কমিউনিস্ট আন্দোলন কোন্্ পথে? by কামরম্নল হাসান
ভারতের বর্তমান পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ধারায় কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ এবং কঠিন। বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কারণে বিভিন্ন রাজ্যের ছোট দল এবং বৃহৎ দুই রাজনৈতিক শিবিরের আধিপত্য দেশটির রাজনীতিক অঙ্গনে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকাকে আরও মুখ্য করে তুলেছে।
গত বছরের ১৫তম লোকসভা নির্বাচনে এই সম্ভাবনা তীব্রভাবে দেখা যায়। স্বাভাবিকভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যগুলোর অন্যতম ইসু্য। তবে এর পাশাপাশি রাজ্যগুলোতে ছোট দলগুলোর প্রভাব প্রতীয়মান। এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরম্নদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টি এবং জয়ললিতার তৃতীয় ফ্রন্ট গঠন নির্বাচনপূর্ব ভারতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। নির্বাচনপূর্ব বিভিন্ন জরিপের ফলাফলেও দেখা যায় এই ফ্রন্ট সরকার গঠনে অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। পাশাপাশি তৃতীয় ফ্রন্ট এ ব্যাপারে আরও পরিষ্কার ধারণা দেয়_ দরকার পড়লে তারা বিজেপি'কে ঠেকাতে কংগ্রেসকেও সমর্থন দিতে প্রস্তুত। কিন্তু নির্বাচনে এই তৃতীয় ফ্রন্টের ভরাডুবি সত্যিই বিস্ময়কর। পার্টির পলিট বু্যরোর সদস্যদের পাশাপাশি দলটির অসংখ্য তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কমর্ীর কাছেও ব্যাপারটি অত্যনত্ম অস্বসত্মির। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এক বিশেস্নষক জানান, দলটির গ্রহণযোগ্যতা এবং কার্যক্রম এখনও বৃহৎ এই রাষ্ট্রের অনেক রাজ্যে একেবারেই নগণ্য। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ কিংবা কেরালার শাসনভার নিয়েও পার্টি এখন ব্যাপক উদ্বিগ্ন। লোকসভা নির্বাচনে এই দুই রাজ্যের ফলাফল অত্যনত্ম নাজুক। পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরালা এই দুই রাজ্যের শাসক দল কংগ্রেস এবং তাদের জোট ব্যাপকহারে ধস নামায় কমিউনিস্ট প্রাথর্ীদের। অন্যদিকে ভারত-মার্কিন পরমাণু ইসু্য এবং নন্দীগ্রামের মতো ঘটনাও দলটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে দেশের আপামর জনগণের কাছে। দীর্ঘ ৩২ বছরের শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিনিয়োগে মন্দা পরিস্থিতি এবং আর্থ-সামাজিক দুর্দশাও এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে মনে করছেন অনেকেই।ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের শুরম্ন মূলত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে। ব্রিটিশ ভারতের বাইরে তাসখন্দে সর্বপ্রথম কমিউনিস্ট পার্টি গঠন শুরম্ন হয়। তখন পার্টির অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন এম এন রায়। কিন্তু রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে গুপ্ত এই সংগঠনটি পরবতর্ীতে নিষিদ্ধ করা হয় এবং তাদের কার্যক্রমের সমাপ্তি ঘটে সেখানেই। পরবর্তীতে ভারত উপমহাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান সংগঠক ছিলেন চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে জন্ম নেয়া মহান বিপস্নবী মুজফ্ফর আহমেদ।
এর পাশাপাশি আরও যেসব নেতার নাম পাওয়া যায় তাঁরা হলেন আব্দুল হালিম, সোমনাথ লাহিড়ী, নৃপেন চক্রবতর্ী, বঙ্কিম মুখার্জি, আব্দুলস্নাহ রসুল, রণেন সেন। পূর্ববাংলার জেলাগুলোতে তখন কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রম ছিল ব্যাপক হারে। পার্টি তখন ছিল প্রধানত শ্রেণী সংগঠন ও পলিটিক্যাল গ্রম্নপ এবং ব্রিটিশ বিরোধিতার কারণে পার্টি ছিল তখন নিষিদ্ধ এবং নেতারা ব্যসত্ম ছিলেন আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্সে। বাংলায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রধান অঞ্চল ছিল জলপাইগুড়ি। ১৯২৫-এ জলপাইগুড়িতে প্রাদেশিক সম্মিলন হয়েছিল, যা কিনা মোটেও কংগ্রেস অধিবেশন ছিল না। সেই সম্মেলনে মহাত্মা গান্ধী ও সুভাষচন্দ্র গিয়েছিলেন। সেই সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র প্রথম প্রসত্মাব দিয়েছিলেন ব্রিটিশদের ছ' মাসের আলটিমেটাম দেয়া হোক। যদি তারা এর মধ্যে এ দেশ ছেড়ে না যায় তাহলে সারাদেশে আন্দোলন হবে। গান্ধীজি এর পৰে ছিলেন না। সুভাষের প্রসত্মাব হেরে গেল। ১৯৩৯-এ সুভাষচন্দ্র দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হলেন গান্ধীজির প্রাথর্ী পট্টভি সীতারামাইয়াকে হারিয়ে। গান্ধীজি নেতাজী সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস থেকে তাড়িয়ে ছাড়লেন। জলপাইগুড়ির কথা এখানে উলেস্নখ করা হয়েছে মূলত অঞ্চলটির গুরম্নত্ব অনুধাবনের লৰ্যে। বাঙালী মধ্যবিত্তের বেশ কিছু সৎ প্রত্যাশা ছিল এই শহরের কমিউনিস্ট নেতাকমর্ীদের থেকে।
দি গ্রেট সন অব বেঙ্গল জ্যোতি বসু বাঙালী মধ্যবিত্তের মধ্যে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে গ্রহণযোগ্য মর্যাদায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আইনসভায় প্রথম কমিউনিস্ট ছিলেন বঙ্কিম মুখাজর্ী। তখন অবশ্য পার্টিকে কংগ্রেসের ছাতার নিচেয় কাজ করতে হতো। ১৯৪১ সালে কংগ্রেস এই ব্যবস্থা নিষিদ্ধ করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতিতে পার্টির কার্যক্রম ছিল মূলত দলকেন্দ্রিক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তখন ভাটা পড়ে যুদ্ধে সোভিয়েত এবং ব্রিটিশদের সখ্যর কারণে। তৎকালীন এই পরিস্থিতি অবশ্যই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক ভুল, যেমনটি পার্টি করেছিল ১৯৯৬ সালে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নেহরম্ন কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেন। ১৯৫০-এ কমিউনিস্ট পার্টির নিষেধাজ্ঞা মুক্ত হওয়ার পর পার্টি নতুন করে তাদের কার্যক্রম শুরম্ন করে। সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে তখন নাম্বুদিরিপাদ এবং এসএ ডাংগেও ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। অন্যদিকে বাংলার আইনসভায় পার্টির নেতা ছিলেন জ্যোতি বাবু। ভারতের স্বাধীনতাউত্তর সময়ে সর্বপ্রথম নন কংগ্রেস সরকার ছিল কেরালায়। কিন্তু ১৯৫৯ সালে সরকার রাজ্যটির নাম্বুদিরিপাদ কেবিনেটকে বরখাসত্ম করে সেখানে প্রেসিডেন্সিয়াল রম্নল জারি করে। কমিউনিস্ট পার্টির আনত্মর্জাতিক সম্মেলনে চীন-রাশিয়াপন্থী কমিউনিস্টদের দ্বন্দ্বে ১৯৬৪ সালে জন্ম হয় সিপিআই (এম)-এর। কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া সিপিআই ভেঙ্গেই নতুন এই দলের সৃষ্টি।
১৯৬৭ সালের লোকসভা এবং রাজ্যসভা নির্বাচনে সিপিআই (এম) রাজ্য দু'টিতে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবিভর্ূত হয়। কেরালায় ইউনাইটেড ফ্রন্ট নাম্বুদিরিপাদের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার গঠনেও দলটি প্রধান ভূমিকা পালন করে। একই বছর কৃষক বিদ্রোহের কারণে নকশালবাড়ির আন্দোলন। চারম্ন মজুমদার এবং কানু সান্যাল ছিলেন এই আন্দোলনের প্রধান তাত্তি্বক নেতা। এই আন্দোলন দেশজুড়ে নতুন করে ভাঙ্গনের সৃষ্টি করে দলটিতে। ১৯৭৭ সালে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে বাম ফ্রন্ট প্রথম সরকার গঠন করে এবং আজ অবধি তারা সেখানে ৰমতাসীন।
ভারতের মতো একটি বৃহৎ রাষ্ট্রে এই পার্টির অন্যতম ভূমিকা হলো পার্টির অসাম্প্রদায়িক নীতি। এছাড়া ভূমি সংস্কার এই পার্টির অন্যতম প্রধান অবদান। ভূমি সংস্কারের ফলে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গে ২৫ লাখ ভূমিহীন প্রানত্মিক কৃষক চাষাবাদের জন্য জমি পায়। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের আরেকটি উদাহরণ হলো পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। দারিদ্র্যপীড়িত এই বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশে অসাম্প্রদায়িক এই পার্টি অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ। ভারতের নব্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ভূমিহীন, দারিদ্র্যকিষ্ট মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে সোচ্চার এই রাজনৈতিক দলটি যদি দেশজুড়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে নিকট ভবিষ্যতে হয়ত প্রধান তিন রাজ্যেও (কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা) তারা ব্যর্থ হবে সরকার প্রতিষ্ঠা করতে।
No comments