বাঘ বেঘোরে মারা যাচ্ছে! by মিজানুর রহমান
সাতীরা খাবারের সন্ধানে বা সঙ্গিনীর খোঁজে লোকালয়ে আসা সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারগুলো আর জীবন নিয়ে বনে ফিরে যেতে পারে না। মানুষের হাতে ওদের মৃতু্য নিশ্চিত। পিটিয়ে আর ফাঁস লাগিয়ে ওদের হত্যা করা হয়।
সুন্দরবনের শুধুমাত্র সাতীরা রেঞ্জেই গত ১১ বছরে ৭টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার গ্রামবাসীর হাতে মারা পড়েছে। এর মধ্যে একটিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বাকি ৫টি বাঘ হত্যা করা হয় গণপিটুনিতে ও ফাঁস লাগিয়ে। একটি মারা যায় চিকিৎসাধীন অবস্থায়। বন বিভাগের দায়িত্বে অবহেলা ও চেতনানাশক পদ্ধতি ব্যবহারের যন্ত্রপাতি ও অভিজ্ঞ লোকবল না থাকায় লোকালয়ে আসা বেশিরভাগ বাঘই জনগণের হাতে প্রাণ হারাচ্ছে। সর্বশেষ শুক্রবার চ-ীপুরে গ্রামবাসী টানা ১২ ঘণ্টা বন বিভাগের কর্মতৎপরতা দেখার জন্য অপো করেও বাঘটিকে অজ্ঞান করার কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় নিরাপত্তার স্বার্থে বাঘটিকে পিটিয়ে হত্যা করে। ২০১০ সালকে ইউনেস্কোর আনত্মর্জাতিক প্রণীবৈচিত্র বর্ষ ঘোষণা সঙ্গে বাংলাদেশ স্বারকারী দেশ হলেও শুক্রবার লোকালয়ে আসা বাঘটিকে বনবিভাগ রা করতে ব্যর্থ হয়েছে।সুন্দরবনে বর্তমানে বাঘের সংখ্যা কত এর পরিসংখ্যান নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। ২০০৬ সালের জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচীর হিসাবে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪শ' ৪২টি। আবার ব্রিটিশ জিওলজিক্যাল সোসাইটির সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ২শ' ৫০টি। তবে সুন্দরবনে বাঘ ও বন্যপ্রাণী নিয়ে গবেষণা করছেন এমন কিছু বেসরকারী সংস্থার মতে সুন্দরবনে প্রতিবছর বাঘ হত্যার ঘটনা বাড়ছে। চোরা শিকারীর পাশাপাশি লোকালয়ে চলে আসা বাঘগুলো গ্রামবাসীদের হাতে অঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে।
গত ১১ বছরে লোকালয়ে চলে আসা যে বাঘগুলো মারা পড়েছে এর মধ্যে সাতীরার শ্যামনগর উপজেলায় ৫টি বাঘ পিটিয়ে ও ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করা হয়। একটি বাঘকে হত্যা করা হয় গুলি করে। কয়রা উপজেলায় ১টি বাঘ মারা যায়। এছাড়া লোকালয়ে প্রবেশ করা একটি বাঘ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। এ সময় বাঘের আক্রমণে ৬ জন নারী পুরম্নষ নিহত হয়। তবে উপকূলীয় গ্রামবাসী শুধু বাঘ হত্যা করে তা নয়। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দু'টি বাঘ সুন্দরবনে ফিরে যেতে সহায়তা করে। ২০০৮ সালের ২২ জুন সন্ধ্যায় একটি বাঘ শ্যামনগরের লোকালয়ে প্রবেশের চেষ্টা করলে গ্রামবাসী বাজি ফুটিয়ে ও চিৎকার শুরম্ন করলে বাঘটি বনে ফিরে যায়। ২০০১ সালের ২৩ এপ্রিল সুন্দরবনের নদী পার হয়ে একটি বাঘ দাতনেখালী গ্রামে ঢুকে পড়লে গ্রামবাসী বাজি ও টিনের শব্দ করে বাঘটিকে সুন্দরবনে ফিরে যেতে বাধ্য করে।
২২ জানুয়ারি সুন্দরবনের চুনানদী পার হয়ে চ-ীপুর গ্রামে ঢুকেপড়া বাঘটি জনগণের সর্বশেষ শিকার। নিরাপত্তার স্বার্থে গ্রামবাসী পিটিয়ে হত্যা করেছে বাঘটি। চামড়া ছাড়িয়ে বাঘটিকে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে বনের মধ্যে। এর আগে গতবছর ২ জুন চুনা নদী পার হয়ে সুন্দরবনের একটি বাঘ শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের মধ্য খলিষাবুনিয়া গ্রামে ঢুকে পড়ে। এই বাঘের আক্রমণে ৩ গ্রামবাসী আহত হয়। ঘটনার পর ুব্ধ গ্রামবাসী বাঘটির গলায় ফাঁস দিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে। ২০০৮ সালের ২০ জুন শ্যামনগরের দণি কদমতলা এলাকায় ঢুকেপড়া বাঘের আক্রমণে এক গৃহবধূসহ ৩ জন নিহত হয়। পর দিন ২১ জুন প্তি গ্রামবাসী বাঘটি পিটিয়ে ও ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করে। ২০০৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের নদী পার হয়ে একটি বাঘ কয়রা উপজেলার নলিয়ান এলাকায় প্রবেশ করলে গ্রামবাসী বাঘটি পিটিয়ে হত্যা করে। ২০০৬ সালের ১২ ডিসেম্বর শ্যামনগরের হরিনগর গ্রামে বাঘের আক্রমণে ৩ জন হতাহত হয়। ১৩ ডিসেম্বর গ্রামবাসী বাঘটি পিটিয়ে হত্যা করে। ১৯৯৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর শ্যামনগরের দাতনেখালী গ্রামে একটি বাঘ ঢুকলে মোহাম্মদ মহসিন নামের এক ব্যক্তি বাঘটি গুলি করে হত্যা করে। ২০০০ সালের ২৫ জানুয়ারি নদী পার হয়ে একটি বয়স্ক বাঘ শ্যামনগরের লোকালয়ে প্রবেশ করে। এ সময় বন বিভাগের লোকজন বাঘটি আটক করে চিকিৎসার জন্যে খুলনায় বিভাগীয় বন বিভাগের অফিসে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাঘটি মারা যায়।
বাঘ হত্যা না করে বনে ছেড়ে দেয়ার নিময় থাকলেও বন বিভাগ সে উদ্যোগ কখনই গ্রহণ করেনি। ট্রাংকুলাইজার গান ব্যবহার করে সহজেই লোকালয়ে প্রবেশ করা এসব বাঘ অজ্ঞান করে নিরাপদে পুনরায় বনে ফিরেয়ে নেয়া সম্ভব বলে মনে করেন প্রাণী বিশেষজ্ঞরা। অথচ সুন্দরবনের সাতীরা রেঞ্জে লোকালয়ে ঢুকেপড়া বাঘগুলো আর প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারছে না। অধিকাংশ েেত্র বনবিভাগ ও পুলিশের উপস্থিতিতে ুব্ধ গ্রামবাসী এ সকল বাঘ হত্যা করেছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, খুলনা বিভাগীয় বন অফিসে দু'টি ট্রাঙ্কুুলাইজার গান রয়েছে। তবে এই গান দু'টি ব্যবহার করার জন্য যেমন দ কোন অপারেটর নেই, তেমনি নেই চেতনানাশক ওষুধ। এ কারণে শুক্রবার চ-ীপুর গ্রামে বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা, টাইগারবাহিনীর সদস্যরা এলেও ট্রাঙ্কুলাইজার গান ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। বন বিভাগের কর্মীরা শুধু গান ও ওষুধের পাত্র নিয়ে এলাকায় মহড়া দিয়েছেন মাত্র।
No comments