চরাচর-চরণতলার মেলা by হাকিম বাবুল
এক দিন এক রাতের 'চরণতলা মেলা'। প্রতিবছর বৈশাখ মাসের কৃষ্ণপক্ষের প্রথম মঙ্গলবার বসে এ মেলা। মেলাটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো_এটি সকালে শুরু হবে এবং পরদিন ভোররাতে শেষ হবে। শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলার গারো পাহাড় এলাকার বিষ্ণুপুর গ্রামের ভারত সীমান্তসংলগ্ন চরণতলায় শ্মশান কালীপূজা উপলক্ষে যুগ যুগ ধরে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
কালের ব্যবধানে এখন চরণতলার মেলাটি স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান ও পাহাড়ি-বাঙালি জনতার মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। বিষ্ণপুর গ্রামের ওই এলাকাটির 'চরণতলা' নাম হওয়ার পেছনে একটি কাহিনী রয়েছে। এ গ্রামে চরণ হাজং নামের এক গৃহস্থ ছিলেন। তিনি প্রতিদিন গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরী পাড়ি দিয়ে ওপাড়ে তাঁর মোষ চরাতে যেতেন। একদিন ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে দ্রুত মোষগুলো পার করে তিনি নিজেও সাঁতরে নদী পার হতে চেষ্টা করেন। কিন্তু নদীর পানির প্রবল স্রোতে চরণ হাজং তলিয়ে যান। সেই থেকে এই জায়গাটির নাম 'চরণতলা' হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। প্রায় পৌনে ২০০ বছর আগে শেরপুরের তিন-আনি জমিদার পত্নী হৈমবতী চৌধুরানীর বিষ্ণুপুরে পৌনে এক কড়া সম্পত্তি নাচন মোহরীর রাজবংশী ভূস্বামী হরসুন্দর রায় চৌধুরী খরিদসূত্রে জমিদারির মালিক হন। তখন থেকেই তাঁদের তত্ত্বাবধানে বংশপরম্পরা ধরে পূজা ও মেলা পরিচালিত হয়ে আসছে। সেখানে শ্মশান কালী মন্দিরকে ঘিরেই এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ মন্দিরটি এতদঞ্চলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে ঐতিহ্য বহন করে আসছে যুগ যুগ ধরে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এ সীমান্তে যখন পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে বাড়ি-ঘর, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করছিল, তখন এতদঞ্চলের মুসলমান অধিবাসীরা মন্দিরটি রক্ষা করে। আগে এ শ্মশান কালীর পূজায় মানতের দুই থেকে আড়াই হাজার পাঁঠা ও মোষ বলি হতো। বর্তমানে তা কমতে কমতে তিন-চার শতে নেমে এসেছে। পূজা উপলক্ষে আয়োজিত দিন-রাতের এ মেলায় বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর দোকান ছাড়াও হিন্দু সাধকদের জন্য শাঁখা-সিঁদুরের দোকান বসে। অন্যদিকে এ মেলায় নানা ধরনের মিষ্টান্ন বিক্রি হয়ে থাকে। স্থানীয় হালুইকেরা দু-এক দিন আগেই সেখানে দোকান খুলে মিষ্টি তৈরি শুরু করেন। মেলায় গৃহস্থালি নানা পণ্যসামগ্রীর দোকান বসে। মেলা চলে সকাল থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত। হাজার হাজার নারী-পুরুষের পদচারণে সকাল থেকে সারা রাত এ এলাকা মুখর থাকে। চরণতলার মেলা উপলক্ষে সেখানে রোগবালাইয়ের আক্রমণ থেকে রক্ষায় শীতলা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। লোকজন তাদের মনোবাসনা পূরণের জন্য এখানে মানত করে এবং পাঁঠা বলি দেয়। বর্তমানে চৌচালা মন্দির হিসেবে যেটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে তা প্রায় ১০০ বছর আগে বাংলা ১৩১৫ সনে অভয় চরণ হাজং নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা তৈরি করেছিলেন। এ পূজার মূল আয়োজক বৃহত্তর গারো পাহাড় এলাকার কোচ, ডালু, বানাই, হাজং, গারো ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত ভক্ত-পুণ্যার্থীর সমাগম ঘটেছিল। পশু বলি হয়েছে তিন শতাধিক।
হাকিম বাবুল
হাকিম বাবুল
No comments