জলবায়ু পরিবর্তন-সমুদ্রের উঠে আসার গল্প by আল গোর
কিংবদন্তিতুল ড্রেক প্যাসেজ পেরিয়েই আমাদের চোখে পড়ল অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ। কী রাজসিক, কী অধরা এক জগৎ। দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণেই সাগর পেরিয়ে অ্যান্টার্কটিকা উপদ্বীপে সার বাঁধা বরফে ঢাকা পর্বত; আর একে ঘিরে আছে সাগরের অঢেল বন্য জীবের জগৎ। এমনকি এই মায়াবী কুহকভরা মহাদেশেও জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট ফুটে উঠতে শুরু করেছে।
ভূমির বরফ গলা আরও দ্রুততর হয়েছে এবং বিরাট বিরাট বরফের চাঁই আরও বেশি হারে সাগরের দিকে ছুটে যাচ্ছে। পরিণামে, বিশ্বের সাগরের উচ্চতা বাড়াও জোরদার হয়েছে। দুনিয়ার বেশির ভাগ বরফই অ্যান্টার্কটিকায় জমে আছে, প্রায় ৯০ ভাগই এখানে। এই বিরাট উপদ্বীপটির দক্ষিণের পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকা বরফখণ্ডে এত বরফ আছে, যা গললে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০ ফুট পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এরই অংশ হলো পাইন দ্বীপ হিমবাহ। অ্যান্টার্কটিকার আরও হিমবাহের মতো এটাও দ্রুত হারে গলতে শুরু করেছে। বিশ্বের সব নিম্নভূমি সমুদ্রতীর ও দ্বীপ জনগোষ্ঠীর ওপর এর প্রভাব সরাসরি—সমুদ্র থেকে দূরের বসতিগুলোও এ থেকে নিরাপদ নয়।
গলায়মান বরফের সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে গেলে দুই ধরনের বরফের মধ্যে তুলনা করা দরকার: ভূমির ওপর জমা বরফ আর সাগরে ভেসে বেড়ানো বরফ। ভাসমান বরফ গলে গেলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতায় তেমন তারতম্য হয় না। কারণ, ইতিমধ্যেই তো এর ওজনের চাপ সমুদ্রে প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু হিমবাহ ও ভূমিতে জমাট বরফ গলে গেলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যায়।
বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন, আগামী শতকে কী মাত্রায় সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়বে। আমরা কেবল জানি যে ইতিমধ্যে তা বাড়তে শুরু করেছে এবং আসলেই দ্বীপ ও উপকূলীয় মানুষের জীবনে এর ক্ষতিকারিতা দেখা দিয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম বন্দরনগরগুলোয় ইতিমধ্যে চার কোটি মানুষ মারাত্মক প্লাবনের হুমকির মুখে আছে। আগামী ৫০ বছরের মধ্যে এই সংখ্যা তিন গুণ হতে পারে।
এমনকি ধনী দেশগুলোও এই বিপদ থেকে মুক্ত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের বেলায় বলতে গেলে মিয়ামি সৈকত, চেসাপিক অঞ্চল, উপকূলীয় লুইজিয়ানা এবং উপকূলীয় টেক্সাসের কথা বলতে হয়। এসব অঞ্চলের কিছু এলাকায় সমুদ্র উঠে আসায় ভূমি ডুবতে শুরু করেছে। এমনকি আমাদের রাজধানীর পাদদেশ পর্যন্ত এর অভিঘাত পড়তে পারে। সাম্প্রতিক একটা সমীক্ষা জানিয়েছে, সমুদ্রের উচ্চতা এক মিটারের ১০ ভাগের এক ভাগ বাড়লেই দুই বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হবে এবং এর শিকার হবে ওয়াশিংটন ডিসির ৬৮ হাজার মানুষ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে, ঝড়ঝঞ্ঝার ক্রমবর্ধমান বিপদ। গত বছর এ রকমই একটি ঝড় আইরিনের সময় নিউইয়র্কের পাতাল রেলপথ ও টানেলগুলো জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। এসব দেশের জনসংখ্যা এখনো দ্রুত হারে বাড়ছে এবং সেখানে অবকাঠামো বানানোর মতো অর্থও সীমিত। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে সবচেয়ে হুমকিতে পড়বে ভারতের কলকাতা ও মুম্বাই; চীনের গুয়াংঝৌ; ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটি। এবং অবশ্যই মালদ্বীপের মতো নিম্নভূমির দ্বীপদেশগুলো ইতিমধ্যে ডুবে যাওয়ার বিপদের মুখে পড়েছে।
তার পরে রইল বাংলাদেশ। সমুদ্রের জলপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়লেই—কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ যা ঘটতে পারে—দুই থেকে আড়াই কোটি বাংলাদেশিকে উপকূলীয় এলাকা থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করাতে হবে। তারা হারাবে তাদের বর্তমান বসতি ও পেশা। এ দেশটির তিন ভাগের দুই ভাগ এলাকাই সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে পাঁচ মিটারেরও কম উঁচু। দেশটির ১৫ কোটি মানুষ অতি অল্প জায়গার মধ্যে আটকে আছে। এ রকম অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তন অকল্পনীয় সমস্যা হিসেবে হাজির হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়া মানে কেবল বন্যা নয়, এর মানে লোনা পানির আগ্রাসনের ফলে ধানের আবাদ ধ্বংস। অথচ চালই হলো এ দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। ক্ষতি বাড়লে প্রায় দুই কোটি কৃষক পেশা হারিয়ে ভিড়াক্রান্ত শহরে ভিড় জমাবে।
এই অ্যান্টার্কটিকায়, বাদবাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করায় কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু বরফে আচ্ছাদিত এই অপরূপ মহাদেশের দিকে তাকিয়ে দুর্ভাবনা আসে, এই বরফ আরও দ্রুত গলা শুরু করলে কী যে হবে?
আল গোর: সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং নোবেল বিজয়ী।গলায়মান বরফের সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে গেলে দুই ধরনের বরফের মধ্যে তুলনা করা দরকার: ভূমির ওপর জমা বরফ আর সাগরে ভেসে বেড়ানো বরফ। ভাসমান বরফ গলে গেলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতায় তেমন তারতম্য হয় না। কারণ, ইতিমধ্যেই তো এর ওজনের চাপ সমুদ্রে প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু হিমবাহ ও ভূমিতে জমাট বরফ গলে গেলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যায়।
বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন, আগামী শতকে কী মাত্রায় সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়বে। আমরা কেবল জানি যে ইতিমধ্যে তা বাড়তে শুরু করেছে এবং আসলেই দ্বীপ ও উপকূলীয় মানুষের জীবনে এর ক্ষতিকারিতা দেখা দিয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম বন্দরনগরগুলোয় ইতিমধ্যে চার কোটি মানুষ মারাত্মক প্লাবনের হুমকির মুখে আছে। আগামী ৫০ বছরের মধ্যে এই সংখ্যা তিন গুণ হতে পারে।
এমনকি ধনী দেশগুলোও এই বিপদ থেকে মুক্ত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের বেলায় বলতে গেলে মিয়ামি সৈকত, চেসাপিক অঞ্চল, উপকূলীয় লুইজিয়ানা এবং উপকূলীয় টেক্সাসের কথা বলতে হয়। এসব অঞ্চলের কিছু এলাকায় সমুদ্র উঠে আসায় ভূমি ডুবতে শুরু করেছে। এমনকি আমাদের রাজধানীর পাদদেশ পর্যন্ত এর অভিঘাত পড়তে পারে। সাম্প্রতিক একটা সমীক্ষা জানিয়েছে, সমুদ্রের উচ্চতা এক মিটারের ১০ ভাগের এক ভাগ বাড়লেই দুই বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হবে এবং এর শিকার হবে ওয়াশিংটন ডিসির ৬৮ হাজার মানুষ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে, ঝড়ঝঞ্ঝার ক্রমবর্ধমান বিপদ। গত বছর এ রকমই একটি ঝড় আইরিনের সময় নিউইয়র্কের পাতাল রেলপথ ও টানেলগুলো জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। এসব দেশের জনসংখ্যা এখনো দ্রুত হারে বাড়ছে এবং সেখানে অবকাঠামো বানানোর মতো অর্থও সীমিত। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে সবচেয়ে হুমকিতে পড়বে ভারতের কলকাতা ও মুম্বাই; চীনের গুয়াংঝৌ; ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটি। এবং অবশ্যই মালদ্বীপের মতো নিম্নভূমির দ্বীপদেশগুলো ইতিমধ্যে ডুবে যাওয়ার বিপদের মুখে পড়েছে।
তার পরে রইল বাংলাদেশ। সমুদ্রের জলপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়লেই—কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ যা ঘটতে পারে—দুই থেকে আড়াই কোটি বাংলাদেশিকে উপকূলীয় এলাকা থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করাতে হবে। তারা হারাবে তাদের বর্তমান বসতি ও পেশা। এ দেশটির তিন ভাগের দুই ভাগ এলাকাই সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে পাঁচ মিটারেরও কম উঁচু। দেশটির ১৫ কোটি মানুষ অতি অল্প জায়গার মধ্যে আটকে আছে। এ রকম অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তন অকল্পনীয় সমস্যা হিসেবে হাজির হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়া মানে কেবল বন্যা নয়, এর মানে লোনা পানির আগ্রাসনের ফলে ধানের আবাদ ধ্বংস। অথচ চালই হলো এ দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। ক্ষতি বাড়লে প্রায় দুই কোটি কৃষক পেশা হারিয়ে ভিড়াক্রান্ত শহরে ভিড় জমাবে।
এই অ্যান্টার্কটিকায়, বাদবাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করায় কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু বরফে আচ্ছাদিত এই অপরূপ মহাদেশের দিকে তাকিয়ে দুর্ভাবনা আসে, এই বরফ আরও দ্রুত গলা শুরু করলে কী যে হবে?
No comments