কেন রাজনীতি ছাড়লেন মনজুর? by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
নির্বাচন
বর্জন শুধু নয়, রাজনীতি থেকেও অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি
করপোরেশনের সদ্য সাবেক মেয়র মনজুর আলম। নির্বাচনে নানা অনিয়ম, পোলিং
এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়াসহ নানা অভিযোগে নির্বাচন শুরু হওয়ার
মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন মনজুর। তখন তাঁর পাশে
ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল মামুন ও নগর সভাপতি আমীর খসরু
মাহমুদ চৌধুরী। যে অভিযোগ তাঁরা তুলেছেন, তাতে যে সত্যতা আছে, এ নিয়ে
কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু এত দ্রুত নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া
এবং রাজনীতি থেকে মনজুরের অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নানামুখী প্রশ্নের জন্ম
দিয়েছে। বিশেষত নির্বাচনের প্রথমার্ধেই বর্জনের পরও তাঁর বড় অঙ্কের ভোট
পাওয়ার (৩ লাখ ৪ হাজার ৮৩৭) ঘটনা সিদ্ধান্তটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
রাজনীতি থেকে কেন অবসর নিলেন মনজুর? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগেই যে কথাটি বলতে হবে, সেই অর্থে কখনোই সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না তিনি। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক উদ্যোগে সমাজসেবামূলক কাজের জন্য তাঁর যতটা সুনাম ও পরিচিতি এ অঞ্চলে, রাজনীতিক হিসেবে নিজেকে ততটা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি তিনি, কিংবা হয়তো তা তিনি চানওনি।
দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ড থেকে টানা তিনবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। তখনকার মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হিসেবে প্যানেল মেয়র যেমন ছিলেন, তেমনি বিভিন্ন সময় ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এক-এগারোর সরকার আসার পর একদিকে তৎকালীন মেয়র মহিউদ্দিন গ্রেপ্তার হলেন, অন্যদিকে মনজুর ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পেলেন। মহিউদ্দিন মুক্তি পাওয়ার পর তাঁর সঙ্গে সন্দেহ-অবিশ্বাস ও দূরত্ব সৃষ্টি হয় মনজুরের। এই দূরত্ব ও ভুল বোঝাবুঝি নিরসনের অনেক উদ্যোগ নিয়েও সফল হতে পারেননি মনজুর। একবার অন্তত ‘লিডারে’র সঙ্গে একান্ত আলাপের সুযোগ পেলে সব সংশয় দূর হয়ে যাবে—এমন কথা বারবার বলেও সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তিনি।
যা-ই হোক, এসব ঘটনার পর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনজুর তাঁর ‘লিডার’ মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিলে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিএনপি তাঁকে সমর্থন দেয়। ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা’র এই কৌশল যে ফলপ্রসূ হয়েছিল, সেই নির্বাচনে মনজুরের বিজয়ই তার প্রমাণ। এর মধ্য দিয়ে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন তিনি। বিএনপির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টার পদও লাভ করেছেন। কিন্তু সে অর্থে বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচি বা আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁকে পাওয়া যায়নি বলে নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেনসহ বড় একটি অংশের যে অভিযোগ, তা অনেকাংশেই সত্য। বরং মেয়র নির্বাচিত হওয়ার অল্প কিছুদিন পর থেকেই মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটে তাঁর। আগের মেয়াদে মহিউদ্দিনের নেওয়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প যেমন তিনি অব্যাহত রেখেছেন, তেমনি করপোরেশনেও মহিউদ্দিনের বলয় ভেঙে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেননি। মহিউদ্দিনের জামাতাকে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পদে বহাল রাখা, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার মহিউদ্দিনের ওপর ছেড়ে দেওয়া এবং এর ভিসি পদ বা থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (টিআইসি) পরিচালক পদে কোনো ধরনের পরিবর্তন না আনা ইত্যাদি পূর্বসূরির সঙ্গে তাঁর সমঝোতার পথে চলার অভিপ্রায়কেই প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া গত পাঁচ বছরে নগর উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাঁর ব্যর্থতার যত সমালোচনাই হোক, সিটি করপোরেশনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখা ও নিজের দুর্নীতিমুক্ত একটি ক্লিন ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিলেন তিনি।
নির্বাচন বর্জন করে মনজুর আলম বলেছেন, ‘জীবনে ছয়বার নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে না দিয়ে জোরপূর্বক কেন্দ্র দখলের মতো পরিস্থিতি কখনো দেখিনি। তাই ভবিষ্যতে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেব না।’ এ কথা শুধুই আবেগপ্রসূত নয়, ভোটের বাস্তব চিত্রেও তাঁর কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়।
মনজুরের রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়া প্রসঙ্গে আমীর খসরু মাহমুদ বলেছেন, রাজনীতি ছাড়ার বিষয় একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়। দলের কোনো সিদ্ধান্ত নয়। আবদুল্লাহ আল নোমান বলেছেন, তিনি হয়তো বলতে চেয়েছেন বর্তমানে যে রাজনৈতিক পরিবেশ তাতে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। তিনি স্বচ্ছ রাজনীতির মানুষ হিসেবে পরিচিত, স্বচ্ছ রাজনীতি পছন্দ করেন। এসব কথার যুক্তি অস্বীকার না করেও বলতে পারি, ভেতরের কথা হচ্ছে, এত তাড়াতাড়ি নির্বাচন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত পছন্দ হয়নি তাঁর। তিনি হয়তো শেষ পর্যন্ত দেখতে চেয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, ভোটারদের মধ্যে তাঁর একটা নীরব সমর্থন আছে। সেটা যে আছে এত অনিয়মের পরও প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যাই তো তা বলে দেয়।
তিন ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা না দিলে কী হতো? নির্বাচনে অনিয়ম কারচুপির একই অভিযোগ কি তাঁরা পরে জানাতে পারতেন না? কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্টরা যেতে পারেননি, কিন্তু বিএনপির স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা কি কোনো কেন্দ্রে ছিলেন, যাতে কর্মীরা মনোবল পেতে পারেন, সমর্থকেরা নীরবে তাঁদের প্রার্থীর পক্ষে রায় দিতে পারেন? পরিচিত ও প্রভাবশালী নেতারা সরকারদলীয় সমর্থকদের প্রতিরোধের মুখে পড়লে বা নিগৃহীত হলে সেটা সংবাদমাধ্যম বা সাধারণ মানুষের কাছে আরও বড় সংবাদ হয়ে উঠত, অভিযোগেরও গুরুত্ব বাড়ত। কিন্তু বিএনপি নেতারা সেই ঝুঁকি নিতে চাননি।
এ প্রসঙ্গে নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে চাই। ২০০৫ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বর্তমান সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এসেছিলেন মেয়র পদপ্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরীর সমর্থনে প্রচারকাজে অংশ নিতে। নির্বাচনের দিন চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সামনে একটি নির্বাচনী ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে ক্যাম্পটিই ভেঙে দেয় বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মীর নাছিরের সমর্থকেরা। তিনি রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় গাড়িযোগে মীর নাছির সেখানে হাজির হলে নূর ছুটে গিয়ে তাঁকে অভিযোগ জানালে মীর নাছিরও তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। এসব ঘটনা ঘটছিল সাধারণ ভোটার ও সাংবাদিকদের সামনে। সেই নির্বাচনে হেরেছিলেন মীর নাছির। সবচেয়ে বড় কথা, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট কেন্দ্রটিতে, যেখানে মহিউদ্দিনের সমর্থকেরা দাঁড়াতেও পারছিলেন না, সেখানে মীর নাছিরের দ্বিগুণ ভোট পেয়েছিলেন মহিউদ্দিন। নিজের চোখে দেখা এই ঘটনার উল্লেখ করার কারণ নিজেই সেদিন উপলব্ধি করেছিলাম, অনেক সময় কেন্দ্রের বাইরের চেহারা দেখে ভেতরের অবস্থা বোঝা যায় না।
২০১০ সালের মেয়র নির্বাচনের সময়ও দেখেছি, প্রবল প্রতাপশালী মহিউদ্দিনের হারিকেন মার্কা প্রতীকের ব্যাজ পরে ঘুরতে থাকা শত শত কর্মীর চোখ এড়িয়ে মনজুর আলমের আনারসের প্রতীকে ভোট দিয়েছিলেন। হারিকেন প্রতীকের ব্যাজ পরে মনজুরের সমর্থকেরাও যে ভিড়ে মিশে গিয়েছিলেন, সে কথাও তো পরে বোঝা গিয়েছিল।
এসব অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় থাকতে চেয়েছিলেন মনজুর। কিন্তু দল সেটা চায়নি, বরং অর্ধেকেরও বেশি সময় বাকি থাকতেই ওয়াকওভার দিয়েছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা।
নির্বাচনের পরিবেশ নিঃসন্দেহে হতাশাব্যঞ্জক, পাশাপাশি দলীয় নেতা-কর্মীদের ‘হাঁফ ছেড়ে বাঁচার’ মনোবৃত্তিও আশাহত করেছে মনজুরের সমর্থকদের। রাজনীতি থেকে মনজুরের অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্তও এই হতাশার ফল বলে মনে করি আমরা।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com
রাজনীতি থেকে কেন অবসর নিলেন মনজুর? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগেই যে কথাটি বলতে হবে, সেই অর্থে কখনোই সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না তিনি। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক উদ্যোগে সমাজসেবামূলক কাজের জন্য তাঁর যতটা সুনাম ও পরিচিতি এ অঞ্চলে, রাজনীতিক হিসেবে নিজেকে ততটা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি তিনি, কিংবা হয়তো তা তিনি চানওনি।
দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ড থেকে টানা তিনবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। তখনকার মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হিসেবে প্যানেল মেয়র যেমন ছিলেন, তেমনি বিভিন্ন সময় ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এক-এগারোর সরকার আসার পর একদিকে তৎকালীন মেয়র মহিউদ্দিন গ্রেপ্তার হলেন, অন্যদিকে মনজুর ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পেলেন। মহিউদ্দিন মুক্তি পাওয়ার পর তাঁর সঙ্গে সন্দেহ-অবিশ্বাস ও দূরত্ব সৃষ্টি হয় মনজুরের। এই দূরত্ব ও ভুল বোঝাবুঝি নিরসনের অনেক উদ্যোগ নিয়েও সফল হতে পারেননি মনজুর। একবার অন্তত ‘লিডারে’র সঙ্গে একান্ত আলাপের সুযোগ পেলে সব সংশয় দূর হয়ে যাবে—এমন কথা বারবার বলেও সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তিনি।
যা-ই হোক, এসব ঘটনার পর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনজুর তাঁর ‘লিডার’ মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিলে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিএনপি তাঁকে সমর্থন দেয়। ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা’র এই কৌশল যে ফলপ্রসূ হয়েছিল, সেই নির্বাচনে মনজুরের বিজয়ই তার প্রমাণ। এর মধ্য দিয়ে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন তিনি। বিএনপির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টার পদও লাভ করেছেন। কিন্তু সে অর্থে বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচি বা আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁকে পাওয়া যায়নি বলে নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেনসহ বড় একটি অংশের যে অভিযোগ, তা অনেকাংশেই সত্য। বরং মেয়র নির্বাচিত হওয়ার অল্প কিছুদিন পর থেকেই মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটে তাঁর। আগের মেয়াদে মহিউদ্দিনের নেওয়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প যেমন তিনি অব্যাহত রেখেছেন, তেমনি করপোরেশনেও মহিউদ্দিনের বলয় ভেঙে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেননি। মহিউদ্দিনের জামাতাকে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পদে বহাল রাখা, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার মহিউদ্দিনের ওপর ছেড়ে দেওয়া এবং এর ভিসি পদ বা থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (টিআইসি) পরিচালক পদে কোনো ধরনের পরিবর্তন না আনা ইত্যাদি পূর্বসূরির সঙ্গে তাঁর সমঝোতার পথে চলার অভিপ্রায়কেই প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া গত পাঁচ বছরে নগর উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাঁর ব্যর্থতার যত সমালোচনাই হোক, সিটি করপোরেশনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখা ও নিজের দুর্নীতিমুক্ত একটি ক্লিন ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিলেন তিনি।
নির্বাচন বর্জন করে মনজুর আলম বলেছেন, ‘জীবনে ছয়বার নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে না দিয়ে জোরপূর্বক কেন্দ্র দখলের মতো পরিস্থিতি কখনো দেখিনি। তাই ভবিষ্যতে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেব না।’ এ কথা শুধুই আবেগপ্রসূত নয়, ভোটের বাস্তব চিত্রেও তাঁর কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়।
মনজুরের রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়া প্রসঙ্গে আমীর খসরু মাহমুদ বলেছেন, রাজনীতি ছাড়ার বিষয় একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়। দলের কোনো সিদ্ধান্ত নয়। আবদুল্লাহ আল নোমান বলেছেন, তিনি হয়তো বলতে চেয়েছেন বর্তমানে যে রাজনৈতিক পরিবেশ তাতে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। তিনি স্বচ্ছ রাজনীতির মানুষ হিসেবে পরিচিত, স্বচ্ছ রাজনীতি পছন্দ করেন। এসব কথার যুক্তি অস্বীকার না করেও বলতে পারি, ভেতরের কথা হচ্ছে, এত তাড়াতাড়ি নির্বাচন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত পছন্দ হয়নি তাঁর। তিনি হয়তো শেষ পর্যন্ত দেখতে চেয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, ভোটারদের মধ্যে তাঁর একটা নীরব সমর্থন আছে। সেটা যে আছে এত অনিয়মের পরও প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যাই তো তা বলে দেয়।
তিন ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা না দিলে কী হতো? নির্বাচনে অনিয়ম কারচুপির একই অভিযোগ কি তাঁরা পরে জানাতে পারতেন না? কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্টরা যেতে পারেননি, কিন্তু বিএনপির স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা কি কোনো কেন্দ্রে ছিলেন, যাতে কর্মীরা মনোবল পেতে পারেন, সমর্থকেরা নীরবে তাঁদের প্রার্থীর পক্ষে রায় দিতে পারেন? পরিচিত ও প্রভাবশালী নেতারা সরকারদলীয় সমর্থকদের প্রতিরোধের মুখে পড়লে বা নিগৃহীত হলে সেটা সংবাদমাধ্যম বা সাধারণ মানুষের কাছে আরও বড় সংবাদ হয়ে উঠত, অভিযোগেরও গুরুত্ব বাড়ত। কিন্তু বিএনপি নেতারা সেই ঝুঁকি নিতে চাননি।
এ প্রসঙ্গে নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে চাই। ২০০৫ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বর্তমান সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এসেছিলেন মেয়র পদপ্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরীর সমর্থনে প্রচারকাজে অংশ নিতে। নির্বাচনের দিন চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সামনে একটি নির্বাচনী ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে ক্যাম্পটিই ভেঙে দেয় বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মীর নাছিরের সমর্থকেরা। তিনি রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় গাড়িযোগে মীর নাছির সেখানে হাজির হলে নূর ছুটে গিয়ে তাঁকে অভিযোগ জানালে মীর নাছিরও তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। এসব ঘটনা ঘটছিল সাধারণ ভোটার ও সাংবাদিকদের সামনে। সেই নির্বাচনে হেরেছিলেন মীর নাছির। সবচেয়ে বড় কথা, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট কেন্দ্রটিতে, যেখানে মহিউদ্দিনের সমর্থকেরা দাঁড়াতেও পারছিলেন না, সেখানে মীর নাছিরের দ্বিগুণ ভোট পেয়েছিলেন মহিউদ্দিন। নিজের চোখে দেখা এই ঘটনার উল্লেখ করার কারণ নিজেই সেদিন উপলব্ধি করেছিলাম, অনেক সময় কেন্দ্রের বাইরের চেহারা দেখে ভেতরের অবস্থা বোঝা যায় না।
২০১০ সালের মেয়র নির্বাচনের সময়ও দেখেছি, প্রবল প্রতাপশালী মহিউদ্দিনের হারিকেন মার্কা প্রতীকের ব্যাজ পরে ঘুরতে থাকা শত শত কর্মীর চোখ এড়িয়ে মনজুর আলমের আনারসের প্রতীকে ভোট দিয়েছিলেন। হারিকেন প্রতীকের ব্যাজ পরে মনজুরের সমর্থকেরাও যে ভিড়ে মিশে গিয়েছিলেন, সে কথাও তো পরে বোঝা গিয়েছিল।
এসব অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় থাকতে চেয়েছিলেন মনজুর। কিন্তু দল সেটা চায়নি, বরং অর্ধেকেরও বেশি সময় বাকি থাকতেই ওয়াকওভার দিয়েছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা।
নির্বাচনের পরিবেশ নিঃসন্দেহে হতাশাব্যঞ্জক, পাশাপাশি দলীয় নেতা-কর্মীদের ‘হাঁফ ছেড়ে বাঁচার’ মনোবৃত্তিও আশাহত করেছে মনজুরের সমর্থকদের। রাজনীতি থেকে মনজুরের অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্তও এই হতাশার ফল বলে মনে করি আমরা।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com
No comments