নিষ্ক্রিয় হল প্রশাসন- ঢাবি কর্তৃপৰ সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে দুর্বল হল প্রশাসনের কারণেই দলবাজি ও সংঘর্ষ ঘটছে by মামুন-অর-রশিদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপৰ হল প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে। হল প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাই অতীতে হলে দখলদারিত্বের সুযোগ করে দিয়েছে। বর্তমানে দখলদারিত্ব না থাকলেও হল প্রশাসনের দুর্বলতার কারণেই হল পর্যায়ে বিভিন্ন গ্রম্নপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।
হল প্রশাসনে প্রভোস্ট ও আবাসিক শিৰকরা স্বপদে দায়িত্বের অনুকূলে যে সুযোগ-সুবিধা নেন, সে অনুযায়ী তাঁরা দায়িত্ব পালন করছেন না বলেই ছাত্র সংগঠনের নেতারা আধিপত্যের লড়াই করার সুযোগ পায়। সংশিস্নষ্ট অনেকে মনে করেন, যদি হল প্রশাসন সক্রিয় থাকত তাহলে হয়ত এ হত্যাকা- এড়ানো যেত। বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলের মেধাবী ছাত্র আবু বকর সিদ্দিক হত্যাকা-ের পর ভবিষ্যতে কোন হলে যাতে এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, সে লৰ্যে হল প্রশাসনকে সক্রিয় করা হচ্ছে। হলে অনাকাঙ্ৰিত কোন পরিস্থিতির আভাস পেলে তা সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং প্রক্টরকে জানাতে বলা হয়েছে; যাতে তাঁরা আগাম ব্যবস্থা নিতে পারেন। প্রভোস্ট কমিটির এক সভায় এই সতর্ক অবস্থান গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়।এদিকে এফ রহমান হলের সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে এখনও আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেক সাধারণ ছাত্রই হল ছেড়ে চলে গেছে। গোটা ক্যাম্পাসে এখন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ছাত্রলীগের অভ্যনত্মরীণ বিরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী ছাত্রের প্রাণহানির পর এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপৰের কঠোর অবস্থানের মুখে ছাত্রলীগের বিবদমান গ্রম্নপের সক্রিয় ক্যাডাররা গা-ঢাকা দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপৰ এই প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক সংঘর্ষে মৃতু্যর ঘটনাকে হত্যাকা- হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছে। একই সঙ্গে স্বজন হারানো পরিবারকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছে। উপাচার্য অধ্যাপক আআমস আরেফিন সিদ্দিক জনকণ্ঠকে বলেন, কৃষক পরিবারের মেধাবী ছাত্র সেই পরিবারের কেবল গুরম্নত্বপূর্ণ সদস্যই নয়, গোটা পরিবারের একটি স্বপ্ন। এভাবে কোন ছাত্রের মৃতু্য কেবল পরিবারের জন্য নয়, বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাষ্ট্রের জন্য অপূরণীয় ৰতি হয়ে যায়। আসলে অকালে প্রাণ হারানোয় ৰতি পূরণের কোন সুযোগ নেই, হবেও না। তবে নিহতের পরিবারের ধূলিসাত হয়ে যাওয়া স্বপ্নের পাশে দাঁড়াবে বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা কিছু আর্থিক অনুদান, নিহতের পরিবারের কাউকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি প্রদানসহ তাদের সমব্যথী হিসেবে কাজ করতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাই এ ব্যাপারে খুবই আনত্মরিক।
হলে প্রাণহানিকর সংঘর্ষের মূল দুর্বলতা চিহ্নিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। হল প্রশাসন সক্রিয় হলে হলে বহিরাগত অবস্থান সম্ভব নয়। কোন ছাত্র সে যে দলেরই রাজনীতি করম্নক, সে শিৰকদের সামনে অছাত্রসুলভ আচরণ করে পার পাবে না। যে কারণে মসত্মান হিসেবে গড়ে ওঠার আগেই হল প্রশাসনের কড়াকড়িতে হলের পরিবেশ শানত্ম থাকবে। হল প্রশাসন সক্রিয় থাকলে হলে অস্ত্র, লাঠি রাখাও সম্ভব নয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে হল প্রশাসনকে সক্রিয় করা এবং সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্র সংগঠনগুলোর মাঝে যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে তার বেশিরভাগেই ঘটে থাকে হলে আধিপত্য বিসত্মার তথা হলে ছাত্র ওঠানোকে কেন্দ্র করে। সর্বশেষ এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের দু'গ্রম্নপের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে এ হলে ছাত্র ওঠানোকে কেন্দ্র করে। যার বলি হয়েছে মেধাবী ছাত্র বকর। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, হলে ছাত্র ওঠানোর অধিকার ও দায়িত্ব হল প্রশাসনের। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে হলে এক প্রকার নিধিরাম সর্দার হয়ে আছে হল কর্তৃপৰ। কাগজেকলমে যাই থাক, শিৰার্থীদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে স্বাৰর করা ছাড়া আর বিশেষ কোন কাজ নেই হল প্রভোস্ট, হাউস টিউটরদের। হলে ছেলে ওঠানো, সিট বণ্টন থেকে শুরম্ন করে বাকি সব করে ছাত্রনেতারা। আর তা অবশ্যই সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতারা। দীর্ঘদিনের এ অনিয়ম বিগত তত্ত্বুাবধায়ক সরকারের আমলে দূর করতে একবার সচেষ্ট হয়েছিল কর্তৃপৰ। কিন্তু শেষ পর্যনত্ম তা ব্যর্থ হয়। দীর্ঘদিন ধরে যে সংস্কৃতি চালু আছে তা হঠাৎ বন্ধ করাও দুস্কর বলে মনে করছেন সংশিস্নষ্টরা। তবে তারা মনে করছেন, যদি হল কর্তৃপৰের হাতেই হলের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায় তাহলে আধিপত্যের সংঘর্ষ অনেক কমবে। তবে এর জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি ৰমতাসীনদের রাজনৈতিক সিদ্ধানত্মও প্রয়োজন।
এদিকে দোষীদের বিরম্নদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধান অনুযায়ী কঠোর দৃষ্টানত্মমূলক শাসত্মি দেয়ার কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপৰ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর সিদ্দিকের মৃতু্যকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপৰ হত্যাকা- হিসেবে বিবেচনা করছে। কোন রাজনৈতিক রং না দেখেই হত্যাকারীদের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে কর্তৃপৰ গণমাধ্যমকে জানিয়েছে।
হত্যার প্রতিবাদে বিৰোভ অব্যাহত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর সিদ্দিক নিহত হওয়ার প্রতিবাদ ও হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে বৃহস্পতিবারও ক্যাম্পাসে বিােভ অব্যাহত ছিল। কয়েকটি ছাত্র সংগঠন এ ঘটনায় প্রক্টরের অপসারণ দাবি করেছে। এ ছাড়া বিবৃতি দিয়ে ক্যাম্পাসে সহিংস ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিএনপি-জামায়াতপন্থী সাদা দলের ৩৫০ শিক। এদিকে এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের দু'গ্রম্নপে সোমবারের ওই সংঘর্ষের ঘটনা তদনত্মে গঠিত কমিটি কাল শনিবার থেকে কাজ শুরম্ন করছে।
বৃহসপতিবার সকাল থেকেই সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীসহ পৃথকভাবে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে বিােভ মিছিল করে। নিহত বকরের বিভাগ-ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিার্থীরা কলা ভবনের সামনে মানবন্ধন কর্মসূচী পালন করে আবু বকরের হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন। অন্যান্য বিভাগের ছাত্রছাত্রীরাও দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে কর্মসূচীতে অংশ নেন। শিৰার্থীদের পাশাপাশি বিভাগের শিকরাও কর্মসূচীতে অংশ নিয়ে দোষীদের শাসত্মি নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান। শিার্থীরা বলেন, সুষ্ঠু তদনত্ম ও নিরপে বিচার না পাওয়া পর্যনত্ম তাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
মানববন্ধন শেষে বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক আখতারম্নজ্জামানের নেতৃত্বে বিভাগীয় শিৰকদের পৰ থেকে উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। স্মারকলিপিতে ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে বকরের হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে শাসত্মি দেয়ার দাবি জানানো হয়।
দুপুরে ছাত্র ইউনিয়ন মধুর ক্যান্টিন থেকে বিােভ মিছিল বের করেন। মিছিলটি কয়েকবার কলা ভবন প্রদণি করে ডাকসু ভবনের সামনে সমাবেশে মিলিত হয়। এ সমাবেশ থেকে সংগঠনের সভাপতি মানবেন্দ্র দেব ঘটনার সুষ্ঠু তদনত্মের পাশাপাশি প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার জন্য প্রক্টর ড. সাইফুল ইসলাম খানের পদত্যাগ দাবি করেন। ছাত্রমৈত্রী, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র আন্দোলন, ছাত্রঐক্য, ছাত্র সমিতি ও ছাত্র ফোরামের সমন্বয়ে গঠিত সন্ত্রাসবিরোধী ৬ ছাত্র সংগঠন গতকাল মেধাবী ছাত্রকে হত্যার প্রতিবাদে বিােভ মিছিল, সমাবেশ কর্মসূচী পালন করেছে। এছাড়া ছাত্রফ্রন্ট ও ছাত্র ফেডারেশনসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন বিবৃতি দিয়ে ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।
বিকেলে মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে হত্যাকারীদের বিচার ও প্রক্টরের পদত্যাগসহ ৫ দফা দাবি জানিয়েছে প্রগতিশীল ছাত্রজোট। এসব দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচীও ঘোষণা করা হয়েছে। জোট ঘোষিত কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে ৬ ফেবু্রয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিৰোভ এবং পরদিন জেলা ও শিৰা প্রতিষ্ঠানে বিৰোভ।
ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে প্রক্টর ড. সাইফুল ইসলাম খান গতকাল জনকণ্ঠকে বলেন, শিার সুষ্ঠু স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদপে তারা নিচ্ছেন। ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি শেখ সোহেল রানা টিপু ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ সাকীব বাদশা গতকাল জানান, অভ্যনত্মরীণ কোন্দল থেকে যাতে কোন বিবাদ না বাধে সেদিকে তাদের কঠোর নজরদারি রয়েছে। আর কেউ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বিবাদ বাধাতে চাইলে তাকে কঠিন শাসত্মির মুখোমুখি হতে হবে।
শিকদের বিবৃতি
এফ রহমান হলে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের অভ্যনত্মরীণ বিবাদের কারণে মেধাবী ছাত্র নিহতের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানান বিএনপি-জামায়াতপন্থী সাদা দলের ৩৫০ শিক। সাদা দলের আহ্বায়ক ড. সদরম্নল আমিন স্বারিত ওই বিবৃতি বলা হয়, একজন ছাত্রের মৃতু্যর মতো মর্মানত্মিক ও দুঃখজনক ঘটনা কারও কাম্য হতে পারে না। ক্যাম্পাসে ও আবাসিক হলগুলোতে দলমতনির্বিশেষে সব ছাত্রের শানত্মিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করে শিার সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখা বিশ্ববিদ্যালয় কতর্ৃপরে জন্য আবশ্যকীয়।
তদনত্ম কমিটির কাজ শুরম্ন কাল
গত মঙ্গলবার রাতে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় গঠিত ৯ সদস্যের তদনত্ম কমিটি আগামীকাল শনিবার থেকে কাজ শুরু করবে। কমিটি সদস্যদের ইতোমধ্যে কাজ শুরু করার জন্য চিঠি দিয়ে অবহিত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ কমিটির আহ্বায়ক। আর প্রক্টর ড. সাইফুল ইসলাম খান সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন_ ড. খন্দকার বজলুল হক, ড. তাজমেরী এসএ ইসলাম, ড. আনোয়ার হোসেন, ড. সাদেকা হালিম, ড. রহমত উল্ক্নাহ, এ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান ও অধ্যাপক ডা. দ্বীন মোহাম্মদ। কমিটি ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা রয়েছে।
No comments