ভিন্নমত-ভবিষ্যতে শেয়ারবাজার যেমন হতে পারে by আবু আহমেদ

আমাদের এক অধ্যাপক শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলেন। আমি তাঁকে বললাম, ভালো, তবে কত দিন তা বজায় থাকে, এ নিয়ে সন্দেহ আছে। তিনি আমার সন্দেহের কারণ জানতে চাইলেন। আমি বললাম, দেখুন, শেয়ারবাজারের সম্প্রসারণ যা হওয়ার, তা গত তিন বছরে হয়ে গেছে। এই সম্প্রসারণ এত তাড়াতাড়ি হয়েছে যে, এর সঙ্গে সরবরাহ তাল রাখতে পারেনি। ফলে শেয়ারের মূল্য


অস্বাভাবিক বেড়ে যায় এবং এই বৃদ্ধির পেছনে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণদানও বড় ভূমিকা পালন করে। রেগুলেটর যে পর্যায়ে রেগুলেট করার কথা, সেটা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। বরং রেগুলেটরের অনুমতি নিয়েই অকাজগুলো বেশি সংঘটিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে শেয়ারবাজার ৮৯০০ সূচকে থাকতে পারে না এবং থাকেওনি। কিন্তু সেই বিধ্বস্ত হওয়ার মূল্যটা দিতে হয়েছে ৩৩ লাখ খুদে বিনিয়োগকারীকে। তাঁরা তাঁদের লোকসান কোনো দিনই পুষিয়ে নিতে পারবেন না, লোকসানটা বড়জোর কমাতে পারবেন। এই ধাক্কায় অনেক বিনিয়োগকারী বাজার ত্যাগ করেছেন। অন্য বিষয় হলো, শেয়ারবাজার থেকে যে অর্থ বের হয়ে গেছে তা পুনঃপ্রবেশ করবে না, এখানেও আংশিক করতে পারে মাত্র। আর কালো টাকার কথা বলছেন? ওই টাকাও অতটা প্রবেশ করবে না।
শেয়ারবাজারের রমরমা বছর ছিল ২০১০, আর রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, ওই আর্থিক বছরে কালো টাকা প্রবেশ করেছে মাত্র এক হাজার কোটি, যা শেয়ারবাজারের জন্য কিছুই নয়। ব্যাংক, বীমা ও লিজিং কম্পানিগুলো এই বাজারে যে টাকা ঢালার তা ঢেলে ফেলেছে। নতুন করে এরা বিনিয়োগ করবে, এটা আশা করা যায় না। বীমা কম্পানিগুলো কিছু অর্থ নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারে, ব্যাংকের পক্ষে সেটা মোটেই সম্ভব নয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি প্রতিরোধের নামে যে মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে, সেই নীতি একদিকে অর্থনীতিতে বিনিয়োগকে যেমন নিরুৎসাহ করবে, অন্যদিকে শেয়ারবাজারে নতুন অর্থপ্রবাহকেও টেনে ধরবে। সব কিছু মিলিয়ে আমি নতুন করে শেয়ারবাজারে বড় অঙ্কের অর্থ প্রবেশের সম্ভাবনা দেখি না। অন্যদিকে ২০১০ এবং বর্তমান বছরে বোনাস বা রাইট শেয়ার ইস্যু করার ধুম পড়ে গেছে। সরকারও শেয়ার বেচা শুরু করেছে। আমরা সরকারকে সেই ২০০৮ থেকে শেয়ার বেচার জন্য অনুরোধ জানিয়ে আসছিলাম। বড় উদ্দেশ্য ছিল শেয়ারের সরবরাহ বাড়ানো, যাতে বাজারটা বর্ধিত চাহিদা সামাল দিতে পারে। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। অর্থ মন্ত্রণালয় হুকুম দিয়েছে তো অন্য মন্ত্রণালয় শেয়ার বেচা আটকে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত সরকারি তরফ থেকে শেয়ার বিক্রি বেগবান করার জন্য ইস্যুটি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর পর্যন্ত নেওয়া হলো। সেখান থেকে অনুমোদন পাওয়ার পরও শেয়ারগুলো বিক্রি হয়নি। দোষটা কার? আর সরকার যখন শেয়ার বিক্রির দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করল, তখন শেয়ারবাজারে ধস নামা শুরু হয়ে গেছে। আজকে আবার নতুন করে সরকারি শেয়ার আসছে, যখন শেয়ারের জন্য আগের আশঙ্কা অনেকটা কমে গেছে। তবু আসুক। কিন্তু তা কেন ৪০ শতাংশ বা ৪৯ শতাংশ? ৫১ শতাংশ শেয়ার ছাড়তে অসুবিধা কোথায়? শুধু মেজরিটি শেয়ার অফ-লোড করার ঘোষণা দিলেই সরকারি শেয়ারের দাম অনেক বেড়ে যেত। যা হোক, আমার বন্ধু অধ্যাপককে বললাম, সামনে অনেক শেয়ার আসবে বটে, কিন্তু ক্রেতা কই, নতুন অর্থ কই? তাহলে অবস্থাটা কেমন হতে পারে নিজেই বলুন। তিনিও বাণিজ্যশাস্ত্রের অধ্যাপক। ব্যবসায় প্রশাসন ও করপোরেটজগৎ নিয়ে পড়ান। তাঁকে বড় ধরনের জ্ঞান দেওয়ার ক্ষমতা আমারও নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি বিকল্প প্রশ্ন করলেন। একটা প্রশ্ন ছিল, সুদের হার বাড়লে কী হবে এবং জিডিপি যদি বাড়ে তাহলে এর প্রভাব শেয়ারমূল্যে পড়বে কি না? আমি বললাম, আমি মূল্য নিয়ে চিন্তিত নই; চিন্তিত এই অর্থনীতিতে করপোরেট গভর্নেন্স নিয়ে। কয়টা কম্পানি শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থে কাজ করছে? এসব কম্পানির মধ্যে অনেক কম্পানি আছে, যারা শুধু উদ্যোক্তাদের স্বার্থে কাজ করছে। বিদেশি কম্পানিগুলো বেআইনিভাবে অর্থ সরালেও এর সুফল পায় তাদের বিদেশি শেয়ারহোল্ডাররা, আর আমাদের দেশি কম্পানিগুলো অর্থ নয়ছয় করে শুধু উদ্যোক্তাদের স্বার্থে। আজকে যে ৬০টি কম্পানি ওটিসি মার্কেটে ঠাঁই করে নিয়েছে, ওরা শেয়ারবাজার থেকে অর্থ নিয়ে কী করেছে তার হিসাব কে নিয়েছে? আজও অনেক কম্পানি 'জেড' গ্রুপে। কেন এরা 'জেড'-এ আছে_এই প্রশ্ন কি রেগুলেটর এসইসি করছে?
আজও রাইট-বোনাস আর আইপিও বিক্রি করে যে অর্থ নেওয়া হচ্ছে, সে অর্থ কোথায় কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা দেখার কি কেউ আছে? ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে জামানত লাগে, আর শেয়ারবাজার থেকে ঋণ নিলে জামানত লাগে না, শুধু কিছু কাগজ তৈরি করে অডিটরের সাইন নিয়ে এসইসির অনুমোদন নিলেই হলো। আর এদের যদি শুধু শেয়ারের জন্য এত দরদ থাকত, তাহলে অনেক কম্পানির উদ্যোক্তাদের হাতে মাইনরিটি কম্পানির শেয়ার কেন? আইপিও ছাড়ার সময় তো এদের হাতে ৬০-৭০ শতাংশ শেয়ার ছিল, বাকি শেয়ার এখন গেল কোথায়? এসইসির কি ক্ষমতা আছে কম্পানিগুলো শেয়ারবাজার থেকে অর্থ নিয়ে সেই অর্থ কিভাবে ব্যবহার করার তা দেখার? এসইসি রুটিনমাফিক কাজ করতে অভ্যস্ত। তারা সিদ্ধান্ত দেয় কাগজ দেখে। কিন্তু ওই কাগজটি অতি সুন্দর করে তৈরি! আসল অবস্থাটা দেখার জন্য এসইসি কখনো চেষ্টা করেনি। এই যে এত রাইট শেয়ারের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, উদ্যোক্তারা তাদের অংশের শেয়ারের জন্য রাইটের অর্থটা কখন জমা দিচ্ছে, তা কি এসইসি খবর নেয়? এসইসির কাজ নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। এই সংস্থাকে সত্যিকার অর্থে পুনর্গঠন করা উচিত। তা না হলে বিনিয়োগকারীদের অর্থ শুধু লোপাটই হতে থাকবে। আমাদের অধ্যাপক সাহেব আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। ওঠার সময় শুধু বললেন, সবই ঠিক বলছেন।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.