শোভাময় জগৎ by আতাউর রহমান
আনিস চৌধুরীর ‘মানচিত্র’ স্বাধীনতা-পূর্বকালে বাংলাদেশে (তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে) সর্বাধিক জনপ্রিয় নাটক ছিল। তত্কালীন পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে এই নাটকটির প্রথম অভিনয় হয়। আনিস চৌধুরী তখন রেডিও পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। বাংলাদেশের এমন কোনো জেলা নেই যেখানে এই নাটকটি অভিনীত হয়নি। নাটকটি একটি বাস্তবধর্মী মধ্যবিত্ত জীবনের চালচিত্র। এক দরিদ্র স্কুল মাস্টারের জীবন সংগ্রামের কাহিনী এই নাটকে বিধৃত হয়েছে।
স্কুল মাস্টারের একটি সংলাপ উদ্ধৃত হলো। ‘জানি, কেন যেন এ বয়েসে আর আশ্রয় করে থাকতে মন চায় না। পাল তোলা নৌকোর মতো ভেসে যেতে ইচ্ছে করে, সেও এক আনন্দ।’ আমি মনে করি না যে, এই সংলাপ সংসার থেকে পালিয়ে গিয়ে ভারহীন হওয়ার পরামর্শ দেয়; বরং জগতকে দেখার প্রবল বাসনা মনে প্রজ্বলিত করে। আসলে এক জীবনে এই বিশ্বভুবনের প্রায় কিছুই আমাদের দেখা হয়ে ওঠে না। রবীন্দ্রনাথের একটি গান শুনতে শুনতে আমার এসব কথা মনে পড়ছিল। রবীন্দ্রসঙ্গীত মানুষকে বরাভয় করে তোলে। শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত কেন, সঙ্গীতে শুধু ঘুমপাড়ানিয়া মন্ত্র নেই, সঙ্গীত মানুষকে ভয়হীন করে, মৃত্যুভয় থেকে মুক্তি দেয়। সঙ্গীত মানুষকে জীবন সংগ্রামেও উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সঙ্গীত ছিল আমাদের অনুপ্রেরণার উত্স। অনেক অপূর্ব আবার ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য সামনে পড়লে মানুষের ভয়-ডর ঘুচে চায়। আমি ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য দেখেছি হিমালয় পর্বত পরিবৃত অঞ্চলে। নিচে তাকালে গভীর খাদ আর উপরে তাকালে আকাশচুম্বী গিরিশৃঙ্গ। সমুদ্রের বিশাল ঢেউয়ে সওয়ার হয়ে নৌকা বা জাহাজে চড়লেও আমাদেরকে ভয় পেয়ে বসে, নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয়, তবে এক্ষেত্রেও পরিশেষে বিরাটকে আবাহন জানাতে ইচ্ছে করে। রবীন্দ্রনাথের গানের চরণ, ‘তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি আমি ডুবতে রাজি আছি আমি ডুবতে রাজি আছি—ঝড়কে আমি করব মিতে, ডরব না তার ভ্রূকুটিতে—দাও ছেড়ে দাও, ওগো, তুফান পেলে বাঁচি।’ তুফান পেয়ে বাঁচার বিষয়টি অদ্ভুত মনে হয়, আবার প্রত্যয়হীনও মনে হয় না। সৌন্দর্যের রকমফের আছে, চাঁদের সৌন্দর্য পেলব এবং সুর্যের সৌন্দর্য প্রখর, ঝলসে দেয়। মানসিক অবস্থার তারতম্যে দুই সৌন্দর্যকেই অবলোকন করতে হয়। সৌন্দর্যের অনাস্বাদিত শোভা মানুষ অনেক সময় সহ্য করতে পারে না, আত্মহত্যা করে, এমন দৃষ্টান্ত আছে। মানুষের মাঝে যে একটি বিবাগী মন বাস করে তা রবীন্দ্রনাথের একাধিক গানে পাওয়া যায়। ‘তাসের দেশ’ নাটকের একটি গানে রাজপুত্র রাজসিংহাসন ছেড়ে অজানার হাতছানির কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে চায়। কারণ রাজপুত্রের গত্বাঁধা জীবন তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। সে তরী ভাসিয়ে বাণিজ্যেতে যেতে চায়। সে গান গেয়ে বলে—‘হেরো সাগর ওঠে তরঙ্গিয়া, বাতাস বহে বেগে। সূর্য যেথায় অস্তে নামে ঝিলিক মারে মেঘে। দক্ষিণে চাই, উত্তরে চাই—ফেনায় ফেনা, আর কিছু নাই—যদি কোথাও কূল নাহি পাই তল পাবো তো তবু—অকূল-মাঝে ভাসিয়ে তরী যাচ্ছি অজানায়।’ কূল না পেলে তল পাওয়ার বাসনা রাজপুত্র ব্যক্ত করে। মানুষের মধ্যে শুধু বিবাগী নয়, ছন্নছাড়াও একটি মন আছে যে মন নিয়ম মানতে চায় না। মানুষ লড়তে ভালোবাসে, তার মধ্যে একটি লড়াকু মন বাস করে। রবীন্দ্রনাথের ‘দুরন্ত আশা’ কবিতায় আছে—‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন, চরণ তলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন’। বাঙালির অতি নিরীহ জীবনকে উনি ধিক্কার দিয়ে আরও অনেক কথা এই কবিতায় বলেছেন। সঙ্গীত মানুষকে এক অতীন্দ্রিয় জগতে নিয়ে যায়। মানব জনম এক অনাস্বাদিত অর্থ পেয়ে যায়। আধুনিক বিজ্ঞান পরামর্শ দেয়, গান দিয়ে আজকাল বিভিন্ন রোগের চিকিত্সা করা সম্ভব, যাকে বলা হয় মিউজিক থেরাপি। মন দিয়ে গান শুনলে নাকি হার্টের রোগসহ দুরারোগ্য ক্যান্সারও প্রশমিত হয়। লালন ফকির সেই কবে স্বপ্ন দেখেছিলেন অসাম্প্রদায়িক বঙ্গভূমির যা তখন উচ্চশিক্ষিত ও বিজ্ঞ মানুষেরও ভাবনায় ছিল না। ধর্ম ও জাতের বিভাজন মানুষ বড় মনে করেছে এবং আজও বেশিরভাগ মানুষ এই বিভাজনকে গুরুত্ব দেয়। ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে। লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এ নজরে। ছুন্নত দিয়ে হয় মুসলমান, নারী লোকের কি হয় বিধান, বামন চিনি পৈতে প্রমাণ বামনী চিনি কীসে রে।’ পৃথিবীর রূপ লালন কীভাবে দেখেছেন তার একটি উদাহরণ দেয়া যাক—‘তিনশো ষাট রসের নদী, বেগে ধায় ব্রহ্মাণ্ড ভেদি, তার মাঝে রূপ নিরবধি, ঝলক দিচ্ছে এই মানুষে।’ মানুষের এই পার্থিব জীবন সঙ্গীতের ধারায় সিক্ত হয়ে অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। লালন আমাদের আরও অসাধারণ কথা, গানের কথা শোনাচ্ছেন—‘পাপ পুণ্যের কথা আমি কারে না শুধাই। এই দেশে যা পাপ গণ্য, অন্য দেশে পুণ্য তাই।’ লালন আরও শোনাচ্ছেন—‘এক ফুলে চার রঙ ধরেছে। ও সে ভাবনারে ফুলে কী আজব শোভা করেছে।’ একটি একটি ফুল যে বাগান তৈরি করে, মওলানা রুমি তা চমৎকার করে জানাচ্ছেন—একটি কীট আঙ্গুর পাতা খাচ্ছিল কারণ ওটা তার নেশা, হঠাত্ সে জেগে দেখে সে আর কীট নেই।পৃথিবীতে এত সব অপরূপ ভাবনা থাকতে আমরা কেন হিংসায় উন্মত্ত হই তা আজও বোঝা গেল না। মানব জাতি সেই বোধের অপেক্ষায় আছে।লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক
No comments