মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ তথ্যচিত্র by মানজারে হাসিন
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত ছবিগুলোর খোঁজ আমরা নানাভাবে পেয়েছি, পেয়েছি নানা মাধ্যম থেকে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশি নির্মাতাদের নির্মিত ছবিগুলোর কথা জানতাম আমরা। ওই নির্মাতাদের মধ্যে অন্যতম জহির রায়হান শহীদ হন ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে। বাকিরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের পরও বেঁচে ছিলেন।
জহির রায়হানের সঙ্গে দীর্ঘদিন প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে ছিলেন চিত্তবর্ধন নামের একজন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই মারা যান তিনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের কিছু অংশ শত্রুমুক্ত হতে শুরু করে ডিসেম্বরের শুরুর দিকে কিংবা নভেম্বরের শেষ দিকে। তখন উত্তরবঙ্গের দিকে একটি ক্যামেরা দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন জহির রায়হান। কথা ছিল, ওই দলটি ঢাকা অভিমুখে আসবে। আসার পথে তারা চেষ্টা করবে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যা, নির্যাতন, ধ্বংসযজ্ঞ এবং বাংলাদেশের বিজয় ফিল্মে ডকুমেন্ট করে রাখার। সম্ভবত অস্থায়ী সরকার যেদিন ঢাকায় আসে, তার তিন দিন বাদে ঢাকায় আসেন জহির রায়হান, একটি ক্যামেরা ইউনিট নিয়ে। ঢাকায় আসার পর জানতে পারেন, অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সার নিখোঁজ! তিনি বেরিয়ে পড়েন ভাইকে খোঁজার জন্য। ফলে তাঁর সঙ্গে যে আরেকটি ক্যামেরা দল ছিল, সেটি আর তেমনভাবে কাজ করতে পারেনি। একদিন জহির রায়হানও নিখোঁজ হলেন। এখন আমরা জানি, শহীদ হয়েছেন তিনি। চিত্তবর্ধন বাবু তা জানতে পেরে মুষড়ে পড়েন। ফলে ঢাকা ফেরার পথে ধারণ করা দৃশ্যাবলির যে নেগেটিভগুলো তাঁর কাছে ছিল, তা নিয়ে আর ঢাকায় আসেননি তিনি। জহির রায়হান, আলমগীর কবির এবং আরও কয়েকজন স্বাধীন চলচ্চিত্রনির্মাতা বাংলাদেশের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলেছিলেন। কিছু চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীরা তখন সেটা পছন্দ করেনি। বিষয়টি চিত্তবর্ধনের জানা ছিল। তখন হয়তো মনে করেছিলেন, তাঁদেরই কারও ষড়যন্ত্র ছিল জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার পেছনে। তাই তিনি তখন আর ঢাকায় না এসে কলকাতায় চলে যান। দুর্ভাগ্যক্রমে হূদেরাগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এভাবেই তাঁর কাছে থাকা দৃশ্য নেগেটিভগুলোর খোঁজ আর পাওয়া যায়নি। তবে জানা ছিল, তার আগে চারটি চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিল, তার মধ্যে একটি হলো স্টপ জেনোসাইড। বাকি তিনটি—আলমগীর কবিরের লিবারেশন ফাইটার, বাবুল চৌধুরীর ইনোসেন্ট মিলিয়ন, জহির রায়হানের স্টেট ইজ বর্ন তৈরি করা হয়েছিল বাংলাদেশ সরকারের প্রযোজনায়।
ওই সময়ই ভারতীয় ফিল্মস ডিভিশন নামের এক প্রতিষ্ঠান, যারা মূলত ছবি নির্মাণ করে সরকারি প্রযোজনায়, তাদের উদ্যোগে সাপ্তাহিক নিউজ বুলেটিনের মতো চলচ্চিত্র ফরম্যাটে নিউজ রিল নির্মাণ করা হয়েছিল কতগুলো। বেশ কিছু ছবিও তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতি সপ্তাহে একটি করে ছবি তৈরি করত প্রতিষ্ঠানটি। সবকিছুই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক। এ ছাড়া স্বাধীন কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয় তখন। এস সুকদেব নামের একজন স্বাধীন চলচ্চিত্রনির্মাতা ছিলেন। ভারতীয় ফিল্ম ডিভিশনে কাজ করতেন। গুণী নির্মাতা হিসেবেও সুনাম ছিল। সুকদেব এবং তপন ঘোষ নামের আরেকজন নির্মাতা একটা ছবি নির্মাণের কাজে হাত দেন, নাম—নাইন মান্থস টু ফ্রিডম, যেটি ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত নির্মিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে বিষয় ভিত্তিক সবচেয়ে সমন্বিত প্রামাণ্যচিত্র।
প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বাঙালিরা যখন আন্দোলন শুরু করে, তখন সেই বিষয়গুলো আস্তে আস্তে ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানের সংবাদমাধ্যম এবং টেলিভিশনগুলোকে কিছুটা আকৃষ্ট করতে শুরু করে। শুরু হয় কিছু কিছু টিভি রিপোর্টের মতো কাজ। তবে দু-একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা, যেমন-লিয়ার লেভিন, পরবর্তীকালে যাঁর ধারণ করা ফুটেজ নিয়ে মুক্তির গান চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়, তিনি কলকাতায় আসেন। প্রথম একটি ছবি তৈরি করেন জয় বাংলা নামে। যুক্তরাষ্ট্রে তা প্রদর্শিতও হয়। বিবিসি, সিবিসি, সিবিএস, গ্রেনাডা টেলিভিশন এবং এবিসির মতো আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেলগুলোও সে সময় অনেক ছবি তৈরি করেছে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় খালেদ মোশাররফ’স ওয়ার, কান্ট্রি মেড ফর ডিজাস্টার ছবিগুলোর মধ্যে। এগুলো আমরা জানতাম কমবেশি।
বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের হয়ে বিকল্পধারার চলচ্চিত্র উৎসব শুরু করি আমরা ১৯৮৮ সালে। তখন থেকেই আমাদের চেষ্টা ছিল, এই ছবিগুলোকে কী করে দর্শকের সামনে নিয়ে আসা যায়। তখনই উদ্যোগ নিয়েছিলাম দেশে-বিদেশে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলো সংগ্রহ করার ব্যাপারে। তারই ফলে ভারতীয় দূতাবাসের সহায়তায় নাইন মান্থস টু ফ্রিডম সংগ্রহ করে দেখিয়েছি আমরা। এ ছাড়া দেখিয়েছি ডেট লাইন বাংলাদেশ-এর মতো চলচ্চিত্র। ভারতীয় ফিল্মস ডিভিশনের কিছু ফুটেজও দেখিয়েছি আমরা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও কিছু ছবি সংগ্রহ করেছে। বিশেষ করে, আক্কু চৌধুরী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন তাতে। বিবিসির কিছু ফুটেজ সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। এভাবেই নানা জনের মারফতে ছবি সংগ্রহ করেছি আমরা। লন্ডনে রুহুল আমীন নামের একজন বাঙালি নির্মাতা আছেন, যিনি উদ্যোগ নিয়ে প্রবাসে বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ-বিষয়ক একটা ছবি তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। ফলে বিবিসি এবং অন্যান্য সংস্থায় কিছু গবেষণা করেছিলেন তার সুবাদে। তাঁর কাছ থেকেও অনেক ফুটেজ সংগ্রহ করেছি আমরা। কান্ট্রি মেড ফর ডিজাস্টার ছবিটি মূলত এসেছিল গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের কাছে। সেখান থেকে সংগ্রহ করি আমরা।
নাগিশা ওশিমা জাপানের মূলধারার চলচ্চিত্রের বাইরে ভিন্ন ধারার নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, প্রথাবিরুদ্ধ চলচ্চিত্রকার যাকে বলে। আমরা যেহেতু বিকল্পধারার চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করি, তাই চেষ্টা ছিল পৃথিবীর সমমনা চলচ্চিত্রনির্মাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার। নাগিশার সঙ্গে আমরা প্রথম কথা বলি বিকল্পধারার চলচ্চিত্র উৎসবের তৃতীয় আসরের আগে, ১৯৯৬ সালে। নাগিশাকে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তবে তাঁকে নিয়ে আসার জন্য ব্যয় করার মতো অর্থের জোগান না থাকায় শেষমেশ তা আর হয়ে ওঠেনি। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আলোকে নির্মিত তাঁর রাহমান: ফাদার অব দ্য বেঙ্গল এবং জয় বাংলা ছবিগুলো পাঠান। বিনিময়ে কেবল একটা সম্মানী দিতে হয়েছিল তাঁকে। জাপানের এনএইচকে চ্যানেলের জন্য নির্মিত ওই ছবিগুলো বাংলাদেশে দেখানো হবে জেনে খুব খুশি হয়েছিলেন নাগিশা।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠান মহাপরিচালক ফরিদুর রহমান আমাদের বিশেষ সহায়তা করেছেন। তিনি চলচ্চিত্রনির্মাতা। আমরা যখন বিকল্পধারার চলচ্চিত্র উৎসব শুরু করি, তখন বিটিভিতে টেলিসিনে নামের একটি যন্ত্র ছিল, যেখানে ফিল্ম ফরম্যাট থেকে ভিডিও ফরম্যাটে রূপান্তর করা যেত। ফরিদুর রহমান আমাদের উৎসবগুলোর সময় কতগুলো চলচ্চিত্রবিষয়ক অনুষ্ঠান করেন। সেগুলোর উপস্থাপক ছিলাম আমি। অনুষ্ঠানগুলো করার সুবাদে সেই সময় আমরা সুযোগ পেয়েছিলাম সংগৃহীত ছবিগুলো টেলিসিনে ব্যবহার করে ভিডিওতে রূপান্তর করার। তাতে করে নির্মাতা এবং বিভিন্ন আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত ছবিগুলো ভিডিওতে রূপান্তর করতে পেরেছিলাম আমরা। ১৯৯৬ সালে বিটিভিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে তিন পর্বের একটি অনুষ্ঠান হয়। সম্ভবত ১৯৭৫ সালের পর রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে সেই প্রথম ওই ধরনের অনুষ্ঠান হয়েছিল। তখনই প্রথম ধারাবাহিকভাবে দেখানো হয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একাধিক চলচ্চিত্র। দর্শকও তা দেখে ঔৎসুক্য প্রকাশ করে বিপুল পরিমাণে।
বাংলাদেশের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে বানানো হয়েছিল হাউ দি ইস্ট ওয়াজ ওন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ নাগরিক বানিয়েছিলেন সেটি। নতুন কিছু ফুটেজ দেখতে পেয়েছিলাম আমরা সেখানে। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী বীর বিক্রমও একটা তথ্য দিয়েছিলেন আমাদের। তিনি জানান, কুষ্টিয়াতে ফরাসি টিভি চ্যানেলের এক সাংবাদিক দল এসেছিল। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী কালের কিছু দৃশ্য ধারণ করেছিল তারা কুষ্টিয়াতে। ধারণা করা হয়, ফরাসি কোনো টিভিতে দেখানো হয়েছিল সেই ফুটেজগুলো। সিবিএস চ্যানেলেও প্রচুর ফুটেজ আছে। যোগাযোগ করে বিস্তারিত তথ্য জেনেছিলাম ফুটেজগুলো সম্পর্কে। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সংগঠন ছিল ‘একাত্তরের যাত্রী’ নামে, সেটি এখন আর সক্রিয় নেই। তারা একবার উদ্যোগ নিয়েছিল। আমিও তাতে যুক্ত থাকায় নতুন কিছু তথ্য পেয়েছিলাম।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, পূর্নাঙ্গ চলচ্চিত্র না হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় ধারণ করা অদেখা চলমান চিত্র পৃথিবীর নানা প্রান্তে রক্ষিত আছে যা আমাদের দেখা চিত্রাবলির চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি। এ ছাড়া জানা গেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কাছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ১৮টি স্বয়ংসম্পূর্ণ টিভি প্রতিবেদন। আছে নিউজ রিল। আমরা সেগুলো সংগ্রহ করতে পারিনি। বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন এর জন্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এটা চার-পাঁচ বছর আগের কথা, এক ফুট ফুটেজের জন্য গুনতে হয় ছয় ব্রিটিশ পাউন্ড। ১৬ মিলিমিটারে ধারণ করা এক ফুট ফুটেজের স্থিতি এক সেকেন্ডও নয়! ১০০ ফুট ফুটেজের স্থিতি হয় মোটে তিন মিনিটের মতো! রাষ্ট্রীয়ভাবে এগুলো সংগ্রহ করার ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি এ পর্যন্ত। বেসরকারিভাবেও হয়নি। অথচ এই ফুটেজগুলো আমাদের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে মহামূল্যবান সম্পদ। এর মাধ্যমে আমরা মুক্তিযুদ্ধের আগের ও পরের অবস্থার বস্তুনিষ্ঠ ধারণা পেতে পারি। আমরা যখন ৪০ বছর পর সেই সময়ের চলচ্চিত্রগুলো দেখি, তখন সেই সময়টাকে উপলব্ধি করতে চাই। নতুন করে ইতিহাস-চেতনা পেতে চাই। এ ছাড়া অনেক সময় এই ফুটেজগুলো যথেচ্ছ এবং অপ্রাসঙ্গিকভাবে ব্যবহূত হচ্ছে। তাতে করে এই ছবিগুলোর ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব হারাতে বসেছে! এর ফলে ইতিহাস সম্পর্কে একটা ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হচ্ছে, ফুটেজগুলো তার আবেগ এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনের গুরুত্ব হারাতে বসেছে যা একজন সচেতন বাঙালির কাছে কাম্য নয়।
একটা বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে রেখে ছবি বা সংবাদচিত্রগুলো তৈরি হয়েছিল। তাই সেই বিষয় পুনরাবিষ্কারের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে চাইলে সচেতনতা জরুরি।
এ ছাড়া এই ছবিগুলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে মেরামত করে নতুন মানের ছবি সংরক্ষণ এবং প্রদর্শনও বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংস্থাগুলো এবং আগ্রহী ব্যাক্তিদের এগিয়ে আসা উচিত। একে বড় ভূমিকা রাখতে পারে প্রচারমাধ্যমগুলো।
নাগিশা ওশিমা
জাপানি এই পরিচালক ও চিত্রনাট্যকারের জন্ম ৩১ মার্চ ১৯৩২, জাপানের কিয়োটোতে। প্রথাবিরোধী চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সুপরিচিত। উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে একটি হলো মেরি ক্রিস্টমাস, মি. লরেন্স। ১৯৮৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল ছবিটি। কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ হতেই ডাক আসে শোচিকু লিমিটেড নামের এক চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থেকে। সেই থেকে শুরু ছবি নির্মান। প্রথম ছবি আ টাউন অব লাভ অ্যান্ড হোপ (১৯৫৯)। নির্মাতা হিসেবে পেয়েছেন ব্লু রিবন, কিনেমা জুনপো অ্যাওয়ার্ড এবং কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা নির্মাতার সম্মাননা।
অনুলিখন: মাহফুজ রহমান
ওই সময়ই ভারতীয় ফিল্মস ডিভিশন নামের এক প্রতিষ্ঠান, যারা মূলত ছবি নির্মাণ করে সরকারি প্রযোজনায়, তাদের উদ্যোগে সাপ্তাহিক নিউজ বুলেটিনের মতো চলচ্চিত্র ফরম্যাটে নিউজ রিল নির্মাণ করা হয়েছিল কতগুলো। বেশ কিছু ছবিও তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতি সপ্তাহে একটি করে ছবি তৈরি করত প্রতিষ্ঠানটি। সবকিছুই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক। এ ছাড়া স্বাধীন কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয় তখন। এস সুকদেব নামের একজন স্বাধীন চলচ্চিত্রনির্মাতা ছিলেন। ভারতীয় ফিল্ম ডিভিশনে কাজ করতেন। গুণী নির্মাতা হিসেবেও সুনাম ছিল। সুকদেব এবং তপন ঘোষ নামের আরেকজন নির্মাতা একটা ছবি নির্মাণের কাজে হাত দেন, নাম—নাইন মান্থস টু ফ্রিডম, যেটি ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত নির্মিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে বিষয় ভিত্তিক সবচেয়ে সমন্বিত প্রামাণ্যচিত্র।
প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বাঙালিরা যখন আন্দোলন শুরু করে, তখন সেই বিষয়গুলো আস্তে আস্তে ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানের সংবাদমাধ্যম এবং টেলিভিশনগুলোকে কিছুটা আকৃষ্ট করতে শুরু করে। শুরু হয় কিছু কিছু টিভি রিপোর্টের মতো কাজ। তবে দু-একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা, যেমন-লিয়ার লেভিন, পরবর্তীকালে যাঁর ধারণ করা ফুটেজ নিয়ে মুক্তির গান চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়, তিনি কলকাতায় আসেন। প্রথম একটি ছবি তৈরি করেন জয় বাংলা নামে। যুক্তরাষ্ট্রে তা প্রদর্শিতও হয়। বিবিসি, সিবিসি, সিবিএস, গ্রেনাডা টেলিভিশন এবং এবিসির মতো আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেলগুলোও সে সময় অনেক ছবি তৈরি করেছে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় খালেদ মোশাররফ’স ওয়ার, কান্ট্রি মেড ফর ডিজাস্টার ছবিগুলোর মধ্যে। এগুলো আমরা জানতাম কমবেশি।
বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের হয়ে বিকল্পধারার চলচ্চিত্র উৎসব শুরু করি আমরা ১৯৮৮ সালে। তখন থেকেই আমাদের চেষ্টা ছিল, এই ছবিগুলোকে কী করে দর্শকের সামনে নিয়ে আসা যায়। তখনই উদ্যোগ নিয়েছিলাম দেশে-বিদেশে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলো সংগ্রহ করার ব্যাপারে। তারই ফলে ভারতীয় দূতাবাসের সহায়তায় নাইন মান্থস টু ফ্রিডম সংগ্রহ করে দেখিয়েছি আমরা। এ ছাড়া দেখিয়েছি ডেট লাইন বাংলাদেশ-এর মতো চলচ্চিত্র। ভারতীয় ফিল্মস ডিভিশনের কিছু ফুটেজও দেখিয়েছি আমরা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও কিছু ছবি সংগ্রহ করেছে। বিশেষ করে, আক্কু চৌধুরী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন তাতে। বিবিসির কিছু ফুটেজ সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। এভাবেই নানা জনের মারফতে ছবি সংগ্রহ করেছি আমরা। লন্ডনে রুহুল আমীন নামের একজন বাঙালি নির্মাতা আছেন, যিনি উদ্যোগ নিয়ে প্রবাসে বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ-বিষয়ক একটা ছবি তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। ফলে বিবিসি এবং অন্যান্য সংস্থায় কিছু গবেষণা করেছিলেন তার সুবাদে। তাঁর কাছ থেকেও অনেক ফুটেজ সংগ্রহ করেছি আমরা। কান্ট্রি মেড ফর ডিজাস্টার ছবিটি মূলত এসেছিল গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের কাছে। সেখান থেকে সংগ্রহ করি আমরা।
নাগিশা ওশিমা জাপানের মূলধারার চলচ্চিত্রের বাইরে ভিন্ন ধারার নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, প্রথাবিরুদ্ধ চলচ্চিত্রকার যাকে বলে। আমরা যেহেতু বিকল্পধারার চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করি, তাই চেষ্টা ছিল পৃথিবীর সমমনা চলচ্চিত্রনির্মাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার। নাগিশার সঙ্গে আমরা প্রথম কথা বলি বিকল্পধারার চলচ্চিত্র উৎসবের তৃতীয় আসরের আগে, ১৯৯৬ সালে। নাগিশাকে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তবে তাঁকে নিয়ে আসার জন্য ব্যয় করার মতো অর্থের জোগান না থাকায় শেষমেশ তা আর হয়ে ওঠেনি। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আলোকে নির্মিত তাঁর রাহমান: ফাদার অব দ্য বেঙ্গল এবং জয় বাংলা ছবিগুলো পাঠান। বিনিময়ে কেবল একটা সম্মানী দিতে হয়েছিল তাঁকে। জাপানের এনএইচকে চ্যানেলের জন্য নির্মিত ওই ছবিগুলো বাংলাদেশে দেখানো হবে জেনে খুব খুশি হয়েছিলেন নাগিশা।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠান মহাপরিচালক ফরিদুর রহমান আমাদের বিশেষ সহায়তা করেছেন। তিনি চলচ্চিত্রনির্মাতা। আমরা যখন বিকল্পধারার চলচ্চিত্র উৎসব শুরু করি, তখন বিটিভিতে টেলিসিনে নামের একটি যন্ত্র ছিল, যেখানে ফিল্ম ফরম্যাট থেকে ভিডিও ফরম্যাটে রূপান্তর করা যেত। ফরিদুর রহমান আমাদের উৎসবগুলোর সময় কতগুলো চলচ্চিত্রবিষয়ক অনুষ্ঠান করেন। সেগুলোর উপস্থাপক ছিলাম আমি। অনুষ্ঠানগুলো করার সুবাদে সেই সময় আমরা সুযোগ পেয়েছিলাম সংগৃহীত ছবিগুলো টেলিসিনে ব্যবহার করে ভিডিওতে রূপান্তর করার। তাতে করে নির্মাতা এবং বিভিন্ন আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত ছবিগুলো ভিডিওতে রূপান্তর করতে পেরেছিলাম আমরা। ১৯৯৬ সালে বিটিভিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে তিন পর্বের একটি অনুষ্ঠান হয়। সম্ভবত ১৯৭৫ সালের পর রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে সেই প্রথম ওই ধরনের অনুষ্ঠান হয়েছিল। তখনই প্রথম ধারাবাহিকভাবে দেখানো হয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একাধিক চলচ্চিত্র। দর্শকও তা দেখে ঔৎসুক্য প্রকাশ করে বিপুল পরিমাণে।
বাংলাদেশের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে বানানো হয়েছিল হাউ দি ইস্ট ওয়াজ ওন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ নাগরিক বানিয়েছিলেন সেটি। নতুন কিছু ফুটেজ দেখতে পেয়েছিলাম আমরা সেখানে। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী বীর বিক্রমও একটা তথ্য দিয়েছিলেন আমাদের। তিনি জানান, কুষ্টিয়াতে ফরাসি টিভি চ্যানেলের এক সাংবাদিক দল এসেছিল। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী কালের কিছু দৃশ্য ধারণ করেছিল তারা কুষ্টিয়াতে। ধারণা করা হয়, ফরাসি কোনো টিভিতে দেখানো হয়েছিল সেই ফুটেজগুলো। সিবিএস চ্যানেলেও প্রচুর ফুটেজ আছে। যোগাযোগ করে বিস্তারিত তথ্য জেনেছিলাম ফুটেজগুলো সম্পর্কে। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সংগঠন ছিল ‘একাত্তরের যাত্রী’ নামে, সেটি এখন আর সক্রিয় নেই। তারা একবার উদ্যোগ নিয়েছিল। আমিও তাতে যুক্ত থাকায় নতুন কিছু তথ্য পেয়েছিলাম।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, পূর্নাঙ্গ চলচ্চিত্র না হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় ধারণ করা অদেখা চলমান চিত্র পৃথিবীর নানা প্রান্তে রক্ষিত আছে যা আমাদের দেখা চিত্রাবলির চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি। এ ছাড়া জানা গেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কাছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ১৮টি স্বয়ংসম্পূর্ণ টিভি প্রতিবেদন। আছে নিউজ রিল। আমরা সেগুলো সংগ্রহ করতে পারিনি। বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন এর জন্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এটা চার-পাঁচ বছর আগের কথা, এক ফুট ফুটেজের জন্য গুনতে হয় ছয় ব্রিটিশ পাউন্ড। ১৬ মিলিমিটারে ধারণ করা এক ফুট ফুটেজের স্থিতি এক সেকেন্ডও নয়! ১০০ ফুট ফুটেজের স্থিতি হয় মোটে তিন মিনিটের মতো! রাষ্ট্রীয়ভাবে এগুলো সংগ্রহ করার ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি এ পর্যন্ত। বেসরকারিভাবেও হয়নি। অথচ এই ফুটেজগুলো আমাদের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে মহামূল্যবান সম্পদ। এর মাধ্যমে আমরা মুক্তিযুদ্ধের আগের ও পরের অবস্থার বস্তুনিষ্ঠ ধারণা পেতে পারি। আমরা যখন ৪০ বছর পর সেই সময়ের চলচ্চিত্রগুলো দেখি, তখন সেই সময়টাকে উপলব্ধি করতে চাই। নতুন করে ইতিহাস-চেতনা পেতে চাই। এ ছাড়া অনেক সময় এই ফুটেজগুলো যথেচ্ছ এবং অপ্রাসঙ্গিকভাবে ব্যবহূত হচ্ছে। তাতে করে এই ছবিগুলোর ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব হারাতে বসেছে! এর ফলে ইতিহাস সম্পর্কে একটা ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হচ্ছে, ফুটেজগুলো তার আবেগ এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনের গুরুত্ব হারাতে বসেছে যা একজন সচেতন বাঙালির কাছে কাম্য নয়।
একটা বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে রেখে ছবি বা সংবাদচিত্রগুলো তৈরি হয়েছিল। তাই সেই বিষয় পুনরাবিষ্কারের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে চাইলে সচেতনতা জরুরি।
এ ছাড়া এই ছবিগুলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে মেরামত করে নতুন মানের ছবি সংরক্ষণ এবং প্রদর্শনও বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংস্থাগুলো এবং আগ্রহী ব্যাক্তিদের এগিয়ে আসা উচিত। একে বড় ভূমিকা রাখতে পারে প্রচারমাধ্যমগুলো।
নাগিশা ওশিমা
জাপানি এই পরিচালক ও চিত্রনাট্যকারের জন্ম ৩১ মার্চ ১৯৩২, জাপানের কিয়োটোতে। প্রথাবিরোধী চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সুপরিচিত। উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে একটি হলো মেরি ক্রিস্টমাস, মি. লরেন্স। ১৯৮৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল ছবিটি। কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ হতেই ডাক আসে শোচিকু লিমিটেড নামের এক চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থেকে। সেই থেকে শুরু ছবি নির্মান। প্রথম ছবি আ টাউন অব লাভ অ্যান্ড হোপ (১৯৫৯)। নির্মাতা হিসেবে পেয়েছেন ব্লু রিবন, কিনেমা জুনপো অ্যাওয়ার্ড এবং কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা নির্মাতার সম্মাননা।
অনুলিখন: মাহফুজ রহমান
No comments