শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ সময়ের দাবি by ড. নিয়াজ আহম্মেদ
সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি পাবলিক বিদ্যালয়ে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাসহ স্কুল-কলেজে অতিরিক্ত ফি আদায় এবং কোচিং-বাণিজ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হয়ে উঠেছে। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে একটু হোঁচট খেয়েছিল। এরপর পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয়।
ক্রমান্বয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সেশনজটমুক্ত হয়ে ওঠে। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও মাসের পর মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সংস্কৃতি থেকে আমরা অনেকটা মুক্ত হতে পেরেছিলাম। গর্ব করে বলতে পারি, গত তিন বছরে আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করি সেটি একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। কিন্তু হঠাৎ করে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আমাদের নাড়া দেয়। আধিপত্য বিস্তার কিংবা বিশাল অঙ্কের অর্থ ভাগ-বাটোয়ারার জন্য নয়, বরং ছোট ছোট তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো অশান্ত হচ্ছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ঘটনাগুলোকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। নয়তো তাদের অবস্থাও খারাপ হতে পারত। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা শেষ পর্যন্ত কতদূর গড়ায় তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
গত ১৬ ডিসেম্বর শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন ছাত্র দুর্বৃত্তদের দ্বারা নিহত হওয়ার পর ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে শান্ত হয়। ঘটনার প্রেক্ষাপট নিয়ে এখানে অনেক আলোচনা করা যায়; কিন্তু আমি তা না করে দুটি বিবৃতির মাধ্যমে পুরো ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি। এক. আমার মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা যতটা না যুক্তিনির্ভর, তার চেয়ে বেশি আবেগতাড়িত। বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদ্যাপনের সময় আমার মেধাবী শিক্ষার্থীদের চেতনার জায়গা খুবই ক্ষীণ দেখতে পাই। শুধু তাই নয়, জাতীয় সংকটময় মুহূর্ত মোকাবিলায় এখন আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাথা ঘামাতে দেখা যায় না। এখানেও তাদের চেতনার জায়গা ক্ষীণ। কিন্তু কখনো কখনো তাদের নিজেদের অসাবধানতার জন্য কোনো সমস্যা হলে তার দায়ভার যেন শতভাগ অন্যের। ভাঙচুর করা থেকে শুরু করে দুর্ব্যবহারের চরম পর্যায়ে পেঁৗছতে তারা একটুও পিছপা হয় না। দুই. প্রতিটি ঘটনায় কেউ কেউ ফায়দা লোটার চেষ্টা করে। কখনো সফল আবার কখনোবা ব্যর্থ। তবে তাদের মোকাবিলা করতে দারুণ বেগ পেতে হয়। পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা ও ধীশক্তিসম্পন্ন না হলে ফায়দা লোটার দল বেশি মাত্রায় সফল হয়। ফলে সামান্য বা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাজীবন দীর্ঘায়িত হয়। মা-বাবার কষ্টের পরিধি বেড়ে যায়। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই কুয়েট বন্ধ হয়েছে। এমনটি আমরা আশা করি না। অন্যায় ও অযৌক্তিক দাবির জন্যই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অচল অবস্থা তৈরির পাঁয়তারা চলছে। যেকোনো নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন দেওয়া এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা অন্যায় নয়। আমরাও তা করি। ব্যাংক অবরোধ করে, মানুষের স্বাধীনতাকে হস্তক্ষেপ করে যখন আন্দোলন করা হয় তখন তা কতটুকু যৌক্তিক, তা ভেবে দেখা উচিত। প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর কাছে এমনটা আমরা আশা করি না। তাদের রাজনৈতিক ইতিহাস অন্যান্য সংগঠনের চেয়ে একটু ভিন্ন।
চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র আমাদের কাছে হতাশাব্যঞ্জক। একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভাঙচুর করা হয়েছে, তা আমরা মেনে নিতে পারি না। এর চেয়েও নগণ্য ঘটনা আমরা লক্ষ করি বুয়েটে, যেখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা। বর্তমান প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের ধৈর্য ও সহনশীলতার ক্ষমতা এতটাই কমে গেছে যে তারা একে অন্যের মতামত পর্যন্ত সহ্য করতে পারে না। আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকের সঙ্গে বর্তমান সময়ের পার্থক্য এখানেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ দেখতে পাচ্ছি। হয়তো এ ধারণা ভুল হতে পারে। ভুল হলে সবার জন্যই মঙ্গল। আমাদের দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন তুলনামূলকভাবে ভালো করছে। এগুলো নির্দিষ্ট কিছু নিয়মনীতির আওতায়ও এসেছে। আমার ধারণা, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের বেশি করে আকৃষ্ট করার জন্যই পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছে, যাতে ঢাকার বাইরের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা আর পড়তে না যায়। বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারকদের ভেবে দেখা উচিত বলে মনে করি।
একজনের ভুলের জন্য অন্যজনের ক্ষমা চাওয়ার রেওয়াজ আমরা এখন রাষ্ট্রের উঁচু মহলেও লক্ষ করছি। আমাদের দারুণ পীড়া দেয়, যখন খোদ শিক্ষামন্ত্রী সাম্প্রতিক সময়ে মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের ঘটনায় ক্ষমা প্রদর্শন করেন। বাংলাদেশের বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে ঘটনাটিকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি। আপনারা হয়তো লক্ষ করবেন যে গ্রামগঞ্জের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানের জন্য এমনটি হচ্ছে, তা বলা সঙ্গত হবে না। গ্রামেগঞ্জে এখনো ভালোমানের বিদ্যালয় রয়েছে, কিন্তু মানুষের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতার জন্য শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর অত্যধিক চাপ পড়ছে। আবার শহরেও রয়েছে মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব। অভিভাবকরা ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁদের সন্তানদের পড়ানোর জন্য সঙ্গত কারণেই ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। ফলে তীব্র প্রতিযোগিতা হয়। স্কুলগুলোতে বাস্তবতার প্রেক্ষাপটেই বেশি করে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করানো হয়। ফলে প্রয়োজন হয় বাড়তি অবকাঠামো, বাড়তি শিক্ষক ও অন্যান্য জনবল। এগুলোর চাপ সামলাতে কর্তৃপক্ষ ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। আদায় করে ডোনেশনের নামে হাজার হাজার টাকা। অবকাঠামো এবং শিক্ষকদের নামে এ টাকা আদায় করা হলেও শিক্ষকদের পর্যাপ্ত বেতন দেওয়া হয় না। আমার ধারণা, অল্পসংখ্যক শিক্ষক সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বেতন-ভাতা পান। বাকিদের স্কুলের ফান্ড থেকে বেতন-ভাতাদি দেওয়া হয়। আবার অনেক বিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষকই সরকারের কাছ থেকে আদৌ বেতন-ভাতা পান না। এ রকম বাস্তবতায় শিক্ষকরা প্রাইভেট টিউশনি এবং কোচিং বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। সনাতন শিক্ষকতা পেশার পরিবর্তে অচিরেই গাড়ি-বাড়ির মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন এবং অনেকে হয়েও যান। আমরা যদি বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তন আনতে না পারি, তাহলে গাছের গোড়ায় পানি না ঢেলে মাথায় পানি ঢালায় যে অবস্থা হয়, তা-ই হবে। শিক্ষা ক্রমান্বয়ে পণ্যে পরিণত হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন আনয়নকল্পে আমাদের নজর দিতে হবে জনসংখ্যা অনুপাতে কতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রয়োজন, তার দিকে। আমরা যদি প্রতি ৩০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একটি করে ক্লাস রুম দাবি করি, সে ক্ষেত্রে আমার বিশ্বাস, ঢাকা শহরে আরো অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হবে। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সরকার কর্তৃক দেওয়া বেতনের আওতায় আনতে হবে, নইলে ডোনেশনের সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হতে পারব কি না সন্দেহ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে না চলার জন্যই ভর্তি বাণিজ্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে একশ্রেণীর লোক ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক হচ্ছে, আর অভিভাবকরা নিয়ত আর্থিক ক্ষতি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আমরা চাইব বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন। নইলে যত উদ্যোগই গ্রহণ করা হোক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা এবং ভর্তি ও কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com
গত ১৬ ডিসেম্বর শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন ছাত্র দুর্বৃত্তদের দ্বারা নিহত হওয়ার পর ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে শান্ত হয়। ঘটনার প্রেক্ষাপট নিয়ে এখানে অনেক আলোচনা করা যায়; কিন্তু আমি তা না করে দুটি বিবৃতির মাধ্যমে পুরো ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি। এক. আমার মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা যতটা না যুক্তিনির্ভর, তার চেয়ে বেশি আবেগতাড়িত। বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদ্যাপনের সময় আমার মেধাবী শিক্ষার্থীদের চেতনার জায়গা খুবই ক্ষীণ দেখতে পাই। শুধু তাই নয়, জাতীয় সংকটময় মুহূর্ত মোকাবিলায় এখন আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাথা ঘামাতে দেখা যায় না। এখানেও তাদের চেতনার জায়গা ক্ষীণ। কিন্তু কখনো কখনো তাদের নিজেদের অসাবধানতার জন্য কোনো সমস্যা হলে তার দায়ভার যেন শতভাগ অন্যের। ভাঙচুর করা থেকে শুরু করে দুর্ব্যবহারের চরম পর্যায়ে পেঁৗছতে তারা একটুও পিছপা হয় না। দুই. প্রতিটি ঘটনায় কেউ কেউ ফায়দা লোটার চেষ্টা করে। কখনো সফল আবার কখনোবা ব্যর্থ। তবে তাদের মোকাবিলা করতে দারুণ বেগ পেতে হয়। পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা ও ধীশক্তিসম্পন্ন না হলে ফায়দা লোটার দল বেশি মাত্রায় সফল হয়। ফলে সামান্য বা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাজীবন দীর্ঘায়িত হয়। মা-বাবার কষ্টের পরিধি বেড়ে যায়। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই কুয়েট বন্ধ হয়েছে। এমনটি আমরা আশা করি না। অন্যায় ও অযৌক্তিক দাবির জন্যই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অচল অবস্থা তৈরির পাঁয়তারা চলছে। যেকোনো নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন দেওয়া এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা অন্যায় নয়। আমরাও তা করি। ব্যাংক অবরোধ করে, মানুষের স্বাধীনতাকে হস্তক্ষেপ করে যখন আন্দোলন করা হয় তখন তা কতটুকু যৌক্তিক, তা ভেবে দেখা উচিত। প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর কাছে এমনটা আমরা আশা করি না। তাদের রাজনৈতিক ইতিহাস অন্যান্য সংগঠনের চেয়ে একটু ভিন্ন।
চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র আমাদের কাছে হতাশাব্যঞ্জক। একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভাঙচুর করা হয়েছে, তা আমরা মেনে নিতে পারি না। এর চেয়েও নগণ্য ঘটনা আমরা লক্ষ করি বুয়েটে, যেখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা। বর্তমান প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের ধৈর্য ও সহনশীলতার ক্ষমতা এতটাই কমে গেছে যে তারা একে অন্যের মতামত পর্যন্ত সহ্য করতে পারে না। আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকের সঙ্গে বর্তমান সময়ের পার্থক্য এখানেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ দেখতে পাচ্ছি। হয়তো এ ধারণা ভুল হতে পারে। ভুল হলে সবার জন্যই মঙ্গল। আমাদের দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন তুলনামূলকভাবে ভালো করছে। এগুলো নির্দিষ্ট কিছু নিয়মনীতির আওতায়ও এসেছে। আমার ধারণা, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের বেশি করে আকৃষ্ট করার জন্যই পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছে, যাতে ঢাকার বাইরের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা আর পড়তে না যায়। বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারকদের ভেবে দেখা উচিত বলে মনে করি।
একজনের ভুলের জন্য অন্যজনের ক্ষমা চাওয়ার রেওয়াজ আমরা এখন রাষ্ট্রের উঁচু মহলেও লক্ষ করছি। আমাদের দারুণ পীড়া দেয়, যখন খোদ শিক্ষামন্ত্রী সাম্প্রতিক সময়ে মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের ঘটনায় ক্ষমা প্রদর্শন করেন। বাংলাদেশের বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে ঘটনাটিকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি। আপনারা হয়তো লক্ষ করবেন যে গ্রামগঞ্জের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানের জন্য এমনটি হচ্ছে, তা বলা সঙ্গত হবে না। গ্রামেগঞ্জে এখনো ভালোমানের বিদ্যালয় রয়েছে, কিন্তু মানুষের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতার জন্য শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর অত্যধিক চাপ পড়ছে। আবার শহরেও রয়েছে মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব। অভিভাবকরা ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁদের সন্তানদের পড়ানোর জন্য সঙ্গত কারণেই ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। ফলে তীব্র প্রতিযোগিতা হয়। স্কুলগুলোতে বাস্তবতার প্রেক্ষাপটেই বেশি করে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করানো হয়। ফলে প্রয়োজন হয় বাড়তি অবকাঠামো, বাড়তি শিক্ষক ও অন্যান্য জনবল। এগুলোর চাপ সামলাতে কর্তৃপক্ষ ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। আদায় করে ডোনেশনের নামে হাজার হাজার টাকা। অবকাঠামো এবং শিক্ষকদের নামে এ টাকা আদায় করা হলেও শিক্ষকদের পর্যাপ্ত বেতন দেওয়া হয় না। আমার ধারণা, অল্পসংখ্যক শিক্ষক সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বেতন-ভাতা পান। বাকিদের স্কুলের ফান্ড থেকে বেতন-ভাতাদি দেওয়া হয়। আবার অনেক বিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষকই সরকারের কাছ থেকে আদৌ বেতন-ভাতা পান না। এ রকম বাস্তবতায় শিক্ষকরা প্রাইভেট টিউশনি এবং কোচিং বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। সনাতন শিক্ষকতা পেশার পরিবর্তে অচিরেই গাড়ি-বাড়ির মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন এবং অনেকে হয়েও যান। আমরা যদি বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তন আনতে না পারি, তাহলে গাছের গোড়ায় পানি না ঢেলে মাথায় পানি ঢালায় যে অবস্থা হয়, তা-ই হবে। শিক্ষা ক্রমান্বয়ে পণ্যে পরিণত হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন আনয়নকল্পে আমাদের নজর দিতে হবে জনসংখ্যা অনুপাতে কতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রয়োজন, তার দিকে। আমরা যদি প্রতি ৩০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একটি করে ক্লাস রুম দাবি করি, সে ক্ষেত্রে আমার বিশ্বাস, ঢাকা শহরে আরো অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হবে। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সরকার কর্তৃক দেওয়া বেতনের আওতায় আনতে হবে, নইলে ডোনেশনের সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হতে পারব কি না সন্দেহ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে না চলার জন্যই ভর্তি বাণিজ্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে একশ্রেণীর লোক ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক হচ্ছে, আর অভিভাবকরা নিয়ত আর্থিক ক্ষতি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আমরা চাইব বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন। নইলে যত উদ্যোগই গ্রহণ করা হোক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা এবং ভর্তি ও কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com
No comments