বিশেষ সাক্ষাৎকার : শাহরিয়ার কবির-বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া অনেক স্বচ্ছ

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে। এই বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বিচার-প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিস্ট নিয়োগের অভিযোগও রয়েছে। এই বিচার-প্রক্রিয়া ও সাম্প্রতিক রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে কালের কণ্ঠের মুখোমুখি হয়েছিলেন একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির।


সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলী হাবিব
কালের কণ্ঠ : দেশে আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আপনি এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। আমরা এই বিচারের একেবারে শুরুর দিকটি জানতে চাই।
শাহরিয়ার কবির : সবার আগে আমাদের বলতে হবে, একাত্তরে কী ঘটেছিল। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর কোথাও এর নজির নেই। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। সরকারি হিসেবে দুই লাখ, বেসরকারি হিসাবে সোয়া চার লাখ নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এক কোটি মানুষকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে এবং যাবতীয় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকার এ বিষয়ে তদন্তের জন্য জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছিল। আমি দেখেছি, তৎকালীন কেবিনেট সচিব এইচ টি ইমাম, তাঁর সই করা একটি চিঠি সব জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছিল কোন জেলায় কী ধরনের গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে তার তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের জন্য। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার দেশে ফিরেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেই বলেছিলেন, যারা গণহত্যা করেছে, তাদের ক্ষমা করা হবে না। এরপর বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকারে এ বিষয়টি বলেছেন এবং ২৪ জানুয়ারি একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হয় ঘাতক-দালালদের বিচারের জন্য। যেটাকে আমরা সাধারণভাবে দালাল আইন বলি। সেই দালাল আইনে ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল সারা দেশে গঠন করা হয়েছিল। ৩৭ হাজার লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু পরে ১৯৭৩ সালের মে মাসে বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। কারণ, অনেকের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধের সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছিল না। এসব যাচাই-বাছাই করে প্রেসনোটে বলা হয়েছিল, যাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ, হত্যা-ধর্ষণ, নির্যাতন, গৃহে অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি ১৮টি অপরাধের উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, এসব অপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে নেই, তাদের ক্ষমা করা হবে। এসব অপরাধে যারা অভিযুক্ত, তাদের বিচার করা হবে, ক্ষমা করা হবে না। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর ২৬ হাজারের মতো লোক ছাড়া পেয়েছিল। কিন্তু ১১ হাজার ব্যক্তি বিভিন্ন কারাগারে আটক ছিলেন। তাদের বিচার চলছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার আগে পর্যন্ত আমরা দেখেছি প্রায় ৭৩টি ট্রাইব্যুনালে দুই হাজারেরও বেশি যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা, ধর্ষণের অপরাধে বিচার হয়েছে। এদের মধ্যে ৭৫২ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে দেন। এর ফলে যাদের বিচার হচ্ছিল, যাদের শাস্তি হয়েছিল, তারা সবাই জেল থেকে বেরিয়ে আসে।
বঙ্গবন্ধু বাহাত্তরের সংবিধানে যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। বলেছিলেন, ধর্মের নামে কোনো দল করা যাবে না। একাত্তরের গণহত্যার এটাও একটা বৈশিষ্ট্য। এই গণহত্যা হয়েছিল ধর্মের নামে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের প্রধান সহযোগী জামায়াতে ইসলামী ধর্মের নামে হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন করেছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল। সে কারণেই বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়। জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসে সংবিধানের ওই ধারাটিও বাতিল করে দেন। তার ফলে যুদ্ধাপরাধীরা রাজনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে আবার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পেল। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি তারা রাজনীতিতে এমনই শক্তি অর্জন করেছে যে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে তারা ক্ষমতায় শরিক পর্যন্ত হয়েছে। ক্ষমতায় থাকাকালীন তারা শতাধিক জঙ্গি-মৌলবাদী সংগঠনের জন্ম দিয়েছে। এটাকে বলা যায় অপরাধ থেকে দায়মুক্তির সংস্কৃতি। কোনো অপরাধের যে বিচার হয় না, ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সেটা আমরা দেখেছি। এ ব্যাপারে একজন আমেরিকান গণহত্যা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বেন, গণহত্যা নিয়ে তাঁর বই আছে, সেই বইতে তিনি বাংলাদেশে গণহত্যার বিষয়টি বলতে গিয়ে বলছেন, 'একাত্তরে পাকিস্তানি জেনারেল এবং বাংলাদেশে যারা তাদের সহযোগী ছিল, যারা গণহত্যা করেছে, তাদের বিচার হয়নি। তাদের বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় কী হয়েছে? এই জেনারেলরা পাকিস্তানে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ- সবকিছু তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এরাই পরে আল-কায়েদার জন্ম দিয়েছেন।' বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তিনি বলেছেন, 'জামায়াতে ইসলামী ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে এবং বাংলাদেশে তারা জঙ্গি-মৌলবাদের জন্ম দিয়েছে। এই জঙ্গি-মৌলবাদ-আল কায়েদা বিশ্বব্যাপী ইসলামের নামে সন্ত্রাসের নতুন যে উত্থান- এর সঙ্গে তিনি যুক্ত করেছেন একাত্তরের গণহত্যার দায়মুক্তিকে। তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন, 'আল-কায়েদা এই যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেছে, তারা অনুপ্রাণিত হয়েছে বাংলাদেশের গণহত্যা থেকে।'
এটা থেকে মুক্ত হওয়া দরকার। এটা তো একাত্তরের পর থেকে শহীদ পরিবারের একটা দাবি। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে, গোলাম আযমকে গ্রেপ্তারের দাবিতে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করেছিলেন। আমরা এখন বলতে পারি, নাগরিক আন্দোলনের ইতিহাসে বাংলাদেশ কেন, কোথাও এর দ্বিতীয় নজির নেই। ১৯৯২ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৫ লাখের মতো মানুষ সমবেত হয়েছিল গণ-আদালতে, গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার প্রত্যক্ষ করতে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের দাবি। সেই দাবি একটি আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। আমরা আন্দোলন করেছি। বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন আন্দোলন করেছে। তরুণ প্রজন্ম আন্দোলন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর যাদের জন্ম, তাদের তো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। সেই প্রজন্ম নতুন করে জানতে পেরেছে একাত্তরে কী হয়েছিল। এই আন্দোলনের ভেতর দিয়ে তরুণ প্রজন্ম গণহত্যার কথা যেমন জানতে পেরেছে, তেমনি জানতে পেরেছে মুক্তিযুদ্ধে একাত্তরে বাঙালির বীরত্বের কথা। এর ফল পাওয়া গেছে ২০০৮ সালের নির্বাচনে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে মহাজোটের অঙ্গীকার ছিল। সেই অঙ্গীকার অনুযায়ী ২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী।
কালের কণ্ঠ : এই বিচারের প্রসঙ্গ যখনই উঠেছে, তখনই বলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করেছিলেন। এভাবে বিভ্রান্ত করার একটা চেষ্টা করা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। এ বিষয়ে যদি আলোকপাত করেন।
শাহরিয়ার কবির : ক্ষমার দুটি বিষয় আছে। একটি হচ্ছে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ক্ষমা। আরেকটি হচ্ছে দালাল আইনে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাদের ক্ষমা। দালাল আইনে গ্রেপ্তারকৃতদের ব্যাপারে পরিষ্কার বক্তব্য ছিল। সুনির্দিষ্ট ১৮টি অপরাধে অপরাধী এমন কেউ সাধারণ ক্ষমার আওতায় পড়বে না। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরই শহীদুল্লাহ কায়সারের হত্যাকারী খালেক মজুমদারদের বিচার হয়েছে। তাদের শাস্তি হয়েছে। সাধারণ ক্ষমা প্রযোজ্য ছিল শুধু তাদের ক্ষেত্রে, যারা বাধ্য হয়ে রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়েছে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করেছে, প্রাণের ভয়ে, হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতনে অংশ নেয়নি, তাদের ক্ষেত্রে। একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির ভিত্তিতে ১৯৫ জন পাকিস্তানিকে ফেরত দেওয়া হয়েছিল। কথা ছিল পাকিস্তান তাদের বিচার করবে। কিন্তু পাকিস্তানিরা তাদের বিচার করেনি। সেটা ছিল উপমহাদেশে শান্তির পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমাদের দেশের ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এর কোনো ভিত্তি নেই। আমাদের দায় হচ্ছে, আগে দেশের অপরাধীদের বিচার করা। এরই প্রথম ধাপে এখন আটজনের বিচার হচ্ছে। ধাপে ধাপে আরো অপরাধীর বিচার হবে। স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে পাকিস্তানেও জনমত সংগঠিত হচ্ছে। সেখানেও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শাখা গঠন করা হয়েছে। সাধারণ ক্ষমার যে বিষয়টি ঘাতকদের সহযোগীরা বলতে চাইছে, সেটা একেবারেই মিথ্যে এবং ভিত্তিহীন। তারা সত্যের অপলাপ করছে। সত্যকে বিকৃত করছে।
কালের কণ্ঠ : গোলাম আযমও তো বলেছেন, বঙ্গবন্ধু তাঁকে ক্ষমা করে গেছেন।
শাহরিয়ার কবির : এটা বলা হচ্ছে জাতিকে বিভ্রান্ত করার জন্য। দেশে ও বিদেশে সবাইকে বিভ্রান্ত করার জন্য এটা বলা হচ্ছে। কিছুদিন আগে সৌদি গেজেটেও এক সৌদি কূটনীতিক এ বিষয়ে লিখেছেন। আমরা এর জবাবে বলেছি, এগুলো সবই মিথ্যাচার। গোলাম আযমকে তো ক্ষমা করার প্রশ্নই ওঠে না। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের অপরাধে ৩৯ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে গোলাম আযম একজন। তাঁকে ক্ষমা করার প্রশ্নই ওঠে না। এ ক্ষমা তাঁদের জন্যই প্রযোজ্য ছিল, যাঁরা দালাল আইনে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তখন ছিল না। গোলাম আযম যেটা বলছেন, জামায়াত ও তাদের সহযোগীরা যেটা বলছে, সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার।
কালের কণ্ঠ : বিচারের স্বচ্ছতা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন। অভিযোগ উঠেছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিস্ট নিয়োগ করা হচ্ছে। প্রচুর টাকা ছড়ানো হচ্ছে।
শাহরিয়ার কবির : স্বচ্ছতার বিষয়ে আমি বলবো, অতীতে বিশ্বে যুদ্ধাপরাধের যতগুলো বিচার হয়েছে, তার চেয়ে বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়া অনেক স্বচ্ছ। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও এ কথা বলেছি। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একটি শুনানিতে আমরা বলেছি, আমরা যে আইনটা করেছি এটা আমাদের নিজস্ব আইন। আমাদের ট্রাইব্যুনাল ডোমেস্টিক ট্রাইব্যুনাল। আমরা যে অপরাধের বিচার করছি, সেই অপরাধগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ। আমাদের আইনে আমরা আমাদের অপরাধীদের বিচার করছি। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। পৃথিবীর কোথায় কোন দেশে কিভাবে বিচার হয়, সেটা নিয়ে কী আমরা কখনো সরকারিভাবে মন্তব্য করি? আমাদের আইনে অভিযুক্তকে আপিলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এটা কোথাও ছিল না। অভিযুক্তদের ব্যাপারে ট্রাইবুন্যাল অনেক নমনীয়। জামায়াতিরা এই সুযোগটি নিচ্ছে। তারা বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিতে চাইছে। বিচারকে বিলম্বিত ও প্রহসনে পরিণত করার সুযোগ নিতে চাইছেন অভিযুক্তদের আইনজীবীরা। আমাদের এখানে যেভাবে বিচার হচ্ছে, তাতে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই। অভিযুক্তরাও জানেন, তাঁরা কী সুযোগ পাচ্ছেন।
কালের কণ্ঠ : এই আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনীতি করার একটা প্রবণতাও বোধ হয় দেখা যাচ্ছে। এটাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
শাহরিয়ার কবির : জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি সবাইকে বুঝতে হবে। ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ছিল। তারা সরাসরি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। বাংলাদেশকে তারা কখনো গ্রহণ করেনি। এই ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ কখনো তাদের কাম্য নয়। গোলাম আযম ১৯৭২ সাল থেকে এ দেশে আসার আগে পর্যন্ত বিদেশে যখন ছিলেন, তখনো তিনি পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি নামে আন্দোলন করার চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন জায়গায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার তদবির করেছেন। জামায়াতের মিশন হচ্ছে, পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত না করা গেলেও এ দেশটিকে একটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তরিত করা। জামায়াতের প্রধান মিত্র হচ্ছে এখন বিএনপি। বিএনপি জানে এই বিচার যদি আমরা ঠিকমতো করতে পারি, তাহলে জামায়াতের নেতারা কেউ এই দায় থেকে মুক্তি পাবেন না। বিচারে তাঁদের শাস্তি হবে এবং জামায়াতের রাজনীতি বাংলাদেশে শেষ হয়ে যাবে। বিএনপি এখন পুরো দাঁড়িয়ে আছে জামায়াতের ওপর। ফলে জামায়াতকে রক্ষা করার দায় বিএনপির ওপর এসে পড়েছে। সেই কারণেই যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করার দায় এখন বিএনপি ঘাড় পেতে নিয়েছে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এটা বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা অনুমোদন করছেন না, আমরা বাইরে গেলেই তা বুঝতে পারি। যেকোনো কারণেই হোক বিএনপি মনে করে জামায়াতকে সঙ্গে নিলে তাদের ক্ষমতায় যাওয়া সহজ হবে। কিন্তু জামায়াতকে তুষ্ট করতে গিয়ে বিএনপি কিভাবে জনবিচ্ছিন্ন হচ্ছে, সেটা দলের হাইকমান্ড উপলব্ধি করছে না।
কালের কণ্ঠ : জামায়াতের সঙ্গে জঙ্গিবাদের সম্পৃক্ততা আছে বলে মনে করেন?
শাহরিয়ার কবির : আমি নিজে তো এর ভুক্তভোগী। ২০০২ সালে ময়মনসিংহের তিনটি সিনেমা হলে হরকাতুল জিহাদ বোমা ফাটাল, মানুষ হত্যা করল। সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পক্ষ থেকে বলে দেওয়া হলো, এ কাজটি করেছে আওয়ামী লীগ ও ভারত। ঢাকা ও ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে মুনতাসীর মামুন ও আমাকে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। বিএনপি-জামায়ত ক্ষমতায় থাকার সময় জঙ্গি-মৌলবাদকে রক্ষার জন্য এমন অনেক কাজ করেছে। জঙ্গিদের তৈরি করেছে তারা। পাকিস্তানের মডেলে বাংলাদেশকে তারা পাকিস্তান বানাতে চেয়েছে। তার পরিণতি তারা ভোগ করেছে। এটা দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর। আমার আশঙ্কা বিএনপির এই জামায়াতনির্ভরতার কারণে দলটি মুসলিম লীগের মতো একেবারেই শেষ হয়ে যাবে। সেটা কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত।
কালের কণ্ঠ : বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক ধারাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শাহরিয়ার কবির : এটা সম্পূর্ণ একটি দেউলিয়া সংগঠনে পরিণত হয়েছে। জামায়াত-বিএনপি যখন এক হয়ে যায়, জামায়াতের সব দায় যখন বিএনপি ঘাড়ে তুলে নেয়, বাংলাদেশের অস্তিত্ববিনাশী রাজনীতি যখন তারা অনুমোদন করে, নিজেরা সেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন সেটাকে আমি গণতন্ত্রের জন্য, দেশ-জাতি-সমাজের জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করি।
কালের কণ্ঠ : সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে যদি কিছু বলেন।
শাহরিয়ার কবির : সরকার ট্রাইব্যুনাল করেছে, এ বছর তো দুটো ট্রাইব্যুনাল হলো। কিন্তু প্রথম থেকেই বলে আসছি ট্রাইব্যুনগুলোয় প্রয়োজনীয় লোকবল দেওয়া হয়নি। আইনজীবীরা সবাই সার্বক্ষণিক নন। আরো দক্ষ আইনজীবী দরকার। এই ট্রাইব্যুনালের একটা গবেষণা সেল নেই, আর্কাইভ নেই। অন্যান্য রসদের প্রচুর অভাব রয়েছে। সীমাবদ্ধতা আছে। জামায়াতের প্রস্তুতির তুলনায় আমাদের প্রস্তুতি খুবই অপ্রতুল। বিদেশে জামায়াত যে বহুমাত্রিক তৎপরতা চালাচ্ছে, শত শত কোটি টাকা খরচ করে তারা বিদেশি আইনজীবী ও সংগঠন ভাড়া করেছে। বাংলাদেশ সরকার এটা কূটনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে পারছে না। একটা দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। জামায়াতের অপতৎপরতা রাজনৈতিকভাবে ও কূটনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। রসদেও অভাব দূর করতে হবে। সাক্ষীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। সাক্ষীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে হবে। আরেকটি দুর্বলতার বিষয় উল্লেখ করতে চাই। যুদ্ধাপরাধের দায়ে কয়েক ব্যক্তির বিচার হচ্ছে। কোনো সংগঠনের বিচার হচ্ছে না। এতে একটা বিষয় কিন্তু থেকে যাচ্চে যে রাজনীতি মানুষকে যুদ্ধাপরাধে, মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রবৃত্ত করে, সেই রাজনীতি যদি বহাল থাকে তাহলে এ ধরনের অপরাধ ঘটবে। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযোগীরা ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। এখন জামায়াতে ইসলামীকে যদি কাঠগড়ায় দাঁড় না করানো হয় তাহলে কিন্তু শহীদ পরিবারগুলোকে বিচার থেকে বঞ্চিত করা হবে। জামায়াত, রাজাকার, আলবদর- সবারই বিচার হতে হবে। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে ছয়টি সংগঠনের বিচার হয়েছিল। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনেরও বিচার করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেছে। এই সরকারকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শাহরিয়ার কবির : সরকারের যতটুকু কাজ গত তিন-সাড়ে তিন বছরে আমরা দেখছি, তাতে হয়তো হতাশার কিছু আছে। কিছু কাজে ক্ষোভ থাকতে পারে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিগত সরকারের সঙ্গে তুলনা করলে তাহলে সরকারের অগ্রগতির দিকটিই চোখে পড়ে। এটা ইতিবাচক বলেই আমি মনে করি। কৃষি উৎপাদন, শিক্ষা, অর্থনীতি- অনেক ক্ষেত্রে সরকারের যে সাফল্য, তা চোখে পড়ার মতো। অন্তত বিগত সরকারের তুলনায় অনেক ইতিবাচক। বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, দেশকে আমরা কোন লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে যে চেতনার সৃষ্টি হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযোগীরা যে সংবিধানটি প্রণয়ন করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আমরা যা বুঝি, সেই লক্ষ্য থেকে যদি আমরা বিচ্যুত হই, তাহলে ভিশন ২০২১ বলে যা বলা হচ্ছে, সেই লক্ষ্যে আমরা পেঁৗছতে পারব না। আমাদের লক্ষ্যটা আগে নির্ধারণ করতে হবে। দোদুল্যমানতার মানসিকতা সরকারকে ছাড়তে হবে। সরকারকে লক্ষ্য স্থির করতে হবে। আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানের মূল চেতনার জায়গাটি ধরে এগোতে হবে। একটা ভিশন তৈরি করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : এখন প্রায়ই নতুন করে ওয়ান-ইলেভেনের কথা শোনা যাচ্ছে। বর্তমান বাস্তবতায় এর বিশ্লেষণ করুন?
শাহরিয়ার কবির : ওয়ান-ইলেভেন আসলে কী? এটা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক ধরনের সামরিক শাসন। সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে সেই সিভিল সরকার অনিয়মতান্ত্রিকভাবে দুবছর ক্ষমতায় ছিল। এখন সে রকম একটা উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে? যারা রাজনীতিকে সামরিকায়ন করেছে, তারা। এটা তো বিএনপির দর্শন। জিয়াউর রহমানের দর্শন। এটা জামায়াতের দর্শন। এটা পাকিস্তানের দর্শন। যখনই পাকিস্তানে সামরিক শাসন এসেছে, সবার আগে জামায়াতে ইসলামী গিয়ে তাদের সমর্থন করেছে। জামায়াত সবসময় সামরিক শাসনের পক্ষে। বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিকে সামরিকায়ন করেছে। সেই ষড়যন্ত্র থেকে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। জনগণকে সজাগ করতে হবে। এ জন্য গণতন্ত্রের পথে যতো বাধা সব দূর করতে হবে। এখানে আমাদের সমঝোতা করার কোনো সুযোগ নেই।
কালের কণ্ঠ : আজকের বাংলাদেশের রাজনীতিকে আপনি আগামীতে কতটা ইতিবাচকভাবে দেখছেন?
শাহরিয়ার কবির : আমি মনে করি, আমাদের রাজনীতিবিদরা, তিনি সরকারেই থাকুন আর বিরোধী দলেই থাকুন, তাঁদেরকে প্রথমে দেশের কথা, সমাজের কথা ভাবতে হবে। দেশ বাঁচলে তবে তো আমি বাঁচব। নিজেদের সন্তানের কথাও তো ভাবতে হবে। এ দেশটা আমাদের। এ দেশটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই- রাজনীতিবিদদের মধ্যে এই বোধের বিকাশ ঘটাতে হবে। দেশের মানুষ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাবোধের উদ্রেক হতে হবে। তবে বাংলাদেশের ইতিহাস বলছে, আজকের যে অবক্ষয়, সেটা আমাদের সাময়িক বিপর্যয়। আমরা সব সময় সামনের দিকে এগিয়ে গেছি। তরুণ প্রজন্মের ওপর আমার বিশ্বাস আছে। সৃজনশীলতার দিক থেকে, যোগ্যতার দিক থেকে আমাদের দেশের তরুণরা পৃথিবীর কোনো দেশের চেয়ে কম মেধাসম্পন্ন নয়। দেশে একটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও আবহ থাকলে একটা দেশ সার্বিকভাবে সামনের দিকে এগোতে পারে। বাঙালি একসঙ্গে রুখে দাঁড়াতে পারে। এটাই আমাদের শক্তি।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শাহরিয়ার কবির: আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.