সনদ by জামাল উদ্দীন
ছেলের
চিঠি পেয়ে আর দেরি করেননি তিনি। তবে আমজাদ পিয়ন এমন চিঠি নিয়ে আসবেন,
সেটাও ভাবেননি। কাল ছিল হাটবার। বিকালে হাটে এসে চিঠি বিলি করা আমজাদের
রুটিন কাজ। মসজিদের ঘাটলায় ব্যাগ রেখে প্রথমে অজু, তারপর চার রাকাত আসরের
নামাজ আদায় করেন এ প্রবীণ ডাক পিয়ন। নামাজ শেষে ঘাটলায় বসে ব্যাগটা খোলেন।
কাগজের ফোল্ডারে আগেই চিঠিগুলো সাজিয়ে রাখেন। তাতে কোন গ্রামের কোন চিঠি তা
বের করা সহজ হয়।
কাল আমজাদের সঙ্গে ফজর আলীর দেখা হতেই বললেন - ভাই সাহেবের খবর আছে।
ফজর আলী বুঝলেন ছেলের চিঠি এসেছে। কিছুটা আনন্দের ঢেউ খেলে যায় তার চোখেমুখে। নিশ্চয়ই মুরাদের চাকরি হয়েছে।
এমন আশা নিয়ে যখন খামটি খুলে চিঠিতে চোখ বুলালেন, ফজর আলী কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। মনে মনে বললেন- সার্টিফিকেট? জীবনবাজি রেখেও বুঝি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠা যায় না? সামান্য কাগজের এত দাম?
তাহলে কি কাগজই সব? বাস্তবতার কোনো দাম নেই? ফজর আলীর মাথায় এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। তবু ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি দলিল মণ্ডলের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন।
দলিল মণ্ডল তার কমান্ডার। সহযোদ্ধা হলেও যুদ্ধের দিনগুলোতে দু’জনের মধ্যে আরও বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। থাকেন শহরে। ফজর আলীর বাড়ি থেকে জেলা শহরটির দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। তাই ভোরবেলায়ই রওনা দিলেন। অন্তত একটা বিহিত করা যেতে পারে এমন আশা তার মনে। সচরাচর ঘর গেরস্থালির কাজ রেখে দূরে কোথাও যান না তিনি। বাপের রেখে যাওয়া সামান্য ভিটেমাটিই তার সম্বল। অনেক কষ্টে ছেলেটাকে বিএ পাস করিয়েছেন। সংসারের অনটন দেখে কেউ কেউ বলেছিল গরিবের ছেলে, অত পড়িয়ে লাভ কী। তার চেয়ে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছু নিয়ে হলেও বিদেশে পাঠিয়ে দাও।
অভাবের সংসার, তবু আপস করতে রাজি নন ফজর আলী। ছোটবেলা থেকেই তার এ জিদ। মাত্র ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়লেও ফজর আলী বোঝেন জীবনে লেখাপড়ার গুরুত্ব কত। তাই একমাত্র ছেলেকে বিএ পাস করানোর ব্রত নিয়েছিলেন তিনি। ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর ছেলেও পড়তে চায়নি। বাবার টানাটানির সংসারে তার পড়ার খরচ চালিয়ে যাওয়া সহজ ছিল না। সে জন্য মুরাদ পড়াশোনা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। তাতে সায় দেননি তিনি। বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধা ফজর আলী জীবনযুদ্ধে হারতে চায় না।
সামান্য চাষের জমি বিক্রি করে মুরাদকে রাজধানী শহরে রেখে বিএ পাস করিয়েছেন তিনি। স্বপ্ন ছিল একদিন ছেলে বড় অফিসার হবে। মুক্তিযোদ্ধা বাবার গর্ব স্বাধীন বাংলাদেশে তার জন্ম সার্থক হবে।
ছেলে বিএ পাস করেছে ঠিকই, কিন্তুু ভালো চাকরি আর জুটছে না। এদিক-সেদিক চাকরির খোঁজও কম করেনি। ওদের মেসের অন্য ছেলেদেরও একই অবস্থা। মামা নেই তো চাকরি নেই- বলেই সেদিন জাহিদ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদন করার পরামর্শ দিল। মুরাদের বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন একথা ওর জানা।
মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা বিশেষ সুবিধা পেতেই পারে। সরকারি চাকরির এ সুযোগটা কাজে লাগাতে বাবার কাছে চিঠি লেখে মুরাদ। মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে যেন ফজর আলী ঢাকায় আসেন। চাকরির আবেদনের সঙ্গে তার ফটোকপি সংযুক্ত করে দিতে হবে।
গ্রামের কারও অজানা নয়, ফজর আলী একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তার তো কোনো সার্টিফিকেট নেই। সার্টিফিকেট লাগবে এ কথাও কোনোদিন ভাবেননি তিনি। দেশের জন্য লড়েছেন। যৌবনে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া, দেশকে হানাদারমুক্ত করা- এই তো ছিল উদ্দেশ্য। তার বিনিময়ে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। তারই যখন ব্যবস্থা হয়ে গেছে, স্বদেশে আর সার্টিফিকেটে কী লাভ?
একবার কথা হয়েছিল সার্টিফিকেটের। সুরুজ মেম্বার বলেছিল, অনেক আগের কথা, নামটি তালিকাভুক্ত কর। তাতে গা করেননি ফজর আলী। তখন খেদও ছিল।
দেশ স্বাধীনের বছর কয়েক পরের ঘটনা। হঠাৎ গ্রামে ফিরে এলো নওশাদ। লোকে রাজাকার বলে কানাঘুষা করলেও প্রাইমারি স্বুলের মাঠে একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সভা আহ্বান করল সে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা হাজির না হলেও মাঠের এক কোণ ভরে গেছে। গ্রামের অনেকেই এসেছে নওশাদকে দেখতে। কী বলে তা শুনতে। নওশাদ কোনো ভণিতা না করেই বলতে লাগল- ভাইসব, আমি ফিরে এসেছি আপনাদের খেদমত করার জন্য। মুক্তিযুদ্ধ করেছি এ দেশের জন্য। এবারে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে আপনাদের মাঝেই থাকতে চাই।
বক্তৃতার মাঝখানে কে একজন বলে উঠল, বাবা নাকি রাজাকারের খাতায় নাম লেখাইছিলেন।
নওশাদ বলে, নাউজুবিল্লাহ। ওরা জালেম। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা বলে। এই দেখুন, এই সার্টিফিকেট কি মিথ্যা? স্বাধীনতার সর্বাধিনায়কের সই আছে এখানে। তারপর থেকে এলাকায় নওশাদই বড় মুক্তিযোদ্ধা। এ দাবি প্রতিষ্ঠিত করে ইউনিয়নের চেয়ারম্যানও হয়ে গেল সে।
ফজর আলী তো হতবাক। কী কাণ্ড ঘটে গেল। অর্থবিত্তে নওশাদ এখন অনেক শক্তিশালী। চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে বিশেষ বাহিনীও গড়ে তুলেছে সে। তার বিরুদ্ধে কথা বলাও এখন ভয়ের ব্যাপার। তবু প্রতিবাদ না করে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না তিনি। একবার পাড়ার চায়ের দোকানে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, পাকিস্তানিদের হটাতে পারলেও বাংলাদেশকে রাজাকারমুক্ত করা যায়নি। রাজাকাররাই সমাজে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা সেজে বসে আছে। তাতেই হল। চেয়ারম্যানের এক পাণ্ডা পরদিন সকাল বেলা হাজির, ফজর আলী চাচা বাড়িতে আছেন?
- কেডায়, কী হইছে?
- হুনেন, চেয়ারম্যান সাব কইছে রাস্তাঘাটে কথাবার্তা হিসাব কইরা কওনের লাইগ্যা।
মুরাদের মা জয়নব বানু আড়ালে থেকে শুনেছেন, কিন্তু বুঝে উঠতে পারেননি। ওরা চলে যাওয়ার পর স্বামীকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেলেন। এ সময়ে ফজর আলীর মনের অবস্থা কিছুটা আঁচ করতে পারেন তিনি। ফজর আলীও কিছু বলেননি। বাড়ির দাওয়ায় বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। স্মৃতিতে তখন রাজাকার নওশাদের চেহারা ভাসছে।
সোনার চরে মুক্তিফৌজরা যখন প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন হন্যে হয়ে ছুটে এসেছিল নওশাদ। মাঝের পাড়ার আব্বাস মিয়ার বড় ছেলে। এসেই কমান্ডার দলিল মণ্ডলের পা জড়িয়ে ধরল। কেঁদে কেটে বলল, আমাকে বাঁচান। আমি আপনাদের সঙ্গে কাজ করতে চাই।
সুঠাম দেহের অধিকারী নওশাদকে বুকে টেনে নিলেন কমান্ডার। বললেন, জীবনটা বাজি রাখতে পারবে তো?
- পারব।
- না, তুই পারবি না। চলে যা এখান থেকে। চিৎকার করে উঠলেন ফজর আলী।
কমান্ডার বললেন, কেন ও চলে যাবে? ও আমাদের সঙ্গে...
- না, কমান্ডার। ওকে আপনি চেনেন না। ও আব্বাস মিয়ার পোলা। ওর বাপে শান্তি কমিটি করেছে গ্রামে।
হঠাৎ গাড়ির ব্রেক কষার মতো কমান্ডার যেন থমকে দাঁড়ালেন। রাজাকারের পোলা মুক্তি সংগ্রামে যেতে চায়! কয়েক পলক তিনি নওশাদের দিকে তাকালেন। চতুর নওশাদ আবারও দু’পা জড়িয়ে ধরে বলল, আমি ঘর ছেড়ে চলে এসেছি। দোহাই আপনার, এ মাটি ধরে শপথ করছি...।
কমান্ডারের মন গললেও ফজর আলী অনড় ছিলেন। বললেন, একে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। যেমন বিশ্বাস করা যায় না আগুনের কণা, বিশ্বাস করা যায় না সাপে ছা, চোরের পোলাকে, তেমনি রাজাকারের ছেলেকেও নয়।
ফজর আলীর জোরালো প্রতিবাদের মুখেও কমান্ডার নওশাদকে গ্রহণ করলেন। তারপর...
শুক্রবার রাত। পরদিন সকালে টেকনিক্যাল হাইস্কুলে হানাদার ক্যাম্পে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া হল। সবাই পরিকল্পনামাফিক প্রস্তুতি নিল। পাশের গ্রাম থেকেও মুক্তিফৌজরা এসে জমায়েত হল। কিন্তু ভোর হওয়ার আগেই সব ওলটপালট হয়ে গেল।
রাতেই, হঠাৎ করে পালিয়ে গেল নওশাদ। কেউ টের পায়নি।
নওশাদকে বলা হয়েছিল ১০ জনকে নিয়ে পেশকার বাড়িতে যেতে। সেখানে পালাক্রমে মুক্তিযোদ্ধা-জনতার একটি দল পাহারা দিচ্ছিল। যাতে পাক আর্মি এদিকে ঢুকতে না পারে। অনন্তপুর থেকে দীঘা যাওয়ার রাস্তার মাঝখান বরাবর মুক্তিযোদ্ধাদের এ অবস্থান। রাস্তাটা আগেই কেটে ফেলেছে স্থানীয় লোকজন। যাতে পাকসৈন্যরা এপারে আসতে না পারে। নৌকাযোগে এলেও গ্রামের ভেতরে ঢোকার পরিস্থিতি ছিল না। বড় খালের মুখেও পাহারা বসানো হয়েছে। যাতে সহজেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।
নওশাদ চলে গেল। কিন্তুু সে জানতে পারল না আরও ১০ জনকে নিয়ে ফজর আলী গেলেন পেছনের আরেকটা বাড়িতে। কমান্ডারসহ বাকি ১০ জন থাকলেন এ বাড়িটায়। এর উদ্দেশ্য ছিল পাকবাহিনী খবর পেলেও যাতে প্রতিরোধ কিংবা আত্মরক্ষা সম্ভব হয়।
রাতেই কমান্ডারের সঙ্গে কথা বলার অজুহাতে অন্যদের পেশকার বাড়িতে রেখে নওশাদ বেরিয়ে এলো। তারপর ঘণ্টা কয়েক ধরে তার কোনো খবর নেই। কোথায় গেল নওশাদ? দলের লোকজন চিন্তিত হয়ে পড়ল। কমান্ডারের সঙ্গে এতক্ষণ ধরে কী কথা? তবু ভাবল হয়তো কলাকৌশল নিয়ে আলোচনা চলছে।
সকালে নওশাদ নেই, কথাটা শোনার পর কমান্ডারের চক্ষু চড়কগাছ। সবার মনে সন্দেহ দানাবেঁধে উঠল। হানাদারদের ক্যাম্প আক্রমণের জন্য সবাই প্রস্তুত, এমন সময়ে ওই ঘটনা সবার মনের গতি যেন কিছুটা শ্লথ করে দিয়েছে। তবু পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক সবাই সামনে এগিয়ে গেলেন।
ক্যাম্পের দূরত্ব আরও এক মাইল। এখান থেকে দুই ভাগে মুক্তিযোদ্ধারা ভাগ হয়ে গেল। দলিল মণ্ডলের নেতৃত্বে বিকল্প রাস্তায় গেল একটি দল। তারা হানাদার ক্যাম্পের পুবদিকে অবস্থান নেবে। অন্য দলটিতে আছেন ফজর আলী। উত্তর দিক থেকে সোজা আক্রমণ চালাবে এ দলটি। ফজর আলীর দলটি আধামাইল যেতেই হঠাৎ গুলির শব্দ। পড়ে গেছে দু’জন। শুরু হয়ে গেল দু’পক্ষের সম্মুখ লড়াই। ট্রেনিং নিয়ে আসা মাত্র দু’দিনের মাথায় শহীদ হলেন রফিক ও জয়নাল। আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। এক পর্যায়ে পিছু হটে জানে বাঁচলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তারা দেখলেন লাশের মুখে থুথু দিচ্ছে একজন, সে গতকাল পর্যন্ত তাদের সঙ্গী নওশাদ।
সেই স্মৃতি মনে হলে আজও ফজর আলীর বুকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে। ইচ্ছা করে আবার অস্ত্র হাতে নিতে, নওশাদদের এ মাটি থেকে উৎখাত করতে। কিন্তু সময় বদলে গেছে। তা আর কখনও সম্ভব নয়, সেটাও বোঝেন ফজর আলী। তাই মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিতে আর লাইনে দাঁড়াননি।
ছেলের চিঠি পেয়ে তিনি নিরুপায় হয়ে গেলেন। জয়নব বানু বললেন, ছেলের চাকরির ব্যাপারটা তো জরুরি।
তিনি নিজেও বোঝেন, কিন্তু কার কাছে যাবেন, এ সময়ে কাকে গিয়ে ধরবেন। শেষে মনস্থির করলেন, দলিল মণ্ডলের কাছে যাবেন।
দলিল মণ্ডলের হাত ধরেই মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন ফজর আলী। একসঙ্গে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। আগরতলা থেকে দেশে ফিরে তার নেতৃত্বেই সোনার চরে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলা হয়।
ফজর আলী ভাবলেন দলিল মণ্ডলের সঙ্গে আলাপ করলে উপায় বের করা যাবে। বহুবছর পর তার সঙ্গে দেখা হবে। সর্বশেষ দেখা হয়েছিল বছর দুই আগে। হঠাৎ ফজর আলীর বাড়িতে এসেছিলেন।
- এ বাড়ির মুক্তিযোদ্ধা কেমন আছেন?
বলা নেই, কওয়া নেই। হঠাৎ যুদ্ধের সাথীকে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ফজর আলী। যুদ্ধের এত বছর পর কে তার খবর রাখে। তার বাড়িতে দলিল মণ্ডলের উপস্থিতি যেন বিরাট কিছু পাওয়া।
আবেগাপ্লুত ফজর আলীকে বুকে জড়িয়ে ধরে দলিল মণ্ডল সেদিন ঠিকই বুঝেছিলেন ফজর আলী খুব ভালো নেই। তাই বলে গেছেন যে কোনো দরকারে যেন তার কাছে যান।
তারপরও দলিল মণ্ডলের কাছে যাননি ফজর আলী। দরকার হয়নি। অভাব অনটনে কিছুটা আর্থিক সাহায্যের জন্য হাত বাড়ানো মুক্তিযোদ্ধার সাজে না। আজ স্ত্রীর অনুরোধে, ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই এলেন। বেশি কষ্ট হয়নি বাড়ি চিনতে। মুক্তিযোদ্ধা দলিল মণ্ডলকে চেনে না কে? রিকশাঅলাকে বলতেই মুক্তিভবনের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল। গেটে মুক্তিভবন এবং দলিল মণ্ডলের নাম খোদাই করা আছে। তবে যে কোনো সময় যে কারও প্রবেশে কোনো বাধা নেই, এমনই বোঝা যায়। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে নীরব, নিস্তব্ধ বাড়িটি। সামনের লনে সারি সারি ফুলের টব।
বাড়িতে কেউ কি নেই? এদিক সেদিক তাকিয়ে সামনে দু’পা বাড়াতেই আগরবাতির ঘ্রাণ নাকে এলো। ঘরের ভেতর থেকে দোয়া-দরূদের শব্দ কানে ভেসে আসছে। দেখলেন, একটি লোক চোখ মুছতে মুছতে ভেতর থেকে বের হয়ে এলেন। যেন ফুপিয়ে কান্না আসছে তার। জোর করে নিজেকে সামলে নিচ্ছেন।
ফজর আলীর ভেতরটাও মোচড় দিয়ে উঠল। এমন পরিবেশ তো স্বাভাবিক নয়। বাড়িতে কি কেউ মারা গেছে? ফজর আলী এগিয়ে গেলেন। আধাপাকা ঘর। ঘরের দরজায় দলিল মণ্ডলের বাঁধাই করা ছবি ঝুলছে। যৌবনদীপ্ত দলিল মণ্ডলের সেই চেহারা কি আর আছে? ঘরের ভেতরে চোখ পড়তেই যা দেখলেন, অবিশ্বাস্য মনে হল তার কাছে। তার কমান্ডারের নিথর দেহ পড়ে আছে মাটিতে।
এ দৃশ্য দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন ফজর আলী। - এ কী হল?
কে যেন বললেন, ভোর ৫টার দিকে হার্ট অ্যাটাকেই মারা গেছেন তিনি। হাসপাতালে নেয়ার সুযোগও হয়নি। প্রবাসী ছেলে দুটি সপ্তাহখানেক আগেই এসেছে। আজ এদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। ফজর আলীর পরিচয় পেয়ে ছেলে দুটি তাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। ওদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে ফজর আলী নিজেও খেই হারিয়ে ফেলেন। শুধু বললেন, তাড়াতাড়ি দাফনের ব্যবস্থা কর।
পাড়ার লোকজন আগেই ছুটে গেছে কবরের জায়গা ম্যানেজ করতে। ডিসি অফিসেও খবর দেয়া হয়েছে, সে জন্যই অপেক্ষা। এই ফাঁকে ফজর আলীও দোয়া-দরূদ পড়তে লাগলেন। তার কমান্ডারের আত্মার শান্তি চাইলেন আল্লাহর কাছে। কিছুক্ষণ পর পাড়ার ছেলে ইকবাল এসে জানাল ডিসি অফিসের কেউ আসতে রাজি হননি।
- কেন?
- ওরা সার্টিফিকেট চেয়েছে।
-কেন?
- মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তার প্রমাণ কী তা জানতে চেয়েছে?
রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করতে ডিসি অফিসের কর্মকর্তারা নিশ্চিত হতে চায় দলিল মণ্ডল আসলেই একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এ অবস্থায় কেউ কিছু না বলে মুহূর্ত কয়েক চুপ থাকেন। নীরবতা ভেঙে দলিল মণ্ডলের ছেলে আজমল বলল, বাবার তো সার্টিফিকেট নেই। কে না জানে, বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন?
- অনেক বুঝিয়ে বলার পরও কোনো কাজ হয়নি, পাড়ার ছেলেটা বলল।
ফজর আলী বললেন- আমি গিয়ে বলব আমরা একসঙ্গে যুদ্ধ করেছি।
- মুখের কথায় কোনো লাভ হবে না।
তবু ফজর আলী এক রকম জোর করেই পাড়ার কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। অনুনয় বিনয় করে যদি কর্মকর্তাদের মন গলানো যায়। তিনিও ব্যর্থ হলেন। সার্টিফিকেট না থাকলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা যায় না- এ কথাটিই শুধু বললেন কর্তকর্তা গোছের লোকটি। কোনোরকম অনুনয়ে কাজ হয়নি। হতাশ হয়ে রুমের বাইরে এসে কিছুক্ষণ হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে থাকলেন ফজর আলী। বললেন, তোমরা চলে যাও। লাশ দাফন করে ফেল।
তারপর ফজর আলী রওনা দিলেন বাড়ির উদ্দেশে। ছেলের চাকরি, দলিল মণ্ডলের লাশ কিংবা এক খণ্ড বাংলাদেশ- এসবের কোনোটাই তার কাছে এখন আর অপরিহার্য নয়।
কাল আমজাদের সঙ্গে ফজর আলীর দেখা হতেই বললেন - ভাই সাহেবের খবর আছে।
ফজর আলী বুঝলেন ছেলের চিঠি এসেছে। কিছুটা আনন্দের ঢেউ খেলে যায় তার চোখেমুখে। নিশ্চয়ই মুরাদের চাকরি হয়েছে।
এমন আশা নিয়ে যখন খামটি খুলে চিঠিতে চোখ বুলালেন, ফজর আলী কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। মনে মনে বললেন- সার্টিফিকেট? জীবনবাজি রেখেও বুঝি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠা যায় না? সামান্য কাগজের এত দাম?
তাহলে কি কাগজই সব? বাস্তবতার কোনো দাম নেই? ফজর আলীর মাথায় এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। তবু ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি দলিল মণ্ডলের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন।
দলিল মণ্ডল তার কমান্ডার। সহযোদ্ধা হলেও যুদ্ধের দিনগুলোতে দু’জনের মধ্যে আরও বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। থাকেন শহরে। ফজর আলীর বাড়ি থেকে জেলা শহরটির দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। তাই ভোরবেলায়ই রওনা দিলেন। অন্তত একটা বিহিত করা যেতে পারে এমন আশা তার মনে। সচরাচর ঘর গেরস্থালির কাজ রেখে দূরে কোথাও যান না তিনি। বাপের রেখে যাওয়া সামান্য ভিটেমাটিই তার সম্বল। অনেক কষ্টে ছেলেটাকে বিএ পাস করিয়েছেন। সংসারের অনটন দেখে কেউ কেউ বলেছিল গরিবের ছেলে, অত পড়িয়ে লাভ কী। তার চেয়ে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছু নিয়ে হলেও বিদেশে পাঠিয়ে দাও।
অভাবের সংসার, তবু আপস করতে রাজি নন ফজর আলী। ছোটবেলা থেকেই তার এ জিদ। মাত্র ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়লেও ফজর আলী বোঝেন জীবনে লেখাপড়ার গুরুত্ব কত। তাই একমাত্র ছেলেকে বিএ পাস করানোর ব্রত নিয়েছিলেন তিনি। ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর ছেলেও পড়তে চায়নি। বাবার টানাটানির সংসারে তার পড়ার খরচ চালিয়ে যাওয়া সহজ ছিল না। সে জন্য মুরাদ পড়াশোনা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। তাতে সায় দেননি তিনি। বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধা ফজর আলী জীবনযুদ্ধে হারতে চায় না।
সামান্য চাষের জমি বিক্রি করে মুরাদকে রাজধানী শহরে রেখে বিএ পাস করিয়েছেন তিনি। স্বপ্ন ছিল একদিন ছেলে বড় অফিসার হবে। মুক্তিযোদ্ধা বাবার গর্ব স্বাধীন বাংলাদেশে তার জন্ম সার্থক হবে।
ছেলে বিএ পাস করেছে ঠিকই, কিন্তুু ভালো চাকরি আর জুটছে না। এদিক-সেদিক চাকরির খোঁজও কম করেনি। ওদের মেসের অন্য ছেলেদেরও একই অবস্থা। মামা নেই তো চাকরি নেই- বলেই সেদিন জাহিদ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদন করার পরামর্শ দিল। মুরাদের বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন একথা ওর জানা।
মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা বিশেষ সুবিধা পেতেই পারে। সরকারি চাকরির এ সুযোগটা কাজে লাগাতে বাবার কাছে চিঠি লেখে মুরাদ। মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে যেন ফজর আলী ঢাকায় আসেন। চাকরির আবেদনের সঙ্গে তার ফটোকপি সংযুক্ত করে দিতে হবে।
গ্রামের কারও অজানা নয়, ফজর আলী একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তার তো কোনো সার্টিফিকেট নেই। সার্টিফিকেট লাগবে এ কথাও কোনোদিন ভাবেননি তিনি। দেশের জন্য লড়েছেন। যৌবনে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া, দেশকে হানাদারমুক্ত করা- এই তো ছিল উদ্দেশ্য। তার বিনিময়ে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। তারই যখন ব্যবস্থা হয়ে গেছে, স্বদেশে আর সার্টিফিকেটে কী লাভ?
একবার কথা হয়েছিল সার্টিফিকেটের। সুরুজ মেম্বার বলেছিল, অনেক আগের কথা, নামটি তালিকাভুক্ত কর। তাতে গা করেননি ফজর আলী। তখন খেদও ছিল।
দেশ স্বাধীনের বছর কয়েক পরের ঘটনা। হঠাৎ গ্রামে ফিরে এলো নওশাদ। লোকে রাজাকার বলে কানাঘুষা করলেও প্রাইমারি স্বুলের মাঠে একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সভা আহ্বান করল সে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা হাজির না হলেও মাঠের এক কোণ ভরে গেছে। গ্রামের অনেকেই এসেছে নওশাদকে দেখতে। কী বলে তা শুনতে। নওশাদ কোনো ভণিতা না করেই বলতে লাগল- ভাইসব, আমি ফিরে এসেছি আপনাদের খেদমত করার জন্য। মুক্তিযুদ্ধ করেছি এ দেশের জন্য। এবারে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে আপনাদের মাঝেই থাকতে চাই।
বক্তৃতার মাঝখানে কে একজন বলে উঠল, বাবা নাকি রাজাকারের খাতায় নাম লেখাইছিলেন।
নওশাদ বলে, নাউজুবিল্লাহ। ওরা জালেম। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা বলে। এই দেখুন, এই সার্টিফিকেট কি মিথ্যা? স্বাধীনতার সর্বাধিনায়কের সই আছে এখানে। তারপর থেকে এলাকায় নওশাদই বড় মুক্তিযোদ্ধা। এ দাবি প্রতিষ্ঠিত করে ইউনিয়নের চেয়ারম্যানও হয়ে গেল সে।
ফজর আলী তো হতবাক। কী কাণ্ড ঘটে গেল। অর্থবিত্তে নওশাদ এখন অনেক শক্তিশালী। চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে বিশেষ বাহিনীও গড়ে তুলেছে সে। তার বিরুদ্ধে কথা বলাও এখন ভয়ের ব্যাপার। তবু প্রতিবাদ না করে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না তিনি। একবার পাড়ার চায়ের দোকানে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, পাকিস্তানিদের হটাতে পারলেও বাংলাদেশকে রাজাকারমুক্ত করা যায়নি। রাজাকাররাই সমাজে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা সেজে বসে আছে। তাতেই হল। চেয়ারম্যানের এক পাণ্ডা পরদিন সকাল বেলা হাজির, ফজর আলী চাচা বাড়িতে আছেন?
- কেডায়, কী হইছে?
- হুনেন, চেয়ারম্যান সাব কইছে রাস্তাঘাটে কথাবার্তা হিসাব কইরা কওনের লাইগ্যা।
মুরাদের মা জয়নব বানু আড়ালে থেকে শুনেছেন, কিন্তু বুঝে উঠতে পারেননি। ওরা চলে যাওয়ার পর স্বামীকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেলেন। এ সময়ে ফজর আলীর মনের অবস্থা কিছুটা আঁচ করতে পারেন তিনি। ফজর আলীও কিছু বলেননি। বাড়ির দাওয়ায় বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। স্মৃতিতে তখন রাজাকার নওশাদের চেহারা ভাসছে।
সোনার চরে মুক্তিফৌজরা যখন প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন হন্যে হয়ে ছুটে এসেছিল নওশাদ। মাঝের পাড়ার আব্বাস মিয়ার বড় ছেলে। এসেই কমান্ডার দলিল মণ্ডলের পা জড়িয়ে ধরল। কেঁদে কেটে বলল, আমাকে বাঁচান। আমি আপনাদের সঙ্গে কাজ করতে চাই।
সুঠাম দেহের অধিকারী নওশাদকে বুকে টেনে নিলেন কমান্ডার। বললেন, জীবনটা বাজি রাখতে পারবে তো?
- পারব।
- না, তুই পারবি না। চলে যা এখান থেকে। চিৎকার করে উঠলেন ফজর আলী।
কমান্ডার বললেন, কেন ও চলে যাবে? ও আমাদের সঙ্গে...
- না, কমান্ডার। ওকে আপনি চেনেন না। ও আব্বাস মিয়ার পোলা। ওর বাপে শান্তি কমিটি করেছে গ্রামে।
হঠাৎ গাড়ির ব্রেক কষার মতো কমান্ডার যেন থমকে দাঁড়ালেন। রাজাকারের পোলা মুক্তি সংগ্রামে যেতে চায়! কয়েক পলক তিনি নওশাদের দিকে তাকালেন। চতুর নওশাদ আবারও দু’পা জড়িয়ে ধরে বলল, আমি ঘর ছেড়ে চলে এসেছি। দোহাই আপনার, এ মাটি ধরে শপথ করছি...।
কমান্ডারের মন গললেও ফজর আলী অনড় ছিলেন। বললেন, একে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। যেমন বিশ্বাস করা যায় না আগুনের কণা, বিশ্বাস করা যায় না সাপে ছা, চোরের পোলাকে, তেমনি রাজাকারের ছেলেকেও নয়।
ফজর আলীর জোরালো প্রতিবাদের মুখেও কমান্ডার নওশাদকে গ্রহণ করলেন। তারপর...
শুক্রবার রাত। পরদিন সকালে টেকনিক্যাল হাইস্কুলে হানাদার ক্যাম্পে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া হল। সবাই পরিকল্পনামাফিক প্রস্তুতি নিল। পাশের গ্রাম থেকেও মুক্তিফৌজরা এসে জমায়েত হল। কিন্তু ভোর হওয়ার আগেই সব ওলটপালট হয়ে গেল।
রাতেই, হঠাৎ করে পালিয়ে গেল নওশাদ। কেউ টের পায়নি।
নওশাদকে বলা হয়েছিল ১০ জনকে নিয়ে পেশকার বাড়িতে যেতে। সেখানে পালাক্রমে মুক্তিযোদ্ধা-জনতার একটি দল পাহারা দিচ্ছিল। যাতে পাক আর্মি এদিকে ঢুকতে না পারে। অনন্তপুর থেকে দীঘা যাওয়ার রাস্তার মাঝখান বরাবর মুক্তিযোদ্ধাদের এ অবস্থান। রাস্তাটা আগেই কেটে ফেলেছে স্থানীয় লোকজন। যাতে পাকসৈন্যরা এপারে আসতে না পারে। নৌকাযোগে এলেও গ্রামের ভেতরে ঢোকার পরিস্থিতি ছিল না। বড় খালের মুখেও পাহারা বসানো হয়েছে। যাতে সহজেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।
নওশাদ চলে গেল। কিন্তুু সে জানতে পারল না আরও ১০ জনকে নিয়ে ফজর আলী গেলেন পেছনের আরেকটা বাড়িতে। কমান্ডারসহ বাকি ১০ জন থাকলেন এ বাড়িটায়। এর উদ্দেশ্য ছিল পাকবাহিনী খবর পেলেও যাতে প্রতিরোধ কিংবা আত্মরক্ষা সম্ভব হয়।
রাতেই কমান্ডারের সঙ্গে কথা বলার অজুহাতে অন্যদের পেশকার বাড়িতে রেখে নওশাদ বেরিয়ে এলো। তারপর ঘণ্টা কয়েক ধরে তার কোনো খবর নেই। কোথায় গেল নওশাদ? দলের লোকজন চিন্তিত হয়ে পড়ল। কমান্ডারের সঙ্গে এতক্ষণ ধরে কী কথা? তবু ভাবল হয়তো কলাকৌশল নিয়ে আলোচনা চলছে।
সকালে নওশাদ নেই, কথাটা শোনার পর কমান্ডারের চক্ষু চড়কগাছ। সবার মনে সন্দেহ দানাবেঁধে উঠল। হানাদারদের ক্যাম্প আক্রমণের জন্য সবাই প্রস্তুত, এমন সময়ে ওই ঘটনা সবার মনের গতি যেন কিছুটা শ্লথ করে দিয়েছে। তবু পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক সবাই সামনে এগিয়ে গেলেন।
ক্যাম্পের দূরত্ব আরও এক মাইল। এখান থেকে দুই ভাগে মুক্তিযোদ্ধারা ভাগ হয়ে গেল। দলিল মণ্ডলের নেতৃত্বে বিকল্প রাস্তায় গেল একটি দল। তারা হানাদার ক্যাম্পের পুবদিকে অবস্থান নেবে। অন্য দলটিতে আছেন ফজর আলী। উত্তর দিক থেকে সোজা আক্রমণ চালাবে এ দলটি। ফজর আলীর দলটি আধামাইল যেতেই হঠাৎ গুলির শব্দ। পড়ে গেছে দু’জন। শুরু হয়ে গেল দু’পক্ষের সম্মুখ লড়াই। ট্রেনিং নিয়ে আসা মাত্র দু’দিনের মাথায় শহীদ হলেন রফিক ও জয়নাল। আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। এক পর্যায়ে পিছু হটে জানে বাঁচলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তারা দেখলেন লাশের মুখে থুথু দিচ্ছে একজন, সে গতকাল পর্যন্ত তাদের সঙ্গী নওশাদ।
সেই স্মৃতি মনে হলে আজও ফজর আলীর বুকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে। ইচ্ছা করে আবার অস্ত্র হাতে নিতে, নওশাদদের এ মাটি থেকে উৎখাত করতে। কিন্তু সময় বদলে গেছে। তা আর কখনও সম্ভব নয়, সেটাও বোঝেন ফজর আলী। তাই মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিতে আর লাইনে দাঁড়াননি।
ছেলের চিঠি পেয়ে তিনি নিরুপায় হয়ে গেলেন। জয়নব বানু বললেন, ছেলের চাকরির ব্যাপারটা তো জরুরি।
তিনি নিজেও বোঝেন, কিন্তু কার কাছে যাবেন, এ সময়ে কাকে গিয়ে ধরবেন। শেষে মনস্থির করলেন, দলিল মণ্ডলের কাছে যাবেন।
দলিল মণ্ডলের হাত ধরেই মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন ফজর আলী। একসঙ্গে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। আগরতলা থেকে দেশে ফিরে তার নেতৃত্বেই সোনার চরে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলা হয়।
ফজর আলী ভাবলেন দলিল মণ্ডলের সঙ্গে আলাপ করলে উপায় বের করা যাবে। বহুবছর পর তার সঙ্গে দেখা হবে। সর্বশেষ দেখা হয়েছিল বছর দুই আগে। হঠাৎ ফজর আলীর বাড়িতে এসেছিলেন।
- এ বাড়ির মুক্তিযোদ্ধা কেমন আছেন?
বলা নেই, কওয়া নেই। হঠাৎ যুদ্ধের সাথীকে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ফজর আলী। যুদ্ধের এত বছর পর কে তার খবর রাখে। তার বাড়িতে দলিল মণ্ডলের উপস্থিতি যেন বিরাট কিছু পাওয়া।
আবেগাপ্লুত ফজর আলীকে বুকে জড়িয়ে ধরে দলিল মণ্ডল সেদিন ঠিকই বুঝেছিলেন ফজর আলী খুব ভালো নেই। তাই বলে গেছেন যে কোনো দরকারে যেন তার কাছে যান।
তারপরও দলিল মণ্ডলের কাছে যাননি ফজর আলী। দরকার হয়নি। অভাব অনটনে কিছুটা আর্থিক সাহায্যের জন্য হাত বাড়ানো মুক্তিযোদ্ধার সাজে না। আজ স্ত্রীর অনুরোধে, ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই এলেন। বেশি কষ্ট হয়নি বাড়ি চিনতে। মুক্তিযোদ্ধা দলিল মণ্ডলকে চেনে না কে? রিকশাঅলাকে বলতেই মুক্তিভবনের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল। গেটে মুক্তিভবন এবং দলিল মণ্ডলের নাম খোদাই করা আছে। তবে যে কোনো সময় যে কারও প্রবেশে কোনো বাধা নেই, এমনই বোঝা যায়। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে নীরব, নিস্তব্ধ বাড়িটি। সামনের লনে সারি সারি ফুলের টব।
বাড়িতে কেউ কি নেই? এদিক সেদিক তাকিয়ে সামনে দু’পা বাড়াতেই আগরবাতির ঘ্রাণ নাকে এলো। ঘরের ভেতর থেকে দোয়া-দরূদের শব্দ কানে ভেসে আসছে। দেখলেন, একটি লোক চোখ মুছতে মুছতে ভেতর থেকে বের হয়ে এলেন। যেন ফুপিয়ে কান্না আসছে তার। জোর করে নিজেকে সামলে নিচ্ছেন।
ফজর আলীর ভেতরটাও মোচড় দিয়ে উঠল। এমন পরিবেশ তো স্বাভাবিক নয়। বাড়িতে কি কেউ মারা গেছে? ফজর আলী এগিয়ে গেলেন। আধাপাকা ঘর। ঘরের দরজায় দলিল মণ্ডলের বাঁধাই করা ছবি ঝুলছে। যৌবনদীপ্ত দলিল মণ্ডলের সেই চেহারা কি আর আছে? ঘরের ভেতরে চোখ পড়তেই যা দেখলেন, অবিশ্বাস্য মনে হল তার কাছে। তার কমান্ডারের নিথর দেহ পড়ে আছে মাটিতে।
এ দৃশ্য দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন ফজর আলী। - এ কী হল?
কে যেন বললেন, ভোর ৫টার দিকে হার্ট অ্যাটাকেই মারা গেছেন তিনি। হাসপাতালে নেয়ার সুযোগও হয়নি। প্রবাসী ছেলে দুটি সপ্তাহখানেক আগেই এসেছে। আজ এদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। ফজর আলীর পরিচয় পেয়ে ছেলে দুটি তাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। ওদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে ফজর আলী নিজেও খেই হারিয়ে ফেলেন। শুধু বললেন, তাড়াতাড়ি দাফনের ব্যবস্থা কর।
পাড়ার লোকজন আগেই ছুটে গেছে কবরের জায়গা ম্যানেজ করতে। ডিসি অফিসেও খবর দেয়া হয়েছে, সে জন্যই অপেক্ষা। এই ফাঁকে ফজর আলীও দোয়া-দরূদ পড়তে লাগলেন। তার কমান্ডারের আত্মার শান্তি চাইলেন আল্লাহর কাছে। কিছুক্ষণ পর পাড়ার ছেলে ইকবাল এসে জানাল ডিসি অফিসের কেউ আসতে রাজি হননি।
- কেন?
- ওরা সার্টিফিকেট চেয়েছে।
-কেন?
- মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তার প্রমাণ কী তা জানতে চেয়েছে?
রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করতে ডিসি অফিসের কর্মকর্তারা নিশ্চিত হতে চায় দলিল মণ্ডল আসলেই একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এ অবস্থায় কেউ কিছু না বলে মুহূর্ত কয়েক চুপ থাকেন। নীরবতা ভেঙে দলিল মণ্ডলের ছেলে আজমল বলল, বাবার তো সার্টিফিকেট নেই। কে না জানে, বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন?
- অনেক বুঝিয়ে বলার পরও কোনো কাজ হয়নি, পাড়ার ছেলেটা বলল।
ফজর আলী বললেন- আমি গিয়ে বলব আমরা একসঙ্গে যুদ্ধ করেছি।
- মুখের কথায় কোনো লাভ হবে না।
তবু ফজর আলী এক রকম জোর করেই পাড়ার কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। অনুনয় বিনয় করে যদি কর্মকর্তাদের মন গলানো যায়। তিনিও ব্যর্থ হলেন। সার্টিফিকেট না থাকলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা যায় না- এ কথাটিই শুধু বললেন কর্তকর্তা গোছের লোকটি। কোনোরকম অনুনয়ে কাজ হয়নি। হতাশ হয়ে রুমের বাইরে এসে কিছুক্ষণ হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে থাকলেন ফজর আলী। বললেন, তোমরা চলে যাও। লাশ দাফন করে ফেল।
তারপর ফজর আলী রওনা দিলেন বাড়ির উদ্দেশে। ছেলের চাকরি, দলিল মণ্ডলের লাশ কিংবা এক খণ্ড বাংলাদেশ- এসবের কোনোটাই তার কাছে এখন আর অপরিহার্য নয়।
No comments