আন্তর্জাতিক-আইএসআই তো সবার হাঁড়ির খবর রাখে... by আয়েশা সিদ্দিকা

মার্কিন সামরিক বাহিনী যখন বিন লাদেনকে খতম করে ততদিনে তিনি আল কায়দার প্রতীক ফিগারে পরিণত হয়েছিলেন। সাংগঠনিক বিস্তারিত বিষয়ে তিনি নিশ্চয়ই একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। আল কায়দার সহযোগী সংগঠনগুলো বিন লাদেনের হত্যার ঘটনায় কীভাবে পাল্টা আঘাত হানে, তার জন্য আসছে দিনগুলো গুরুত্বপূর্ণ


সেনানগরী এবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে পাওয়ার ঘটনাটি অত্যন্ত লজ্জাকর। কাজটি ওবামা ও সিআইএর জন্য প্রশংসা বয়ে আনতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানের নিরাপত্তা এস্টাবলিশমেন্ট সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে কতটা আন্তরিক এ প্রশ্নটিও এতে দেখা দেবে। কারণ, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সেনাবাহিনীর কাকুল প্রশিক্ষণ একাডেমীর একেবারে কাছে অবস্থিত একটি নির্জন বাড়িতে বিন লাদেন থাকেন, এ তথ্যটি জানত না, তা বোকাকেও বিশ্বাস করানো কঠিন। আইএসআই এমন একটি গোয়েন্দা সংস্থা, যারা বেসামরিক নাগরিকদের পর্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করে থাকে।
এ ঘটনার পর পাকিস্তানের বিদেশ অফিস থেকে একটি সাদামাটা বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তানের সাধারণ সহযোগিতার বিষয়টিই কেবল উল্লেখ করা হয়েছে। গণমাধ্যমের রিপোর্টেও ওই অপারেশনটি প্রধানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর থেকে সন্দেহাতীতভাবে এ অপারেশনে কৌশলগত সহযোগিতা দেওয়া হয়ে থাকবে। আর এ সহযোগিতা না পেলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিন লাদেনকে খুন করার মিশন সফল করতে পারত না। খুব সম্ভবত দু'দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা হ্রাসের জন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকতে পারে। ওয়াশিংটন থেকে যখনই পাকিস্তানের ওপর জোর চাপ দেওয়া হয়েছে তখনই দেখা গেছে তারা আল কায়দা অপারেটিভদের পাকড়াও করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করতে।
সম্ভবত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে এই শঙ্কায় বিন লাদেনবিরোধী অভিযানে ওয়াশিংটনকে আমরা কতটা সহযোগিতা করেছি, তা কখনও শিকার করা হবে না। আল কায়দার স্থানীয় সহযোগীরা এ খবরটি নিশ্চয়ই আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করবে না। তারা সরকারের সঙ্গে এই অভিযানের কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা আঁচ করতে পারলে সরকারের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে পারে। আর নিরাপত্তা এস্টাবলিশমেন্টের ভেতরে এবং ব্যাপকভাবে জনগণের মধ্যে আল কায়দার প্রতি সহানুভূতি থাকার বিষয়টি তো সবার জানা।
ভালোভাবে বিচার করে দেখলে বোঝা যাবে যে, বিন লাদেনের নিহত হওয়া একটি নিছক ঘটনা মাত্র। এর অর্থ এই নয় যে, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান এবং এই অঞ্চলের ওপর থেকে জঙ্গিবাদী ভূত নেমে যাবে, তা কিন্তু নয়। ওসামার মৃত্যুর সঙ্গে ১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট জেনারেল জিয়াউল হকের রহস্যময় মৃত্যুর একটি সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। তখনও জিয়া মারা যেতে পারে তা বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। জিয়াউল হকের মৃত্যুর পর যেমন আমাদের তাকে নিয়ে আরও অনেক দিন বাস করতে হয়েছে, লাদেনের ক্ষেত্রেও অবস্থা একই রকম হবে। বস্তুত তথাকথিত জিহাদপন্থি মিডিয়া আউটলেটগুলো, অ্যাঙ্কররা ও ভাষ্যকাররা এটাকে একটি বড় ধরনের ষড়যন্ত্র আখ্যায়িত করে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করতে দেরি করবে না।
এমন অনেকেই আছেন যারা এ ঘটনার বিবরণ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করবেন। আর অন্যরা তো রাজধানীর সনি্নকটে মার্কিন সামরিক অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করে দিয়েছেন। এ ধরনের এক সাংবাদিককে যখন আমি ইসলামাবাদের একেবারে কাছে বিন লাদেনের অবস্থানের ফলে আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে_ এ ধরনের প্রশ্ন করা বিশ্বাসযোগ্য হবে বলি, তখন তিনি আমার প্রতি অশোভন আচরণ করতে দ্বিধা করেননি।
মিডিয়ার এ ধরনের প্রচারণা প্রতিরক্ষা এস্টাবলিশমেন্টকে অভ্যন্তরীণভাবে সম্ভাব্য যে কোনো ক্ষতিকারক চাপ থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে তাড়িত হতে পারে। পাকিস্তানে বিন লাদেনের অবস্থানের বিষয়টি সবসময় আইএসআই অস্বীকার করে আসছিল। বস্তুত বিন লাদেন যেখানে বসবাস করে আসছিল সেটি একটি সেনা শহর এবং বাড়িটি আবার প্রধান সামরিক একাডেমীর একেবারে কাছাকাছি। এর ফলে আল কায়দা এবং পাকিস্তানের সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের মধ্যে কোনোরকম সহযোগিতার সম্পর্ক ছিল না তা বলা যাবে না। আইএসআই যেখানে সবার হাঁড়ির খবর পর্যন্ত রাখে, সেখানে তারা বিন লাদেনের অবস্থান সম্পর্কে জানত না এটা কেমন করে সম্ভব হতে পারে? আইএসআইর কিছু পাঁজি লোক আল কায়দা প্রধানকে সহায়তা করে থাকতে পারে মর্মে সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল আতহার আব্বাস কিছু গল্প না ফাঁদতে পারলে দেশে সন্দেহ আরও বেশি করে দেখা দেবে। প্রধান ধারার মিডিয়ার সঙ্গে তার পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ভালো যোগাযোগ রয়েছে।
তবে জিয়ার সঙ্গে যে যুগ শুরু হয়েছিল তা লাদেনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আবশ্যিকভাবে শেষ হয়ে যাবে না। আশির দিকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য জিয়া যে সন্ত্রাসবাদী মেশিন গড়ে তোলেন, লাদেন ছিলেন তারই অংশ। পাকিস্তান এবং এই অঞ্চলকে জিয়াউল হকের মতো লাদেনের ভূতের সঙ্গেও অনেক দিন বসবাস করতে হবে। জিয়া এবং লাদেনের ছেলেরা সংখ্যায় অনেক।
মার্কিন সামরিক বাহিনী যখন বিন লাদেনকে খতম করে ততদিনে তিনি আল কায়দার প্রতীক ফিগারে পরিণত হয়েছিলেন। সাংগঠনিক বিস্তারিত বিষয়ে তিনি নিশ্চয়ই একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। বিশেষত তার স্থানীয় সহযোগী সংগঠনের নাড়িনক্ষত্র তার জানা ছিল না। জইস-ই-মোহাম্মদ, হরকাত-উল-জিহাদ-উল-ইসলামী ও লস্কর-ই-তৈয়বার মতো আল কায়দার সহযোগী সংগঠনগুলোকে মোকাবেলা করা সহজ নয়। কারণ, এসব সংগঠনের স্থানীয় জনগণের মধ্যে গভীর সামাজিক ভিত্তি রয়েছে। আল কায়দার সহযোগী সংগঠনগুলো বিন লাদেনের হত্যার ঘটনায় কীভাবে পাল্টা আঘাত হানে, তার জন্য আসছে দিনগুলো গুরুত্বপূর্ণ।

আয়েশা সিদ্দিকা : ইসলামাবাদভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে ভাষান্তরিত
 

No comments

Powered by Blogger.