বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক-আমাদের চাই দর-কষাকষির কূটনৈতিক সক্ষমতা by মহিউদ্দিন আহমদ
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কারও কারও কাছে আমাদের শেয়ারবাজারের মতোই নিম্নগামী মনে হতে পারে। পত্রিকার পাতা ঘাঁটলে আর লোকজনের কথা শুনলে মনে হয় এই সম্পর্কের স্বাদ রীতিমতো তেতো। নানা কারণে এই দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক জটিল হচ্ছিল বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই।
সম্প্রতি এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অনেক বিষয়। যেমন, সীমান্তে বিএসএফের হাতে বাংলাদেশি হত্যা, তিস্তা নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং টিপাইমুখ বাঁধ। এ ছাড়া বাণিজ্যে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা, ট্রানজিট এবং ছিটমহল বিনিময়সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে সমস্যা আছে অনেক বছর ধরেই। এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কেমন করে এই বিষয়গুলোর সুরাহা করব?
জনমনে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে ভারত ‘আক্রমণকারী’ এবং বাংলাদেশ ‘আক্রান্ত’। এই ধারণা কেমন করে তৈরি হলো তা যেমন আলোচনার দাবি রাখে, তেমনই জরুরি প্রয়োজন হলো, এই ধারণা যদি অমূলক না হয়, তাহলে এর গোড়ায় যাওয়া এবং বিহিত করা। যেহেতু এখানে দেশ দুটো, কোনো একটি দেশের একার পক্ষে এর সমাধান সম্ভব নয়।
১৯২০-এর দশকে হসরত মোহানির প্রস্তাব অনুযায়ী, যদি এ অঞ্চলে একটি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র (ইউনাইটেড স্টেটস অব ইন্ডিয়া) গঠন করা যেত, তাহলে এত দিনে আমরা হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতোই বিক্রমশালী একটি দেশের সচ্ছল নাগরিক হতে পরতাম। কিন্তু আমরা তা করিনি। আমাদের নেতারা আমাদের শেখালেন, হিন্দু আর মুসলমান এক দেশে বসবাস করতে পারে না। সুতরাং দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্ভব হলো। তার ভিত্তিতে পাকিস্তান-হিন্দুস্তান তৈরি হলো। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হলো। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্বের বিষয়টা রয়েই গেল। মাঝেমধ্যেই ওটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর এই দ্বন্দ্বই আজ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে অনেকটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
অতীত পরিবর্তন করা যায় না। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিলে ভবিষ্যতে ভুল করার প্রবণতা কমে যায়। তবে সব সময় অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে থাকলে সামনের দিকে খুব একটা এগোনো যায় না। আমরাও পারছি না। এখনো আমাদের চিন্তায়, চেতনায়, অভ্যাসে এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে ১৯৪৭ ও ১৯৭১ এমনভাবে মিশে আছে যে ওই সময়ের অনেক বিষয় নিয়ে আমরা দিনের পর দিন কুতর্ক করি, ইতিহাসের জাবর কাটি।
আমাদের দেশের মানুষ চরম দারিদ্র্য আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ছোট্ট একটা দেশ, মানুষ অনেক বেশি। এই বিরাট জনসংখ্যার চাপ সামলানোর মতো জমি কিংবা অর্থনীতি আমাদের নেই। এ রকম একটি দেশ টেকসই হবে, এটা বিশ্বাস করতেও অনেক মানসিক শক্তি ও ধৈর্যের প্রয়োজন। দেশটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন একধরনের আগ্রাসী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিপুল আয়োজন এবং জাতীয় মতৈক্য। মুশকিল হলো, আমাদের দেশের মানুষ দুটো শিবিরে ভাগ হয়ে গেছে। কেউ ভারতের দালাল, কেউ পাকিস্তানের! দেশপ্রেমটা অন্তত আমরা অন্যের কাছ থেকে শিখতে পারতাম। কিন্তু শিখিনি। আমরা এখনো একটা ‘নেশন’ হয়ে উঠতে পারিনি।
আমাদের দেশে প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক তেমন নেই, আছেন বাগাড়ম্বরকারী। তর্জনী তুলে, গলার রগ ফুলিয়ে, কণ্ঠস্বর সপ্তমে চড়িয়ে এঁরা শুধু গর্জন করতেই শিখেছেন। অর্থনীতিবিদেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব বাগাড়ম্বকারীর অধীনে চাকরি করেন, নীতিনির্ধারণে তাঁদের ভূমিকা রাখার ইচ্ছা কিংবা সুযোগ নেই।
ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি নাজুক। এ অঞ্চলে প্রধান নদীগুলোর সব পানি নিষ্কাশনের নালা হলো বাংলাদেশ। তাই এ দেশের মানুষ পরিবেশগত ভারসাম্য নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাকে নির্ভর করতে হয় ভারতের ওপর। এ অবস্থায় আমরা কী করতে পারি?
আমি মনে করি, আমাদের সামনে তিনটি বিকল্প খোলা আছে। প্রথমত, আমরা ভারতকে বুঝিয়ে বলতে পারি, আমরা তোমাদের বন্ধু। আমরাও তোমাদের বন্ধুতা চাই। তোমরা এমন কোনো কাজ কোরো না, যাতে আমাদের ক্ষতি হয়। আমরাও এমন কিছু করব না, যাতে তোমাদের ক্ষতি হয়। এটাই সম্ভবত সবচেয়ে উত্তম বিকল্প। কিন্তু এটা কাজ করছে না। এ জন্য দুটো দেশই দায়ী। তবে বিতর্ক হতে পারে, কে বেশি দায়ী, কে কম দায়ী।
দ্বিতীয় বিকল্প হচ্ছে, আমরা ভারতের করুণাপ্রার্থী হয়ে থাকব এবং ভারতের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রীতি ও কর্মসূচির আওতায় উপগ্রহের মতো বিরাজ করব। মাঝেমধ্যে চিৎকার-চেঁচামেচি করব, আবার তাদের ব্যবস্থাপত্র মেনে নেব।
তৃতীয় বিকল্প হলো, আমরা এমন একটি রাষ্ট্র হয়ে উঠব, যখন ভারত আমাদের সমীহ করবে এবং আমাদের ঘাঁটাতে সাহস করবে না। অর্থাৎ আমাদের হয়ে উঠতে হবে এ অঞ্চলে ইসরায়েলের মতো। ইসরায়েলের যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি মুরব্বি আছে, আমাদেরও তেমন মুরব্বি দরকার। বাংলায় একটি প্রবচন আছে, ছাগল নাচে খুঁটার জোরে। আমাদের ওই রকম একটি খুঁটা দরকার। ‘কোথায় পাব তারে?’
আমার ধারণা, এ দেশে তিনটি বিকল্পের পক্ষেই কম-বেশি মানুষ আছে। দ্বিতীয় বিকল্পটা একেবারেই সম্মানজনক নয় বিধায় ওটা নিয়ে আর আলোচনা করতে চাই না। তৃতীয় বিকল্পটি পাকিস্তান নির্বোধের মতো কিছুটা বিবেচনায় রেখেছিল ১৯৭১ সালে। তাদের ধারণা ছিল, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন তাদের কুল রক্ষা করবে। কিন্তু তা হয়নি। এটা একেবারেই অবাস্তব প্রপঞ্চ। বাকি থাকল প্রথম বিকল্পটি। এখানে অবশ্য আমরা ভারতের চেয়ে পিছিয়ে আছি।
ভারত রাষ্ট্রের সব ধরনের ক্ষুদ্রতা ও একধরনের আধিপত্যবাদী মনোভাব সত্ত্বেও তার দুটো জিনিস আমি মনে করি, অনুকরণীয়। প্রথমত, জাতীয় স্বার্থে দলমতের ওপরে উঠে তারা রাজনৈতিক মতৈক্য তৈরি করতে পেরেছে। দ্বিতীয়ত, ভারত রাষ্ট্রের একটি দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা আছে। এর আওতায় আছে খাদ্য, নিরাপত্তা, সেচ, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য অবকাঠামো।
আমাদের মধ্যে এ দুটো বিষয় পুরোপুরি অনুপস্থিত। এবং সে জন্যই আমরা এখনো একটি ‘নেশন’ হয়ে উঠতে পারিনি। আর সে জন্যই আমরা ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে সমান মর্যাদা নিয়ে দর-কষাকষির নৈতিক শক্তিটা পাই না। এখানে আমি আমাদের রাষ্ট্রের কর্ণধারদের কাছে কিছু চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে চাই।
এযাবৎ আমাদের দুই দেশের সরকারপ্রধানদের মধ্যে যতগুলো শীর্ষ বৈঠক হয়েছে, তার কার্যবিবরণী প্রকাশ করুন। জনগণকে জানতে দিন, আপনারা কী কথাবার্তা বলেছেন, ময়দানে আপনারা দলের চেলাচামুণ্ডাদের কাছে অনেক কিছুই বলেন। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আপনাদের কী কথাবার্তা হয়েছে তা আমাদের জানান।
দ্বিতীয়ত, যৌথ নদী কমিশনের যত বৈঠক হয়েছে এযাবৎ, তার কার্যবিবরণী প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করুন। আমরা জানতে চাই, আপনাদের কে কতটুকু বলেছেন দেশের মানুষের পক্ষে। আমরা নিশ্চিত হতে চাই, ভারত রাষ্ট্র চার দশক ধরে আমাদের ওপর কী কী জুলুম করেছে। তথ্যগুলো জানা থাকলে এ দেশের মানুষ তাদের উপলব্ধি থেকেই মতৈক্য গড়ে তুলবে। এবং তা হতে পারে ভারতের সঙ্গে দর-কষাকষির জন্য বড় একটা শক্তি। এর পক্ষে ভারতের অনেক নাগরিকও থাকবে বলে আমার বিশ্বাস, যারা বাংলাদেশের মানুষকে ঠকাতে চায় না, তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করতে চায় না।
আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্র তার নাগরিকদের যে চোখে দেখে, অন্যদের সেভাবে নয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই দেশটির আচরণ অত্যন্ত উদ্ধত। ভারতের সাবেক এক রাষ্ট্রপতিকে বিমানবন্দরে তারা জামা খুলে সার্চ করেছিল, তাদের এক রাষ্ট্রদূতের পাগড়ি খুলে দেখেছিল, ছোরা কিংবা বোমা আছে কি না। ওই দেশের মূলধারার সংবাদপত্রে ভারতের স্থান হয় ভেতরের পাতার এক কোণে, কখনো স্থানই হয় না। ভারতের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র যে আচরণ করে, বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আচরণ প্রায় একই রকম।
ভারতের কিছু কিছু এলাকাকে বলা চলে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ। যেমন, উত্তর-পূর্ব ভারত। কোনো কোনো রাজ্যে চলছে অঘোষিত সেনাশাসন। সেনাবাহিনীকে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছে বিশেষ আইনে। দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্র কখনোসখনো নিজ দেশের নাগরিকদের সঙ্গেও বৈরী আচরণ করে। বাংলাদেশেও অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ বজায় আছে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। সেখানে সেনাশাসন বলবৎ ছিল কয়েক দশক। এখনো তারা বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকা থেকে বেশি দৃশ্যমান। রাষ্ট্র শক্তিশালী হলে, এর নির্যাতনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হলে, জনগণের জন্য জায়গা কমে যায়। রাষ্ট্রের ক্ষমতায়ন আর জনগণের ক্ষমতায়ন পরস্পরবিরোধী। ভারত রাষ্ট্রটিতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন হয়েছে নানাভাবে। এর ফলে ভারতের অভ্যন্তরে কোটি কোটি মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে, বাস্তুহারা হচ্ছে, প্রান্তিক অবস্থানে চলে যাচ্ছে। ভারত রাষ্ট্রটির কিছু কিছু কর্মকাণ্ডের ফল সীমান্তের বাইরে বাংলাদেশের অনেক মানুষকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তাদের জীবন-জীবিকা প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এসব দেশে মানুষ ছোট, রাষ্ট্র বড়।
এই প্রেক্ষাপটে আমাদের দুই দেশের মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের মূল্যায়ন করা দরকার। রাজনীতিক, নাগরিক সংগঠন, গণমাধ্যম এবং ‘সুশীল’দের মধ্যে যেভাবে দলবাজি চলছে, যেভাবে প্রতিটি বিষয়ের রাজনৈতিকীকরণ হচ্ছে, তাতে শুধু বিভ্রান্তি বাড়ছে। কাজের কাজ হচ্ছে না কিছুই।
আমাদের বুঝতে হবে, আমরা এমন একটা অবস্থা ও সময়ের মধ্যে আছি, যেখানে ভারতের ওপর আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করতে হয় এবং ভারতের পক্ষে আমাদের ব্ল্যাকমেইল করার সুযোগ রয়ে গেছে প্রচুর। আমরা প্রচুর টক শো, মানববন্ধন আর শোভাযাত্রা করে আমাদের অবস্থান পাল্টাতে পারব না। চাই বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ।
কয়েক দিন আগে জেনারেল এরশাদ হুংকার দিয়েছিলেন, ‘জান দেব, তবু তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করব’। আমরা তাঁর স্ট্যান্টবাজির সঙ্গে পরিচিত। এঁরা কখনো জান দেন না। দশ-দশটি বছর ক্ষমতা আঁকড়ে থেকে তিনি কী করেছেন, তা আমরা জানি। আমাদের কূটনৈতিক ভাষা শিখতে হবে, কূটনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের কিছু কিছু মন্ত্রণালয় চলে নবিশদের দিয়ে। ৪০ বছর পরও আমরা এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। গলাবাজি বা নবিশীকরণে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা হয় না, সে জন্য প্রয়োজন দর-কষাকষির কূটনৈতিক সক্ষমতা। আমাদের রাষ্ট্র সেই সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে কি?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com.
জনমনে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে ভারত ‘আক্রমণকারী’ এবং বাংলাদেশ ‘আক্রান্ত’। এই ধারণা কেমন করে তৈরি হলো তা যেমন আলোচনার দাবি রাখে, তেমনই জরুরি প্রয়োজন হলো, এই ধারণা যদি অমূলক না হয়, তাহলে এর গোড়ায় যাওয়া এবং বিহিত করা। যেহেতু এখানে দেশ দুটো, কোনো একটি দেশের একার পক্ষে এর সমাধান সম্ভব নয়।
১৯২০-এর দশকে হসরত মোহানির প্রস্তাব অনুযায়ী, যদি এ অঞ্চলে একটি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র (ইউনাইটেড স্টেটস অব ইন্ডিয়া) গঠন করা যেত, তাহলে এত দিনে আমরা হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতোই বিক্রমশালী একটি দেশের সচ্ছল নাগরিক হতে পরতাম। কিন্তু আমরা তা করিনি। আমাদের নেতারা আমাদের শেখালেন, হিন্দু আর মুসলমান এক দেশে বসবাস করতে পারে না। সুতরাং দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্ভব হলো। তার ভিত্তিতে পাকিস্তান-হিন্দুস্তান তৈরি হলো। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হলো। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্বের বিষয়টা রয়েই গেল। মাঝেমধ্যেই ওটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর এই দ্বন্দ্বই আজ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে অনেকটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
অতীত পরিবর্তন করা যায় না। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিলে ভবিষ্যতে ভুল করার প্রবণতা কমে যায়। তবে সব সময় অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে থাকলে সামনের দিকে খুব একটা এগোনো যায় না। আমরাও পারছি না। এখনো আমাদের চিন্তায়, চেতনায়, অভ্যাসে এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে ১৯৪৭ ও ১৯৭১ এমনভাবে মিশে আছে যে ওই সময়ের অনেক বিষয় নিয়ে আমরা দিনের পর দিন কুতর্ক করি, ইতিহাসের জাবর কাটি।
আমাদের দেশের মানুষ চরম দারিদ্র্য আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ছোট্ট একটা দেশ, মানুষ অনেক বেশি। এই বিরাট জনসংখ্যার চাপ সামলানোর মতো জমি কিংবা অর্থনীতি আমাদের নেই। এ রকম একটি দেশ টেকসই হবে, এটা বিশ্বাস করতেও অনেক মানসিক শক্তি ও ধৈর্যের প্রয়োজন। দেশটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন একধরনের আগ্রাসী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিপুল আয়োজন এবং জাতীয় মতৈক্য। মুশকিল হলো, আমাদের দেশের মানুষ দুটো শিবিরে ভাগ হয়ে গেছে। কেউ ভারতের দালাল, কেউ পাকিস্তানের! দেশপ্রেমটা অন্তত আমরা অন্যের কাছ থেকে শিখতে পারতাম। কিন্তু শিখিনি। আমরা এখনো একটা ‘নেশন’ হয়ে উঠতে পারিনি।
আমাদের দেশে প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক তেমন নেই, আছেন বাগাড়ম্বরকারী। তর্জনী তুলে, গলার রগ ফুলিয়ে, কণ্ঠস্বর সপ্তমে চড়িয়ে এঁরা শুধু গর্জন করতেই শিখেছেন। অর্থনীতিবিদেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব বাগাড়ম্বকারীর অধীনে চাকরি করেন, নীতিনির্ধারণে তাঁদের ভূমিকা রাখার ইচ্ছা কিংবা সুযোগ নেই।
ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি নাজুক। এ অঞ্চলে প্রধান নদীগুলোর সব পানি নিষ্কাশনের নালা হলো বাংলাদেশ। তাই এ দেশের মানুষ পরিবেশগত ভারসাম্য নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাকে নির্ভর করতে হয় ভারতের ওপর। এ অবস্থায় আমরা কী করতে পারি?
আমি মনে করি, আমাদের সামনে তিনটি বিকল্প খোলা আছে। প্রথমত, আমরা ভারতকে বুঝিয়ে বলতে পারি, আমরা তোমাদের বন্ধু। আমরাও তোমাদের বন্ধুতা চাই। তোমরা এমন কোনো কাজ কোরো না, যাতে আমাদের ক্ষতি হয়। আমরাও এমন কিছু করব না, যাতে তোমাদের ক্ষতি হয়। এটাই সম্ভবত সবচেয়ে উত্তম বিকল্প। কিন্তু এটা কাজ করছে না। এ জন্য দুটো দেশই দায়ী। তবে বিতর্ক হতে পারে, কে বেশি দায়ী, কে কম দায়ী।
দ্বিতীয় বিকল্প হচ্ছে, আমরা ভারতের করুণাপ্রার্থী হয়ে থাকব এবং ভারতের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রীতি ও কর্মসূচির আওতায় উপগ্রহের মতো বিরাজ করব। মাঝেমধ্যে চিৎকার-চেঁচামেচি করব, আবার তাদের ব্যবস্থাপত্র মেনে নেব।
তৃতীয় বিকল্প হলো, আমরা এমন একটি রাষ্ট্র হয়ে উঠব, যখন ভারত আমাদের সমীহ করবে এবং আমাদের ঘাঁটাতে সাহস করবে না। অর্থাৎ আমাদের হয়ে উঠতে হবে এ অঞ্চলে ইসরায়েলের মতো। ইসরায়েলের যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি মুরব্বি আছে, আমাদেরও তেমন মুরব্বি দরকার। বাংলায় একটি প্রবচন আছে, ছাগল নাচে খুঁটার জোরে। আমাদের ওই রকম একটি খুঁটা দরকার। ‘কোথায় পাব তারে?’
আমার ধারণা, এ দেশে তিনটি বিকল্পের পক্ষেই কম-বেশি মানুষ আছে। দ্বিতীয় বিকল্পটা একেবারেই সম্মানজনক নয় বিধায় ওটা নিয়ে আর আলোচনা করতে চাই না। তৃতীয় বিকল্পটি পাকিস্তান নির্বোধের মতো কিছুটা বিবেচনায় রেখেছিল ১৯৭১ সালে। তাদের ধারণা ছিল, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন তাদের কুল রক্ষা করবে। কিন্তু তা হয়নি। এটা একেবারেই অবাস্তব প্রপঞ্চ। বাকি থাকল প্রথম বিকল্পটি। এখানে অবশ্য আমরা ভারতের চেয়ে পিছিয়ে আছি।
ভারত রাষ্ট্রের সব ধরনের ক্ষুদ্রতা ও একধরনের আধিপত্যবাদী মনোভাব সত্ত্বেও তার দুটো জিনিস আমি মনে করি, অনুকরণীয়। প্রথমত, জাতীয় স্বার্থে দলমতের ওপরে উঠে তারা রাজনৈতিক মতৈক্য তৈরি করতে পেরেছে। দ্বিতীয়ত, ভারত রাষ্ট্রের একটি দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা আছে। এর আওতায় আছে খাদ্য, নিরাপত্তা, সেচ, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য অবকাঠামো।
আমাদের মধ্যে এ দুটো বিষয় পুরোপুরি অনুপস্থিত। এবং সে জন্যই আমরা এখনো একটি ‘নেশন’ হয়ে উঠতে পারিনি। আর সে জন্যই আমরা ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে সমান মর্যাদা নিয়ে দর-কষাকষির নৈতিক শক্তিটা পাই না। এখানে আমি আমাদের রাষ্ট্রের কর্ণধারদের কাছে কিছু চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে চাই।
এযাবৎ আমাদের দুই দেশের সরকারপ্রধানদের মধ্যে যতগুলো শীর্ষ বৈঠক হয়েছে, তার কার্যবিবরণী প্রকাশ করুন। জনগণকে জানতে দিন, আপনারা কী কথাবার্তা বলেছেন, ময়দানে আপনারা দলের চেলাচামুণ্ডাদের কাছে অনেক কিছুই বলেন। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আপনাদের কী কথাবার্তা হয়েছে তা আমাদের জানান।
দ্বিতীয়ত, যৌথ নদী কমিশনের যত বৈঠক হয়েছে এযাবৎ, তার কার্যবিবরণী প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করুন। আমরা জানতে চাই, আপনাদের কে কতটুকু বলেছেন দেশের মানুষের পক্ষে। আমরা নিশ্চিত হতে চাই, ভারত রাষ্ট্র চার দশক ধরে আমাদের ওপর কী কী জুলুম করেছে। তথ্যগুলো জানা থাকলে এ দেশের মানুষ তাদের উপলব্ধি থেকেই মতৈক্য গড়ে তুলবে। এবং তা হতে পারে ভারতের সঙ্গে দর-কষাকষির জন্য বড় একটা শক্তি। এর পক্ষে ভারতের অনেক নাগরিকও থাকবে বলে আমার বিশ্বাস, যারা বাংলাদেশের মানুষকে ঠকাতে চায় না, তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করতে চায় না।
আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্র তার নাগরিকদের যে চোখে দেখে, অন্যদের সেভাবে নয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই দেশটির আচরণ অত্যন্ত উদ্ধত। ভারতের সাবেক এক রাষ্ট্রপতিকে বিমানবন্দরে তারা জামা খুলে সার্চ করেছিল, তাদের এক রাষ্ট্রদূতের পাগড়ি খুলে দেখেছিল, ছোরা কিংবা বোমা আছে কি না। ওই দেশের মূলধারার সংবাদপত্রে ভারতের স্থান হয় ভেতরের পাতার এক কোণে, কখনো স্থানই হয় না। ভারতের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র যে আচরণ করে, বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আচরণ প্রায় একই রকম।
ভারতের কিছু কিছু এলাকাকে বলা চলে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ। যেমন, উত্তর-পূর্ব ভারত। কোনো কোনো রাজ্যে চলছে অঘোষিত সেনাশাসন। সেনাবাহিনীকে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছে বিশেষ আইনে। দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্র কখনোসখনো নিজ দেশের নাগরিকদের সঙ্গেও বৈরী আচরণ করে। বাংলাদেশেও অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ বজায় আছে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। সেখানে সেনাশাসন বলবৎ ছিল কয়েক দশক। এখনো তারা বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকা থেকে বেশি দৃশ্যমান। রাষ্ট্র শক্তিশালী হলে, এর নির্যাতনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হলে, জনগণের জন্য জায়গা কমে যায়। রাষ্ট্রের ক্ষমতায়ন আর জনগণের ক্ষমতায়ন পরস্পরবিরোধী। ভারত রাষ্ট্রটিতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন হয়েছে নানাভাবে। এর ফলে ভারতের অভ্যন্তরে কোটি কোটি মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে, বাস্তুহারা হচ্ছে, প্রান্তিক অবস্থানে চলে যাচ্ছে। ভারত রাষ্ট্রটির কিছু কিছু কর্মকাণ্ডের ফল সীমান্তের বাইরে বাংলাদেশের অনেক মানুষকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তাদের জীবন-জীবিকা প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এসব দেশে মানুষ ছোট, রাষ্ট্র বড়।
এই প্রেক্ষাপটে আমাদের দুই দেশের মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের মূল্যায়ন করা দরকার। রাজনীতিক, নাগরিক সংগঠন, গণমাধ্যম এবং ‘সুশীল’দের মধ্যে যেভাবে দলবাজি চলছে, যেভাবে প্রতিটি বিষয়ের রাজনৈতিকীকরণ হচ্ছে, তাতে শুধু বিভ্রান্তি বাড়ছে। কাজের কাজ হচ্ছে না কিছুই।
আমাদের বুঝতে হবে, আমরা এমন একটা অবস্থা ও সময়ের মধ্যে আছি, যেখানে ভারতের ওপর আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করতে হয় এবং ভারতের পক্ষে আমাদের ব্ল্যাকমেইল করার সুযোগ রয়ে গেছে প্রচুর। আমরা প্রচুর টক শো, মানববন্ধন আর শোভাযাত্রা করে আমাদের অবস্থান পাল্টাতে পারব না। চাই বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ।
কয়েক দিন আগে জেনারেল এরশাদ হুংকার দিয়েছিলেন, ‘জান দেব, তবু তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করব’। আমরা তাঁর স্ট্যান্টবাজির সঙ্গে পরিচিত। এঁরা কখনো জান দেন না। দশ-দশটি বছর ক্ষমতা আঁকড়ে থেকে তিনি কী করেছেন, তা আমরা জানি। আমাদের কূটনৈতিক ভাষা শিখতে হবে, কূটনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের কিছু কিছু মন্ত্রণালয় চলে নবিশদের দিয়ে। ৪০ বছর পরও আমরা এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। গলাবাজি বা নবিশীকরণে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা হয় না, সে জন্য প্রয়োজন দর-কষাকষির কূটনৈতিক সক্ষমতা। আমাদের রাষ্ট্র সেই সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে কি?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com.
No comments