনজিচালিত স্কুটার চলে। এগুলো আপনাদের উন্নত দেশের শহরগুলোতে নেই। এই সিএনজিগুলোর পেছনে ট্রাক বা বড় গাড়িকে উদ্দেশ করে লেখা থাকে, 'আমি ছোট, আমাকে ধাক্কা দেবেন না'। তেমনি আমরাও ছোট। আরবের মতো সমুদ্রসম তেল নেই। আছে সামান্য একটু উন্নত জাতের কয়লা ও যৎসামান্য গ্যাস। এটুকুর দিকে নাইবা তাকালেন। স্বার্থ না দেখে এখানে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আপনারা সহায়তা করুন, আমাদের শিক্ষা বিস্তারে সহায়তা করুন। ঈশ্বর যদি কেউ থাকেন, আপনাদের ভালো করবেন।
লেখক : সাংবাদিক mohshinhabib@yahoo.com
No comments