সরস্বতী পূজা by তারাপদ আচার্য্য
আজ সরস্বতী পূজা। শীতের আমেজ চারদিকে। সকালের ঘন কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে পৃথিবী যেন ঝিমোচ্ছে। সূর্যদেবের মিষ্টি আলোর পরশ যেন জাগিয়ে দিচ্ছে বসুন্ধরা। এই পরিবেশের ভেতর মেতে উঠেছে ধরা আনন্দে। এ আনন্দ সরস্বতী পূজার।
সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সব পূজাই আনন্দ এবং উত্সবের মাঝে সেই পরম করুণাময়ের কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করা। শক্তির আরাধনা করা। জ্ঞানের আরাধনা করা। বিশ্ব ও জাতির মঙ্গল চাওয়া।
পুরাণে ও পুরাণোত্তর আধুনিককালে দেবী সরস্বতী বাক্য বা শব্দের অধিষ্ঠাত্রী বাগ্দেবীরূপে প্রসিদ্ধা। পরবর্তীকালে বৈদিক দেবী সরস্বতীর অন্য পরিচয় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় তিনি কেবল বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপেই সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বৈদিক সরস্বতী বাগাধিষ্ঠাত্রী বা বাগ্দেবীরূপেও বর্ণিতা হয়েছেন। ঋগ্বেদে সরস্বতীর সঙ্গে বিদ্যাধিষ্ঠাতৃত্বের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও অথর্ববেদে এবং ব্রাহ্মণে সরস্বতী বাগেদবী।
সরস্বতী যে পরমেষ্ঠী বা ব্রহ্মার পত্নী তার ইঙ্গিত আমরা পাই। কিন্তু বাগ্দেবী ও সরস্বতীর অভিন্নতা স্পষ্ট নয়। ব্রাহ্মণে স্পষ্টভাবেই সরস্বতীকে বাক্ বা বাক্যদেবী বলা হয়েছে।
রামায়ণে বাণী সরস্বতীও বাগ্দেবী।
প্রজাপতি বাকের সৃষ্টিকর্তা। তিনি বাকেক পার্থিব, অন্তরীক্ষস্থ এবং দ্যুলোকস্থ অর্থাত্ অগ্নি, বিদ্যুত্ ও সূর্যরূপে তিন ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। পরবর্তীকালে পৌরাণিক উপাখ্যানে সরস্বতী প্রজাপতি ব্রহ্মার কন্যা, কখনও পত্নী।
সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবী। বেদে সরস্বতী প্রধানত নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সরস শব্দের অর্থ জল। সরস্বতী=সরস (জল)+মতুন (অস্ত্যর্থে)+ঙীন (স্ত্রী)। অতএব সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী অর্থাত্ নদী।
সরস্বতী পূজা কবে কখন কে শুরু করেন তা সঠিক করে জানা যায় না। তবে পণ্ডিতরা অনেকেই মনে করেন, সরস্বতী প্রথমে ছিলেন নদী, পরে হলেন দেবী। রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন—
‘আর্য্যাবর্তে সরস্বতী নামে যে নদী আছে, তা-ই প্রথমে দেবী বলে পূজিত হয়েছিলেন; বর্তমানে গঙ্গাকে যেমন হিন্দুরা উপাস্যদেবী হিসেবে পূজা করে থাকেন। ক্রমান্বয়ে সরস্বতী হলেন জ্ঞানের দেবী।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ‘পুরস্কার’ কবিতায় সরস্বতীর বিবরণ দিয়েছেন—
বিমল মানস সরস বাসিনী
শুক্লবসনা শুভ্রহাসিনী
বীণাগঞ্জিত মঞ্জুভাষিণী
কমলকুঞ্জাসনা\
বিশিষ্ট কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘মেঘমল্লার’ গল্পে প্রদু্যুম্নের সম্মুখে আবির্ভূতা সরস্বতীর অপূর্ব বর্ণনা দিয়েছেন—
প্রদ্যুম্ন বিস্ময়ের দেখল—মাঠের মাঝখানে শতপূর্ণিমার জ্যোত্স্নার মতো অপরূপ আলোর মণ্ডলে কে এক জ্যোত্স্নাবরণী অনিন্দ্যসুন্দরী মহিমাময়ী তরুণী। তার নিবিড়কৃষ্ণ কেশরাশি অযত্ন বিন্যস্তভাবে তার অপূর্ব গ্রীবাদেশের পাশ দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তার আয়ত নয়নের দীর্ঘকৃষ্ণপক্ষ কোনো স্বর্গীয় শিল্পীর তুলি দিয়ে তার তুষারধবল বাহুবল্লী দিব্য পুষ্পাভরণে মণ্ডিত, তার ক্ষীণ কটি নীলবসনের মধ্যে অর্ধলুকায়িত মণিমেখলায় দীপ্তমান, তার রক্তকমলের মতো পা দুটিকে বুকে পেতে নেয়ার জন্য মাটিতে বাসন্তি পুষ্পের দল ফুটেছে।
... হ্যাঁ, এই তো বিদ্যা ও জ্ঞানের দেবী সরস্বতী।
জ্যোতিতে সূর্যাগ্নির তেজ, তাপ ও চৈতন্যরূপে জীব দেহে বিরাজ করায় চেতনা, জ্ঞানের প্রকৃত কর্ত্রী তো দেবী সরস্বতী। সরস্বতী দেবীর রূপান্তর হয়েছে পৃথিবীতে নদীরূপে এবং সরস্বতীই অগ্নি-ইন্দ্র-মরুত্ অশ্বিদ্বয়ের সংস্পর্শে শত্রুঘাতিনী, ধনদাত্রী এবং বৃহস্পতি-ব্রহ্মাণস্পতির বিদ্যাবত্তার সংযোগ নদী সরস্বতীর সঙ্গে অভিন্নরূপে সরস্বতীর তীরে উচ্চারিত বৈদিকমন্ত্রে সংশ্লিষ্ট হয়ে পুরাণে বিদ্যা ও জ্ঞান ভিন্ন অপর গুণগুলো অন্যত্র স্থাপন করে হলেন বিদ্যাধিষ্ঠাত্রী। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে গোলকে বিষ্ণুর তিন পত্নী—লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গঙ্গার মধ্যে বিবাদের ফলে গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতীর নদীরূপ পাওয়াই হচ্ছে সরস্বতীর পৃথিবীতে সরস্বতী নদী ও সরস্বতী দেবীরূপে প্রতিষ্ঠিতা হওয়ার তত্ত্ব।
বৃহস্পতি হচ্ছেন জ্ঞানের দেবতা, তিনি বাক্পতিও। ইন্দ্রও বাক্পতি। বৃহস্পতি-পত্নী সরস্বতীও জ্ঞানের দেবী। সব জ্ঞানের ভাণ্ডার তো ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর মহেশ্বর। তাদেরই শক্তিতে সরস্বতী জ্ঞানের দেবী। সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞের আগুন জ্বেলে সেখানেই ঋষি লাভ করেছিলেন বেদ, ঋগমন্ত্র। সুতরাং সরস্বতী জ্ঞানের দেবী হিসেবেই পরিচিত হয়েছিলেন। দিনে দিনে সরস্বতী তার অন্য বৈশিষ্ট্যগুলো ছাড়িয়ে কেবল বিদ্যাদেবী অর্থাত্ জ্ঞানের দেবীতে পরিণত হলেন।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ
No comments