কালের আয়নায়-একটি চলতি যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বলা চলে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ড. ইউনূস একটি বহু ফ্রন্টের যুদ্ধ শুরু করেছেন বেশ আগেই। 'আজ একটি কালো দিন' শীর্ষক লেখায় তার আরেকটি প্রকাশ্য ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করলেন মাত্র। তিনি তার বক্তৃতা ও লেখায় বারবারই ব্যাংকটির মালিক হিসেবে গরিব মহিলাদের কথা উল্লেখ করেন।
এ সম্পর্কে কেউ কেউ বলেন, ব্যাংকটির কর্তৃত্বের ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে তার যুদ্ধে এই গরিব মহিলাদের তিনি হিউম্যান-শিল্ড হিসেবে ব্যবহার করছেন
পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটির পর প্রথম কলম ধরেই ভেবেছিলাম, এবার দেশে মোটামুটি শান্তি ও শৃঙ্খলার মধ্যে ঈদ উদযাপিত হওয়ায় সরকার ও জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে কী জন্য এই ক্রনিক অশান্তির দেশে হঠাৎ শান্তি দেখা দিল তা নিয়ে কিছু লিখব। হঠাৎ একেবারে প্রত্যুষে (লন্ডন সময়) ঢাকার এক সাংবাদিক বন্ধুর কণ্ঠের আওয়াজ পেলাম টেলিফোনে। তিনি বললেন, আজকের 'প্রথম আলো' পত্রিকা দেখেছেন? সম্ভবত খুব নরম আওয়াজে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে।
বাংলাদেশে পবিত্র রোজার মাসের পর যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার কথা জানতাম। ঘোষণা দিয়েছিলেন বিএনপি নেত্রী। বলেছিলেন, 'রমজানের পরই আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে বিএনপি।' ভাবলাম, 'প্রথম আলো' বুঝি সেই যুদ্ধ শুরু হওয়ার খবরই ছেপেছে। বন্ধুকে সে কথা বলতেই তিনি বললেন, "আরে না, না, এই যুদ্ধ ঘোষণা বিএনপির নয়, এটা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। তিনি পণ্ডিত মানুষ। পাণ্ডিত্যপূর্ণ নরম ভাষায় যে বিবৃতিটি দিয়েছেন এবং আজ (শুক্রবার) যেটি নিবন্ধ আকারে 'প্রথম আলোতে' বেরিয়েছে সেটি বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়া আর কিছু নয়। এই যুদ্ধ ঘোষণায় দেশের তরুণ সমাজকে সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোরও প্রচ্ছন্ন আহ্বান জানানো হয়েছে।"
সাংবাদিক বন্ধুর কথায় 'প্রথম আলো' কাগজটিতে সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় ড. ইউনূসের লেখাটি খুঁজে বের করতে হলো। লেখাটির শিরোনাম দেখেই বুঝলাম, সাংবাদিক বন্ধু অত্যুক্তি করেননি। শিরোনাম হলো, 'আজ একটি কালো দিন।' তিনি লিখেছেন, 'জাতির জীবনে এটা একটা কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সরকার গরিব মহিলাদের মালিকানায় এবং তাদেরই তত্ত্বাবধানে সুপরিচালিত, বিশ্বময় সুপরিচিত, নোবেল বিজয়ী একটি প্রতিষ্ঠান থেকে তার মৌলিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাকে অন্যরকম প্রতিষ্ঠানে পরিণত করলেন।'
এ কথাটা নোবেলজয়ীর মনের ক্ষোভ, যুদ্ধ ঘোষণা নয়। যুদ্ধ ঘোষণা তিনি করেছেন লেখাটির পরবর্তী এক অংশে অত্যন্ত সুকৌশলী নরম ভাষায়। এই লেখাটি অনেকটা ছোট্ট বাক্সবন্দি দেশলাইয়ের কাঠির মতো। সামান্য ঘর্ষণে আগুন জ্বলে উঠতে পারে এবং তা থেকে দাবদাহ সৃষ্টি হতে পারে। সে বিশ্লেষণে পরে আসছি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার সংশোধিত গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ ২০১২ জারি করেছে। এই অধ্যাদেশ জারির দিনটিকেই ড. ইউনূসের মতো একজন নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব 'জাতির জীবনের কালো দিবস' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার এই লেখাটি 'প্রথম আলো' অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রথম উপসম্পাদকীয় হিসেবে ছেপেছে, অন্যান্য কাগজেও বিবৃতি এবং খবর হিসেবে ছাপা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন, এই অধ্যাদেশটিতে এমন কী আছে, যাকে জাতির জীবনের কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়? এই অধ্যাদেশ ১৯৮৩ সালের গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশের ১৪ ধারার সংশোধনী। নতুন সংশোধনী অনুসারে ব্যাংকের চেয়ারম্যান পরিচালনা বোর্ড বা পর্ষদের সদস্যদের পরামর্শ নিয়ে ব্যাংকের একজন এমডি নিয়োগের জন্য একটি সিলেকশন কমিটি গঠন করবেন। এই কমিটির সদস্য হবেন তিন থেকে পাঁচ জন। কমিটি এমডি বা ম্যানেজিং ডিরেক্টর বাছাইয়ের জন্য তিনজনের একটি প্যানেল নির্বাচন করবে। তাদের মধ্য থেকেই একজন নতুন ম্যানেজিং ডিরেক্টর বেছে নেওয়া হবে।
এই সংশোধনী জারির দিনটিকেই কালো দিবস ঘোষণা করে ড. ইউনূস তার প্রবন্ধে দেশবাসীকে, বিশেষ করে তরুণ সমাজকে এই সংশোধনী প্রতিহত করা, এমনকি তার মনোপূত একটি সরকার প্রতিষ্ঠারও প্রচ্ছন্ন ডাক দিয়েছেন, যে সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে তার মৌলিকত্ব ফিরিয়ে দেবে। অর্থাৎ নোবেলজয়ীর কর্তৃত্ব আবার ফিরিয়ে দেবে। ব্যাংকটির মৌলিকত্ব হয়তো এখানেই।
'আজ একটি কালো দিন' শীর্ষক লেখায় ড. ইউনূস লিখেছেন, "আমি আশাবাদী মানুষ। নিজের মনে আশার ক্ষীণ আলো জ্বালিয়ে রাখতে চাই। আমি আগের মতো আবারও দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন এর (গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত সরকারি ব্যবস্থার) প্রতিকারের ব্যবস্থা করেন। আমি তরুণদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকদের এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তাদের ফিরিয়ে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকেন। আশা করি ভবিষ্যতে একদিন আমাদের দেশে এমন সরকার আসবে, যাদের প্রথম কাজ হবে একটি জাতীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গরিব মহিলাদের এই ব্যাংকটিকে গরিব মহিলাদের হাতে তুলে দিয়ে এই ব্যাংকের গৌরবময় অগ্রযাত্রাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে দেবেন।" (কোনো দেশের সরকারের প্রায়োরিটি কি একটি ব্যাংক হতে পারে?)
আগেই বলেছি, এটি অত্যন্ত সুললিত নরম ভাষায় একটি যুদ্ধ ঘোষণা। এই ঘোষণায় দেশবাসীকে একটি নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ডাক দেওয়া হয়েছে এবং তরুণ সমাজকে এই ব্যাংকের মালিকানা সরকারি কর্তৃত্ব থেকে ফিরিয়ে এনে আগের কর্তৃত্বের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণের প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে। এমনকি এমন একটি সরকার (বর্তমান সরকারের পরিবর্তে) প্রতিষ্ঠার আশা করা হয়েছে, যে সরকার এই ব্যাংকের মালিকানা 'গরিব মহিলা মালিকদের' হাতে ফিরিয়ে দেবে।
এই কাজটি করতে হলে দেশের মানুষকে সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করতে হবে। তরুণদের সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামতে হবে এবং সেই আন্দোলনের ফলে বর্তমান সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে তারা গ্রামীণ ব্যাংককে আবার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়াকেই প্রথম দায়িত্ব মনে করবে। নোবেলজয়ীর প্রবন্ধটির আসল উদ্দেশ্য যে এটিই তা বোঝার জন্য খুব বেশি জ্ঞানবুদ্ধির দরকার নেই।
যদিও দেশের অনেক মানুষের কাছে শ্রদ্ধেয় নোবেলজয়ী তার দেশের সরকারের বিরুদ্ধে এই প্রচ্ছন্ন যুদ্ধ ঘোষণাটি এতদিনে লিখিতভাবে করলেন, কিন্তু যুদ্ধটি শুরু করেছেন বহু আগে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদ থেকে সরে আসার পর থেকেই। আমার সহৃদয় পাঠকদের স্মরণ আছে কি-না জানি না, গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তৃত্ব থেকে সরে আসার পর থেকেই তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যসহ সব শেয়ারহোল্ডারের (যাদের তিনি গরিব মহিলা-মালিক বলেন) কাছে সিরিজ ইশতেহার পাঠাতে শুরু করেন, যাতে তিনি সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার জন্য তাদের পরামর্শ দিতে থাকেন।
এই ক্রমাগত উস্কানি দানের ফলে ব্যাংকটির 'গরিব মহিলা মালিকেরা' নতুন একজন এমডি নির্বাচনে সরকারকে বাধা দিতে শুরু করেন, কিন্তু কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি। কারণ, এই আন্দোলনে জনসমর্থন পাওয়া যায়নি এবং ব্যাংকের গরিব মহিলা মালিকেরাও এই ব্যাপারে নিত্যপ্ররোচনার মুখে যে উৎসাহিত হননি, তার প্রমাণ এখন পাওয়া যাচ্ছে।
সরকার এই নোবেলজয়ীর সম্মান এবং মর্যাদায় আঘাত দিতে চায়নি। যখন দেখা গেল, তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি ব্যাংকটির ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদটি আঁকড়ে আছেন এবং তাতে এই পদে থাকার বয়ঃসীমা তিনি পেরিয়ে গেছেন এবং তাতে দেশের আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে, তখন তাকে নিজ থেকে পদ থেকে সরে যাওয়ার জন্য সরকার বিনীত অনুরোধ জানায়। তিনি তাতে রাজি হননি। এরপর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে ব্যাংকটির ইমেরিটাস চেয়ারম্যান পদ গ্রহণ করে এর সুপরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অনুরোধ জানান। তিনি এই অনুরোধও অগ্রাহ্য করেন এবং এমডি পদ আঁকড়ে থাকার ব্যাপারে জেদ দেখাতে থাকেন।
অতঃপর এমডি পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর পর তিনিই সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে (কেউ কেউ বলেন ড. কামাল হোসেনের পরামর্শে) মামলা করেন। সরকার তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেনি। এটাও ছিল সরকারের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ, তবে আইনি লড়াই। এই লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার পর তিনি আইন-বহির্ভূত বর্তমান লড়াইয়ে নামেন। সেটা হলো, তিনি নিজে যে ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যাংকটিতে একচ্ছত্র আধিপত্য ভোগ করেছেন, সেই আধিপত্যের অবসান হওয়ায় সে কথা না বলে বিপুল সংখ্যক গরিব নারী শেয়ারহোল্ডারকে (সামান্য টাকার শেয়ার) মালিক হিসেবে দেখিয়ে তাদের অধিকার ও স্বার্থ খর্ব করা হয়েছে ধোয়া তুলে দেশের এবং বিশ্বের মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন আদায় করে সরকারকে নতিস্বীকারে বাধ্য করার লড়াই।
দেশের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়ার সমর্থন তিনি এই যুদ্ধে লাভ করেন। তাতেও দেশে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারায় তিনি যে কাজটি শুরু করেন, সেটা কেবল সরকারবিরোধী তৎপরতা নয়, সেই তৎপরতাকে রাষ্ট্রবিরোধী বলেও আখ্যা দেওয়া যায়, সে বিতর্কও কেউ কেউ তুলছেন। এই তৎপরতা হলো দেশের সরকারের ওপর তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বহিঃশক্তির, এমনকি বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ারের চাপ প্রয়োগ। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাবেক ও বর্তমান মার্কিন কূটনীতিকরা যেভাবে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে চলেছেন তা কূটনৈতিক শালীনতা ও অধিকার বহির্ভূত কাজের শামিল।
অনেকে মনে করেন, পদ্মা ব্রিজের অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক যে সরে গেল তার মূলেও নাকি রয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাংলাদেশ সরকারকে চাপে ফেলা। এই গুজব সম্পর্কে ড. ইউনূস নিজে কিছু বলছেন না। কিন্তু তার হয়ে কথা বলছেন ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত। গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্তের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এটা সাম্প্রতিক বিশ্বের এক মহাবিস্ময়। আমেরিকার মতো বিশ্বের একক সুপার পাওয়ার বাংলাদেশের বড় বড় সমস্যাগুলো নিয়ে নয়, একটি ব্যাংকের সমস্যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন, রহস্যটা কী?
সুতরাং বলা চলে, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ড. ইউনূস একটি বহু ফ্রন্টের যুদ্ধ শুরু করেছেন বেশ আগেই। 'আজ একটি কালো দিন' শীর্ষক লেখায় তার আরেকটি প্রকাশ্য ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করলেন মাত্র। তিনি তার বক্তৃতা ও লেখায় বারবারই ব্যাংকটির মালিক হিসেবে গরিব মহিলাদের কথা উল্লেখ করেন। এ সম্পর্কে কেউ কেউ বলেন, ব্যাংকটির কর্তৃত্বের ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে তার যুদ্ধে এই গরিব মহিলাদের তিনি হিউম্যান-শিল্ড হিসেবে ব্যবহার করছেন।
ত্রিশ বছরের বেশি এই গ্রামীণ ব্যাংকের তথাকথিত মালিকানায় থেকেও এই গরিব মহিলাদের ক'জন প্রকৃত দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছেন, অথবা ড. ইউনূসের মতো বিত্ত-বৈভবের অধিকারী হয়েছেন তার একটি তালিকা প্রণয়নের চেষ্টা করা কি যায় না? জন্মাবধি গ্রামীণ ব্যাংক ছিল ড. ইউনূসের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে। আর যে গরিব মহিলাদের ব্যাংকের মালিক বলে দেখানো হয় তারা ছিল তার অঙুলি হেলনে চালিত বশংবদ পর্ষদ। এই পর্ষদকে তিনি এখনও তার কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারের কাজে ব্যবহার করছেন। সরকারকে তাই গ্রামীণ ব্যাংকের একজন দক্ষ ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিয়োগে নোবেলজয়ীর পাতা ফাঁদ এড়ানোর জন্য ব্যাংক সংক্রান্ত অধ্যাদেশে নতুন সংশোধনী আনতে হয়েছে।
ড. ইউনূস তার নিবন্ধে গ্রামীণ ব্যাংককে সুপরিচালিত ও নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠান রূপে আখ্যা দিয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে গত দু'দশক ধরে বহু অভিযোগ। ব্যাংকটির উচ্চ সুদের হার, ঋণগ্রহীতাদের ওপর নির্যাতন, গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় অসংখ্য কোম্পানি করে তা অন্য মালিকানায় এবং নোবেলজয়ীর একচ্ছত্র তত্ত্বাবধানে নেওয়া, ব্যাংকটির লভ্যাংশের টাকা কোথায় যায়, শেয়ারহোল্ডারদের ভাগ্যে ডিভিডেন্ড জোটে কি-না, তার পরিমাণ কত, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে একাধিক অভিজ্ঞ পরিচালককে অতীতে কেন সরানো হয়েছে, ব্যাংক পরিচালনায় সাবেক এমডির স্বেচ্ছাচারিতা ইত্যাদি অন্তহীন অভিযোগ জমে উঠেছে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে। সরকার এ সম্পর্কে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এই তদন্তের পরই জানা যাবে ব্যাংকটি কতটা সুপরিচালিত এবং কতটা গরিব মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত ছিল। ড. ইউনূস একটু অপেক্ষা করুন না। এই তদন্তের ফল প্রকাশিত হলেই তো জানা যাবে, তার দাবির সত্যতা কতটুকু?
তিনি বলেছেন, গ্রামীণ ব্যাংক নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠান, যদি তাই হয় তাহলে এই নোবেল পুরস্কারের অর্ধেকটা ব্যাংকে এবং অর্ধেকটা তার কাছে গেল কেন? পুরস্কারের বেলাতেও এই আধাআধি বখরার ফলে কি মনে হয় না যে, ব্যাংকটির লাভের বখরার পুরোটাই ছিল তার। ব্যাংকটি উচ্ছিষ্টভোগী মাত্র। অনেকেই মনে করেন, নোবেলজয়ীর আসল আতঙ্ক এই ব্যাংক সম্পর্কিত তদন্ত নিয়ে, ব্যাংক উদ্ধার এহ বাহ্য। তদন্ত বন্ধ করার জন্যই তার এই সরকারবিরোধী বহু ফ্রন্টের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে যদি সরকার জেতে তাহলেই ব্যাংকটি সব অনিয়ম ও অব্যবস্থামুক্ত হবে এবং যে গরিব মহিলাদের এর মালিক বলে প্রচার করা হয়, তাদের প্রকৃত অধিকার ও স্বার্থের সুরক্ষা হবে। এটি একটি অসম যুদ্ধ। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়?
লন্ডন, ২৪ আগস্ট, শুক্রবার, ২০১২
পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটির পর প্রথম কলম ধরেই ভেবেছিলাম, এবার দেশে মোটামুটি শান্তি ও শৃঙ্খলার মধ্যে ঈদ উদযাপিত হওয়ায় সরকার ও জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে কী জন্য এই ক্রনিক অশান্তির দেশে হঠাৎ শান্তি দেখা দিল তা নিয়ে কিছু লিখব। হঠাৎ একেবারে প্রত্যুষে (লন্ডন সময়) ঢাকার এক সাংবাদিক বন্ধুর কণ্ঠের আওয়াজ পেলাম টেলিফোনে। তিনি বললেন, আজকের 'প্রথম আলো' পত্রিকা দেখেছেন? সম্ভবত খুব নরম আওয়াজে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে।
বাংলাদেশে পবিত্র রোজার মাসের পর যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার কথা জানতাম। ঘোষণা দিয়েছিলেন বিএনপি নেত্রী। বলেছিলেন, 'রমজানের পরই আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে বিএনপি।' ভাবলাম, 'প্রথম আলো' বুঝি সেই যুদ্ধ শুরু হওয়ার খবরই ছেপেছে। বন্ধুকে সে কথা বলতেই তিনি বললেন, "আরে না, না, এই যুদ্ধ ঘোষণা বিএনপির নয়, এটা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। তিনি পণ্ডিত মানুষ। পাণ্ডিত্যপূর্ণ নরম ভাষায় যে বিবৃতিটি দিয়েছেন এবং আজ (শুক্রবার) যেটি নিবন্ধ আকারে 'প্রথম আলোতে' বেরিয়েছে সেটি বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়া আর কিছু নয়। এই যুদ্ধ ঘোষণায় দেশের তরুণ সমাজকে সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোরও প্রচ্ছন্ন আহ্বান জানানো হয়েছে।"
সাংবাদিক বন্ধুর কথায় 'প্রথম আলো' কাগজটিতে সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় ড. ইউনূসের লেখাটি খুঁজে বের করতে হলো। লেখাটির শিরোনাম দেখেই বুঝলাম, সাংবাদিক বন্ধু অত্যুক্তি করেননি। শিরোনাম হলো, 'আজ একটি কালো দিন।' তিনি লিখেছেন, 'জাতির জীবনে এটা একটা কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সরকার গরিব মহিলাদের মালিকানায় এবং তাদেরই তত্ত্বাবধানে সুপরিচালিত, বিশ্বময় সুপরিচিত, নোবেল বিজয়ী একটি প্রতিষ্ঠান থেকে তার মৌলিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাকে অন্যরকম প্রতিষ্ঠানে পরিণত করলেন।'
এ কথাটা নোবেলজয়ীর মনের ক্ষোভ, যুদ্ধ ঘোষণা নয়। যুদ্ধ ঘোষণা তিনি করেছেন লেখাটির পরবর্তী এক অংশে অত্যন্ত সুকৌশলী নরম ভাষায়। এই লেখাটি অনেকটা ছোট্ট বাক্সবন্দি দেশলাইয়ের কাঠির মতো। সামান্য ঘর্ষণে আগুন জ্বলে উঠতে পারে এবং তা থেকে দাবদাহ সৃষ্টি হতে পারে। সে বিশ্লেষণে পরে আসছি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার সংশোধিত গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ ২০১২ জারি করেছে। এই অধ্যাদেশ জারির দিনটিকেই ড. ইউনূসের মতো একজন নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব 'জাতির জীবনের কালো দিবস' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার এই লেখাটি 'প্রথম আলো' অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রথম উপসম্পাদকীয় হিসেবে ছেপেছে, অন্যান্য কাগজেও বিবৃতি এবং খবর হিসেবে ছাপা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন, এই অধ্যাদেশটিতে এমন কী আছে, যাকে জাতির জীবনের কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়? এই অধ্যাদেশ ১৯৮৩ সালের গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশের ১৪ ধারার সংশোধনী। নতুন সংশোধনী অনুসারে ব্যাংকের চেয়ারম্যান পরিচালনা বোর্ড বা পর্ষদের সদস্যদের পরামর্শ নিয়ে ব্যাংকের একজন এমডি নিয়োগের জন্য একটি সিলেকশন কমিটি গঠন করবেন। এই কমিটির সদস্য হবেন তিন থেকে পাঁচ জন। কমিটি এমডি বা ম্যানেজিং ডিরেক্টর বাছাইয়ের জন্য তিনজনের একটি প্যানেল নির্বাচন করবে। তাদের মধ্য থেকেই একজন নতুন ম্যানেজিং ডিরেক্টর বেছে নেওয়া হবে।
এই সংশোধনী জারির দিনটিকেই কালো দিবস ঘোষণা করে ড. ইউনূস তার প্রবন্ধে দেশবাসীকে, বিশেষ করে তরুণ সমাজকে এই সংশোধনী প্রতিহত করা, এমনকি তার মনোপূত একটি সরকার প্রতিষ্ঠারও প্রচ্ছন্ন ডাক দিয়েছেন, যে সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে তার মৌলিকত্ব ফিরিয়ে দেবে। অর্থাৎ নোবেলজয়ীর কর্তৃত্ব আবার ফিরিয়ে দেবে। ব্যাংকটির মৌলিকত্ব হয়তো এখানেই।
'আজ একটি কালো দিন' শীর্ষক লেখায় ড. ইউনূস লিখেছেন, "আমি আশাবাদী মানুষ। নিজের মনে আশার ক্ষীণ আলো জ্বালিয়ে রাখতে চাই। আমি আগের মতো আবারও দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন এর (গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত সরকারি ব্যবস্থার) প্রতিকারের ব্যবস্থা করেন। আমি তরুণদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকদের এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তাদের ফিরিয়ে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকেন। আশা করি ভবিষ্যতে একদিন আমাদের দেশে এমন সরকার আসবে, যাদের প্রথম কাজ হবে একটি জাতীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গরিব মহিলাদের এই ব্যাংকটিকে গরিব মহিলাদের হাতে তুলে দিয়ে এই ব্যাংকের গৌরবময় অগ্রযাত্রাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে দেবেন।" (কোনো দেশের সরকারের প্রায়োরিটি কি একটি ব্যাংক হতে পারে?)
আগেই বলেছি, এটি অত্যন্ত সুললিত নরম ভাষায় একটি যুদ্ধ ঘোষণা। এই ঘোষণায় দেশবাসীকে একটি নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ডাক দেওয়া হয়েছে এবং তরুণ সমাজকে এই ব্যাংকের মালিকানা সরকারি কর্তৃত্ব থেকে ফিরিয়ে এনে আগের কর্তৃত্বের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণের প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে। এমনকি এমন একটি সরকার (বর্তমান সরকারের পরিবর্তে) প্রতিষ্ঠার আশা করা হয়েছে, যে সরকার এই ব্যাংকের মালিকানা 'গরিব মহিলা মালিকদের' হাতে ফিরিয়ে দেবে।
এই কাজটি করতে হলে দেশের মানুষকে সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করতে হবে। তরুণদের সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামতে হবে এবং সেই আন্দোলনের ফলে বর্তমান সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে তারা গ্রামীণ ব্যাংককে আবার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়াকেই প্রথম দায়িত্ব মনে করবে। নোবেলজয়ীর প্রবন্ধটির আসল উদ্দেশ্য যে এটিই তা বোঝার জন্য খুব বেশি জ্ঞানবুদ্ধির দরকার নেই।
যদিও দেশের অনেক মানুষের কাছে শ্রদ্ধেয় নোবেলজয়ী তার দেশের সরকারের বিরুদ্ধে এই প্রচ্ছন্ন যুদ্ধ ঘোষণাটি এতদিনে লিখিতভাবে করলেন, কিন্তু যুদ্ধটি শুরু করেছেন বহু আগে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদ থেকে সরে আসার পর থেকেই। আমার সহৃদয় পাঠকদের স্মরণ আছে কি-না জানি না, গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তৃত্ব থেকে সরে আসার পর থেকেই তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যসহ সব শেয়ারহোল্ডারের (যাদের তিনি গরিব মহিলা-মালিক বলেন) কাছে সিরিজ ইশতেহার পাঠাতে শুরু করেন, যাতে তিনি সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার জন্য তাদের পরামর্শ দিতে থাকেন।
এই ক্রমাগত উস্কানি দানের ফলে ব্যাংকটির 'গরিব মহিলা মালিকেরা' নতুন একজন এমডি নির্বাচনে সরকারকে বাধা দিতে শুরু করেন, কিন্তু কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি। কারণ, এই আন্দোলনে জনসমর্থন পাওয়া যায়নি এবং ব্যাংকের গরিব মহিলা মালিকেরাও এই ব্যাপারে নিত্যপ্ররোচনার মুখে যে উৎসাহিত হননি, তার প্রমাণ এখন পাওয়া যাচ্ছে।
সরকার এই নোবেলজয়ীর সম্মান এবং মর্যাদায় আঘাত দিতে চায়নি। যখন দেখা গেল, তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি ব্যাংকটির ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদটি আঁকড়ে আছেন এবং তাতে এই পদে থাকার বয়ঃসীমা তিনি পেরিয়ে গেছেন এবং তাতে দেশের আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে, তখন তাকে নিজ থেকে পদ থেকে সরে যাওয়ার জন্য সরকার বিনীত অনুরোধ জানায়। তিনি তাতে রাজি হননি। এরপর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে ব্যাংকটির ইমেরিটাস চেয়ারম্যান পদ গ্রহণ করে এর সুপরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অনুরোধ জানান। তিনি এই অনুরোধও অগ্রাহ্য করেন এবং এমডি পদ আঁকড়ে থাকার ব্যাপারে জেদ দেখাতে থাকেন।
অতঃপর এমডি পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর পর তিনিই সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে (কেউ কেউ বলেন ড. কামাল হোসেনের পরামর্শে) মামলা করেন। সরকার তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেনি। এটাও ছিল সরকারের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ, তবে আইনি লড়াই। এই লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার পর তিনি আইন-বহির্ভূত বর্তমান লড়াইয়ে নামেন। সেটা হলো, তিনি নিজে যে ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যাংকটিতে একচ্ছত্র আধিপত্য ভোগ করেছেন, সেই আধিপত্যের অবসান হওয়ায় সে কথা না বলে বিপুল সংখ্যক গরিব নারী শেয়ারহোল্ডারকে (সামান্য টাকার শেয়ার) মালিক হিসেবে দেখিয়ে তাদের অধিকার ও স্বার্থ খর্ব করা হয়েছে ধোয়া তুলে দেশের এবং বিশ্বের মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন আদায় করে সরকারকে নতিস্বীকারে বাধ্য করার লড়াই।
দেশের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়ার সমর্থন তিনি এই যুদ্ধে লাভ করেন। তাতেও দেশে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারায় তিনি যে কাজটি শুরু করেন, সেটা কেবল সরকারবিরোধী তৎপরতা নয়, সেই তৎপরতাকে রাষ্ট্রবিরোধী বলেও আখ্যা দেওয়া যায়, সে বিতর্কও কেউ কেউ তুলছেন। এই তৎপরতা হলো দেশের সরকারের ওপর তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বহিঃশক্তির, এমনকি বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ারের চাপ প্রয়োগ। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাবেক ও বর্তমান মার্কিন কূটনীতিকরা যেভাবে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে চলেছেন তা কূটনৈতিক শালীনতা ও অধিকার বহির্ভূত কাজের শামিল।
অনেকে মনে করেন, পদ্মা ব্রিজের অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক যে সরে গেল তার মূলেও নাকি রয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাংলাদেশ সরকারকে চাপে ফেলা। এই গুজব সম্পর্কে ড. ইউনূস নিজে কিছু বলছেন না। কিন্তু তার হয়ে কথা বলছেন ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত। গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্তের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এটা সাম্প্রতিক বিশ্বের এক মহাবিস্ময়। আমেরিকার মতো বিশ্বের একক সুপার পাওয়ার বাংলাদেশের বড় বড় সমস্যাগুলো নিয়ে নয়, একটি ব্যাংকের সমস্যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন, রহস্যটা কী?
সুতরাং বলা চলে, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ড. ইউনূস একটি বহু ফ্রন্টের যুদ্ধ শুরু করেছেন বেশ আগেই। 'আজ একটি কালো দিন' শীর্ষক লেখায় তার আরেকটি প্রকাশ্য ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করলেন মাত্র। তিনি তার বক্তৃতা ও লেখায় বারবারই ব্যাংকটির মালিক হিসেবে গরিব মহিলাদের কথা উল্লেখ করেন। এ সম্পর্কে কেউ কেউ বলেন, ব্যাংকটির কর্তৃত্বের ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে তার যুদ্ধে এই গরিব মহিলাদের তিনি হিউম্যান-শিল্ড হিসেবে ব্যবহার করছেন।
ত্রিশ বছরের বেশি এই গ্রামীণ ব্যাংকের তথাকথিত মালিকানায় থেকেও এই গরিব মহিলাদের ক'জন প্রকৃত দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছেন, অথবা ড. ইউনূসের মতো বিত্ত-বৈভবের অধিকারী হয়েছেন তার একটি তালিকা প্রণয়নের চেষ্টা করা কি যায় না? জন্মাবধি গ্রামীণ ব্যাংক ছিল ড. ইউনূসের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে। আর যে গরিব মহিলাদের ব্যাংকের মালিক বলে দেখানো হয় তারা ছিল তার অঙুলি হেলনে চালিত বশংবদ পর্ষদ। এই পর্ষদকে তিনি এখনও তার কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারের কাজে ব্যবহার করছেন। সরকারকে তাই গ্রামীণ ব্যাংকের একজন দক্ষ ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিয়োগে নোবেলজয়ীর পাতা ফাঁদ এড়ানোর জন্য ব্যাংক সংক্রান্ত অধ্যাদেশে নতুন সংশোধনী আনতে হয়েছে।
ড. ইউনূস তার নিবন্ধে গ্রামীণ ব্যাংককে সুপরিচালিত ও নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠান রূপে আখ্যা দিয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে গত দু'দশক ধরে বহু অভিযোগ। ব্যাংকটির উচ্চ সুদের হার, ঋণগ্রহীতাদের ওপর নির্যাতন, গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় অসংখ্য কোম্পানি করে তা অন্য মালিকানায় এবং নোবেলজয়ীর একচ্ছত্র তত্ত্বাবধানে নেওয়া, ব্যাংকটির লভ্যাংশের টাকা কোথায় যায়, শেয়ারহোল্ডারদের ভাগ্যে ডিভিডেন্ড জোটে কি-না, তার পরিমাণ কত, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে একাধিক অভিজ্ঞ পরিচালককে অতীতে কেন সরানো হয়েছে, ব্যাংক পরিচালনায় সাবেক এমডির স্বেচ্ছাচারিতা ইত্যাদি অন্তহীন অভিযোগ জমে উঠেছে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে। সরকার এ সম্পর্কে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এই তদন্তের পরই জানা যাবে ব্যাংকটি কতটা সুপরিচালিত এবং কতটা গরিব মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত ছিল। ড. ইউনূস একটু অপেক্ষা করুন না। এই তদন্তের ফল প্রকাশিত হলেই তো জানা যাবে, তার দাবির সত্যতা কতটুকু?
তিনি বলেছেন, গ্রামীণ ব্যাংক নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠান, যদি তাই হয় তাহলে এই নোবেল পুরস্কারের অর্ধেকটা ব্যাংকে এবং অর্ধেকটা তার কাছে গেল কেন? পুরস্কারের বেলাতেও এই আধাআধি বখরার ফলে কি মনে হয় না যে, ব্যাংকটির লাভের বখরার পুরোটাই ছিল তার। ব্যাংকটি উচ্ছিষ্টভোগী মাত্র। অনেকেই মনে করেন, নোবেলজয়ীর আসল আতঙ্ক এই ব্যাংক সম্পর্কিত তদন্ত নিয়ে, ব্যাংক উদ্ধার এহ বাহ্য। তদন্ত বন্ধ করার জন্যই তার এই সরকারবিরোধী বহু ফ্রন্টের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে যদি সরকার জেতে তাহলেই ব্যাংকটি সব অনিয়ম ও অব্যবস্থামুক্ত হবে এবং যে গরিব মহিলাদের এর মালিক বলে প্রচার করা হয়, তাদের প্রকৃত অধিকার ও স্বার্থের সুরক্ষা হবে। এটি একটি অসম যুদ্ধ। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়?
লন্ডন, ২৪ আগস্ট, শুক্রবার, ২০১২
No comments