নির্যাতিত আবদুল কাদের-পুলিশে শুদ্ধি অভিযান দরকার

একটির পর একটি ঘটনা। ভয়াবহতায় কোনোটিই কোনোটির চেয়ে কম নয় এবং সবক'টিই উদ্বেগজনক। প্রথমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হলো কলেজছাত্র লিমন। অপরাধ ঢাকতে গিয়ে তাকে সন্ত্রাসী বানানোর চেষ্টা হলো। আমিনবাজারে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত হলো ছয় ছাত্র।


পরে জানা গেল, ডাকাত সন্দেহে যাদের হত্যা করা হয়েছে তারাই ডাকাতির শিকার এবং ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য পুলিশই নিহতদের বেঁচে যাওয়া সঙ্গীকে নির্দেশনা দিয়েছিল। সর্বশেষ ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরকে ঘিরে। সেগুনবাগিচা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হলে ফেরার পথে সাদা পোশাকের পুলিশ তাকে গ্রেফতার করলেও পরে বলেছে, ডাকাতির প্রস্তুতিকালে বিশ্বরোড এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ডাকাতির অভিযোগ যাতে কাদের স্বীকার করেন সে জন্য তার ওপর নির্মম অত্যাচারও করা হয়। এ তিনটি ঘটনাই গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত। নাগরিকদের মনোযোগ এ ঘটনাগুলোর দিকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছে। মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে সজাগ হয়েছে। কিন্তু শুধু কি এ তিনটি ঘটনাই ঘটেছে? মানুষের জানাশোনার বাইরেও এ ধরনের ঘটনা যে আরও ঘটনা ঘটছে না সে বিষয়ে নিশ্চিত করবে কে? এ ঘটনাগুলো ভয়াবহ ও নৃশংস সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। অল্পবয়সী নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের গুলি করে পঙ্গু করে দেওয়া, ডাকাতির অভিযোগে হত্যা করা কিংবা স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য পিঠে চাপাতি দিয়ে আঘাত করার ঘটনা ভয়াবহতার নজির। কিন্তু তারও চেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এ ঘটনাগুলোতে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর নেতিবাচক অবস্থান। রাষ্ট্রে যে বাহিনীগুলো জনগণের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে তারা যদি জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় তবে এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে? কিন্তু সম্প্রতি এমন দুঃখজনক ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। অভিযোগ উঠেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা হয় অপরাধীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে নিরপরাধকে অপরাধী বানানোর চেষ্টা করছেন, নয়তো নিজেরাই অপরাধীর ভূমিকায় নেমে নিরপরাধ ব্যক্তিদের নির্যাতন-নিপীড়ন করছেন। এ ঘটনাগুলো নাগরিকদের মনে এ ধরনের অনাস্থা তৈরি করছে, এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা ও অসহায়ত্বও ছড়িয়ে পড়ছে। তাই সরকারের উচিত বিষয়গুলোর দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া। আবদুল কাদেরের ঘটনায় হাইকোর্ট দায়িত্বশীল ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন। সংবাদপত্রে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় তাদের পক্ষে এ ভূমিকা গ্রহণ সম্ভব হয়েছে। মানবাধিকার কমিশনও সোচ্চার ভূমিকা নিয়েছে। মাননীয় বিচারপতিদের সম্মুখে ঘটনা উন্মোচিত হয়েছে। আপাতত আবদুল কাদের ষড়যন্ত্রমূলক মামলার হাত থেকে বেঁচে গেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ূয়া একজন শিক্ষার্থী কেন এমন হয়রানিমূলক গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হবে এবং এমন ঘটনা ঘটার পর কেন পুলিশ প্রশাসন ও সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো নিশ্চুপ থাকবে। পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে এবং সংবাদপত্রে তা প্রকাশিত হলে সবার আগে সেই বাহিনীকেই তৎপর হতে হবে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরও উপযুক্ত নির্দেশনা দিতে হবে। এমন না ঘটে যখন হাইকোর্টকে নির্দেশনা দিতে হয়, তখন সেটি নিয়ে ভাবনার অবকাশ থেকে যায়। আমরা মনে করি, অপরাধী পুলিশদের রক্ষা নয়, অপরাধের বিহিত করার জন্য প্রশাসনের আরও দ্রুত তৎপর হওয়া দরকার। শুধু তাই নয়, একের পর এক যেভাবে পুলিশ ও অন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তাতে এসব বাহিনীতে শুদ্ধি অভিযান দরকার। পুলিশ একটি দায়িত্বশীল বাহিনী, এ বাহিনীতে অনেক সৎ ও যোগ্য মানুষ আছেন। কিন্তু কিছু অপরাধপ্রবণ ব্যক্তির জন্য বাহিনীটি সমালোচনার মুখে পড়তে পারে না। তাই পুলিশের মধ্যে অপরাধ প্রবণতার উৎস বের করে তার আশু প্রতিবিধান দরকার। নাগরিকরা আর কোনো অপরাধের সঙ্গে পুলিশের সংশ্লিষ্টতা দেখতে চায় না। আবদুল কাদেরের ঘটনার পর এমন উদাহরণ আর ঘটবে না, এটাই প্রত্যাশা।

No comments

Powered by Blogger.