নতুন গ্রাহক বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার-অপচয় শিল্পে, অথচ আবাসিকে গ্যাস বন্ধ by অরুণ কর্মকার

বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানাসহ গ্যাসভিত্তিক সব শিল্পে জ্বালানির ব্যাপক অপচয় হচ্ছে। আবাসিক গ্রাহকেরাও অপচয় করছেন, তবে শিল্পের তুলনায় তা নগণ্য। মূলত শিল্প-কারখানায় পুরোনো প্রযুক্তির অদক্ষ যন্ত্রপাতির ব্যবহার এই অপচয়ের প্রধান কারণ।


সরকারি হিসাবে বর্তমানে দেশে প্রতিদিন ২৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে ২০০ কোটি ঘনফুটের মতো। অপচয় বন্ধ করা গেলে উৎপাদন না বাড়িয়েও বর্তমান চাহিদার সমান গ্যাস সরবরাহ করা যায়। কিন্তু তা করার উদ্যোগ না নিয়ে নতুন গ্রাহকদের গ্যাস-সংযোগ বন্ধ রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলার বৃথা চেষ্টা করা হচ্ছে।
সরকারি-বেসরকারি সূত্রগুলো বলছে, দীর্ঘদিন ধরে সংযোগ বন্ধ রাখায় নতুন গ্রাহকেরা বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। সারা দেশের কয়েক হাজার গ্রাহক নতুন সংযোগ পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়াসহ সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন সংযোগ বন্ধ করার আগেই। তাঁদেরও সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না।
এখন আবার সরকারি নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, গ্যাসের সরবরাহ বাড়লে শিল্পে সংযোগ অগ্রাধিকার পাবে। অথচ শিল্পে অপচয় প্রায় ৪০ শতাংশ। ব্যবহারও অনেক বেশি। সারা দেশে আবাসিক গ্রাহক গ্যাস ব্যবহার করেন মোট উৎপাদনের মাত্র ১২ শতাংশ। শিল্পে ব্যবহার ৩৩ শতাংশ (ক্যাপটিভ বিদ্যুৎসহ), বিদ্যুতে ৩৯ শতাংশ, সিএনজিতে ৫ ও সার কারখানায় ১০ শতাংশ গ্যাস ব্যবহূত হয়। বাকিটা ব্যবহূত হয় চা-বাগান ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হোসেন মনসুর অপচয় সম্পর্কে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আসলে হাতির খোরাক জোগাচ্ছি। বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান হাতির খাদ্যের মতো গ্যাস গিলছে। তাদের গ্যাস ব্যবহারের পরিমাণ স্বাভাবিক হলে বর্তমান অবস্থায়ও অধিকাংশ নতুন গ্রাহককে গ্যাস দেওয়া যেত।’
তিতাসের জরিপ: তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জরিপ অনুযায়ী, তাদের বিতরণ এলাকায় অধিকাংশ শিল্পের বয়লার পুরোনো প্রযুক্তির ও জ্বালানি ব্যবহারে অদক্ষ। এ কারণে প্রতিদিন ১৫ কোটি ঘনফুট (১৫০ মিলিয়ন) গ্যাসের অপচয় হচ্ছে।
তিতাসের আওতাধীন এলাকার আবাসিক গ্রাহকদের ব্যবহূত চুলা জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষ হলে প্রতিদিন আরও প্রায় পাঁচ কোটি ঘনফুট গ্যাস সাশ্রয় করা সম্ভব বলেও জরিপের ফলাফলে জানা গেছে।
তিতাস ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ এলাকায় গ্যাস বিতরণ করে। বর্তমানে তাদের দৈনিক চাহিদা ১৮০ কোটি ঘনফুটের মতো। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় তিতাস প্রতিদিন পায় ১৬০ কোটি ঘনফুটের মতো। তাদের বিতরণ এলাকার অপচয় বন্ধ করেই তিতাসের বর্তমান এ ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।
বিদ্যুতের অবস্থা শোচনীয়: দেশে সবচেয়ে বেশি গ্যাস ব্যবহূত হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে (দৈনিক প্রায় ৮০ কোটি ঘনফুট)। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের বর্তমান চাহিদা ১০০ কোটি ঘনফুটেরও বেশি। কিন্তু গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জ্বালানি ব্যবহারে গড় দক্ষতা ৬০ শতাংশের মতো। অর্থাৎ এখন যে পরিমাণ জ্বালানি ব্যবহার করে ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, ওই একই পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতে পারে।
এ জন্য পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করা দরকার। একই সঙ্গে নতুন যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে, সেগুলোতে জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষ যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার।
বর্তমানে এক মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জ্বালিয়ে গড়ে পাঁচ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করে একই পরিমাণ গ্যাস জ্বালিয়ে আট মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ সহকারী ম. তামিম বলেন, পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করে এখনকার মতো একই পরিমাণ গ্যাস জ্বালিয়ে অন্তত এক হাজার মেগাওয়াট বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
ম. তামিম বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শিল্পের বয়লার ও পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করে জ্বালানিদক্ষতা বাড়ানোর একটি কার্যক্রম নেওয়া হয়েছিল। কিছু কাজও হয়েছিল। তবে সময়স্বল্পতায় তা বেশি দূর এগোয়নি।
তবে তিতাস সম্প্রতি তাদের এলাকার আবাসিক গ্রাহকদের প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনার একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প কার্যকর করছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একটি শিল্পের বয়লার পরিবর্তন করে যে ফল পাওয়া যাবে, এক হাজার আবাসিক গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় এনেও সেই ফল পাওয়া যাবে না।
বৈষম্যের শিকার নতুন গ্রাহক: সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলেছেন, জ্বালানির অপচয় বন্ধ না করে নতুন গ্রাহকদের গ্যাস-সংযোগ দেওয়া বন্ধ রেখে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। কারণ, শহরাঞ্চলের গ্রাহকের জন্য সরকারি উদ্যোগে বিকল্প কোনো জ্বালানির সংস্থান করা হয়নি। পাইপলাইনে গ্যাস ব্যবহারকারীদের মাসে দিতে হয় ৪৫০ টাকা। আর এলপি গ্যাস ব্যবহারকারীদের মাসে অন্তত দুটি সিলিন্ডার কিনতে হয়। এর দাম দুই হাজার ৮০০ টাকা। তাও আবার চাহিদা অনুযায়ী পাওয়া যায় না।
জ্বালানির জন্য এলপি গ্যাস সহজলভ্য করা এবং দাম কমানোর যে প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছিল, তার বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেই। সরকার ইতিমধ্যে ২২টি নতুন কোম্পানিকে এলপি গ্যাস আমদানির লাইসেন্স দিলেও কোনো কোম্পানি এখন পর্যন্ত কাজ শুরু করেনি। অথচ, গ্রাহকের দিক বিবেচনা করলে জ্বালানি নিত্যদিনের একটি অপরিহার্য পণ্য।

No comments

Powered by Blogger.