মিডিয়া ভাবনা-টিভিতে বিশেষজ্ঞদের প্রশ্নোত্তর অনুষ্ঠান by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
সময় টিভি চ্যানেলকে অভিনন্দন। তারা প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে নিয়ে একটি চমৎকার অনুষ্ঠান প্রচার করছে। অনুষ্ঠানটির নাম ‘সরাসরি: মুহম্মদ জাফর ইকবাল’। প্রতি শুক্রবার সকাল ১০টায় প্রচারিত এই অনুষ্ঠানে ড. ইকবাল ছাত্রছাত্রীদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন। প্রতিটি অনুষ্ঠান পূর্বঘোষিত একটি বিষয়কেন্দ্রিক হয়ে থাকে, যদিও ছাত্রদের প্রশ্ন সব সময় একটি বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকে না। একটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ রাখা গেলে ভালো হতো।
ছাত্রছাত্রীরা ফোনে, ই-মেইলে, এসএমএসে ও চিঠিতে ড. ইকবালকে নানা প্রশ্ন করেন। ড. ইকবাল খুব আন্তরিকভাবে ও মোটামুটি সংক্ষেপে প্রশ্নগুলোর জবাব দেন।
আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলগুলোর শিক্ষামূলক ও অর্থপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্যে এটিকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠান বলা যায়। টিভি চ্যানেলের বেশির ভাগ অনুষ্ঠানই নিছক বিনোদনমূলক। সস্তা ও লঘু বিনোদন অনুষ্ঠানের সংখ্যাই বেশি। দর্শকেরা বিনোদন অনুষ্ঠানই বেশি চায়। স্পন্সররাও বিনোদন অনুষ্ঠানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখায়। কাজেই চ্যানেল কর্তৃপক্ষ আর কী করতে পারে। স্রোতের সঙ্গে চলাটাই তারা মেনে নিয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশ একটি গরিব ও উন্নয়নশীল দেশ। দেশের ৩১ ভাগ লোক এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। ৪০ ভাগ লোক শিক্ষাবঞ্চিত। টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ ও স্পন্সরদের এই বাস্তবতা মনে রাখা দরকার। বিনোদন ও তথ্যমূলক অনুষ্ঠানের (খবর, টক শো) পাশাপাশি সুচিন্তিত শিক্ষামূলক ও উন্নয়ন অনুষ্ঠানের জন্যও টিভি চ্যানেলে সময় দিতে হবে। আমি খুব সচেতনভাবে ‘সুচিন্তিত’ শব্দটি ব্যবহার করেছি। কারণ, যেনতেন একটি অনুষ্ঠান করলেই কাজ হবে না। তা হতে হবে সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত। শিক্ষাবিষয়ক সুপরিকল্পিত অনুষ্ঠান করার কথা সরকারি বিটিভি ও প্রাইভেট টিভি চ্যানেল কেউ তেমন ভাবছে না। মনে হয় স্পন্সররাও এ ব্যাপারে অনাগ্রহী। অন্তত কয়েকটি টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ আমাকে সে রকম ধারণাই দিয়েছে। এই তথ্য যদি সত্য হয়, তাহলে আমাদের দেশের বাণিজ্যিক স্পন্সরদের খুব দায়িত্বশীল ও দেশপ্রেমিক বলা যাবে না। তারা শুধু তাদের পণ্যের প্রচারেই আগ্রহী। বড় বাজেটের স্পন্সরদের বার্ষিক বাজেটের অন্তত ২৫ শতাংশ শিশুতোষ অনুষ্ঠান, শিক্ষাবিষয়ক অনুষ্ঠান ও উন্নয়ন অনুষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ করার জন্য আমি প্রস্তাব করছি। বিজ্ঞাপন বাজেটের ৭৫ শতাংশ টাকা কি বিনোদন অনুষ্ঠানের জন্য যথেষ্ট নয়? স্পন্সরদের ভেবে দেখতে অনুরোধ করি।
সময় টিভির ‘সরাসরি: মুহম্মদ জাফর ইকবাল’ অনুষ্ঠানটি একটি মডেল অনুষ্ঠান হতে পারে। ড. ইকবাল প্রধানত বিজ্ঞান ও লেখালেখি নিয়ে নানা প্রশ্নের জবাব দিয়ে থাকেন। আমাদের দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের শিক্ষক খুবই কম। আমি আবার লিখছি—খুবই কম। তাঁদের সান্নিধ্যে আসার বা তাঁদের সরাসরি ছাত্র হওয়ার সুযোগ খুব কম ছাত্রছাত্রীরই হয়ে থাকে। অনেকে ইতিমধ্যে অবসরও নিয়েছেন। কিন্তু জ্ঞানচর্চায় তাঁরা এখনো সজীব ও সক্রিয়। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এ ধরনের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের নিয়ে বিষয়ভিত্তিক সরাসরি সম্প্রচারিত টিভি অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করতে পারে, যেগুলোর দর্শক হবে অবশ্যই ছাত্রছাত্রীরা। সংখ্যায় কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা কম নয়। এবং তারাই দেশের ভবিষ্যৎ। বিষয় আগাম প্রচার করলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আগেভাগে প্রশ্ন পাওয়া কঠিন হবে না। তা ছাড়া সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানে ফোন তো থাকবেই। যেসব বিষয় নিয়ে এ ধরনের ‘প্রশ্ন ও উত্তর’ অনুষ্ঠান হতে পারে, তা হলো: বাংলা ভাষা, ইংরেজি ভাষা, অঙ্ক, বিজ্ঞানের নানা বিষয়, বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১, অর্থনীতি ও আরও অনেক। একেকটা বিষয়ে ১০-১৫টি অনুষ্ঠানও হতে পারে। আলোচ্য বিষয়ে যার মনে যত প্রশ্ন আছে, সবই এই অনুষ্ঠানে করা সম্ভব। তথ্য বা পরিসংখ্যান স্মৃতি থেকে বলা সম্ভব না হলে বিশেষজ্ঞ আলোচক তাঁর উত্তর পরের অনুষ্ঠানেও দিতে পারেন। কোনো উত্তরের সঙ্গে কেউ একমত না হলে তার ভিন্নমতও পরের অনুষ্ঠানে প্রচার করা যায়। এ ধরনের অনুষ্ঠান অন্তত এক ঘণ্টা স্থায়ী হওয়া উচিত, যেন বিশেষজ্ঞ শিক্ষক বিস্তারিতভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন।
আমার ধারণা, এ ধরনের অনুষ্ঠান জনপ্রিয় হতে পারে। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী নানা প্রশ্ন মাথায় নিয়ে ঘুরছে। তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো ব্যক্তি তারা হাতের কাছে পায় না। টিভি এর একটি ভালো মাধ্যম হতে পারে। ঢাকার টিভি স্টুডিওতে বসে একজন বিশেষজ্ঞ শিক্ষক টেকনাফ, তেঁতুলিয়া, নিঝুমদ্বীপ ও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের একই বৈঠকে উত্তর দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারবেন। টিভি ও রেডিও ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে তা সম্ভব হবে না।
বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও স্পন্সররা এই প্রস্তাবটি ভেবে দেখতে পারে।
মত ও ভিন্নমত
আজকাল টক শোর কল্যাণে নানা ব্যক্তির নানা মত টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে। কখনো কখনো তা নিয়ে বিতর্কও সৃষ্টি হয়। কখনো বুঝে, কখনো না বুঝেও এসব বিতর্ক হয়ে থাকে। বিতর্ক হওয়া ভালো। কিন্তু ভিন্নমতের নামে বক্তা বা আলোচকের অফিস আক্রমণ করা, তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া, মিছিল করা, ব্যক্তিগত আক্রমণ করা—এর কোনোটাই সমর্থনযোগ্য নয়। অথচ এগুলো করা হয় গণতন্ত্রের নামে। আসলে এগুলো ফ্যাসিবাদী আচরণ। যারা এ রকম আচরণ করে তারা গণতন্ত্রের শত্রু। টক শো বা কোনো নিবন্ধের বক্তব্য নিয়ে কেউ ভিন্নমত পোষণ করলে তার জবাব পত্রিকায় লিখে বা টক শোতে আলোচনার মাধ্যমে দিতে হবে এবং বক্তা বা লেখককে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। অফিস আক্রমণ করে টক শোর জবাব দেওয়া যাবে না। যারা কোনো বক্তা বা লেখকের অফিস বা বাসা আক্রমণ করে, তাদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের জন্য আমি আবেদন জানাচ্ছি।
সম্প্রতি টিভিতে প্রচারিত অধ্যাপক আসিফ নজরুলের কিছু বক্তব্যকে উপলক্ষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু নিন্দনীয় ঘটনা ঘটেছে, যা গণতন্ত্র চর্চাকে ব্যাহত করবে এবং যা বাক্স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপতুল্য। আমরা এর নিন্দা জানাই।
আ-মরি বাংলা ভাষা
ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা, বই নিয়ে সাংবাদিকতার ছড়াছড়ি দেখা যাবে সংবাদপত্র ও টিভিতে। তা যাক। কিন্তু সংবাদপত্রে বাংলা ভাষাবিষয়ক একটি নিয়মিত কলাম কি সাহিত্য বিভাগেও প্রকাশ করা যায় না? সংবাদপত্রে ও বইয়ে ভুল বাংলা ও ভুল বানান অনেক সময় দেখা যায়। শুদ্ধ বাংলা শুদ্ধ বানানের ব্যাপারে অনেকেরই অমনোযোগ রয়েছে। সংবাদপত্রের একটি নিয়মিত কলাম এ ব্যাপারে আমাদের মনোযোগ বাড়াতে ও ভুল বাংলা ও বানান চিহ্নিত করে শুদ্ধ রূপ দিতে পারে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
No comments