এমন পুলিশ নয়, যেমন পুলিশ চাই by হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
বাংলাদেশের
পুলিশের বিরুদ্ধে, পুলিশ প্রহরায় চলাচলকারী কিংবা চাহিবামাত্র পুলিশের
সেবা পাওয়ার মতো ক্ষমতাধর অসাধারণ মানুষরা ছাড়া, সাধারণ মানুষের অভিযোগের
অন্ত নেই। পুলিশ বাহিনী স্বয়ং এবং সরকারের (সব সময়ের) কর্তাব্যক্তিরা ছাড়া
সবাই স্বীকার করবেন যে, যেসব অভিযোগ রটে, তা কিছু না কিছু বটে। পুলিশ একটি
বিশাল বাহিনী, বিপুল তার সদস্যসংখ্যা। সুতরাং অভিযোগ থাকবে এবং উঠবে - এটাই
স্বাভাবিক। সব অভিযোগ মেনে নিয়েও মাঝে মধ্যে ভাবি, পুলিশ যদি না থাকতো!
ভাবতেই আঁতকে উঠি। পুলিশ আছে, তাতেই এই, যদি না থাকতো তবে কী যে হতো! কী যে
হতো, আসলেও ভাবা যায় না। ভাই শত অভিযোগ সত্ত্বেও পুলিশ আমাদের চাই-ই।
প্রশ্ন হলো, কেমন পুলিশ? কেমন - সে প্রশ্নে পরে আসছি। আগে যেমন পুলিশ চাই
না, সেই প্রসঙ্গে একটু আসি। রাজধানীর শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির ঘটনাটি
এখনো মানুষের মনে দগদগে ঘা হয়ে আছে। পাঠক জানেন, খেলতে গিয়ে পানির পাইপে
পড়ে যায় জিয়াদ বা জিহাদ নামে সাড়ে তিন বছর বয়সি একটি শিশু। ঘটনা জানাজানি
হতেই ঘটনাস্থলে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র্যাব ও মিডিয়াকর্মীরা।
ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা নিজস্ব পদ্ধতিতে নানা রকম চেষ্টা চালাতে থাকে
শিশুটিকে উদ্ধারে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো শ্বাসরুদ্ধকর এই অভিযান সরাসরি
সম্প্রচার করতে থাকে। সারা দেশ এবং দেশের বাইরেও অসংখ্য মানুষ বিনিদ্র রজনী
যাপন করে সেদিন। সবাই সর্বান্তকরণে চাইছিল, শিশুটি উদ্ধার হোক । এই
রূদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির বাইরে পুলিশ সঙ্গোপনে মঞ্চস্থ করে চলছিল আরেক নাটক।
তারা পাইপে আটকে থাকা শিশুটির পিতা নাসির ফকিরকে ঘটনাস্থল থেকে চুপিসারে
ধরে নিয়ে যায় এবং শিশুটি উদ্ধার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সাড়ে ১২ ঘণ্টা থানায়
আটকে রাখে। এই দীর্ঘ সময় তাকে কিছু খেতেও দেয়া হয়নি। বরং ভয়ভীতি দেখিয়ে বার
বার জানতে চেয়েছে, ছেলেকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস, বল! পুলিশ যা করেছে,
তাকে সর্বাংশে অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। এ ধরনের ঘটনায় খোঁজখবর
নেয়ার জন্য ঘটনার শিকারদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলা যেতেই পারে। প্রশ্ন হলো,
এই কথা বলাটা কতটুকু অমানবিক বা অভদ্রজনোচিত হবে। আটক ব্যক্তিকে
তুই-তোকারি করা বা তাকে ১২ ঘণ্টা অভুক্ত রাখাকে কোনো মানদণ্ডেই কি যৌক্তিক
বলা যায়? শিশু জিয়াদের পিতার বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছে বলেই আমরা জানতে ও
কথা বলতে পারছি। জনশ্রুতি এ রকম যে, দু’চারটা ব্যতিক্রম ছাড়া শতভাগ
ক্ষেত্রে এরকম এবং এর চাইতেও হাজারগুণ খারাপ পরিস্থিতির শিকার হতে হয় থানায়
আটক ব্যক্তিকে। শুরুতে বলেছিলাম, যেমন পুলিশ চাই না। এখন ভয়ে ভয়ে বলছি,
উপরে যেমন পুলিশ দেখলাম, তেমন পুলিশ চাই না। কেমন পুলিশ চাই - সে প্রসঙ্গে
বরেণ্য লেখক মরহুম হুমায়ূন আহমেদের অভিজ্ঞতাটি একটু পাঠককে জানাতে চাই।
তাঁর পায়ের তলায় খড়ম বইয়ের কিছু অংশ এরকম : যাত্রার শুরুতেই বিপত্তি। পুলিশ
গাড়ি থামাল। হাসিমুখে জানতে চাইল, কত স্পিডে গাড়ি চলছে, তা কি জানো? শংকু
বলল, অফিসার, স্পিড মনে হয় বেশি হয়েছে। রেন্ট-এ-কার থেকে এই গাড়ি নিয়েছি।
এখনো অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। পুলিশ বলল, এটা স্বাভাবিক। তোমরা যাচ্ছ কোথায়?
গ্র্যান্ড কেনিয়ন দেখতে। আগে দেখোনি? আমি বেশ কয়েকবার দেখেছি, আমার বন্ধুরা
দেখেনি। তাদের নিয়ে যাচ্ছি। পুলিশের অন্তরঙ্গ কথাবার্তা শুনে আমার ধারণা
হলো, শংকু মনে হয় এ যাত্রা পার পেয়ে গেল। মোরশেদকে কানে-কানে তা-ই বললাম।
মোরশেদ বলল, অসম্ভব! তিনশ’ ডলার ফাইন করবে। পয়েন্ট কাটবে। সব করবে
হাসিমুখে। পুলিশের কাছ থেকে নিস্তার পেয়ে শঙকু জানাল, তাকে পাঁচশ’ ডলার
জরিমানা করেছে। দুই পয়েন্ট কেটেছে (আমেরিকায় ড্রাইভিং লাইসেন্সের সঙ্গে দশ
পয়েন্ট দেয়া হয়। সব পয়েন্ট কাটা গেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল।) পুলিশ চোখ
গরম করল না, চেহারায় ‘ভাব’ আনলো না, ভুরু কুঁচকালো না, ধমকাধমকি করল না,
বরং অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে কথা বলল, যেন প্রিয়জনের সুবিধা-অসুবিধার খবর নিচ্ছে।
সব করল হাসিমুখে, এমনকি পয়েন্ট কাটা ও জরিমানার কাজটিও। বাংলাদেশে এমনটি
ভাবা যায়? হুমায়ূন আহমেদ তার বইয়ের এ অধ্যায়টির নাম দিয়ে গেছেন ঈশ্বরের
দীর্ঘশ্বাস। ঈশ্বর কেন দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন তা তার বইটি পড়ে জানা যেতে
পারে। আমি অভাজন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি, এমন পুলিশই তো আমাদের চাই। খুব বড়
চাওয়া কি? হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী : সাংবাদিক humayunsc@yahoo.com পাদটিকা :
প্রিয় পাঠক, আমার কথাটি ফুরিয়েছে, কিন্তু নটে গাছটি মুড়ায়নি। সেটি দেখতে
হলো প্রথম আলোর ২৯ ডিসেম্বর সংখ্যার ৫ম পৃষ্ঠায় আইনে বলপ্রয়োগের ক্ষমতা চায়
পুলিশ শীর্ষক সংবাদটি দ্রষ্টব্য।
No comments